ঘুরে এলাম মেঘের বাড়ি- সাজেক!!!

“দুনিয়াটা অনেকের কাছে টেনিস বলের মতো ছোট্ট। একটুখানি। এরা নিত্যদিন নানা কাজে লন্ডন- প্যারিস- নিউইয়র্ক করে বেড়াচ্ছে। আর অনেকের কাছে এই পৃথিবী এক অফুরান তেপান্তরের দেশ; সাতসমুদ্দুর তেরো নদী, ভুত-পেত্নী, রাক্ষস খোক্কসে আকীর্ণ। তাদের অজানা দুনিয়ার শেষ নেই।”
বলাই বাহুল্য আমি পড়ি দ্বিতীয় দলে। ছোটবেলায় বছরে একবার আট-দশজনের দল করে একটা ভ্রমণ হতো বটে। একবার সিলেট, বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম- কক্সবাজার। ক্যাডেট কলেজের আধাসামরিক ভ্রমণগুলো ছিল অন্যরকম, আমার প্রিয় সুনীল- শীরষেন্দু- হুমায়ুন- মুজতবা আলীর মতন নয়। প্রকৃতির নন্দনকানন জাহাঙ্গীরনগরে বসেও আমি ছটফট করতাম ঘুরে বেড়াতে। অচেনা লোক, অচেনা রাস্তা, অচেনা সমুদ্র, অচেনা পাহাড়, অচেনা আকাশ- অদেখা বলেই হয়তো মন হু হু করত ওদের জন্যে।
বছরের তৃতীয় ট্যুর এই সাজেক ভ্রমণ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পরীক্ষায় কোনমতে মাথা গুঁজে কলম পিষে দে ছুট। দু’চার প্রস্থ কাপড় আর টুকিটাকি ব্যাকপ্যাকে গুছিয়ে হল থেকে বের হতেই খুশি খুশি ভাবটা শুরু হলো। বারোজনের ট্যুর গ্রুপ, সাতজন যাবো ঢাকা থেকে। বাদবাকি পাঁচজনের সাথে দেখা হবে চট্টগ্রাম থেকে। স্টার কাবাবে লেগরোস্টে পেটপুজো করে যাত্রা শুরু, পরদিন শীতের ভোরে আঁধারে লুকিয়ে থাকা চট্টগ্রাম শহরে আশ্রয় তনুদের বাড়ি। তনু- তন্ময় দুজনই যাচ্ছে সাজেক। দেখতে দেখতে পুরো ট্যুরগ্রুপ হাজির। উষ্ণ জলে নাইটজার্নির ক্লান্তি ধুয়ে মুছে আমরা বেশ ফিটফাট; আন্টির রান্না গোশত ভুনা, ডাল, ডিম, পরোটা ইত্যাদি মুহূর্তের মধ্যেই পেটের মধ্যে চালান হয়ে গেলো। সকাল নটার দিকে অক্সিজেন মোড় থেকে দিঘীনালার বাস।

