অটোয়ার জার্নাল – চার

হারিয়ে যাবার নিয়ম নেই এখানে
আমি বুঝতে চাই এই অনুভূতিগুলো আমার মতো অন্যদের হয় কিনা। আমরা যখন সাংঘাতিক ভঙ্গুর অবস্থায় থাকি। ওলটপালট জীবনকে একদম নতুন করে সাজাতে চেষ্টা করি। কিংবা বার বার পিছলে যাই শূন্য থেকে পূর্ণ হবার চেষ্টায়, তখন হয়তো একবারে ছন্নছাড়া অবস্থা থেকেই শুরু করি। ব্যাপারটা কখনোই এমন হয় না যে হঠাৎ একদিন তুমি একখণ্ড লাল ইট দিয়ে নতুন ঘর বাধার মতো করে তোমার জীবন নতুন করে শুরু করলে। সত্যিই কখনো কখনো মনে হয়, এমন যদি হতো। যদি কোন দিন!

জীবন যখন ঘুরে দাড়ায়, তখন দেখতে মনে হয় যেন ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা ধুলোবালির মতো অস্পষ্টতা ও হতাশা। এবং কষ্ট। তারপর একসময় যখন একটু একটু করে অবসন্নতা ফিকে হয়, বাস্তব জীবন স্পষ্ট হতে শুরু করে। ঠিক তখনই আবিষ্কার করো যে তুমি যেন জীবনের টুকরো টুকরো হওয়া ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাড়িয়ে আছো। এবং তখন সেই ভঙ্গুর, অস্থায়ী, আপাত: জোড়া লাগানো অসম্ভব – জীবনের এমনসব ভাঙ্গা টুকরোগুলো দিয়েই তুমি আবার নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখো। এমন একটা কিছু যা অন্তত তোমার খানিকটা স্থায়ী মনে হয়। এমন কিছু যা হয়তো তোমার পরিপূর্ণ বলে মনে হয়। এমন কিছু যা তোমাকে ভাবতে সাহায্য করবে যে সুখ আসলে অলীক না পুরোটাই। তেমন কল্পনা বিলাস।

রিয়েলিটি বাইটস
আমার নিজের জীবনের দিকে তাকালে আমার প্রায়শই মনে হয়, আমি একটি খুব জটিল চক্রবক্র আঁকিবুঁকির দিকে তাকাচ্ছি। যেখানে ডজন ডজন অর্থহীন বিভিন্ন আকারের চক্র রয়েছে। যেগুলোর বাস্তব জীবনে অস্তিত্ব রয়েছে, অথচ অর্থহীন। হতে পারে সেগুলোর বাস্তব চাহিদা এবং সত্যিকার প্রয়োজন ফেলে দেবার নয়। কিংবা সেগুলো মানুষের জীবনের স্বপ্ন এবং দায়দায়িত্বের যাদু-বাস্তব অবয়ব হয়তো। কিংবা হয়তো সেগুলো আপাত: অস্বীকার করা যায় না, জীবনের এমন সব সীমারেখা। এবং অদ্ভুতভাবে আমরা সবাই এইসব ভাঙ্গা ভাঙ্গা টুকরোর উপর আলো ফেলে দেখতে চাই এবং তাকিয়ে থাকি জীবনকে নতুন করে দেখার জন্যে। জীবনকে অন্যরকম করে দেখার কথা ভাবি।

এবং কোথাও এক জায়গায়, হয়তো অস্পষ্ট ভাবনা রেখাগুলোর ঠিক মাঝামাঝি, এই চক্রবক্র রেখাগুলো একে অন্যকে স্পর্শ করে আছে। সেখানে খুব অস্পষ্ট ক্ষীণ এক দলা জায়গার মতো একটা কিছু আছে, আমরা যাকে বলি ‘ভবিষ্যৎ’। এটা এতোই ক্ষুদ্র, যে অন্য সবকিছুর সাথে মিশে বর্তমানে লীন হয়ে থাকে। সে কারণেই হয়তো মনে হয় যে সামনে আর কিছু নেই। আশা নেই। প্রতিশ্রুতি নেই। নেই রাঙা প্রভাতের আলো। আছে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। এবং অনন্ত দীর্ঘ কালো পথ। আমি এমনকি জানিও না, তখন সেই অতল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কি দেখা উচিত।

