অদ্ভুত আঁধার এক

১.

গরমটা যা জাকিয়ে পড়েছে এবার। বিশ্রি এক অনুভূতি সারাদিন। উফঃ দিনে কোথাও এক দন্ড বসে থাকার উপায় নেই, ঘামে গায়ের কাপড় ভিজে জব জব করে সারাক্ষন। রাত ৯টা। রোকেয়া হল, মেইন বিল্ডিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাতের এই সময়টুকুতে বারান্দার রেলিং এ বসে রুমের ক্যাসেটে জোয়ান বায়েজ ছেড়ে অন্যরুমের সুখদুঃখে আড়ি পাতার মতো এক চিলতে আনন্দ ঢাকার আর কোথাও নেই। এই সময়ে সবাই বাইরে থেকে হলে ফিরতে শুরু করে। কারো চেহারায় থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্নে বুদ হওয়া সুখের স্পষ্ট শিহরণ, কারো চেহারায় থাকে প্রাইভেট টূইশনি করে ফেরা মলিন ক্লান্তি, কেউবা হারানো, প্রাপ্তি ও সংকটের জটিল হিসাব করতে করতে ভ্রু কুচকে বিশ্ববিদ্যালয়, সেশনজ্যাম ও ঢাকা শহরকে তুচ্ছ করে, আবার কেউ নিত্যদিনের হাহাহিহি, ফুচকা, পুরি, সিঙ্গারা সহ আড্ডার ঝিলিক মুখায়বে ফুটিয়ে হলে ফেরে। আমি ঠিক বুঝতে পারিনা আমি কোন দলে সত্যিকারে পড়ি। আমার ধারণা আমি গোত্রহীন আমাদের হলের রেইন ট্রিটার মতো অসাড়তা নিয়ে বেচেঁ আছি। যেন এক একটি ঋতু পাল্টায় আর আমি শুধু পাতার রঙ বদলাই।

আমার নাম অনন্যা রহমান। আমি অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ডিবেট করি। সেই যোগ্যতাকে বিবেচনা করে হলের প্রয়োজনে ঢাকায় বাসা থাকা সত্তেও দিব্যি আমাকে হলে একটি সিট দেওয়া হয়েছে। আগে ভারতনাট্যম শিখতাম, অনুষ্ঠানেও নাচতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। আমি হলে থাকাটা দারুনভাবে উপভোগ করি। আমার রুমমেট মুনমুন এবং সোনালি। ওরা আমার বিভাগের। আমরা ব্যাচমেট এবং বন্ধু। ওদের কারনেই আমার এই মেইন বিল্ডিংয়ে রুম নম্বর এইট্টিতে ওঠা। আরেকটা মেয়ে আছে আমাদের রুমে, নাম অরণি। ফার্মেসিতে পড়ে। মেয়েটা ভাল, কিন্তু ও একটু অন্যরকম। কিংবা হয়তো আমাদের কারণে কোনঠাসা। জীবনকে সুক্ষ ও বিচিত্রভাবে দেখার এবং অপার স্বাধীনতা উপভোগ করার মতো এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা আমার বাইশ বছরের জীবনে কোথাও কোনদিন ছিল না। আমার সরকারি চাকুরীজীবি সৎ বাবা-মা তাদের সাধ্যের ভেতর আমাকে কোন কিছু দিতে কার্পণ্য করেননি। একটি মেয়ের মেয়ে ওঠার জন্য পারিপার্শিক প্রতিবেশে যা কিছু প্রয়োজন তারা কোনকিছুর কমতি রাখেননি। আমিও খুব পরিপূর্ন ছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জীবন আমার সেই গুডি গার্ল সত্ত্বাকে ওলোটপালোট করে দিল। আগে আমি বেছে বেছে এমন সব উপাদানে আমার জীবনকে সাজাতাম যাতে আমার বাহবা কুড়ানো নিরাপদ জীবনকে ইর্ষা করে মানুষ। কিন্তু এখন আর আমি সেই জীবনে কোন স্বার্থকতা খুঁজে পাই না। জীবনকে আমার এখন পরীক্ষা করতে ভাল লাগে। হয়তো আমি ভুল, কিংবা আমি জানি না কি ভুল বা সঠিক। কিন্তু আমি পরীক্ষণ করি, অভিজ্ঞতার ঝুড়ি ভরিয়ে তুলছি এবং এটাই আমি চাই। এই কথাগুলো কিন্তু আমি সরাসরি বলতে পারিনা। আমি সবার সাথে মিলে মিশে এমনভাবে থাকি, কাউকে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দেই না। আমার এই হলে থাকা জীবনটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। বিশেষত টয়োলেট এবং বাথরুম – যারা হলে থেকেছে তারা এটা জানেন, হল জীবনের মর্ম হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করেছেন। সেটাও মনে হয় আমার এখন সয়ে গিয়েছে। আমার ছোট বোন রেবুতি এসেছিল কয়েক সপ্তাহ আগে আমার হল জীবন কেমন দেখতে। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু ও বাথরুম থেকে ফিরে এসেই অস্থিরভাবে কঠিন স্বরে আমাকে বললো,