P_20151224_081415_BF

শান্তি পরিবহনে চেপে শান্তিময় ট্যুরের আসল শুরু। বাসে আদিবাসী- বাঙালি সংখ্যায় প্রায় সমান সমান। পরদিন বড়দিন বলে ভীড়টা বেশি। জানালার পাশে জাঁকিয়ে বসলাম, চনমনে রোদ উঠেছে। রাস্তার দুধারে দ্রুত সরে যাচ্ছে গাছের সারি, বাড়িঘর। আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে।
হলুদের ক্ষেত। কলাগাছের সারি। পাহাড়ী ছড়ায় ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে জলস্রোত। স্কুল, মসজিদ। জায়গা গুলোর নাম ভারী মিষ্টি, সবই প্রকৃতিকে ঘিরে। মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, দীঘিনালা। গতকাল এমন সময়ে পরীক্ষার হলে বসে ছাইপাঁশ লিখছিলাম- সেকথা এখন বিশ্বাস হতে চাচ্ছেনা। চোখ দিয়ে গোগ্রাসে গিলছি চারপাশ। দলের বাকিরা কেউ কেউ গল্প করছে, কেউ চোখ বুজে আবার কেউবা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। সবার হাতে হাতে পাস হচ্ছে টাটকা পাহাড়ী কলা, চিপস, চানাচুর, বিস্কিট, চকলেট, মুড়ির মোয়া জাতীয় নানান সুখাদ্য। দুপুর গড়িয়ে গেলো দীঘিনালা পৌঁছাতে পৌঁছাতে। সেখানটায় অপেক্ষা করছিলেন তরুণদা; আমাদের চাঁদের গাড়ির সারথী তরুণ চাকমা। হাসিখুশি মানুষ, দেখেই ভালো লেগে গেলো সবার। আগেভাগে গাড়ির সামনের সিটটা দখল করলাম; রবিন, সোহরাব, রাহাত আর অয়ন হইহই করতে করতে উঠলো ছাদে।
994433_170597043296603_4594265848740587775_n
সাজেক যাবার রাস্তার তুলনা ঠিক কিসের সাথে করা যায় ভেবে পাইনা। প্রাক্রিতিক রোলার কোস্টার? উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা, সর্পিল রাস্তা; কখনো পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে, কখনো মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই উপরে উঠে তো এই ধাঁই করে নেমে যায়। তাজা পাহাড়ী বাতাস, শীতকালের আমেজ টের পাওয়া যায়। কাঠবাঁশ দিয়ে গড়া ঘর, জুমখেত, খাদ, ছড়া পার হয়ে যাচ্ছি। বুক ঢিপ ঢিপ করছে উত্তেজনায়। কেমন করে এই রাস্তা বানিয়েছে ভাবতেই অবাক হতে হয়। মাঝে মাঝে আরমি ক্যাম্পে থামছে গাড়ি, এন্ট্রি করে নিতে হয় প্রতি ক্যাম্পে। আমাদের সাথে দুই আর্মি অফিসার বন্ধু পরিচয় দিতেই তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়া গেলো সব জায়গা থেকে। খুব গোছানো ক্যাম্পগুলো। পেল্লাই সাইজের আনারস হয়েছে পাহাড়ি ঢালে। শৈশবের নায়ক ডঃ সঙ্কর্ষণ রায়ের লেখায় পড়তাম তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে কিভাবে ঘুরে বেড়াতেন পাথরের খোঁজে; মিষ্টি আনারস আর পেঁপে খেতেন পেটপুরে। আমি তক্কে তক্কে রইলাম, সুযোগ মিললে একটা গোটা আনারস পেটে চালান করে দেয়াটা আমার জন্যে কোন বিষয় হবেনা।
ক্যালেন্ডারের পাতার মতন বাংলাদেশের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ী। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য শিশু, কি মায়াকাড়া চেহারা একেকজনের। হাত নেড়ে, নেচে কুঁদে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আমাদের অভিনন্দন জানাতে এতো কিছু ভেবে শুরুতে তো খুশিতে বাকুম বাকুম, কিছুক্ষণ পর কয়েকজনের বীভৎস চিৎকারে থতমত খেয়ে গেলাম। তরুণদা বুঝিয়ে দিলেন ব্যপারটা।অনেকেই নাকি জীপ থেকে ওদের দিকে চকলেট ছুঁড়ে দেয়, সেই চকলেটের জন্যেই এতকিছু। আমারা সবাই শুনেই অপছন্দ করলাম ব্যপারটা। হুড়োহুড়ি করে চকলেট কুড়োতে গিয়ে কত অঘটন ঘটতে পারে!