আমি তখন সারি সারি রেখা আঁকিবুঁকি কেটে থাকা চক্রের ভিতরে বসে থাকি এবং হয়তো একেবারেই অর্থহীন সময় পার করি। তবু থাকি। সেই চক্রগুলো যখন আলাদা করে তুলে নিই, বার বার দেখি সেগুলো দিয়ে কি করা যায়। তখন আরো খানিকটা নির্বোধ সময় কাটে। এমনকি জীবনের যে চক্রের টুকরোগুলো ভালো, সেগুলোও অহেতুক হতাশ করে। ঠিক মানায় না যেন আমার জীবনের সাথে। প্রতিবেশের সাথে। বাস্তবতার সাথে। মানায় না আমার সাথে। নিজের চেনাজানা জীবন নিজের কাছেই আনকোরা মনে হয়। তখন খানিকটা দ্বিধাবোধ হয় সবকিছুতে। মনে হয়, এই আমি আসলে আমি নই। তাহলে কি সুখ নামের মিথের পিছনে মিছেই ছুটে যাওয়া। হেরে যেতে হবে? যদি হেরে যাই।

সেই ভাবনা থেকেই যা যা বিশ্বাস করি তার উপর ভর করে একটি নকশা আঁকি। বিশ্বাস, অবিশ্বাস বা নামহীন যে কোন কিছুর অস্তিত্ব। যদি কেউ বলতে পারতো তখন কি করলে ভাল হয় তাহলে দারুণ হতো। সেটাই হতো সবচেয়ে সহজ সমাধান। কিন্তু তেমনটা হবার না। একটি বয়সে আর বলার কেউ থাকে না। তখন নিজেকেই সবকিছু বলতে হয় ভিতরের আমি-কে। এই গল্পগুলো যার যার একান্ত নিজের। একজন গল্পকার শুধু তার নিজের গল্প পূর্ণ করে চলে। গল্পটি অন্য কেউ পূর্ণ করতে পারে না। অন্য কেউই নয়। হয়তো একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে কোন দিগন্তজোড়া আলো দেখতে পাবো। নির্মল বিশুদ্ধ বায়ূ। কিংবা জানালা গলিয়ে এক ফালি সোনালী আলো। অর্থপূর্ণ কোন নকশা। এবং সেটা আমিই পূর্ণ করবো। আমি জানি প্রতিটি মানুষই হয়তো এমন একটি সময়ের ভেতর দিয়ে যায়। জীবনের গল্প তৈরি করার সময়। আজ আমার পালা।

উদ্দেশ্যহীন কাল্পনিক ভাবনাগুলো
জীবন কখনো থমকে দাড়ায় ক্লান্তিতে। অনিশ্চয়তার অমানিশায়। হয়তো এই অবস্থাটা চলতে থাকে যতক্ষণ না জীবনের পড়ে থাকা টুকরোগুলোকে একসাথে করার শক্তি না হয়। আমি জানি এই শক্তির মাঝেই থাকে জীবনের ধাঁধাঁর উত্তর। এমনকি আমি যদি আপাতভাবে দেখতে নাও পাই। প্রতিনিয়ত জীবনকে সরল রেখায় দেখার এক অলীক চিন্তা করি। হয়তো অনেকেই করে। কোন কোন দিন ইচ্ছে করেই সবকিছু থেকে সরে থাকতে ইচ্ছে করে। যেদিন কোন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। এমন এলোমেলো কিছু করা যাতে মনে হয় জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। স্থবির না।

পথের মাঝে পথ হারায় মানুষ। চাঁদের পথে পথ হাঁটা। দ্বিধাসংকটে আবর্তিত হয়। আবার একদিন একটু একটু করে ঠিক হয়। এমনকি আমি যদি আপাতভাবে বেরিয়ে আসার পথের আলো নাও দেখতে পাই। শুধুমাত্র সুখী এবং সফল জীবনের প্রজেকশন একমাত্র সত্য নয় হয়তো। সফল মানুষের যে ছবিটি আমি বা আমরা দেখি সেটি কি একটি ভ্রান্তিবিলাস? হতাশা, দুর্ভাবনা, অনিশ্চয়তা, বোকা বোকা অনুভূতি, ব্যর্থতা, প্রতারণা, খণ্ডিত সত্য সবকিছু নিয়েই তো জীবন। জীবনের মিথ থেকে বেরিয়ে শিকড় খুঁজে ফেরার ব্যর্থ নেশা তাড়িয়ে তাড়িয়ে পরাস্ত করে। তখন হয়তো একজন হয় প্রাকৃতজন।

