মৃত্যুর আগে

-১-

গতকাল হুমায়ূন কবির সাহেব কলকাতা এসেছেন শুনে জীবনানন্দ সকাল সকাল তাঁর বাসায় চলে এসেছেন। কিন্তু আজকেও হুমায়ূন কবির সাহেবের সাথে দেখা হল না। পিএ যদিও বলল উনি বাড়িতে নেই, তবু সাক্ষাতের জন্য আসা এত লোকজন আর গাড়ি বারান্দায় দাড়ানো গাড়ি বলে দিচ্ছে একজন নিঃস্ব কবির সাথে দেখা করে চাকরির আর্জি শোনার চাইতে আরো অনেক বড় কাজ আছে মন্ত্রী মশায়ের। দুই মাস আগে একবার কবির সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল। বিশেষ কোণ আশ্বাস দেননি। একথা সেকথা বলে  তাঁকে বিধানচন্দ্র রায়, নলিনীরঞ্জন সরকার, কিরণশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু প্রমূখ ক্ষমতাসীন ভারি-ভারি ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে নিজের সমস্যার কথাটা বলতে বলেছে। প্রথম প্রথম জীবনানন্দ বিধান রায়কে ছোটো-বড়ো বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছে, কিন্তু প্রত্যুত্তর আসে নি। সরাসরি এদের কারো সাথে দপ্তরে গিয়ে দেখা করার সাহস তাঁর হয়নি। সে ভেবে দেখেছে, যে সামাজিক অবস্থানে তাঁর বাস, সেখান থেকে আগবাড়িয়ে গিয়ে ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে কোনো লাভ নেই। ওঁরা ‘অনেক দূরের মানুষ’। তার চাইতে কবির সাহেব কে কাছের মানুষ মনে হয় তাঁর। ভদ্রলোক নিজেও একজন কবি এবং দূঃস্থ কবি সাহিত্যকদের পাশে দাঁড়ানোর একটা ঝোঁক আছে। তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ বইটাও সে কবির সাহেব কে উৎসর্গ করেছে। যদিও কিছুদিন যাবৎ কবির সাহেব অনেক চিঠি লিখে, নিজের দূরাবস্থার কথা জানিয়েও কোন লাভ হয়নি।

এখন সিগনেটের দীলিপ বাবুর যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে সিড়ি দিয়ে নামছিল জীবনানন্দ। যদি ওনাকে বলে সাগরময় ঘোষ কে একটা ফোন করানো যায়। গত কমাসে আটটা কবিতা সাগরবাবুর কাছে সে রেজিস্ট্রি করে ডাকে পাঠিয়েছে। কোন উত্তর আসেনি। কবিতা কটা ছাপা হলে কিছু টাকা হাতে আসত। টাকার খুব টানাটানি যাচ্ছে আজকাল। সাথে সিগনেটের কোন কবিতা সংকলনে যদি একটা কবিতা ছাপানো যায়।   বাইরে আসতেই শীতকালের চড়া রোদ লাগল মাথায় আর মুখে। ভাবনায় ছেদ পড়ল, মাথাটাও যেন একটু চক্কর দিল। হাই প্রেশার আর সকালে না খাওয়ার যে একটা কুফল আছে, শরীর জানান দিল তাঁকে। শরীর মহাশয় হলেও তারও তো একটা সহ্য ক্ষমতা আছে। যদিও সাহিত্যের জন্য বেঁচে থাকার সহজ সাফল্য পাবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু মানুষের জীবন তো শুধু তাঁর একার না। ঘরে দুটো রোগা ছেলে মেয়ে, একটা বউ আছে, পাওনাদার আছে, আত্মীয়-বন্ধুরা আছে। আর সকল সম্পর্কই চাহিদা নির্ভর। একজন কাপালিকের মত নিঃস্ব কবি, যার সামনে কিছু নেই আর ভবিষ্যতে কিছু থাকবার সম্ভাবনাও নেই, তাঁকে এই চাহিদা নির্ভর সম্পর্কগুলো ক্রনিক আলসারের মত বয়ে বেড়াতে হয়।

আবারও চারদিকে তাকাল জীবনানন্দ। নিউ আলিপুরের এই দিকটা বড়লোকদের আবাসস্থল। রাস্তায় পায়ে চলা লোক কম দেখা যায়। এখন দশটা বাজে। মানুষ জন ধীরে ধীরে আরও কমে আসছে। সবাই যে যার গন্তব্যে পৌছে গেছে। এমনকি কিছু দূরের গাছের নিচে বসে দুই ভিখারীও ভিক্ষা চাইতে প্রস্তুত। বিড়িতে শুকটান দিচ্ছে। তাঁর মত উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে মনে হয়না কেউ এই মুহুর্তে এখানে আছে। এখনো দীলিপ বাবুর কাছে যাবে কিনা মনস্থির করতে পারছে না। যেতে-আসতে ২৫ পয়সা বাস ভাড়া লাগবে। পকেটে সর্বসাকূল্যে গতকাল দেশ পত্রিকার শব্দজট সমাধান করে পাওয়া একটাকা আছে। এইটাকা শেষ হলে আর কোথা থেকে টাকা আসবে তাঁর কোন সম্ভাব্য উপায় এই মূহুর্তে তাঁর জানা নেই।

এদিক সেদিক তাকাতে তাকে রাস্তার ওপারে একটা ডাবওয়ালাকে ঝুড়িতে করে ডাব বিক্রি করতে দেখল সে। প্রেশারের কারনে ডাক্তার বলেছিল কচি ডাব খেতে। এই মুহুর্তে গলাও শুকিয়ে আছে তাঁর। সে রাস্তা পার হয়ে ডাবওয়ালা কে জিজ্ঞেস করল, ডাব কত করে?