– এক্ষুনী ব্যাগ গুছাও। তুমি এখানে থাকতে পারো না।

আমি জানতাম ও এমন কিছুই বলবে। কিন্তু আমি আমার হলে থাকার সিদ্ধান্তে অনড়। ডাইনিং আর টিভি রুমে কি অবস্থা হয়, তা কেউ না দেখলে কোনদিন বুঝবে না। ভাগ্যিস রেবুতি ওদিকটায় যায়নি। অবশ্য ধারণ ক্ষমতার তুলনায় এত বেশি মেয়ে কিছু করারও হয়তো নেই। রেবুতি এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বাসায় আমার ঘরে ফেরা নিয়ে। বাপি-মামনিও হলে ছিলেন ছাত্রাবস্থায়, তাই তারা জানেন এসব। খুব বেশি বিচলিত হননি। কিন্তু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, রেজাল্ট যেন ঠিক থাকে। আমি অবশ্য পড়ালেখার ব্যাপারে বেশ সিনসিয়ার। আসলে আমার ফলাফল কিন্তু স্কুল-কলেজ সবজায়গায় ভাল ছিল। তাই এখন অনেকটা এমনিতেই তাগিদটা এসে পড়ে। আর ফলাফল ভাল করার জন্য খুব যে পড়তে হয়, তাও না। আমি বরং পাঠ্যের বাইরের যে একটা বিকশিত ইন্টেলেকচুয়াল পরিবেশ আছে সেটির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেই। সত্যি কথা বলতে, সেই পরিবেশটা যে খুব বেশি স্বাস্থ্যকর তা কিন্তু নয়। নানা রকম কাঁদা ছোড়াছুড়ি। তবে আমি মেয়ে হিসাবে সবসময় একটা আলাদা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকি। শুধু তাই কেন, বাহূল্য আগ্রহ এবং আমাকে নিয়ে টানাটানির যে একটা ব্যাপার হয় সেটা আমি ভালই বুঝি। এসব নিয়ে প্রথমে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম, এখন ঠিক ঠিক সামলে নিয়েছি। আমি এখন জানি ঠিক কোন সময় নিজেকে সরিয়ে আনতে হয় ঝামেলা ছাড়াই। তবে শিক্ষক এবং ছেলেগুলোও বলিহারি, বাইরে একটা ভালমানুষি মহৎ প্রাণ ইমেজ ঝুলিয়ে রেখে পেটেপেটে এত ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব। তবে, সবাই যে এমন তাও নয়। আসলে ভালরাই হয়তো বেশি। কিংবা ভাল-মন্দ মিলেই হয়তো মানুষ। তবে প্রতিষ্ঠিত ইন্টেলিকচুয়ালদের চেয়ে উঠতিরাই বরং ভাল এবং নিরাপদ। একটি ব্যাপার আমি বেশ বুঝে গিয়েছি, আগে অনেককে খুব বড় মাপের মানুষ বলে মনে হতো। এখন জানি এই বড় মানুষগুলোরো কদর্য দিক রয়েছে। প্রথমে মেনে নিতে পারিনি, ধাক্কাটা সামলাতে বেশ সময় নিয়েছি। এখন আর এসব ভেবে খারাপ লাগেনা। হয়তো ডিবেটটা না করলে এই জগতের কথা আমার অজানাই থেকে যেত।

২.