বেলা চারটা নাগাদ আমাদের গাড়ি থামলো আলো রিসোর্টের সামনে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রিজার্ভেশন ম্যানেজ করেছিল রবিন। কাঠ আর বাঁশের তৈরি ঘর, বিছানা পাতা প্রায় পুরো ঘর জুড়েই। মস্ত বড় জানালা দিয়ে দেখা যায় বিখ্যাত সাজেক উপত্যকা। পাশাপাশি দুটো ঘর, মাঝখানে বেড়া দিয়ে আলাদা করা। একটাতে ছেলেরা, একটাতে মেয়েরা। এখানে জলের সাপ্লাই নেই, বহুদুর থেকে ড্রামে করে জল তুলে আনতে হয়। আঁজলাভরা কনকনে ঠাণ্ডা পানির ঝাপ্টা দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই বেড়িয়ে পড়লাম ব্যাগ রেখে। একদম কাছেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুদৃশ্য রিসোর্ট। খুব চমৎকার বসার যায়গা উপরটায়। সূর্যমামা অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কমলা রঙের বলের মতো সূর্য ঝুলে আছে কুয়াশামোড়া পশ্চিম আকাশে। সাদা সাদা চাদর নেচে বেড়াচ্ছে দিগন্তজোড়া সবুজ পাহাড়ি প্রান্তরে। দূর থেকে বোঝা যায় আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো। ওই ভয়ংকর সুন্দর রাস্তা দিয়ে এসেছি আমরা! টুপ করে হারিয়ে গেলো সূর্যটা। প্রায় সাথে সাথেই ধবধবে সাদা একটা চাঁদ উঠে গেলো পুবাকাশে। কনকনে বাতাসে চুল উড়ছে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে দেখছি চারপাশ। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটার মতোই সুন্দর সাজেক। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো, পাহাড়ী এলাকায় অন্ধকার নামে হুট করেই। এতো সুন্দর সন্ধ্যা কি এসেছে কখনো?
945891_170597079963266_4741895071019846343_n
প্রচন্ড ক্ষুধার্ত সবাই, দুপুরে সলিড কিছু পেটে পড়েনি। চা- বিস্কুট খাবার পরে মনে হলো আগুনে ঘি পড়েছে। রাত আটটায় ডিনার, তার আগের সময়টা কাজে লাগাতে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তার দুধারেই কটেজ, তাতে থাকাও চলে, ট্যুরিস্টদের ভাড়া দেয়ার কাজটাও হয়। বাড়ির সামনে কমলালেবু গাছ, আধাপাকা বড় বড় কমলা ঝুলে আছে। চাঁদের আলো ততক্ষণে ছড়িয়ে গেছে সবখানে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উপরে আছি আমরা, এখানটায় কুয়াশা নেই। চাঁদের আলোয় রুপালি কুয়াশা জড়িয়ে আছে উপত্যকাকে। চন্দ্রাহত ছয় তরুণ, ছয় তরুণী হেঁটে চলেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বেশ খানিকটা গিয়ে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় বসে পড়লাম আমি আর সৃষ্টি। বাকিরা এগিয়ে গেলো।
আমরা বসেছি বেশ উঁচু একটা জায়গায়। ঘাসের উপর আরাম করে বসে চারপাশে তাকালাম, দমবন্ধ করা সৌন্দর্য সম্ভবত একেই বলে। হৈমন্তী জোছনায় থৈ থৈ করছে চারপাশ। অদ্ভুতরকম নীরবতা চারিদিকে। কেবল পাতার শিরশির শব্দ। ইলেক্ট্রিসিটি নেই এখানে। সৃষ্টি মেন্ডলিনে বাজনা শুরু করলো। বুক কেমন করা সুর ছড়িয়ে গেলো পাহাড়ে পাহাড়ে। লালনের সুর হাহাকারের মতো ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ‘মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে?’