ডাবওয়ালা উদাসীন ভাবে জবাব দিল, দশ পয়সা করে। আজকাল চেহারায় যেন একটা দারিদ্রের স্থায়ী দাগ পরে গেছে। কেউ খুব গুরুত্ব দেয় না, ভাবল জীবনানন্দ।

-আট পয়সা করে সব জায়গায় বিক্রি হয়, তুমি এত দাম চাইছ কেন হে? কিছুটা দরদাম করে ডাবওয়ালার কাছ থেকে পাওয়া উদাসীনতার অপমান ঝেড়ে ফেলতে চায় জীবনানন্দ।

-একদাম, আমার এখানে দরদাম হয়না। নিলে নেন। সাফ জবাব ডাবওয়ালার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাকে খদ্দের চিনতে শিখিয়েছে। সামনে দাঁড়ানো ক্রেতার যে ট্যাকে খুব বেশী জোর নেই, তা সে না তকিয়েই বলে দিতে পারে। একটার বেশী ডাব হয়তো কিনবে না। শুধু শুধু কথা খরচ করার কোন কারন সে খুজে পায় না। এই জায়গাও তাঁর বদলাতে হবে। আগে সামনের বাড়ীর বাবুর কাছে হাজার লোক আসত প্রতিদিন। আসা যাওয়ার পথে বাবুরা তাঁর কাছ থেকে ডাব কিনে খেত। বিকাল গড়ানোর আগেই ঝুড়ি ফাঁকা এখন মাসে দুয়েকদিন এমন হয়। বাকি সময় কেউ আসেনা। মাসে তো আর দুই দিন ব্যাবসা করে পেট চলে না। তবে আজকে সকাল থেকে অনেক লোকজন আসছে। ব্যাবসা আজকে ভাল হবে মনে হয়।

-দাও দেখি একটা, হালকা শাস ওয়ালা দিও। ডাবের শাস খেয়ে ক্ষুধাটা চাপা দেয়া যাবে, ভাবল সে। তারপর ডাবওয়ালার কেটে দেয়া ডাবটা হাতে নিয়ে একপাশে ছায়ায় সরে দাঁড়িয়ে চুমুক দেয়। বেশ মিস্টি। এক চুমুকে পানিটা খেয়ে নিয়ে ডাবওয়ালাকে ডাবটা দেয় সে। ঝুড়ির ভেতর থেকে একটা দা বের করে ডাবটা অভিজ্ঞ হাতে দুই ফালি করে, পাশথেকে ছোট একটা চলটা তুলে আবার সেটা আবার জীবনানন্দ কে ফিরিয়ে দেয়। সেটা হাতে নিয়ে দেখে বেশ খানিকটা নরম শাস আছে। তৃপ্তি করে চেঁছে খায় সে। ক্ষুধার ভাব অনেকটাই কেটে গেছে তাঁর।

রঞ্জু আর মঞ্জুর জন্য কটা ডাব নিয়ে যাবে ভাবল সে। অনেক দিন ধরেই জ্বর জ্বর ভাব ছেলেটার। মেয়েটাও এমন রোগা, এ অসুখ সে অসুখ লেগেই আছে। ডাক্তারের কাছে নেয়ার সামর্থ্য এই মুহুর্তে তাঁর নেই। আরো চারটে ডাব বেছে কেনার পর দাম দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখে একটা চারটে দশ পয়সা আছে। মনে পড়ল আসার আগেই ফার্মেসি থেকে রঞ্জুর জন্য এক ফাইল ভাইটেক্স কিনেছে। তাতেই ষাট পয়সা বেরিয়ে গেছে।

-পঞ্চাশ পয়সা। চারটে ডাব বাধছাঁদা করে এগিয়ে দেয় ডাবওয়ালা।

-একটা দশ পয়সা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জীবনানন্দ বলে, ভাই এগুলো থাক। পরে এক সময় এসে নিব।

হুহ!! হাত থেকে পয়সাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করে ডাবওয়ালা। নিজের মনে গজগজ করতে থাকে। কি তা ভাল করে শোনেনা জীবনানন্দ।

-২-

হনহন করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেয় সে, কিছুটা দৌড়ে গিয়ে বালিগঞ্জগামী একটা লোকাল বাসে লাফ দিয়ে উঠে পরে। অনেকটা তাচ্ছিল্য এড়ানোর জন্যে অহেতুক তাড়াহুড়া করে সে।