আমি খেয়াল করছি রাজকুমারী গত কয়েকদিন ধরে একা রেলিং ধরে উন্মনা হয়ে দাড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো মেঝের দিকে তাকিয়ে পায়চারি করে। রাজকুমারী থাকে আমাদের দুইরুম পর। আমার রুমমেট সোনালির সাথে বেশ সখ্যতা। মাঝেমাঝে আমাদের রুমে আসে। আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ছাত্রী। আমরা ওকে রাজকু বলে ডাকি। রাজকু অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। হয়তো ভরা পূর্নিমার চাঁদটাকে মন ভরে দেখছে। তাই আমি আর ওকে বিরক্ত করিনি। একইভাবে নির্জনে প্রায় ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে থাকতে দেখে, আমি যেন পায়চারি করছি এমনভাবে ওর কাছে গেলাম। আমাকে খেয়াল করলো না। চেহারায় কেমন উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা আর অসহায়তা নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ওর এই অবয়ব দেখে আমার ভেতরে কেমন একটা শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। আমি সন্তর্পনে ওর হাতটা ধরতে ও যেন সম্বিত ফিরে পেল,

– ও অনন্যা তুই!

–  কি হয়েছেরে রাজকু?

–  কই? কিছুনারে।

–  না তোকে অনেকক্ষন দেখলাম একইভাবে আছিস। ভাললাম কিছু হয়েছে কিনা।

রাজকু স্মিত একটু হাসলো। সে হাসি একেবারে নৈবত্তিক। সুখ-দুঃখ কিছুই বোঝালো না তাতে। শুধু বললাম – কোন সমস্যা হয়ে থাকলে বলিস আমাকে। রাজকু কোন উত্তর দিল না।

আমি রুমে চলে এলাম। সোনালি বাড়িতে গিয়েছিল। সিলেট থেকে ওর মা আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। মুনমুন আর আমাকে আগে বলে রেখেছিল, আমরা সেটা দিয়ে রাতে খাবো। সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস রান্না। আমার তেমন ভাল লাগে না, আমি জানি মুনমুনও যে আহামরি পছন্দ করে তেমন নয়। কিন্তু গত সাতমাস ধরে দেখছি, সোনালি বাড়ি গেলে আমাদের জন্য সাতকরার কিছু একটা আনবেই। খাবার এবং গল্পগুজবে আমি রাজকুর কথা ভুলে গেলাম।

৩.

পাচঁ দিন পর। ঠিক ভর দুপুরে। কলাভবনের তিনতলা। আমি ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্যারের রুমের সামনে দাড়িয়ে ইকোনোম্যাট্রিক্স বইটার পাতা উল্টাচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতে তাকিয়ে দেখি রাজকু। আমি বইটি বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলাম। রাজকুর চুল এলোমেলো। কাপড় অপরিপাটি। চোখের নিচে কালি, চোখটা খুব শুকনো। দেখে মনে হলো হয়তো ঠিকমতো ঘুমায়নি কতকাল। এমন মলিন আমি কোনদিন ওকে দেখিনি।

– তোর একটু সময় হবে?

– একশোবার হবে। কি হয়েছে বলতো রাজকু?

রাজকু কোন কথা বলে না। যেন একটি নিথর মানুষ দাড়িয়ে। কিছুক্ষন স্থির তাকিয়ে থাকে আমার চোখে, তারপর সামনের কোয়াডের সবুজ গাছটার দিকে তাকায় এক দৃষ্টিতে একটু যেন ঋঝু ভঙ্গিতে। আমিও এক মূহুর্ত ওর চোখে তাকিয়ে কি বলবো কথার খেই হারিয়ে ফেলি। একসময় দেখি ওর চোখ গড়িয়ে এক দুফোটা পানিও পড়ে অসচেতনভাবে। সেটা আবার হাতের তেলোয় মুছে নেয়। আমার হাতটি হটাৎ একসময় সয়ংক্রিয়ভাবে রাজকুর কাধে ভরসার পরশ বুলাতে থাকে। হয়তো তাতে কোন কাজ হয়না। করিডোরে অন্য কোন বিভাগের একটি বেঞ্চ পড়ে ছিল। আমি ইশারা করি সেখানে গিয়ে বসার। আমরা বসি। কিংবা সময়ের ভেতর সময় হারিয়ে ‌ফেলি।

৪.

