যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম (পর্ব ২)

ওই দেখা যায় ক্যাডেট কলেজঃ

খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই খুব চুপচাপ; মাঝেমাঝে চামচের টুংটাং শব্দ হচ্ছে নীরবতা ভেঙ্গে। এমনকি আমার বাচাল ছোট ভাইটাও কথা না বলে খেয়ে যাচ্ছে নিরবে। আজকে আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছে মামনি। রান্না হয়েছেও চমৎকার। অথচ দেখে মনে হচ্ছেনা খাওয়ায় রুচি আছে কারো। নববর্ষের দিন আজ, কিন্তু কেউ বাইরে বের হইনি আজকে, কারণ কালকে আমার ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার দিন। আজকে সাড়ে তিনটার ট্রেনে রওয়ানা হবো ফেনীর উদ্দেশ্যে। ব্যাগ গোছানো শেষ, ক্যাডেট কলেজের দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী গত কয়েকদিনে সব কেনাকাটা করেছে মা। কতরকম জিনিস যে কেনা লাগলো! অক্সফোর্ড নামে যে একটা জুতো আছে তাই আমি আগে জানতাম না। পাপা ঠাট্টা করে মাকে বলে,”ভালই তো হোল, মেয়ে বিয়ে দেবার সময় তো অনেক কিছু কিনতে হতোই, এখন সেটার একটা প্র্যাকটিস হোল কি বল?” মা মুখ বাঁকিয়ে বলে,” কচু। মেয়ে বিয়ে দিতে হলে কি এত টিকা, ভ্যাকসিন দেয়া লাগত নাকি?” সত্যি, ভ্যাকসিন দেয়া আর রক্ত পরীক্ষা করানোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের মত। বিশেষ করে রক্ত পরীক্ষার সময় যখন ইয়া বড় একটা সুঁই আমার হাতে ঢুকিয়েছিল, তখন ব্যাথা কতটুকু পেয়েছি জানিনা, কিন্তু চিৎকার করেছি গলা ফাটিয়ে। আরও মজার ব্যপার হল, হাতে তুলা চেপে যখন বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, তখন দেখি কি মা চোখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল! ব্যথা ভুলে আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকি মায়ের দিকে,” মা! ব্যথা পেলাম আমি আর কাঁদছ তুমি! মা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলে,” তোর গায়ে কখনো মশার কামড়ের দাগ পড়তে দেইনি। তোর গায়ে সুঁই  ঢুকালে আমি ব্যথা পাই না?” আমি মাথা নেড়ে সায় দেই, কথাটা ভুল বলেনি মা। আমার গায়ে কেউ হাত তুললে মা সত্যি কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে যায়, কোন ভাবে ব্যথা পেলেও মাথাটা বিগড়ে যায় একদম। শীতের দিনে একবার মা গোসলের জন্য পানি গরম করে সেটা নামিয়ে রেখে দরজা খুলতে গিয়েছিলো। আর ছোট্ট আমি হেলেদুলে গিয়ে হাঁড়ির ফুটন্ত পানিতে গিয়ে দিলাম পা ডুবিয়ে। তারপর কি হল বলার অপেক্ষা রাখেনা। পায়ের পোড়া ক্ষত না শুকানো অব্দি মা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো। ওইদিন থেকে আজ পযন্ত মা কনকনে শীতের দিনেও গরম পানি দিয়ে গোসল করেনি। সুতরাং আমার হাতে সুঁই ঢুকালে মা ব্যথা পেতেই পারে, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

