দহন নিরবধি

অমাবশ্যা রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কখনো একটানা, কখনো থেমে থেমে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এদিকটায় লোকালয় কম, কিছুটা পথ দূরে স্টাফ কোয়ার্টার। একেবারে তিস্তার তীরে। রেস্ট হাউস আর তিস্তার মাঝে ঝাউবনে লিলুয়া বাতাস লুকোচুরি খেলে। সামনে কিছু ফলজ গাছ বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে। একেকটা গাছের সামনে নামফলকে রোপনকারীর নাম এবং রোপনের তারিখ অবহেলায় সময়ের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে।

হুইস্কিটা একটু ধরলে দোতলার লাউঞ্জের ইজি চেয়ায়ে হেলান দেয়া অবস্থায় একটা ঢেকুর ওঠে খান সাহেবের। খাসির রেজালার ঝাঁঝটা একদম গলা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে। মুখটা কুচঁকে বিকৃত করে ঝাঁঝালো তেতো স্বাদটা সামলান তিনি। ঈষৎ উঠে বসে, আরেক চুমুক পান করেন। তারপর ঘড়িটা একবার দেখে ভরাট গলায় অনুচ্চস্বরে ডাকেন,

– আক্কাস। আক্কাস।

এই ডাকের অর্থ আক্কাসের জানা। সে নিকটে দাড়িয়ে ছিল। খান সাহেবের হাত ধরে পাওয়া তিস্তা ব্যারেজে রেস্ট হাউসের চাকরি দশ বছর পেরোলো। তারও একযুগ আগে থেকে তার খেদমতের কাজ করেছে, তাই সাহেবের সব ইশারা তার নখদর্পনে। সবসময় সাহেবের সাথে মেহমান থাকে না। তখন সব ব্যবস্থা আক্কাসকেই করতে হয়।

– স্যার, সব রেডি আছে।
– কোন ঝামেলা করবে নাতো? দেখিস, গেলবারের মতো ভেজাল না করে। কান্নাকাটি একদম অসহ্য লাগে।

আক্কাস লজ্জিত হয়। জিভে কামড় কেটে বলে,

– না স্যার, এ্যারে সব বুঝায়ে দিছি। কোন ভেজাল হবার চান্স নাই এইবার। নিশ্চিন্ত থাকেন, স্যার। নতুন লাক্স সাবান কিনে দিসি আগে যাতে …
– কি নাম?
– স্যার, নাম হইলো তহমিনা।

ছোট সাইড টেবিলের উপর একটি জ্যাক ড্যানিয়েলের বোতল, প্রাণের অরেঞ্জ জুস, একটি পানির জগ, বেনসন এন্ড হেজেসের প্যাকেট, লাইটার, এ্যাশট্রে এবং একটি গ্লাস এলোমেলোভাবে ক্লান্ত প্রহর গুনে যাচ্ছিল। গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে একটু যেন টলতে থাকেন উঠে দাড়িয়ে খান সাহেব। তারপর নির্ধারিত ভিআইপি কক্ষের দিকে এগিয়ে যান।

সাত ভাইবোনের সংসার তহমিনাদের। বাপটা যক্ষায় পটল তুলেছে বছর তিনেক। খুব টানাপোড়ন। পেটে অনেক ক্ষিধে; পেটপুরে যে ভাত পায় না ঠিকমতো। বিশেষ করে মঙ্গার এই সময়টায়। ক্লাস এইট পাশ ভাইটার এমএলএসএস পদের চাকরিটার জন্য প্রথমে গার্ড বেলায়েত, তারপর কেয়ারটেকার আক্কাসের ঘর হয়ে শেষ পর্যন্ত খান সাহেবের হাতে।

ছবি: সিলভিয়া নাজনীন, দৃক এক্সিভিশন

২,১৬৬ বার দেখা হয়েছে

২৭ টি মন্তব্য : “দহন নিরবধি”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ঠিক এই প্লটেই গল্পটা আরো একটু বড় হতে পারতো।
    শুরুটা কিন্তু দারুন হয়েছিল, হঠাৎ এসে থেমে গেলেন।

    অনেকদিন পর সিসিবির কোন গল্প আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। ভালো লাগছিল, কিন্তু হঠাৎ শেষ হওয়ায় একটু হতাশ হয়েছি বলতে পারেন। 🙂


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)

    দোস্ত খুব সাধারণ এবং কমন একটা প্লট ... তবুও তোর ভাষার ব্যবহার আর ডিটেইলিং ভাল লাগছে। ঢেকুর ... খাসির রেজালার ঝাঁঝ ...
    শুরুটা দারুন হয়েছিল ... শেষে আইসা তাড়াহুড়া করছিস মনে হয়।

    কামরুলের সাথে পুররা একমত ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাফি (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।