1929144_170597116629929_2508660969565448552_n

একের পর এক গান চলছে। পথচলতি অনেকে এসে সুর মেলাচ্ছেন, কেউ কেউ রেকর্ড করছেন। পরদিন বড়দিন, কাছেই গির্জা। সেখান থেকে সান্তাক্লজ বেড়িয়ে আসলেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় গানের তালে তালে হাসিমুখে নেচে গেলেন একপাক।
চাঁদের আলোয় অ্যাডভেঞ্চারের আশায় পথ ছেড়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছিল সবাই। শান্তিবাহিনী আর আরাকানদেরর গুলির ভয় দেখিয়ে রবিন ফিরিয়ে আনল সবাইকে। রিসোর্টের পথ ধরলাম সবাই। পাহাড়ি বাতাসে সবার ক্ষুধা চনমনিয়ে উঠেছে। পাতে পাতে পরিবেশন করা হলো গরম ভাত, সবজি, ঝাল ঝাল গোশত ভুনা আর ঘন ডাল। অত্যন্ত উপাদেয় রান্না, গোগ্রাসে গিললাম।
পাহাড়ের মাথায় বটবৃক্ষ, অনেকদূর ছড়ানো তার ডালপালা। পাতার ফাঁকে ফাঁকে গলে পড়ছে জোছনা। কুয়াশার নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে কিন্তু, একদম হঠাত হঠাত পাওয়া যায়। চকচকে রাজপথে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে আমি সেই ঘ্রাণ পেলাম। অলৌকিক লাগছে কেমন সবকিছু। এই বিশালতার কাছে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র বোধ হয়! পালকের মতো হালকা আবার পাথরের মতো ভারী লাগে নিজেকে,আমার লাগে। সৃষ্টিকে বলতেই ও গুনগুন করে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলো, তারপর অনুবাদ। কি যে মধুর সেই তিলাওয়াত! শুনতে শুনতে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে কখন টের পেলাম না।

== Say, “He is Allah , [who is] One, Allah , the Eternal Refuge. Nor is there to Him any equivalent. ==