তাচ্ছিল্য আজকাল যেন সকলের কাছ থেকে জীবনানন্দর প্রাপ্য হয়ে গেছে।  সম্পাদক-সমালোচক থেকে শুরু করে আত্মীয়-বন্ধু সকলেই আজকাল আর হিসাবেই আনে না তাঁকে। অনেকেই বাড়ী বয়ে এসে তাচ্ছিল্য করে যায়। আর সর্বক্ষন তাচ্ছিল্য করার জন্য তো বাড়ীতে লাবন্য আছেই। নীহাররঞ্জন গুপ্ত লাবন্যর কেমন যেন সম্পর্কে দাদা হয়। কদিন আগেও সেটা নিয়ে সে বলেছিল, লেখক তো তিনিও। কত খ্যাতি, কত সম্মান। টাকাও তো অনেক কামান না লেখালেখি করে। ডাক্তারী করা তো আজকাল ছেড়েই দিয়েছেন প্রায়। আর তুমি কুলির মত সারা দিন খেটে কি লেখ যে একটা পয়সাও আয় হয় না? কোন জাবাব দিতে পারেনি জীবনানন্দ। খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে তখন তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা। বুদ্ধদেব বসু কে একবার চিঠি লিখে তাঁর সম্পর্কে বলেছিল, “তাঁর কবিতা চিত্ররূপময়। তাঁর কবিতায় তাকিয়ে থাকার আনন্দ আছে।” সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং  সমর সেন একটা নতুন কবিতাপত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছিলেন, যার নাম দেয়া হয়েছিল কবিতা । পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা ছাপা হয়, যার নাম ছিল ‘মৃত্যুর আগে’। সেটা পড়েই রবীন্দ্রনাথ একথা লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বাবুকে। নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন যখন ১৯৫২ খৃস্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ “বনলতা সেন” বইটাকে  বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করে, সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব বাবু এই কথাগুলো তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন। উগ্রমূর্তী স্ত্রীর গঞ্জনার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাই বারবার মাথার মধ্য ঘুরছিল কেন, কে জানে? হয়ত  অতীত স্বীকৃতি দিয়ে বর্তমানের ব্যার্থতার ব্যাথা ঢাকার চেষ্টা নিজের মধ্যে নিজে করে যাচ্ছিল।

চিঠি অবশ্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকেও লিখেছিল একবার। ৮ই ডিসেম্বর, ১৯১৫ সালে। ষোল বছর বয়সে অনেকটা আবেগের বশে যখন সে কয়েকটা কবিতা নোবেল পাওয়া কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে মান যাচাই করার জন্য পাঠিয়েছিল, তার জবাবে উত্তর এসেছিল,

কল্যানীয়াসু,

তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাঁতে সন্দেহমাত্র নেই। -কিন্তু ভাষা-প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে। বড়জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে। যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমান তা নয় বরঞ্চ উল্টো।

-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চিঠিটা সে খুব যত্ন করে রেখেছিল অনেকদিন। শেষবার যখন পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসে তখন বাঁধা ছাঁদার ফাঁকে কোথায় যেন হারিয়ে যায় চিঠিটা। অনেকদিন খুব যত্ন করে রাখলেও তাঁর মনে হয়েছে কবিতা গুলো রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেননি তিনি। কিছুটা রাগও করেছিলেন হয়ত। কারন চিঠির শেষে কোন আশীর্বাদ ছিল না, ভাষাও ছিল বেশ রুক্ষ। তাঁর পরেও সে আনন্দ পেয়েছিল এই ভেবে যে চিঠির শুরুতে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবি স্বীকৃতি দিয়েছেন।

বালিগঞ্জ! বালিগঞ্জ! কন্ডাক্টরের চিৎকারে সম্বিত ফেরে তাঁর। বাস একটু ধীর হলে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে পরে সে। ধীরে ধীরে বাড়ীর দিকে হাঁটা দেয়। ট্রামের টুং টুং ঘন্টা শুনে একটু থামে। ট্রাম আসছে। আশেপাশের মানুষজন, টানা রিক্সা সব দাঁড়িয়ে গেছে। ট্রাম ক্রসিং এর একটু আগে সেও দাঁড়িয়ে যায়। খুব মনযোগ দিয়ে ট্রামটা লক্ষ্য করে। লাল হলুদ মেশানো একটা যন্ত্র পেটের মধ্যে কতগুলো মানুষ কে নিয়ে গন্ত্যব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ যন্ত্রটার নিজের কোন গন্ত্যব্য নেই। মনে পড়ে অনেক আগে ট্রাম নিয়ে সে একটা কবিতা লিখেছিল। খুব একটা ভাল হয়নি বলে কোথাও পাঠায়নি সে, যদিও একবার সঞ্জয় ভট্টাচার্য কে কবিতাটা পূর্বাশা পত্রিকার ছাপাবার জন্য পাঠাবে ভেবেছিল।

ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত

কবেকার কোন্‌ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়

‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক- ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই

কখন এমন হলে হায়!’

আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে

কবেকার কোন্‌ সে জীবন ডুবে যায়।

 

সবসময়ই ট্রাম জিনিসটার প্রতি একটা অদ্ভূত আকর্ষন বোধ করেছে সে। ট্রামের সাথে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে  শরীর তাঁর। মনে হয় ট্রামের নিচে চাপা পরে মরলে মৃত্যু অনুভব করা যাবে। একটু একটু করে ভারী চাকাগুলো যখন শরীর থেঁৎলে দেয়া শুরু করবে মৃত্যু তখন কোন প্রাচীন প্রেতীনির মত ধীর পায়ে এগিয়ে আসবে আধা-থেঁৎলা শরীরটার দিকে, যা কখনও একটা মানুষের শরীর ছিল।

 

বিধাতার লীলা বড়ই অদ্ভূত। কারও কারও ভক্তি ভরে করা আজন্ম প্রার্থনা তিনি মঞ্জুর করেন না, আবার কারও মুহুর্তের অসতর্ক উচ্চারন সাথে সাথে অনুমোদন করে দেন।