রাজকু আর রাদিনের সম্পর্ক দুবছর গড়ালো। ফার্ষ্ট ইয়ার পেরিয়ে একদিন রাজকু-রাদিন বিহঙ্গ হবার স্বপ্ন দেখে। ওরাও হয়তো খেয়াল করেনি হাতে হাত রেখে রঙ্গীন পেখমমেলা দিনগুলো কিভাবে এগিয়েছে। রাদিনের সাথে আমার ডিবেটের সূত্রে চেনাজানা। রাদিন খুব সপ্রতিভ এবং বুদ্ধিদীপ্ত ভাল ডিবেটর। পড়াশুনা জানাও বেশ, আর কি তীক্ষ্ণ যুক্তিখন্ডন করে! আমার বিশ্বাস রাদিন একদিন ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির কেউ একজন হবে। রাদিনের আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের একজন শিক্ষক হয়ে যাওয়াও অসম্ভব কিছুনা। কিংবা একজন ক্যারিয়ার ডিপ্পোম্যাট। রাজশাহীর কলেজ অধ্যাপক বাবা-মায়ের প্রাণের টুকরো রাজকুর জন্যে বসন্তের আলো ঝলমল দিনের মতো একটি ভবিষ্যত আমি দিব্য চোখে এঁকে রেখেছিলাম। হয়তো তেমনটাই হবে। কিংবা মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। জীবন কখনো এসে গতিপথ পাল্টায়। কিংবা থমকে দাড়ায় মূহুর্তের জন্য। তাতে আমরা কখনোবা খানিকটা সংশয়বাদী হয়ে পড়ি। রাজকুর শরীরে একটি ছোট্ট ভ্রুণ তীর তীর করে বেড়ে উঠছে। একটি জীবনের আভাস। হতে পারতো ওর জীবনের সবথেকে আনন্দের। সেই অনাগত জীবন এখন একটি বিভীষিকা রাজকুর অস্তিত্ত্বে। আমি রাদিনকে ফোন করি, দেখা করবো বলে। রাদিন গুলশানে, লিভার ব্রাদার্সের অফিসে আন্তঃ বিভাগ রম্য বিতর্ক প্রতিযোগিতা “সখী ভালবাসা কারে কয় …” এর জন্য ফেয়ার এন্ড লাভলির স্পন্সর মিটিংয়ে। আমাকে জানায় সন্ধা সাতটায় মধুর ক্যান্টিনে আসতে।

ঠিক সময়ে আমি যাই মধুতে। সন্ধা তখন লাগো লাগো। একটি ঘোর করা মাদক আলো, দলা দলা ধোয়া আচ্ছন্ন করে রেখেছে সময়টিকে। ইউনিভার্সিটির কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে আযান ভেসে এলো। মধুদার ছেলে ধুপধনু ধরিয়ে পাত্রটি হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে তুলসিতলা আর ক্যাশ কর্নারের মধ্যে দৌড়োদৌড়ি করছে। এই সময়টিতে লীগ বা দলের ছেলেরা থাকে না সাধারনত। পশ্চিম কোনার বড় টেবিলটি ছাত্র ইউনিয়নের দখলে। সেই টেবিলে ক্যামেলিয়া কিছু একটা বলছে, মানবেন্দ্র মনোযোগ দিয়ে সেটি শুনছে, সাথে অন্যরাও। পাশের টেবিলটি ফেডারেশনের কয়েকজন গোল হয়ে বসে আলোচনা করছে। তার পাশের টেবিলে দুচারজন সখের কবি লিটল ম্যাগ নিয়ে কথা চালাচ্ছে। আমি জানালার পাশের দুজন বসা যায় এমন আইবিএ-মূখী একটি টেবিলে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলাম। রাদিন এলো আরো কুড়ি মিনিট পর। ওর সপ্রতিভ হাসিহাসি আপন করে নেওয়া মুখটা আমাকে সেদিন একটুও টানলো না। আমরা বসলাম একত্রে। আমি কোন ভনিতা না করে বললাম,

– রাদিন, রাজকুর এখন কি হবে?