আরেকটু রাত হতেই দলের ছয়জন উঠে বসলাম চাঁদের গাড়িতে। কম্বলমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা। পথচলতি মেঘের দলকে কখনো লাগছে মুগুর হাতে দৈত্যের মতো, কখনো ফুলের মতো, কখনো আধখাওয়া চিকেনের মতো। মাঝরাত পর্যন্ত চলল জোছনা বিলাস। ওই সময়ের অনুভূতি লেখার চেষ্টা করবনা, সবকিছু প্রকাশ করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়নি।
সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছা নিয়ে সবাই ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিলাম বটে, কিন্তু ঘুম থেকে উঠলাম কেবল আমি আর মুনস। দরজা খুলে থতমত খেয়ে যেতে হলো, চাঁদ ডুবে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কুয়াশা ঝরছে বৃষ্টির মতো টুপটুপ করে। মোবাইলের ম্রিয়মান আলো সম্বল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম দুজন। ছয়টা নাগাদ চাঁদের গাড়িতে চেপে রওনা হলাম কংলাক পাড়ার উদ্দেশ্যে।শোঁ শোঁ করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হাতমোজা, কানটুপি ইত্যাদি পড়ে কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছি আমরা। একসময় গাড়ি থামল, বাঁশ কিনে যুদ্ধংদেহী বেশে পাহাড়ে উঠা শুরু। মাঝে মাঝেই থামতে হচ্ছে ফটোসেশনের জন্যে। সাজেক উপত্যকা তখন নীলচে দেখাচ্ছে। পাহাড়ী বাচ্চাগুলোকে দেখলে অবাক হতে হয়।কি অনায়াসে তড়তড় করে উঠছে আর নামছে! একদিন দুদিনের জন্যে বেড়াতে এলে পাহাড়ী জীবন ভালোই লাগে। কিন্তু জীবন এখানে কঠিন, প্রকৃতি এখানে নির্দয়। খাবার পানির জন্যে কষ্ট, ইলেক্ট্রিসিটি নেই! ফোনে চার্জ দিতে না পারায় আমাদের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আর এখানকার অধিবাসীরা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর! কি সামান্য তাদের চাহিদা, কত অল্পেই তুষ্ট তারা! ছোট্ট একটা ঘরে সবাই মিলে থাকা, পাহাড় বেয়ে জল নিয়ে আসা, অতি সাধারণ খাবারদাবার। তারমধ্যে সারাদিনই আনাগোনা পর্যটকদের। আমরা একদিনের জন্যে এসে হইচই করে পাহাড় মাথায় তুলে যাই, আর উনারা এর মধ্যে থাকেন প্রতিদিন! ছবির একটা ভালো সাবজেক্ট খুঁজতে আমরা দিব্যি উঠে বসি উনাদের বাড়ির দাওয়ায়। হুট করে কেউ যদি আমাদের বাড়ীর বারান্দায় উঠে আসে তাহলে কেমন লাগবে!!!
IMG_6144
সূর্যের দেখা মিলল না। কুয়াশাচ্ছন্ন কংলাক পাড়ায় ছবি তোলা হলো ভুরি ভুরি। আসা পথে হেলিপ্যাডে নেমে আরো কয়েকটা। এখানটায় বেশ সুন্দর একটা বসার জায়গা আছে, দোলনা টোলনাও আছে দিব্যি। রোদ উঠছে ততক্ষণে, যতদূর চোখ যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়। কি যেন একটা গাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে, আরেকটা গাছে চোখজুড়ানো হলুদ। এতো রঙ, এতো রূপ! আহা সাজেক!
পাহাড় বেয়ে ফেরার পর সকালের খাবারটা হল সাংঘাতিক, গরম গরম পারাটা, গোশত ভুনা, ডাল ভুনা, ডিম। দলের সবাই স্বীকার করবে সেই অসাধারণ ডালের স্বাদ আমাদের সবার মুখে লেগে আছে এখনো।
সাজেক থেকে ফেরার পথে চাঁদের গাড়ির ছাদে চেপে বসলাম। And the experience of a lifetime began! সেই উত্তেজনার কাছে পাত্তাই পাবেনা থিম পার্কগুলোর মিনমিনে রাইডগুলো!
আসার পথে আলুটিলায় থামলাম। মন্দ লাগেনি, প্রাকৃতিক গুহায় মশাল হাতে প্রবেশ, অতঃপর পথ খুঁজে পেতে নাকানিচুবানি খাওয়া। গুহা থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেলো রায়হান ভাই, ইভাপুর সাথে। উনারা রিছাং ঝর্ণা হয়ে এলেন মাত্র! ও একটা মজার কথা না বললেই নয়। গুহা থেকে বের হয়ে এসে আমাদের চেহারা কিন্তু দেখার মতো হয়েছিল। মুখে, নাকের ভেতর, কানের ভেতর কালি জমে যা তা অবস্থা। আমার গুণধর ছোট ভাইয়ের ভাষায়, “নাকের কাছে টিস্যু নিতেই ধবধবে সাদা টিস্যু ভরে গেলো ভ্রমর কৃষ্ণ কালিতে। এ যেন ঘোর অমানিশা!”
IMG_6380