 

-৩-

 

ট্রাম চলে গেছে। লাইনের দুই পাশে এতক্ষন থেমে থাকা মানুষ আর টানা রিক্সা গুলোর মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি লেগে যায়া। সবারই গন্ত্যব্যে পৌছানোর তাড়া। ঠেলা-গুতো এড়াতে জীবনানন্দ একপাশে সরে যায়। তারপর ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সে। তাঁর নিজের বাড়ি সেই কবে দখল হয়ে গেছে। এক লাইফ-ইনসিওরেন্স কোম্পানির বড়োবাবুদের ন্যাওটা মহিলা কে সাবলেট দিয়েছিলেন। সেই উপভাড়াটেনি সারারাত এমন নাচ গান আর রাতভর আসর বসিয়ে হৈ-হুল্লোড় করত যে বাড়ীতে টেকা দায় হয়ে পরে।  তবে ভাড়াটা মাসের ঠিক এক তারিখে মিটিয়ে দিতেন মহিলা। জীবনানন্দর লেখাপড়া আর পারিবেশিক শান্তি মাথায় উঠলে ভাড়াটেনিকে তুলে দিতে তিনি বহু চেষ্টা করেন, প্রথমত বদলি ফ্ল্যাট দেখে দিতে চেয়েছেন; দ্বিতীয়ত, ইনসিওরেন্সের বড় কর্মকর্তা সাবিত্রীপ্রসন্নকে, অজিত দত্তকে ধরেছেন; এমনকি হুমায়ুন কবিরের সাহেবের কাছে গিয়েও ধরনা দিয়েছেন; তৃতীয়ত, বরিশালের মানুষ এবং উষা পত্রিকার সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ সেনকে এবং পাড়ার মানুষ বন্ধু সুবোধ রায়কে ধরে পাড়ার গুন্ডা যুবকদের সাহায্য নেবার কথা ভেবেছেন। কিন্তু, কিছুতেই কিছু করা যায় নি, মহিলা বহাল-তবিয়তে থেকে গিয়েছেন। শেষমেষ তাঁকে এসে উঠতে হয়েছে ছোট ভাইয়ের বাড়িতে। ছোটভাই নিচতলায় দুটো ঘর ছেড়ে দিয়েছে থাকার জন্য। একটা ঘরে তিনি আর রঞ্জু আরেকটাতে মঞ্জু কে নিয়ে থাকে লাবন্য। আলাভোলা দাদাকে খুবই ভালবাসে অশোক। একে তো অতিরিক্ত একটা পরিবারের বোঝা ঘাড়ের উপরে নিয়ে নিয়ে মুখ বুজে থাকে সে, তার উপর মাসে মাসে কিছু টাকা সে দাদার হাতে দেয় সে। দাদার হাতে টাকাটা দেবার সময় এমন ভাবে মাথা নিচু করে থাকে যেন খুব বড় কোন অপরাধ করছে সে। ছোটবোন সুচরিতাও মাসে দুই তিনবার আসে দাদার সাথে দেখা করতে। প্রতিবার আসলে কোন বইয়ের বা খাতার ভাঁজে কিছু টাকা গুজে দিয়ে যায়। সরাসরি দাদার হাতে টাকা দিতে তাঁর বাধে।

 

এই উপরি কটা টাকা, এক বন্ধুর ব্যাবসার অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাম অ্যাডভাইজার হওয়া, নিজের ভাড়া-বাড়ির একাংশ বেআইনি ভাবে সাবলেট করে দেওয়া, মাঝে-মধ্যে টাকা নিয়ে কবিতা এবং প্রবন্ধ ছাপানো – এ-রকম সব স্বনিযুক্ত কাজকর্ম করে কোনো এক-ভাবে রোজ-আনি-রোজ-খাই ধরনে সংসারটা টেনে যাচ্ছে সে। ভবিষ্যতের কথা ভাবার সাহস হয়না তাঁর। কোন সম্মানজনক চাকরী গত একবছর চেষ্টা করেও জুটাতে পারেনি। যদিও গোপালচন্দ্র রায়ের দৌলতে এবং বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বদান্যতায় গতবছর ভাল চাকরি পেয়েছিলেন একটা হাওড়া গার্লস কলেজে। চাকরিটাও তাঁর পছন্দসই ছিল, কিন্তু কলকাতার ল্যান্সডাউন রোড থেকে হাওড়া ময়দান – রোজ দু’ বেলা ঠ্যাঙানোটা ছিল খুবই কষ্টকর। নিজের শরীরও প্রায় অসহযোগিতা করছিল – ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, চোখের অসুখ। অনেকটা বাধ্য হয়ে শেষমেষ চাকরিটা ছেড়ে দেয় জীবনানন্দ।

 

বাড়ির সামনে আসতেই জীবনানন্দ দেখে রঞ্জু বের হচ্ছে। বাবাকে দেখে হাসি দেয় একটা। কই যাস, জিজ্ঞেস করে সে।

 

-মোড়ের দোকান থেকে চা আনতে। পীসি এসেছে। বাড়ীতে চাপাতা নেই।

 

কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে যায় সে। রঞ্জুও চা আনতে চলে যায়। আজকাল সুচরিতার সাথে দেখা হলে একটা অপরাধবোধ কাজ করে তাঁর মধ্যে। ছোটবোন টা সব সময় তাঁকে অনেক বড় কবি হিসেবে শ্বশুর বাড়ীতে পরিচয় দিয়েছে। আজকাল নাকি সেকথা নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দেয় তাঁর বোন কে। শ্বশুর বাড়ী থেকে পাওয়া বোনের অপমানের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হয়। অনেক বার বের করতে চেয়েছে আর দশটা মানুষের মত সে কেন হল না? একটা চাকরি, মাস শেষে বেতন, স্ত্রীর হাসি মুখ, সুস্থ সবল সন্তান, কিছু জমানো টাকা আর কি চাই?

