যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম(পর্ব ৫)

আইসিসিএলএলএম ও কিছু গোপন দুঃখঃ

 

ছোট বেলা থেকেই মা আমাকে বলতেন, নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। কম থাকার কারণে আমাকে কখনো কষ্ট পেতে হয়নি, পেতে হয়েছে বেশি থাকার কারণে। ব্যপারটা আরেকটু গুছিয়ে বলি।

মানুষ হিসেবে আমি প্রচণ্ড আবেগী। শৈশবের রঙ্গিন জীবনটা কৈশোরে মোড় নেয়ার সাথে সাথে এই আবেগটা বেশ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো বৈকি। প্রেম- ভালোবাসা সংক্রান্ত ব্যপারগুলো নিয়ে ভাবার শুরুটা তখন। ছোটবেলা থেকে একসাথে ব্যাডমিন্টন খেলে বড় হওয়া পাশের ফ্ল্যাট এর সহপাঠীকে দেখে নিজের অজান্তেই গাল-টাল লাল হয়ে সেকি বিশ্রী অবস্থা! ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার পড়ে আরও পরিবর্তন এলো। ছোটবেলা থেকে  ঘাড় গুঁজে বই পড়ার কারণে অনেক প্রেমের উপন্যাস পড়েছিলাম বটে, কিন্তু চর্মচোখে খুব বেশি প্রেমিক/প্রেমিকার দেখা তখনি মেলেনি। লাইটস আউটের পর বন্ধুদের মুখে তাদের ভালোবাসার গল্প শুনতে কি যে ভালো লাগতো! মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও গল্প শুনতাম, প্রেমে পড়ার গল্প, লুকিয়ে কথা বলবার গল্প! মাঝে মাঝে অনেকের কাছে বেনামে চিঠি আসতো, কত সাবধানতার সাথে সেটা লুকিয়ে আনা হত। চিঠি হাতে পাওয়ার সাথে সাথে বন্ধুটির মুখে এক অপূর্ব আনন্দ খেলা করতো! আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতাম, আমার খুব পরিচিত মেয়েটিকে কি মায়াবতী, কি মিষ্টিই না লাগতো! নিজেরও একটা ভালোবাসার মানুষ হোক তা কখনো চাইনি বললে মিথ্যা বলা হবে। চিন্তা করতে বেশ ভালই লাগতো এই পৃথিবীর কোথাও হয়তো কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। একদিন তার সাথে দেখা হবে, একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় পার করে দিবো! বলাই বাহুল্য, এসব শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজের ছোট ভাই ছাড়া আর কোন ছেলের সাথে কথা বলা তো দূরে থাকুক, চোখের দিকে তাকানোর মত সাহসই ছিলোনা। ছিলাম গার্লস ক্যাডেট কলেজে, ছুটিতে থাকতাম গর্তজীবী হয়ে। ইন্টারনেট ছিলোনা, ছিলোনা ফেসবুক একাউন্ট। অতএব দু’একজন ক্লাসমেট ছাড়া আর কোন ছেলের নাম জানতাম না। আমার বন্ধুদের অনেকেই ছুটিতে এসে কোচিং করতো, সেই সুবাদে অন্য অনেক ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের। শুনতাম, বন্ধু হিসেবে অসাধারণ ক্যাডেটরা। শুনেই ভালো লাগতো, আসলে ক্যাডেট নামটি কোনোকিছুর সাথে জুড়ে থাকলেই কেন যেন খুব আপন লাগতো, এখনো লাগে। ক্যাডেট কলেজের প্রসপেক্টাস ছাড়া বয়েজ ক্যাডেটদের প্রথম দেখেছিলাম আইসিসিএলএলএম এ। ২০০৬ সালের আইসিসিএলএলএম এর কথা আমার কিছুই মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে জুতার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই পুরো ৫ দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সবাইকে দেখতে একিরকম লাগতো। তবে পরের ৪ টি আইসিসিএলএমএম এর কথা আমার খুব ভালো করে মনে আছে। কারণ আমার ২০ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখগুলো আমার ওই সময়েই পাওয়া।

