আমি যখন ক্যাডেট ছিলামঃ পর্ব ৬

যে কোন কথাকে তিল থেকে তাল বানানো মানুষের জন্মগত প্রতিভা। ক্যাডেটরাই বা বাদ যাবে কেন? ক্যাডেট জীবনে এমন অনেক গল্প শুনেছি যা শুধু তিল থেকে তাল বললে ভুল বলা হবে, ব্যপারগুলো তিল থেকে তাল, সেই তাল থেকে পিঠা আর পিঠা থেকে পিঠা উৎসবে রূপ নিয়েছে। এই রকম পিঠা উৎসব ধরণের অনেকগুলো গল্প থেকে ৫ টি বলি।

* ওয়াল ম্যাগাজিন (১)
একদম প্রথম বছরের কথা। ওয়াল ম্যাগাজিন নামক বস্তুটি বানানো নিয়ে প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। টান টান উত্তেজনা। শিল্পী, লেখক আর হস্তলেখক মহলে সাজ সাজ রব। স্টোর রুমে টেবিল পেতে কাজ শুরু হয়েছে। সে রুমে প্রবেশাধিকার আবার সংরক্ষিত, অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে কাজ এগিয়ে চলছে। এমন সময় ঘটলো অঘটন। পাশের হাউসের এক বন্ধু কি একটা দরকারে যেন এসেছিলো আমাদের হাউসে। আর আমাদের হাউসেরই এক বন্ধুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে দুর্ঘটনাক্রমে ঢুকে পড়লো স্টোরে। ভুল বুঝতে পেরে প্রায় সাথে সাথেই বেরও হয়ে এলো। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। কথা একান-সেকান হতে হতে শেষ পর্যন্ত হল এরকম, তমুক হাউসের একজন এসে আমাদের ওয়াল ম্যাগাজিন পুরোটা কপি করে ফেলেছে! ব্যস, পড়ে গেল কান্নাকাটির রোল। সিনিয়র কাঁদে, জুনিয়র কাঁদে, হাউস বেয়ারার চোখও ছলছল! কেউ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে, কেউ সিঁড়িতে বসে কাঁদে, আমাদের হাউসের আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, জানালার কার্নিশে বসা কাকও কাঁদে! অথচ কারো মাথায় একবারও এলো না, ১০/২০ সেকেন্ডে কেমন করে সব দেখে কপি করা সম্ভব!( নেহায়েত ব্যাক্তিটি রোবট অথবা স্যার অনন্ত জলিল হলে ভিন্ন কথা)

পাদটীকাঃ সেই ওয়াল ম্যাগাজিন কম্পিটিশনে অন্য দুই হাউসের সাথে আমাদের কোনই মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবং বলাই বাহুল্য আমরা কৃতিত্বের সাথে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম!

• কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিসপ্লেঃ
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিসপ্লের জন্যে অনেক কিছু ডাউনলোড করতে হবে। কম্পিউটার ল্যাবের অবস্থা নাজুক, মডেম নাই বললেই চলে। অ্যাডজুটেন্ট স্যারকে অনেক রিকোয়েস্ট করে একদিনের জন্যে উনার ল্যাপটপটা পাওয়া গেলো, কাজ আগালো কিছুটা। এইরকম সময়ে আমার তিন লেজওয়ালা দুই রুমমেটের মাথায় ভূত চাপলো। তেনারা গুগল করে বেশ কিছু নায়ক-নায়িকার স্বল্পবসনা ছবি বের করলেন নিতান্তই ফাজলামো করে। তিলটুকু ওই পর্যন্তই। পরদিন হাউস মাস্টার ম্যাডামের রুমে ডাক পড়লো আমাদের, উনার পোষা জীনের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন আমাদের কুকীর্তির কথা। দুই রুমমেটের মুন্ডুপাত করতে করতে ফিরে আসলাম। ম্যাডামকে বুঝাইতে বেশ কষ্ট হইলেও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি আমাদের বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু ওই যে, পিঠা উৎসব তো এখনো বাকি! পরদিন অন্তত ৫ জনের মুখে জানতে পারলাম আয়েশা হাউসের ৪ পারভারট নাকি নীল ছবি দেখতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে, দুইদিনের মধ্যে তাদের লাথি মেরে বের করে দেয়া হবে।

পাদটীকাঃ অথোরিটির কিছু পোষা জীন থাকে এইটা মনে হয় নতুন কিছু না। সেরকমই কেউ হিস্ট্রি চেক করে কথাটা তেনাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। এই জীন টা কে/কারা তা আজো জানিনা, জানতে ইচ্ছাও করেনি।

• জয়নাল হাজারী ও ভুতঃ
কুখ্যাত জয়নাল হাজারীর টর্চার সেল ছিলো খুব কাছেই, এই তথ্যটি আমরা জানতে পেরেছিলাম ফেনীর ক্যাডেট বন্ধুদের কাছে। এটাই ছিলো এই গল্পের তিল। কথাটা চাউর হওয়ার পর থেকেই মজার মজার গল্প ছড়াতে লাগলো প্রতিদিন। কেউ জানালায় সাদা শাড়ি পরা মহিলাকে দেখতে লাগলো, কেউ মাঝরাতে কান্না শুনতে শুরু করলো!