 

হয়ত সে এ সবই পেতে পারত। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে নিজের মত প্রকাশ করার একটা অদ্ভূত বাতিক আছে তাঁর। ১৯২৭ এ যখন সে যখন সিটি কলেজে পড়ায় তখন একবার কিছু হিন্দু ছাত্রের অনুরোধে তিনি লক্ষীপূজার আয়োজন করেন। কলেজের বেশীর ভাগ ছাত্র তখন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। বেশীরভাগ শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যরাও তাই। একটা সাধারন লক্ষীপূজা তাঁদের কাছে হয়ে উঠল সাম্প্রদায়িক আচার। এ নিয়ে ছাত্র অসন্তোষ আর শিক্ষকদের তাতে সমর্থনের ফল হল তরুন প্রভাষক জীবনানন্দ দাশের চাকরিচ্যূতি। যদিও তাঁকে দেয়া চিঠিতে কলেজ কতৃপক্ষ কলেজের অর্থনৈতিক অনটন কে তাঁর এই চাকরি থেকে অব্যহতির কারন হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারপর আবার একই ঘটনার পূনরাবৃতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে বরিশালের বিএম কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে আসে সে।  হুমায়ুন কবিরের সাহেবের দৈনিক পত্রিকা স্বরাজে একটা চাকরি জুটে যাবে এই ভরসায়। চাকরি জুটেও গিয়েছিল। ১৯৪৭ দেশ-বিভাগের  পুরো পরিবার কলকাতায় নিয়ে আসে। কিন্ত চাকরিটা বছর দেড়েকের বেশি টেকে নি। কী কুক্ষণেই-যে সে স্বরাজ পত্রিকার সাময়িকীতে নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটা ছোটো লেখা লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেছিলেন : ‘… আপাতদৃষ্টিতে এত বড় একটা প্রবল উৎস ব’লে মনে হয় যে-নজরুলী রচনাকে, তা কি বড় সাহিত্য সৃষ্টি করবে না একদিন? কিন্তু, তবুও, ক্রমে-ক্রমে বুঝতে হল যে, নজরুল ইসলামের লেখায় মহাকবিতার গভীর প্রসাদ নেই, তার প্রতিশ্রুতিও কম।’ লেখাটা ছাপা হবার পরপরই স্বরাজ পত্রিকার কর্তাব্যক্তিরা ক্ষেপে গেলেন খুব। এমনকি তাঁর কাছের মানুষ হুমায়ুন কবির সাহেবও, এতটাই ক্ষেপলেন যে, তাঁর চাকরিটা পত্রপাঠ চলে গেল। এর পর থেকে অনেকটা নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে সে। কোন কিছু বলতে ভয় পায়। এমনকি নিজের লেখা নিয়েও সে ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না। হয়ত বয়সের সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস আর সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা কমে আসছে মনে হয়।

 

-দাদা আমি যাই। কখন সুচরিতা ঘরে ঢুকেছে বুঝতে পারে নি সে। ভাবনার মাঝখান থেকে হঠাৎ সম্বিত ফেরে জীবনানন্দের।

-এখনি যাবি কি? আমি তো কেবল আসলাম। বস, দুটা কথা বলি।

-না দাদা। আজ বাড়ীতে কাজ আছে। ওঁর কয়েক বন্ধুকে সন্ধ্যায় দাওয়াত করেছে। রান্না-বান্নার জোগার দেখতে হবে।

-যা তাহলে। আসিস আবার সময় পেলে।

– তা আমি আসি। তুমি না বললেও আসব। আর তোমার শরীরের খেয়াল রেখ। কি অবস্থা করেছ দেখেছ? রঞ্জু আর মঞ্জুর শরীরও তো ভাল না। ডাক্তারের কাছে যাও না কেন?

-দেখি যাব। একটু টাকার জোগার করতে পারলেই…, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় জীবনানন্দ।

সুচরিতাও বোঝে দাদার দাদার ডাক্তারের কাছে যাবার অক্ষমতা মনে করিয়ে দিয়ে সে তাঁকে আঘাত করে ফেলেছে। তাঁর আর কোন কথা মনে আসে না। আসি তাহলে, বলে আস্তে আস্তে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। জীবনানন্দ এক মনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট কিছুর দিকে নয়, কোন কিছুর দিকেই নয়। শূন্য তাকিয়ে থাকা, যেন তাঁর ভবিষ্যত দেখছে, অনেক সম্ভাবনার মাঝে এরকমই শূন্য।

-চিঠি! চিঠি! দরজার কড়া নেড়ে ডাকপিওন হাঁক দেয়। উঠতে গিয়ে দেখে রঞ্জু চিঠিটা নিয়ে আসছে। আবার খাটে বসে পরে সে।