হয়তো আশার কথা, আপ্ত আগামীকাল একরকম থাকে না। আজ না হোক। আগামীকাল ঠিকই অন্যরকম হয়। ঠিক যেমন জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে যখন মনে হয় সবকিছু খুবই ঠিক ঠিক। জীবন একদম পূর্ণ। একটি ক্ষীণ মুহূর্ত যখন জীবন কানায় কানায় ভরাট। হয়তো তার স্থায়িত্ব কম, কিন্তু তেমন এক অনুভূতি হয়। সেই দিনটির দিকে চেয়েই মানুষ জীবন পার করে। কারো জীবনে সেই দিনটি আসে, কারো আসে না। যদি কোন দিন।

হারিয়ে গিয়েছি এইতো জরুরী খবর
গোটা শহর বাতি জ্বেলে সতর্ক
পায়ে পায়ে হারাবার জায়গা খুঁজে মরি।
কোথাও নেই ঝুম ঝুম অন্ধকার,
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা,
স্বপনে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল।
যদি কোন দিন,
ঝরে ঝরে যায় অন্ধকার
ভালবাসা ধুয়ে দেয় গোটা মুখ আমার
যদি কোন দিন।
দুচোখে স্বপ্ন ভরে দিয়ে যায় কেউ,
যদি কোন দিন!

****
ছবি: দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি, ১৯৩১, সালভাদোর দালি

২,৪৭৮ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “অটোয়ার জার্নাল – চার”

    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      সহমত। চাকভুম চাকভুম চান্নি রাতে ... লা লা লা ♫♪♫

      পুনশ্চ: সেভ এ্যা হর্স, রাইড এ্যা ব্রাইড 😛

      [এটা একটা আর্টিকেলের রিফ্লেকশন, যে কোন মানুষ একটি দীর্ঘ সময়ের পর তার জীবনের দিকে গভীরভাবে ফিরে তাকালে এমন চক্রবক্র হিজিবিজিই দেখার কথা। এটাই বলছিলাম অন্যরাও দেখে কিনা। জীবন অর্থহীন এলোমেলো হবার পরও, আমরা পজিটিভ অর্থ বের করে ভাববার চেষ্টা করি।]


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
      • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

        ইয়ে লাভ-বী ভাই, আপনি ইদানীং খুব খ্রাপ হয়া গেছেন-আমি ব্লগে নিয়মিত না দেইখাই এই অবস্থা...আমার মত ঈমানদার নেক বান্দা থাকলে ইরাম অচলীল বাক্য আপনার সোনামুখ হইতে বাহির হৈতোনা।

        অফ টপিক- ইয়ে, পিসিসির আজিমুল আহসান স্যার আমাদের এইখানে ইন্সট্রাকটর ছিলেন,স্যার বদলি হয়ে এই কয়দিন আগে ঢাকায় গেলেন।চিনেন নাকি উনাকে? স্যার সম্ভবত ৯৬ সালে ইন্টার।

        জবাব দিন
        • রাব্বী (৯২-৯৮)

          হিহিহি ... অচলীল কেন হপে? জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।

          অট: ৯৬ ব্যাচের আহসান ভাই পুলিশে নাই, জানি। আর কলেজে নাম আজিম হয়ে থাকলে তিতুমীর হাউসের একজনের কথা মনে হইতেছে। সিউর না যদিও।


          আমার বন্ধুয়া বিহনে

          জবাব দিন
  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    কয়েকবার পইড়াও লেখার মূল স্বাদ আস্বাদনে ব্যর্থ হইলাম। কার কাছ থেকে যা এন্টেনা ধার লই ~x( ~x(

    তবে মূল স্বাদ না ধরলেও শাখা প্রশাখার স্বাদ কিছুটা পাইছি। ঐটা ভাল্লাগছে।

    জবাব দিন
  2. ফখরুল (০৪-১০)

    কেম্নে জানি বুইঝা ফালাইলাম , সব না হইলেও অনেক খানি। 🙁

    যদি কোন দিন,
    ঝরে ঝরে যায় অন্ধকার
    ভালবাসা ধুয়ে দেয় গোটা মুখ আমার
    যদি কোন দিন.........

    এই লাইনকটা'র জন্যই গানটা বার বার শুনি............যদি কোন দিন......

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।