পরবর্তী গন্তব্য রিছাং ঝর্ণা। দলের বাকিরা ঝর্ণার উদ্দ্যেশে নামা শুরু করলেও আমি থেকে যাই পাহাড়ের উপরেই। কোন নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার মানুষদের সাথে কথা বলাটা আমার অভ্যাসের মতো, পরিচিত না হলে ট্যুরটা ঠিক জমে উঠেনা যেন। কাঠের বানানো কেবিন মতো আছে একটা, ঢুকে পড়লাম। গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কথা হলো স্থানীয় অনেকের সাথেই। অধিকাংশই কৃষিকাজের সাতেহ জড়িত, আর বাকিদের জীবিকা ট্যুরিস্টদের ঘিরেই। আড্ডা এতটাই জমে উঠলো যে অনেক চেষ্টা করেও চা আর পিঁয়াজুর দাম কিছুতেই দেয়া গেলোনা।চা শেষ করে আশপাশটা একটু ঘুরে বেড়ালাম। গাছ থেকে পেড়ে খেলাম রসালো কুল। এখানকার প্রকৃতিও রুপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। বেশীক্ষণ একনাগাড়ে দেখলে কেমন দমবন্ধ লাগে! কিছুদূর নেমে আবার আরণ্যক খুলে বসলাম। হেডফোনে গান বাজছে, ‘এইতো আমি চাই, মাখব গায়ে সোনা…।হাত বাড়ালেই ছাই।।আবার কখন ঘিরছে আমায় চাদর সকাল……’। পেয়ালার মতো উপুড় করা নীল আকাশের নিচে আমি, চারপাশে ঘরলাগানো সবুজ। সমুদ্র বরাবরই ভালবাসি। সমুদ্র আমার ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু পাহাড়? পাহাড় কাছে টানে! সমুদ্রের কাছে গেলে মনে হয় পাশে কেউ থাকুক, আর পাহাড়? পাহাড়ের কাছে এলে মনে হয় একটুখানি একা বসে থাকি। দু চোখ ভরে দেখি, হৃদয় দিয়ে দেখি, পাখির পায়ে পায়ে লেগে থাকা গাছে ডালপালার আওয়াজ শুনি, বাতাসের ফিসফিসানি শুনি পাতার সাথে……এখানে ইট-পাথরের বাড়ি নেই। মোটরহর্ন নেই। আমি আছি। আমি আছি। আমি আছি।
IMG_4714
রাত সাড়ে আটটায় বাস, সে পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে গল্প করে কাটালাম। পুরো ট্যুরে একমাত্র অপূর্ণতা, পাহাড়ে গিয়ে ওখানকার খাবার খাওয়া হলোনা। ওদের মতো করে রাঁধা তরকারি। ওদের মতো করে রাঁধা ভাত।
আমাদের ড্রাইভার তরুনদা কিন্তু অনেকগুলো তাকলাগানো তথ্য দিয়েছেন আমাদের। সাজেক যাবার পথের ধারে বেশ কয়েকজনকে কুকুরের বারবিকিউ করতে দেখেছিলাম নিজের চোখেই, যাকে বলে আক্ষরিক অর্থেই হটডগ। উনি বললেন উনার পরিচিত বেশ কিছু স্থানীয়দের বিশ্বাস কুকুর পুড়িয়ে ভোজের আয়োজন না করলে নাকি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ঠিক পূর্ণ হয়না। ক্ষেত্র বিশেষে বিড়াল পোড়াও চলে। পাহাড়ের জঙ্গলে নাকি হরিণ চরে বেড়ায়, বাজারে দেদারসে বিক্রিও হয় হরিণের মাংস। আগে বললে উনি আমাদের খাওয়াতেও পারতেন। উনার তথ্য এখানেই শেষ না। উনি দাবী করলেন গহীন জঙ্গলে এমন কয়েকঘর বর্বর লোকের বাস যারা এখনো মানুষের মাংস খায়! এমনকি বাবা-মা অথর্ব হয়ে পড়লে তাদেরকেও……………! ‘বাংলাদেশে ক্যানিবালিজম??!!’ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী দু পক্ষের মধ্যেই বিতর্ক চলল কিছুক্ষণ। আমার মনে হলো কি জানি হতেও পারে হয়তো! ডঃ সঙ্কর্ষণ রায়ের বইতে পড়েছিলাম উনি আশির দশকে মেঘালয়ের পাহাড়ে নরবলির প্রমাণ খুঁজে পেয়েছিলেন! অতএব এ যুগেও হয়তো তেমনটা হতে পারে, কি জানি! ধু ধু পাহাড়ের বুকে ঘন জঙ্গলে, যেখানটায় সভ্যতার কোন ছোঁয়া নেই, সেখানটায় এমন হওয়া কি একেবারে অসম্ভব বলা যায়?
বাস যথাসময়েই ছাড়লো। দলের এক অংশ সরাসরি ঢাকার বাসে চেপে বসলো। আমাদের তিনজনের পরদিন চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরেফিরে দেখার ইচ্ছা ছিল। আমাদের গন্তব্য তাই চট্টগ্রাম। পুরো রাস্তা এলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।
শেষ করব সাজেকের একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে।
ছেলেবেলা থেকেই বিভূতিভূষণের খুব ভক্ত আমি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, ইছামতী, চাঁদের পাহাড়…… আর কারও লেখায় প্রকৃতি এতো সুন্দর করে এসেছে কি? আমার জানা নেই। অনেকদিন ধরেই একটা শখ ছিল, তার লেখা ‘আরণ্যক’ বইএর অন্তত কিছুটা পড়ব সেরকম পরিবেশে বসে। ইচ্ছা পূরণ হলো। সাজেকের চোখজুড়ানো পাহাড়ের একেবারে কিনারায় আছে একটা দোলনা। সামনে শ’ শ’ ফুট নেমে গেছে উপত্যকা। নাম না জানা পাখির ডাক ভেসে আসছে, শোনা যাচ্ছে পাতার শিরশির। সেই দোলনায় বসে আমি বইএর পাতায় চোখ রাখলাম। পাতার পর পাতা উলটে চলেছি, আমার সকাল মিলেমিশে একাকার আরণ্যকের সাথে! এরকম কিছু মুহূর্তের জন্যেই বোধকরি বেঁচে থাকাটা এতো আনন্দের!!
IMG_6231