-তোমার চিঠি, বলে চিঠিটা তাঁর হাতে দেয় রঞ্জু। দেশ পত্রিকার খাম দেখে খুশি হয়ে ওঠে সে। নিশ্চই কোন কবিতা ছাপার জন্য মনোনীত হয়েছে। দ্রুত হাতে খামটা খুলে ফেল সে। খুলেই মনটা হতাশায় ভরে ওঠে। তাঁর লেখা চিঠি আর কবিতা ফেরৎ দিয়েছেন সাগরময় ঘোষ। কোন প্রত্যূত্তরের জবাব নেই, শুধু খামে ভরে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে তাঁর লেখা দুটো চিঠি আর আটটা কবিতা।  বুকের বামদিকে একটা ব্যাথার অনুভূতি হয় তাঁর। চিনচিনে ব্যাথা, এটাই কি ব্যার্থতার গ্লানির শারীরিক প্রকাশ, ভাবে সে। তারপর নিজের লেখা বালিশে মাথা রেখে পড়তে থাকে সেঃ

 

১৪.৭.৫৪

প্রিয়বরেষু,

আশা করি, ভালো আছেন। আমি খুব অসুস্থ ছিলাম, এখন আগের চেয়ে ভালো আছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপাবার জন্য এই সঙ্গে কয়েকটি কবিতা পাঠালাম। এর ভেতর থেকে একটি কবিতা শারদীয়া সংখ্যার জন্যে নিয়ে বাকিগুলো আপনার পত্রিকার অন্যান্য সংখ্যায় ছাপাবার সুযোগ পেলে আনন্দিত হব। লেখাগুলোর প্রাপ্তি-সংবাদ ও আপনার চিঠি পেলে আনন্দিত হব। আমার শুভেচ্ছা ও প্রীতিনমস্কার গ্রহণ করুন।

ইতি।

আপনার জীবনানন্দ দাশ

১.১০.৫৪

প্রীতিভাজনেষু,

মাস দেড়েক হল সাত/আটটি কবিতা আপনাকে (বাড়ির ঠিকানায়) রেজিস্ট্রি ক’রে পাঠিয়েছিলাম, সুযোগ-মতো ‘দেশ’এ ছাপাবার জন্যে। আপনার কোনো চিঠিপত্র পাই নি। কবিতাগুলো পাঠিয়ে আপনাকে বিব্রত করা উচিত হয় নি – বোধ করছি। আমার মনে হয়, এখন কবিতাগুলো কিছু-কাল আমার কাছে থাকুক; বিশেষত প্রেমের কবিতা তিনটি (‘সে’, ‘তোমাকে’ ও ‘তোমাকে ভালোবেসে’); কবিতা তিনটি নানা কারণে এখন আর ছাপাব না, ভাবছি। আপনি এই চিঠি পেয়ে কবিতাগুলো আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে খুশি হব। পরে ‘দেশ’-এ আপনার প্রয়োজন হলে আবার পাঠানো যাবে। রেজিস্ট্রি ক’রে পাঠাবার জন্যে টিকিট এই-সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। আশা করি ভালো আছেন। শুভাকাঙ্ক্ষা ও প্রীতিনমস্কার জানাচ্ছি।

ইতি।

জীবনানন্দ দাশ

 

-বাবা খাবে না? রঞ্জু এসে জিজ্ঞেস করে।

-উঠি। জবাব দেয় সে। কিন্তু বিছানা থেকে নড়েনা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। জানালা দিয়ে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে একটু শীত শীত করে তাঁর। পায়ের কাছে রাখা কম্বলটা আবার গায়ে জড়িয়ে নেয়, আবার ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

রঞ্জু বাবার মন খারাপ টের পায়। কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। জীবনানন্দও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যে দুবার ঘরে এসে রঞ্জু দেখে গেছে যে বাবা ঘুমাচ্ছেন। সেও পাশের ঘরে গিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পরে। শুধু মাত্র এক নিস্তবদ্ধ হাহাকার কবির ঘরজুড়ে পায়চারী করে বেড়ায়।

 

-৪-

 

-এই অবেলায় ঘুমাচ্ছ কেন? হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জীবনানন্দ দেখে খাটের এক কোনায় সুবোধ বসে আছে। দুই বাড়ি পরেই থাকে সে। বয়সে তাঁর চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট, কিন্তু এই বয়সে এসে আর বয়সের ব্যাবধান বন্ধুত্বের বাঁধা হয় না। এই পাড়ায় আসার পর থেকেই সুবোধের সাথে তার বেশ আলাপ হয়েছে। এখন যে কজন গুটিকয় বন্ধু অবশিষ্ট আছে, তাঁর মধ্যে সুবোধই তাঁর সব থেকে বেশী খোঁজ খবর রাখে।

– কি হল, ওঠো দাদা। বাড়ীতে বউ আজকে কচুরি করেছিল। ভাবলাম তোমার জন্যও নিয়ে আসি। দুই ভাই আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া যাবে।

-আমার তো এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। কম্বল সরিয়ে উঠতে উঠতে জীবনানন্দ জানায়।

-এই অবেলায় আর ভাত খেয়ে কাজ নেই। তুমি মুখধুয়ে আস। কচুরির গতি করি।

মুচকি হেসে জীবনানন্দ উঠানের দিকে চলে যায় হাত মুখ ধুতে। একটু বেশী সময় নিয়ে চোখে মুখে পানি দেয় সে। তারপর উঠানের দড়িতে ঝোলানো গামছা দিয়ে মুখ মুছে ঘরে ঢুকে দেখে প্লেটে অনেক গুলো কচুরি সাজানো। রঞ্জু আরেকটা ছোট প্লেটে ছয়টা কচুরি আলাদা করে নেয়।