পাদটিকাঃ এই ব্যপারে আমি আগেও একটা রম্য ব্লগ লিখেছিলাম, আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।

• ওয়াল ম্যাগাজিন (২)
এই গল্পের তিলটি আমার আর তারান্নুমের বপণ করা। একদিন গেমস এ যাওয়ার সময় হুট করেই মনে হইলো একটু মজা করা যাক। তখনো ওয়াল ম্যাগাজিন কম্পিটিশন চলছে। পাশের হাউসের এক বন্ধুকে দেখে আমি আর তারান্নুম সাবধানী গলায় ফিসফিস করে (কিন্তু বন্ধুটি যাতে শুনতে পায় সেই খেয়াল রেখে) বলতে শুরু করলাম, “ আচ্ছা মাটি কি এইখান থেকে নিলেই ভালো হবে রে? ওই যে ওয়াল ম্যাগাজিনের জন্যে?” তারান্নুম যথাযথ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, “ হুম, এইটাই তো মনে হয় পোড়াতে সুবিধা হবে।” তারপর হঠাৎ করে ওই বন্ধুটিকে দেখে বাড়াবাড়ি সতর্কতা দেখিয়ে চুপ হয়ে যাওয়ার ভান করলাম। ব্যস, সেইদিন রাতে প্রেপ থেকে হাউসে ফেরার পরে আমাদের হাউসেরই এক জুনিয়র জানতে চাইলো, “ আপু, এবার নাকি আমাদের ওয়াল ম্যাগাজিন পুরোটাই টেরাকোটার কাজ হবে? মাটির উপর লিখতে কষ্ট হবেনা আপু?”

পাদটীকাঃ টেরাকোটার কাজ ছিলোনা, কিন্তু সেইবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম!

• ৬ খানা মুঠোফোন ও একটি ল্যাপটপঃ
আমার রুমমেট সারজানার গুণমুগ্ধ এক ভক্ত জুটে গিয়েছিলো, সেই জুনিয়র তার প্রিয় আপুর জন্যে এক খানা পুতুল খরিদ করে এনে উপহার দিয়েছিল। সেই পুতুলে টিপলে সেটা আবার গানও গাইতো! দূর থেকে শুনলে সেটাকে মোবাইলের রিংটোন ভাবাটা খুব একটা ভুল হবেনা। এই পুতলার কিন্নরী কণ্ঠের সঙ্গীত শুনে অনেকেই আমাদের জিজ্ঞাসা করতো রুমে কোন মোবাইল আছে কিনা। না বলতে বলতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম, তবু লোকের চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হলনা। সবার চোখে লেখা থাকতো, “ মোবাইল তো আছেই বাছা, তুমি না বললেই কেন হইবেক?” এই পুতুল ছিলো এই গল্পের তিল। এই কথা দিকে দিকে ছড়াতে ছড়াতে এমন হল, আমাদের ৪ জনের রুমে ৬ খানা মুঠোফোন আর একটি ল্যাপটপ। ইন্সপেকশনের সময় আমরা সেগুলো কোথায় রাখি সেইটা এক রহস্য। দিনে দিনে আমরা কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেলাম, শুনতে কিন্তু বেশ লাগতো কথাগুলো। নিজেদের জেমস বণ্ড টাইপের মনে হতো! একসময় আমরা কথাগুলোকে উসকে দিতাম। যেমন একদিন এক বন্ধু ইন্সপেকশনের দিন আমার রুমমেট মৌসুমিকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, “ দোস্ত, ল্যাপটপটা লুকাবি কিভাবে?” মৌসুমিও অবলীলায় বলে দিলো, “ দোস্ত, স্টোর রুমে কম্বলের স্তুপের মধ্যে লুকায়ে ফেলছি!” ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই আমার কবি শামসুর রাহমানের কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো,
“কি সহজে হয়ে গেলো বলা,
একটুও কাঁপল না গলা!”

পাদটিকাঃ শেষের দিকে আমাদের রুমে মোবাইল ছিলো বটে, কিন্তু জনশ্রুতির ধারেকাছেও যায়নি সংখ্যাটা!