ভূত দেখলে মানুষ যেমন চমকে ওঠে, রাদিন তেমনি ভীষন ভয় পেলো যেন। আমাকে বললো,

– মধুতে নয়, অন্য কোথাও কথা বলি, চল।

– শোন, আমি তোদেরকে সাহায্য করতে চাই। এখানেই ঠিক আছে।

আমি অভয় দিলাম। বুদ্ধিমান ছেলে, কথা না বাড়িয়ে আমাকে হাতেপায়ে ধরলো ওকে বাঁচাবার জন্য। আমার তাচ্ছিল্যের হাসি রাদিনকে বুঝিয়ে দিলো যে বাঁচার প্রশ্নটি এখন সবথেকে বেশি একটি অনাগত ঘুমন্ত জীবনের। অনেক বেশি রাজকুর। ওরা রাদিনের চেয়ে অনেক অনেক দ্বিধান্বিত শরীরী এবং জাগতিক জীবনের বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষনে। আমি হয়তো একটু বোকা। রাদিন কথায় কথায় আমাকে কেমন করে যেন রাজকুর দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। আমি মেনেও নিলাম। রাদিনের আবেগময় অসহায়ত্তে আমি পরাজিত হলাম। হয়তো একজন মেয়ে বলেই, কিংবা জানিনা নিজেকে রাজকুর জায়গায় দাড় করিয়েছিলাম বার বার, সেই দূর্বলতা থেকে, আমি রাজকুর পাশে দাড়ালাম। পুরো বিষয়টি শুধু আমাদের পাঁচজন মানুষের ভিতরে থাকলো। আমি গসিপ করা একদম পছন্দ করি না। সোনালি এবং মুনমুনকে বলে রেখেছি, এটা যেন আর একটি মানুষও জানতে না পারে। সোনালি আমাকে বার বার বারণ করলো এসবে না জড়াতে। কিন্তু আমি তো ওসব গা বাঁচানো কথা শোনার মতো লক্ষী মেয়েটি নই।

৫.

ক্লিনিকটি মুহম্মদপুরে। নিচতলার প্যাথোলজি বিভাগটি যেন নামকাওয়াস্তে। কেমন শ্যাতশ্যাতে আর বদ্ধ। দেয়ালে পোষ্টারে সাঁটা একটি শিশু গর্ভের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। ডাক্তার তেমন চোখে পড়লো না। এককোনায় একটি ফুলের টবে মৃত একটি গাছ। সেটিতে এখন পানের পিক ফেলা হয়, গোড়ার মাটি লালচে হয়ে আছে। রাজকু আর আমি খুব সকাল সকাল গিয়ে আমাদের এ্যাপোয়েন্টমেন্টের সময় এবং নাম জানিয়ে রিসেপশনের সামনে খালি চেয়ায়ে বসে আছি। আমাদের সামনের চেয়ারে দুজন মধ্যবয়সি মহিলা বসে, একজন বোরকা পরিহিতা। রাজকু আমার হাতটি শক্ত করে ধরে বসে আছে। ওর ওড়নাটি মাথায় জড়িয়ে রাখা। আমি গত এক সপ্তাহ রাজকুর বন্ধু থেকে যেন নিকটতম একজন আত্মীয়। পরম নির্ভরতায় অসহায় রাজকু আমাকে একটি ভেলার মতো আঁকড়ে ধরে আছে। আমিও কার্পন্য করিনি ভালবাসা দিতে, বুকে জড়িয়ে রেখেছি পাখির ছাঁনার মমতায়। আজ আমারো একটু ভয় ভয় করছে। কি এমন বয়স আমাদের। একজন নার্স বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। হাতে একটি ক্লিপ বোর্ড। ডাকলেন,

– ফারিয়া আফজাল।

– এই যে, আমরা …

–  আসেন আমার সাথে …

রাজকুর ভাল নাম ফারিয়া আফজাল। আমার চোখের দিকে তাকালো রাজকু। ওকে ভীত উদভ্রান্ত কবুতরের মতো মনে হলো। আমি ওর ধরে থাকা হাতে আলতো করে চাপ দিলাম।

– পেশেন্ট কে?

– এইযে, ও পেশেন্ট।

– হাসবেন্ড কোথায়?