 

-তোমার বোনের জ্বর সেরেছে? সুবোধ রঞ্জুকে জিজ্ঞেস করে।

 

ঘার হেলিয়ে জবাব দিয়ে বেরিয়ে যায় রঞ্জু। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। জীবনানন্দ প্লেট থেকে একটা কচুরি তুলে কামড় দেয়। চা দেবার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে বাড়িতে চাপাতা নেই। আবার চুপচাপ আরেকটা কামড় দেয় কচুরী তে। হিং দেয়ায় বেশ স্বাদ হয়েছে। পেটে ক্ষুধা থাকায় বেশ ভাল লাগে কচুরী খেতে। আরেকটা হাতে তুলে নেয় সে।

 

-কাল রেডিও তে তোমার মহাজিজ্ঞাসা কবিতার আবৃত্তি শুনলাম। তুমি দাদা নিয়মিত রেডিওতে কবিতা পড়লেই পার। বেশ ভরাট গলা তোমার। শুনতে বেশ লাগে।

 

কিছু বলেনা জীবনানন্দ। মৃদু একটু হাসে। রঞ্জুকে চেঁচিয়ে জল দিয়ে যেতে বলে। তারপর সুবোধকে জিজ্ঞেস করে, খাচ্ছ না কেন?

 

-আমি বাড়ী গিয়ে খাব। তোমার বৌদির দাদা আজ কাশী থেকে এসে আমাদের বাসায় উঠবে। জলখাবার তার সাথে বসেই খেতে হবে।

 

কিছু আর বলে না জীবনানন্দ। রঞ্জুর এনে দেয়া জল এক চুমুকে শেষ করে বাইরে থেকে চা আনার জন্য কয়েকটা খুচরো পয়সা দেয় সে রঞ্জুর হাতে। তারপর সুবোধ কে জিজ্ঞেস করল, গত কয়েকদিন তোমার দেখা পেলাম না যে? বাইরে কোথাও গিয়েছিলে নাকি?

-না দাদা বাড়ীতেই ছিলাম। ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরেছিল। কয়েকদিন খুব ভুগিয়েছে।

-হ্যা, এখন এই রোগতো শীতের শুরুতে ঘরেঘরে লেগেই আছে। আমার মেয়েও তো এক সপ্তাহ হল ভুগছে। চল আজকে চা খেয়ে বিকালে হেঁটে আসি। শরীরের ঘাম ঝড়ালে জ্বর-জারি সব পালাবে।

– এই শরীরে মনে হয় না পেরে উঠব। তাছাড়া বাড়িতে লোক আসবে। ফিরতে হবে সন্ধ্যার আগে।

 

এমন সময় রঞ্জু দুই গ্লাস চা নিয়ে ঢোকে। চা খেতে খেতে অনেক্ষন আড্ডা হয়। কথা বেশীর ভাগ সুবোধই বলে গেল। স্বভাবসুলভ ভাবে জীবনানন্দ চুপচাপ শুনে গেল। সুবোধের একটা গুন ছিল যে সে অনেকের উচ্চারন নকল করতে পারত। বনফুল আর করুনানিধি নিধান এর উচ্চারন ত্রুটির নকল শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে জীবনানন্দ। ঘন্টাখানেক পরে সুবোধ বলে, দাদা যাই।

-আমিও বেরোব একটু হাঁটতে। চল কিছুটা হেঁটে আসি। তাঁর পর বাড়ী যাবে। বৌদির দাদার আসতে তো এখনো দেরী আছে।

-নাহ দাদা। আজকে থাকুক। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আর একটু জোর দিয়েই অনুরোধ প্রত্যাখান করে সুবোধ। জীবনানন্দও আর জোরাজুরি করে না। বিদায় নিয়ে সুবোধ চলে যায়। জীবনানন্দও হাটতে যাবার জন্য প্রস্তত হতে থাকে। হঠাৎ টেবিলের উপরে লক্ষ্য করে পুরোনো একটা প্রবাসী পত্রিকার নিচে কয়েকটা টাকা চাপা দেয়া আছে। তুলে দেখে দুটো দশ টাকার নোট। সুচরিতা দিয়ে গেছে বরাবরের মত। একটু খুশি হয়ে ওঠে সে। একদমই কোন টাকা ছিলনা হাতে। কুড়ি টাকা খুব কাজে আসবে। নোট দুটো পকেটে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পরে সে। তারপর হাটতে হাটতে বালিগঞ্জ বাজারে চলে আসে। বাজারে ঘুরতে তাঁর ভালই লাগে। অনেক মানুষ একজাগায় নানা উদ্দ্যেশে ঘুরে বেড়ায়, দোকানীরা নানান কৌশলে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, কেউ মনের মত দামে কিছু কিনতে না পেরে নিজের মনে গজগজ করে হেটে যাচ্ছে, আরও কত কি। ঘুরেঘুরে এসব একমনে দেখতে থাকে। একজনকে ডাব বিক্রি করতে দেখে সকালের কথা মনে পরে তাঁর। সকালের অপমানের প্রতিশোধ নিতেই দরদাম না করে চারটে ডাব কিনে ফেলে সে। তারপর বাড়ীর দিকে হাঁটা ধরে। বাজারের ভেতর থেকে বের হয়ে ট্রামক্রসিং এর এসে পড়ে। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল সে। ট্রামলাইনগুলো পার হবার সময় লাইনের মাঝখানে জন্মানো ঘাসে তাঁর চোখ আটকে যায়। হালকা সবুজ অনেক ঘাস লাইনের ফাঁকে এক সারিতে জন্মেছে। বিভিন্ন মাপের, তাদের সবুজটাও যেন মাঠে জন্মানো ঘাসের মত গাড় না। একটু ফ্যাকাশে মত সবুজ, অনেকটা কচি কলাপাতার মত রঙ। রাস্তার মাঝের ৩ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি জায়গায় নিজের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে দিয়ে জন্মে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, কখনও উচ্চতায় একটু বড় হলেই কর্পোরেশনের সাফাই অভিযানে উৎখাত হচ্ছে। বাইরের জগতের কাছে সব সময়ই অপ্রকাশিত থেকে যায় তাদের সৌন্দর্য, কারো কোন কাজেও লাগে না তারা কখনও।