শুরুতেই বলছিলাম বেশি থাকার কারণে দুঃখ পাওয়ার কথা। দুটো জিনিস খুব বেশি আমার। একটির কথা শুরুতেই বলেছি। আবেগ, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ওজন। সুন্দরী মায়ের গায়ের রঙ, নাক, চোখ, ঠোঁট কিছুই পাইনি আমি। সবাই বলে আমি হয়েছি আমার বাবার মতো। ছোটবেলা থেকেই আমি ভীষণ মোটা। দড়িলাফ, ব্যায়াম, পিটি-প্যারেড, ডায়েট কন্ট্রোল কোনটাই কাজে আসেনি আমার ক্ষেত্রে। এক পর্যায়ে বাড়তি ওজন নিয়ে মাথা ঘামানোটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম হতাশ হয়ে। নিজেকে নিয়ে কখন দুঃখ ছিলোনা আমার, অন্তত আইসিসিএলএমএম এর  আগে। আমি খুব অবাক হয়ে শুনতে পেলাম আমার ওজনটা অনেকের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার ছিল ওখানে। আমার কালচে রঙ এর ঠোঁট ছিল কৌতুকের ব্যপার। আমি কোন ব্র্যান্ড এর সিগারেট খাই এটা ছিল গবেষণার বিষয়। জীবনে কখনই দেখা না হওয়া, কথা না হওয়া মানুষগুলোর সামনে আমি হয়ে গেলাম এক জীবন্ত কার্টুন। স্টেজে গান করতে উঠলে অডিটোরিয়ামে শুরু হতো বিচিত্র গুঞ্জন। আমার এতদিনের চেনা জগতটাকে একদম হুট করেই অচেনা হয়ে যেতে দেখেছি তখন। বাড়ী ফিরে গেলাম আইসিসিএলএমএম এর পড়ে। মা গভীর রাতে আমার মশারি ঠিকমতো গুঁজানো আছে কিনা দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন তার তের বছরের মেয়ে নিজের অসুন্দর চেহারার দুঃখে কেঁদে বালিশ ভেজাচ্ছে।

—————- চলবে —————-

(আজকে এই লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু কারো ব্যপারে অভিযোগ করা নয়। অনেকদিন পর পুরনো ডায়রি ঘাঁটতে গিয়ে ওই দিনগুলোর কথা মনে পরে গেলো,  তাই লেখা। অনেকের কাছেই মনে হতে পারে নিতান্তই ব্যক্তিগত এই দুঃখগুলোর কথা লেখাটা যৌক্তিক নয়। তাদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

২,৩০৩ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম(পর্ব ৫)”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    হাহা, আমি দড়ির মতো শুকনা, তাতে কি হইছে? এইসব নিয়ে চিন্তাও করি না। সুস্থ থাকাই বড় কথা, এখন কি আমি ব্যায়ামবীর না এইটা নিয়ে আক্ষেপ শুরু করব নাকি? চিল খেয়া চিল


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
    • খেয়া (০৬ - ১১)

      ভাইয়া, প্রথমত আমি মন খারাপ করছি না। ওই বয়সটা আমি পার করে এসেছি যখন বিপরীত লিঙ্গের এই ধরণের মন্তব্য আমার কাছে খুব খারাপ লাগতো। আমি জানি সুস্থ থাকাটাই বড় ব্যপার। আমার কোন আক্ষেপ ও নেই। কিন্তু সত্যিটা কি জানেন ভাইয়া, টিনএইজটা বড় ভয়ংকর সময়। তখন আনন্দ- দুঃখ দুইটাই খুব তীব্র। যাইহোক, আপনাকে যে কথাটা অনেকদিন যাবত বলতে চাইছিলাম, আমি আপনার লেখার খুব ভক্ত। :boss:


      খেয়া (২০০৬-২০১১)

      জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আমার আজীবনের দুঃখ একটু মোটা হলাম না কেন।
    ক্যাডেট কলেজ জীবনের হাড্ডিসার রোগাপটকা চেহারা নিয়ে এখনো আমার আফসোস আছে। মনে হতো আরেকটু স্বাস্থ্য ভালো হলে মেয়েরা টপাটপ প্রেমে পড়ে যেতো। 😛 😛 =)) =))

    জবাব দিন
    • খেয়া (০৬ - ১১)

      হিহিহিহি। ভাইয়া, প্রেম ব্যপারে কোন আফসোস নাই আমার। আমি জানি একটা প্রবাদ আছে আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী। কিন্তু যে ব্যপারটা আমাকে কষ্ট দিতো তা হচ্ছে, শুধুমাত্র কাউকে দেখতে সুন্দর না বলে কাউকে কষ্ট দিয়ে অন্যরা কি করে আনন্দ পেতে পারে! 🙁


      খেয়া (২০০৬-২০১১)

      জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    আহারে.........
    ধুর, তুমি এখনও এইসব জিনিসপত্র নিয়া মন খারাপ করতেস?
    জীবনে সিগারেট হাতে ধরি নাই তবু কলেজ থেকেই স্যার ম্যাডাম রা জিজ্ঞেস করতো, কতদিন ধরে "টানি" আমি। ক্যাডেট পোলাপানের কথা তো বাদই দিলাম।
    ছোটখাট একটা ভুড়ি আছে আমার, ওইটা নিয়াও কম টিটকারি শুনি না।

    এইগুলা নিয়া মন খারাপ করবা না। মানুষের পরিচয় চেহারায় নয়, তার ব্যবহারে।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • খেয়া (০৬ - ১১)

      এখনো মন খারাপ ঠিক করছি না। কিন্তু এই লেখাটা লেখার আগপর্যন্ত আমার খালি মনে হইত, আই অউ দিস মাচ টু দা মটু গারলস ক্যাডেট হু ক্রাইড এভরি নাইট। কাউকে জানার আগেই তাকে জাজ করাটা উচিত না, অন্তত তার গায়ের রং/ফিগার দেখে তো নয়ই। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন জন কে হাসাহাসি করি, মজা(!) নেই। আমি এই লেখাটা এই জন্যে লিখেছি যাতে আমরা মুদ্রার অন্য পিঠটা ও বুঝবার চেষ্টা করি। আমাদের ৫ মিনিটের মজার জন্যে যাতে আরেকজনের কষ্ট না হয়! এই লেখাটা পড়ে একজন ও যদি আরেকজনের চেহারা নিয়ে মজা করতে গিয়ে থমকে দাড়ায় তাহলেই আমার লেখা সফল। 🙂


      খেয়া (২০০৬-২০১১)

      জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সুন্দর লেখা।

    সুন্দর চেহারা দেখেই অনেকে ভেবে নেয় মনটাও সুন্দর হবে।
    হায়রে বোকা মন।

    এরপরো আমরা সুন্দর চেহারা খুজি।
    এটা কিন্তু সর্বক্ষেত্রে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ইসসিরে তোমার বাবা-মা তোমারে হোমিওপ্যাথি খাওয়ায় নাই ক্যান!
    ছুডু বেলায় আমিও বিশাল মোটা ছিলাম। তারপর হোমিও খাওয়াইয়া সাইজে আনছিলো।
    কলেজে নিয়ম কানুনের মধে ছিলাম বইলা মোটা হইতে পারি নাই। স্বাস্থ্য ভালো ছিলো। কিন্তু মোটা ছিলাম না।

    এখন আবার জিমে যেতে হবে। ১০০ কেজি ওজন আমার।

    কালো ঠোট আমার ছিলো না। হাম দুইবার হইলো, মুরগী বসন্ত একবার।
    এইসবের মধ্যে কেমনে জানি ঠোট কালো হয়ে গেলো ক্লাস এইতে না নাইনে থাকতেই।

    ভূগোলের মোস্তাফিজ স্যার জিজ্ঞাসা করতেন কি বিড়ি খাই।
    স্যার মজা করেই বলতেন।
    মোস্তাফিজ স্যারকে মিস করি।

    ২০০১ বা দুই সালের দিকে নতুন জিনিস হলো। শরীরে শ্বেতী দেখা দিলো।
    প্রথমে বুঝতেই পারি নাই এইটা শ্বেত বা ধবল রোগ।
    বেশ কিছু চিকিৎসা করে বিরক্ত হয়ে চিকিৎসা ছেড়ে দিসি। একসময় এমনকি ক্যামোফ্লেজ ক্রিম ও ইউজ করছি।

    মাইকেল জ্যাকসন, অমিতাভ বচ্চনের শ্বেত ছিলো বা আছে।
    নবীর জামা পাওয়া ওয়াইজ করণীর ও ছিল।

    আর আমারো আছে।

    তবে ব্যাপারটা কি বলি।
    নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা এক ধরণের আর্ট। ইচ্ছা করে এলোমেলো থাকার ও কোন মানে হয় না।

    তুমি ছোটবোন তো অনেক কথা মনে আসছে কিন্তু কলমে আসা থেকে বিরত রাখ্ছি। 😀

    মোটা-চিকন, সাদা-কালো এইসব নিয়া আমাদের কালক্ষেপণ যতদিন না যাবে আমাদের নিয়া চালাকের দল ব্যাবসা করেই যাবে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।