৫,৬৮৬ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “ঘুরে এলাম মেঘের বাড়ি- সাজেক!!!”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অষ্টাশি-উননব্বুই সালের দিকে এসআইএন্ডটি-তে ওডাব্লুিউ কোর্স করার সময় প্রথম সাজেকের কথা শুনি।
    সেই থেকেই সাজেক যাবার একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষে রেখেছি।
    কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্রের মিল না ঘটায়, অথবা ইচ্ছার প্রবল্য ঘাটতি থাকায় কেন যেন সেটা হয়ে উঠছে না।
    এই লিখাটা পড়ার পর দ্বিতীয় কারনটা যে আর থাকবে না, সেটা নিশ্চিত।
    এখন দেখি প্রথম কারনটাও অবলেপন করতে পারি কিনা।

    এটাকে কেবলই চমৎকার ভ্রমন-বর্নন বললে কম বলা হবে। ভ্রমন-বর্ননের পাশাপাশি এটা একটা ট্যুর-গাইড এবং ইচ্ছা-জাগানিয়া লিখাও বটে।
    পথের বর্ননাগুলো পড়ে কিছুদিন আগে ঘুরে আসা নানিয়ারচরে যাবার রাস্তার কথা মনে পড়লো।
    সেই এলোমেলো উথালপাথাল পথ, পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা আনারস ক্ষেত পরিষ্কার ফুটে উঠলো মনের পর্দায়।

    অনেক ভাল লাগা কিছু অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে পারায় প্রিয়তে না নিয়ে কোনো উপায় থাকছে না যে......


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • খেয়া (০৬ - ১১)

      ভাইয়া! বলে বুঝাতে পারব না কি পরিমাণ ভালো লাগছে আপনার কমেন্ট পড়ে। জানেন ভাইয়া, অনেকদিনের ইচ্ছা ভ্রমণগল্প লিখব। কিভাবে যাবেন,কোথায় থাকবেন- এসব না। গল্প! যেটা পড়ে মনে হবে লেখকের সাথে সাথে আমিও ঘুরে এলাম! অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া! 🙂


      খেয়া (২০০৬-২০১১)

      জবাব দিন
  2. নাফিস (২০০৪-১০)

    আহ ! আজ দেখি ঈদ ঈদ ভাব.. পরপর দুইটা ট্রাভেল ব্লগ। ঘুরতে থাকো, লিখতে থাকো। এইটাই জীবন।আর যারা ঘোরাঘুরি করতে ডিসকারেজ করে তাদের থেকে দূরে থাকো। লেখা ভাল্লাগছে। :thumbup:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নাফিস (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।