 

ঘাসগুলোর সাথে নিজের খুব মিল খুজে পায় সে। সেও দিনের পর দিন আধো অন্ধকার একটা ঘরে বসে লিখে চলেছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস। বেশীর ভাগই কেউ কোথাও ছাপতে চায় না। মাঝে সাঝে যাও ছাপা হয়, কর্পোরেশনের সাফাই কর্মীদের মত সমালোচকরা তাঁর লেখাকে নিশ্চিহ্ন করতে ঝাঁপিয়ে পরে। পারলে তাঁকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ভিতরে একধরনের ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃনা আর অভিমানের মিশ্র অনুভূতি টের পায়।

 

টুং টুং শব্দ পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে ট্রাম আসছে। শরীরের উপর দিয়ে ট্রাম চলে যাওয়ার চিন্তাটা আবার মাথায় ভর করে। প্রাচীন প্রেতীনির মত মৃত্যুর ধীর পায়ে এগিয়ে আসার ছবিটা সে যেন চোখের সামনে দেখে। মুখে মোহনীয় কিন্তু ক্রুর একটা হাসি নিয়ে মৃত্যু এগিয়ে আসছে। বুকের ভিতর অদ্ভূত উত্তেজনা বোধ করে সে। ঠিক করে ফেলে আজকেই মৃত্যুর মুখোমুখি হবে সে। এক অদ্ভূত বিপন্ন বিস্ময় তাঁর সমস্ত রক্তের মাঝে খেলা করে যায়।

১,৭০১ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “মৃত্যুর আগে”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এ লেখাটা যখন পড়ি তখন শহরের বাইরে। জুত করে মন্তব্য করার উপায় ছিলোনা।
    দারুণ হয়েছে লেখাটা। কি যত্ন করেই না লিখেছো!
    জীবনানন্দে বুঁদ হয়ে না থাকলে এভাবে লেখা সম্ভব না।
    নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ব্লগ শুধু না, বাংলায় সাহিত্যেই এই গল্প একটা অনন্য সংযোজন।
    আরো আরো লেখা দাও ভাই।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    স্থবির যৌবন
    জীবনানন্দ দাশ

    তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যৃর দূত এসে
    কহিবেঃতোমারে চাই- তোমারেই,নারী;
    এইসব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি
    চ’লে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে।

    বলিলাম;শুনিল সেঃ’তুমি তবু মৃত্যুর দূত নও-তুমি-’
    ‘নগর-বন্দর ঢের খুঁজিয়াছি আমি;
    তারপর তোমার এই জানালায় থামি
    ধোঁয়া সব;-তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি-’

    শীতের বাতাস নাকে চলে গেলো জানালার দিকে
    পড়িল আধেক শাল বুক থেকে খসে
    সুন্দর জন্তুর মতো তার দেহকোষে
    রক্ত শুধু দেহ শুধু শুধু হরিণীকে

    বাঘের বিক্ষোভ বুকে নিয়ে নদীর কিনারে-নিম্নে-রাতে?
    তবে তুমি ফিরে যাও ধোঁয়ায় আবার;
    উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত বিবর্ণ এবার-
    বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে
    তোমারে তুলিয়া লবে কুয়াশা-ঘোড়ায়।
    তুমি এই পৃথিবীর অনাদি স্থবির;-
    সোনালি মাছের মতো তবু করে ভিড়
    নীল শৈবালের নিচে জলের মায়ায়

    প্রেম-স্বপ্ন-পৃথিবীর স্বপ্ন প্রেম তোমার হৃদয়ে।
    হে স্থবির, কী চাও বলো তো-
    শাদা ডানা কোনো এক সারসের মতো?
    হয়তো সে মাংস নয়-এই নারী; তবু মৃত্যু পড়ে নাই আজ তার মোহে।

    তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে
    কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।
    কোকিল কুকুর জ্যেৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে?
    মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. যেই ঘুম ভাঙ্গেনাকো কোনদিন ঘুমাতে ঘুমাতে
    সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে।
    আমরা।
    জীবনানন্দ দাশ
    বুঁদ হয়ে ডুবে গিয়েছিলাম আপনার লেখায়,লেখককে অনেক ধন্যবাদ রুপসী বাংলার কবি সম্পর্কে এমন প্রানবন্ত একটা লেখা পোস্ট করার জন্য।শুভকামনায় থাকলাম ভ্রাতা। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।