– হাসবেন্ড আসেনি। আমি ওর বড় বোন।

ঢাকা শহরে যারা এমআর করায় তারা এসবে সিদ্ধ। সবই জানেন। নার্সটির তীর্যক প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি পড়ে নিতে কাফকা কিংবা কোয়েলো পড়া জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। আমি তাকে একটু সাইডে নিয়ে আলাদা করে একটি হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে সকল প্রশ্নের ইতি টেনে দিলাম।

আমাদের সেই দিনটি ক্লিনিকে থাকতে হলো। খুব গা ঘিনঘিন করা পরিবেশে একটি রাত। পরিবেশের চেয়ে আমার কাছে নিরাপত্তার প্রশ্নটি খুব বেশি করে মনে হলো। অন্য ক্লিনিক থেকে একদম অন্যরকম। মুনমুন এলো খাবার নিয়ে দুপুরে। দুপুর এবং রাতের খাবার একসাথে পুরোনো আইসক্রিমের বাক্সে করে। বিকালে ও হলে ফিরে গেলো। সোনালি আসেনি। প্রথম থেকেই আমার সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করে আসছিল। রাদিন ফোন করে খোঁজ নিল বেশ কবার। অপরাধবোধে ওর নাকি সামনে আসতে ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। ওর খরচাপাতি মেটাবার প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিলাম। পরদিন দুপুর নাগাদ রাজকুকে নিয়ে আমি হলে ফিরে এলাম। হলে একটি দিন থেকে রাজকু ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেল। তার দুদিন পর রাজশাহীতে।

৬.

সোনালি, মুনমুন এবং আমি গিয়েছি জগন্নাত হলে বিজয়ার দিন দুপুরে। তারপর পুরোনো ঢাকা ঘুরে হলে ফিরে দেখি রাজকু ফিরেছে হলে। একমাস পর। কি যে মায়াবতী চেহারা হয়েছে ওর। ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্যটাও যেন একটু উন্নত হয়েছে। ও হয়তো মা হলে সবকিছু দারুন পরিপূর্নতা পেতো। রাদিন আমাকে অনেক কাকুতিমিনুতি করেছে আমি যেন ওর ইউনিভার্সিটির ক্যারিয়ার ধবংস করে না দেই। কথা দিতে হবে, কাউকে যেন না বলি। আমার খুব রাগ হলেও ক্ষমা করে দিয়েছি। এক মাস পর রাজকু মেইন বিল্ডিং থেকে রোকেয়া হলের এক্সটেইনশনে ওর রুম পাল্টে নিয়েছে। যা অনিবার্যভাবে হবার কথা ছিল তাই হলো। আনুষ্ঠানিকতার কোন প্রয়োজন ছিলনা। তবু আমরা একদিন জানলাম রাদিন-রাজকুর পথ এখন আলাদা। ধীরে ধীরে রাদিন এবং রাজকু এক রকম আমার জীবন থেকেও দূরে চলে যেতে থাকলো। পরীক্ষা এবং ডিবেট নিয়ে আমি ডুবে থাকলাম। একদিন বাসার চাপাচাপিতে হল জীবনের ইতি টেনে পাকাপাকি আমাদের সোবহানবাগের বাসায় চলে গেলাম। মুনমুন, সোনালি এবং আমার নতুন সব এ্যাডভেনচার আবার একইভাবে চললো। রাদিনের সাথে দেখা হলে এরপর থেকে খানিকটা যেন লেজনাড়া একটি কুকুরের মতো আচরণ করতো। হয়তো ভয়ে কিংবা দ্বিধা সংকোচের অস্বস্তিতে। আমি কথা রেখেছি, কাউকে কিছু বলিনি। রাজকু যেন অনেক দূরের কোন দেশের বাসিন্দা হয়ে গেল ধীরে ধীরে। প্রথমে খেয়াল করিনি, একদিন সোনালি ধরিয়ে দিল যে রাজকু আমাদের এড়িয়ে চলে সচেতনভাবে। একদিন আবিষ্কার করলাম রাজকু যেন আর আমাকে চেনেনা। হয়তো আমরা কোনদিন বন্ধু ছিলাম না। পরিচয় হয়নি। হয়তো এটিই নিয়ম। হয়তো জীবনের এই রীতি আমি জানতাম না। শিখে নিলাম।

৭.