• আবারও আইসিসিএলএলএমঃ
প্রতিবছরের মতোই সেবারও আইসিসিএলএলএম এর কয়েকজন আলোচিত ভাইয়াদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার মধ্যেই এক কলেজ প্রিফেক্ট ভাইয়ার কথা চলে এলো।(সঙ্গত কারণেই পরিচয় বলা যাবেনা) “ ভাইয়াটা কি স্মার্ট, কি দারুণ করে কথা বলে, কি জোশ কমান্ড দেয়, ব্লা ব্লা” বলার পর এক বন্ধু বেশ একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, “ উনার কথা বলে কোন লাভ নাই। কিছু করতে পারবিনা তোরা কেউ।” কেন জানতে চাইতেই বোমা ফাটাল বন্ধুটি, “ আরে, ওই ভাই তো গ্যে!” আমরা তো হতভম্ব, কিন্তু এই ব্যপারে ভুরি ভুরি যুক্তি উপস্থাপিত হল, তাছাড়া ভাইয়া বেচারা ছিলেন একটি বিশেষ কলেজের সর্বাধিনায়ক! অতএব অনেকে ভগ্ন হৃদয়েই মেনে নিল সেই নির্মম কথাটা। পরে আসল তিলটি আবিষ্কার হল, ভাইয়ার গুণমুগ্ধ আরেক গার্লস ক্যাডেট উনার উপর ‘ক্রাশ’ খেয়ে মর্মবেদনায় আকুল হয়ে মন্তব্য করেছিল, “ইশ, ভাইয়াটা তো জোশ, কিন্তু উনি তো অমুক কলেজের।বাই চান্স যদি উনি একটু অন্যরকম(!) হন!” সেই কথাই ওই ক্যাডেট কলেজ থেকে আমাদের কলেজ পর্যন্ত আসতে আসতে এমন হয়ে গেছে!

৩,৫৩৫ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “আমি যখন ক্যাডেট ছিলামঃ পর্ব ৬”

  1. হারুন (৮৫-৯১)

    সিনিয়র কাঁদে, জুনিয়র কাঁদে, হাউস বেয়ারার চোখও ছলছল! কেউ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে, কেউ সিঁড়িতে বসে কাঁদে, আমাদের হাউসের আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, জানালার কার্নিশে বসা কাকও কাঁদে! শুধু আমি কেয়াটা কাঁদি না।


    শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা..

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    ব্যস, পড়ে গেল কান্নাকাটির রোল। সিনিয়র কাঁদে, জুনিয়র কাঁদে, হাউস বেয়ারার চোখও ছলছল! কেউ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে, কেউ সিঁড়িতে বসে কাঁদে, আমাদের হাউসের আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, জানালার কার্নিশে বসা কাকও কাঁদে!

    😀 :)) =))


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    পরদিন অন্তত ৫ জনের মুখে জানতে পারলাম আয়েশা হাউসের ৪ পারভারট নাকি নীল ছবি দেখতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে, দুইদিনের মধ্যে তাদের লাথি মেরে বের করে দেয়া হবে।

    পার্ভার্ট না, নরমাল।
    আমারে ফেকু কনফার্ম করছে যে মেয়েরাও নীল- লাল-হলুদ সব রঙের ছবি ই দেখে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    পাশের হাউসের এক বন্ধু কি একটা দরকারে যেন এসেছিলো আমাদের হাউসে।

    তোমাদের তিন হাউজ কি আলাদা আলাদা বিল্ডিং এ নাকি???


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    • ওয়াল ম্যাগাজিন (২)
    এই গল্পের তিলটি আমার আর তারান্নুমের বপণ করা। একদিন গেমস এ যাওয়ার সময় হুট করেই মনে হইলো একটু মজা করা যাক। তখনো ওয়াল ম্যাগাজিন কম্পিটিশন চলছে। পাশের হাউসের এক বন্ধুকে দেখে আমি আর তারান্নুম সাবধানী গলায় ফিসফিস করে (কিন্তু বন্ধুটি যাতে শুনতে পায় সেই খেয়াল রেখে) বলতে শুরু করলাম, “ আচ্ছা মাটি কি এইখান থেকে নিলেই ভালো হবে রে? ওই যে ওয়াল ম্যাগাজিনের জন্যে?” তারান্নুম যথাযথ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, “ হুম, এইটাই তো মনে হয় পোড়াতে সুবিধা হবে।” তারপর হঠাৎ করে ওই বন্ধুটিকে দেখে বাড়াবাড়ি সতর্কতা দেখিয়ে চুপ হয়ে যাওয়ার ভান করলাম। ব্যস, সেইদিন রাতে প্রেপ থেকে হাউসে ফেরার পরে আমাদের হাউসেরই এক জুনিয়র জানতে চাইলো, “ আপু, এবার নাকি আমাদের ওয়াল ম্যাগাজিন পুরোটাই টেরাকোটার কাজ হবে? মাটির উপর লিখতে কষ্ট হবেনা আপু?”

    :boss: :boss: :boss:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খেয়া (০৬ - ১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।