পনেরো বছর পর। আমার অনেক কিছু হবার কথা ছিল জীবনে। আমি হয়েছি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার উপ-সম্পাদিকা। একটি নাট্যদলের সাথেও জড়িত রয়েছি। আমি মূলতঃ স্ক্রীপ্ট লিখি আর পর্দার পিছনে বেশি কাজ করি। আমি যে ছেলেটিকে ভালবাসতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার সাথে আমার মতের অমিল প্রকট আকারে বেরিয়ে আসে লেখাপড়ার পর্ব চুকানোর পর। জীবনের প্রতি নির্লিপ্ততায় আমি আর উচ্চতর শিক্ষার পথে পা বাড়াইনি। মামনি বেশ কজন সুপাত্র ধরে এনেছিলেন আমার জন্য। আমাকে তাদের ভালও লেগেছিল। কোন এক উন্নাসিকতায় সেসব বিয়ের প্রস্তাব ভেস্তে যায়। বাঙ্গালি জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনটি একদিন আমিও করে ফেলি, বিয়ে করি একজন প্রকাশককে। আমাদের সন্তান এখন নালন্দা বিদ্যালয়ে যায়। রাদিন শেষপর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, শিকাগো থেকে পিএইচডি করেছে। তারপর ইয়েল থেকে পোষ্টডক করে এখন ইউনিভাসিটি অব সাউথ ডাকোটার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের কন্ট্রাক্ট প্রফেসর। হয়তো খুব শীঘ্রি কোথাও টেনিউর ট্র্যাক পজিশন পেয়ে যাবে। রাজকুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। এখনো নেই। গতবছর ঢাকায় অফিসার্স ক্লাবের এক বিয়েতে আকষ্মিক আমাদের দেখা হয়। অস্বস্তি কাটিয়ে সৌজন্য কথার সময় জানতে পারি রাজকু এখন জেনেভাতে থাকে, স্বামী ডব্লিউটিওতে উচ্চপদস্থ ফাইনানশিয়াল এনালিস্ট। সোনালির জীবন সবার চেয়ে স্বাভাবিক। ও সত্যিকারে মধ্যবিত্ত ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্বামী ব্যাংকার, নিজে কলেজ অধ্যাপিকা। ছুটিতে নিয়ম করে কক্সবাজার বেড়াতে যায়। অবশ্য গতবছর নেপাল এবং এবছর ভারতে বেড়াতে গিয়েছিল। তবে, একটি সন্তানের জন্য এখনো খুব হাপিত্যেশ করে। মুনমুনের মাষ্টার্সে থাকতে বিয়ে হয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষকের সাথে প্রেম করে। টেকেনি। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ট্র্যাক পাল্টে এখন কেমব্রিজের কিংস কলেজে শান্তি এবং সংঘর্ষ বিদ্যায় পিএইচডি করছে। আমরা তিনজন এখনো সুযোগ পেলে একসাথে হই। প্রবর্তনার আড্ডায় গিয়ে হই হই করি। আমরা এখন আর রাজকুর এ্যাবোরশন নিয়ে কথা কাটাকাটি করি না, করি আমেরিকার এ্যাবোরশন পলিসি নিয়ে। গাঁজা নিয়ে। দান্তেওয়ারে নিয়ে। পার্বত্য চট্টগাম নিয়ে। ফুলবাড়ী নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের নারী নিপীড়ন বিরোধী রায় নিয়ে। কিংবা সিমিদের আত্মহত্যা নিয়ে।

*** *** ***

১. শিরোনামটি জীবনানন্দ দাসের কবিতা থেকে ধার নেওয়া। কয়েক দফা উপযুক্ত নাম নিয়ে ঘষামাঁজা করে যখন কিছুই মনোঃপুত হচ্ছিল না, তখন এই নামটি বসিয়ে স্থিত হই।

২. ছবি: সালভাতোরে ফিউম।

৪,০২৬ বার দেখা হয়েছে

৩৫ টি মন্তব্য : “অদ্ভুত আঁধার এক”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    অসাধারন তোমার ডিটেলিং।

    সাত নম্বরটায় তড়িঘড়ি করেছো মনে হয়েছে। অনন্যার নিস্পৃহতা ভালো লেগেছে খুব। ব্যক্তিগত জীবনে আমিও এমন নিস্পৃহত থাকতে চাই বলেই বোধহয় গল্পটা দাগ কাটলো খুব।

    তুমি লেখালেখিতে আরেকটু সময় যদি দিতে পারতে !


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    ভাইয়া গল্পটা মনে দাগ কেটে গেলো। :clap: :কলাপ

    আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ছাত্রী।

    আমার ডিপার্টমেন্টের নাম দেখলাম মনে হলো। কিন্তু যেই কান্ডকির্তী দিসেন লজ্জার ব্যাপার। আমার ব্যাচে অন্তত কোনো রাদিন নাই এইটা বলতে পারি।

    জবাব দিন
  3. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    অনুভুতিটাকে বোঝানোর জন্যে দারুন, চমৎকার বা অসাধারন -- এই শব্দগুলোকে যথোপুযোক্ত মনে হচ্ছে না। :boss: :boss: :boss:
    তোর আরও লেখা পড়ার অপেক্ষাতে থাকলাম।

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      জ্বী, আপু। সময় করে পড়লেন সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ। আপনারা পড়লে মনটা অনেক আনন্দ পায়। ... জিতু, স্টার্ট ফ্রন্টরোল বিগিন ... হোয়াট! সিনিয়রের সাথে তুমি? :grr:

      ফান এপার্ট, এমনি যে সবসময় হয় তা হয়তো না। তবে অনেকগুলি বাস্তবতার এটি একটি হয়তোবা। পড়বার জন্য এবার সত্যিকার ধন্যবাদ!


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  4. মেলিতা

    লেখা ভাল লেগেছে।
    কিন্তু আল্টিমেট মেসেজ টা ধরতে পারলাম না! মূল্যবোধের পরিবর্তন? অথবা সময় সেরা চিকিতসক?
    (দয়া করে ভাইয়া কিছু মনে করবেন না। থিসিস এর প্রপোজাল লিখতেছি তো, সব কিছুতে উপপাদ্যের সমাপ্তি খুঁজি---অতএব প্রমানিত হলো ত্রিভুজের যেকোন ২ বাহুর সমষ্টি তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর টাইপ 😀 )

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      মেলিতা, আসলে কোন মেসেজ মাথায় ছিল না সেই অর্থে। ঠিকই বলেছো, সময়ের সাথে সাথে বোধের পরিবর্তন সহজাত। এভাবেই আমরা নিজেদের বার বার ভেঙ্গে আবার গড়ি। সময়ের সাথে সেই ভাঙ্গা-গড়ার স্ট্রাগল একজন অন্য ভাবনার মানুষ কিভাবে উপলব্ধি করলো তার টুকরো টুকরো চিত্র ধরতে চেষ্টা করেছি শুধু। তোমার কথায় বললে, ধরো, থিসিস হলো একটি অবজেকটিভ প্রজেক্ট আর আমাদের জীবন সবসময় সাবজেকটিভ।

      কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ!


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  5. আয়েশা ( মগকক) আয়েশা

    রাব্বী ভাই,
    মনে হচ্ছে একটা মেয়ে-ই লিখেছে. অনেক প্রিসাইস বর্ণনার জন্য ফিকশন মনে হচ্ছেনা. dakota এর আগে নর্থ বা সাউথ বসিয়ে নিতে পারেন.সাতকরা দিয়ে মা এর হাতের মাংসের ঝোল খেতে মন্চায়:((

    জবাব দিন
  6. হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    লেখায় আগেই পাঁচতারা দাগাইছিলাম, কমেন্টানো হয় নাই। একটা প্রশ্ন রয়ে গেল ... গল্পের চরিত্রগুলোকে...... বিশেষ করে রাজকু আর রাদিনকে কি স্ম্ৃতি তাড়া করে ফেরে না? আসলেই কি সব কিছু ভুলে মানুষ থাকতে পারে?

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      রাজকু এবং রাদিন চরিত্রে গুরুত্ব বেশি পড়লে হয়তো এই বিষয়টি উঠে আসতো। আমার ধারণা অতীত সবসময় পিছু করে চলে তাই স্মৃতি তাড়া করে ফেরার কথা। তবে পারিপার্শিক বাস্তবতা যখন পাল্টে যায় তখন স্মৃতির গুরুত্ব মূখ্য এবং গৌন বাস্তবতার অস্পষ্টতায় জীবনের সাথে মিশে থাকে। ধন্যবাদ হাসান।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।