আজকে খেতে বসে যে মা কিছুই খেতে পারছেনা সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি। একটু ভাত আর ডাল নিয়ে নাড়াচাড়া করে খাবার ভান করছে শুধু। আমি একটু পানি খেয়ে নিয়ে মাকে বলি,” মা,তুমি কিছু খাচ্ছনা না কেন?” মা চমকে বলে উঠে,”কই,খাচ্ছি তো! তুই খাচ্ছিস না কেন? আরেক টুকরা মাছ নে। কাল থেকে কোথায় পাবি এইসব?” বলতে বলতে মায়ের গলাটা কেঁপে যায়। সে টা খেয়াল না করার ভঙ্গিতে আমি বললাম, “ক্যাডেট এ এর চেয়ে আরও ভাল খাবার দিবে। শুনলে না মুকিদ ভাইয়ার আম্মু কি বললেন? “ মুকিদ ভাইয়া আমাদের একমাত্র পরিচিত ক্যাডেট। ফৌজদারহাটে পড়ে। মা আমার কথায় তেমন একটা ভরসা পেল বলে মনে হয় না। মুখ কাল করেই বলল, “কিন্তু ওখানকার রান্না যদি খেতে না পারিস?” আমি এবার হেসে ফেলি,” মা, তুমি আমাকে যে হারে খাওয়াচ্ছ, ছয় মাস না খেয়ে থাকলেও আমার কিচ্ছু হবে না। আমার গায়ে এমনি অনেক গোশত। আরেকটু হলে  overweight হয়ে বাদ পরে যেতাম। আল্লাহর দোহাই লাগে,তুমি টেনশন টা একটু কমাও। আর দয়া করে একটু খাও, জার্নি করতে হবে কিন্তু।“ পাপা আর সৃষ্টি(আমার ছোটভাই) এতক্ষণ চুপচাপ বসে আমাদের কথা শুনছিল। এবারে পাপা মুখ খুলে,” খেয়াসোনা, জুতার ফিতা বাঁধাটা মনে আছে তো?” আমি দু্রবল ভাবে মাথা নাড়ি। টেবিলের সবাই হেসে ফেলে একসাথে। কাল রাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা দুধরষ পরিশ্রমের পরনামি জুতার ফিতা বাধা শিখেছি। সামান্য জুতার ফিতা বাঁধায় যে এত অসামান্য কারিগরি তা কে জানতো? হঠাৎ মায়ের ফোন বেজে উঠে। “নিশ্চয়ই তোর ফোন।যা কথা বলে আয়।“ আমি হাত না ধুয়েই দৌড় দেই ফোন ধরতে। গত কয়েকদিনে যে কতো ঘণ্টা ফোনে কথা বলেছি তার হিসাব নেই। সব আত্মীয়স্বজনরা ফোন করেছেন, কয়েকদফা দেখাসাক্ষাৎ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। সবার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে চিরবিদায় দিচ্ছে। ক্যাডেট কলেজ থেকে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। স্কুল আর কোচিং এ বিদায় নিতে যাওয়ার সময়ও দেখি সবার চোখ ছলছল। সারা তো কেঁদেকেটে হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললো। ওর কান্না দেখে আমার খুব কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো। স্যার-ম্যাডামরাও অনেক আদর করলেন, এমনকি লাকি ম্যাডাম পযন্ত বুকে চেপে ধরে আদর করে দিলেন! গানের স্কুলে বিদায় নিতে গেলাম একদিন। সতীর্থরা ছলছল চোখে বিদায় দিল। নববর্ষের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলছিলো সেইদিন। সত্যি বলতে কি আমারও বেশ খারাপই লাগছিলো। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানটায় আমি গান করি,এবার কিছুই করা হলনা।১৫ তারিখে কলেজে পৌঁছাতে হবে যে!

অন্যরকম কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে অবশ্য। আমার সাথে আরেকটা মেয়ে ভরতিপরীক্ষা দিয়েছিল ক্যাডেটে,কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চান্স পায়নি। ওর মনখারাপ দেখে আমারো খারাপ লাগছিলো, কিন্তু ওকে কি বলা উচিৎ সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কোচিং এ বিদায় নিতে যাওয়ার সময় শুনি ও বলছে,” ভালো হইছে চান্স পাইনি। আমার মামা অনেক বড় আর্মি অফিসার, উনি বলেছেন নতুন কলেজে একদম পড়াশোনা হবেনা। ধানক্ষেতের মধ্যে ক্যাডেট কলেজ বানিয়ে রেখেছে নাকি!” কথাটা শুনে কিছু বলিনা আমি,সারা খুব কড়া একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলো, ওকেও আটকালাম হাত ধরে। কি দরকার শুধুশুধু ঝামেলা করে। ভেতরে ভেতরে একটু দমে যাই নিজেও। সত্যিই কি ধানক্ষেতের মধ্যে ক্যাডেট কলেজ বানিয়ে রেখেছে! পাপাকে বলতেই সব হেসে উড়িয়ে দেয়,” আরে বেটি, ও মন খারাপ করেছে তো তাইহয়তো ওর মামা সান্তনা দিয়েছেন এসব বলে।“ পাপার কথায় মনের জোর ফিরে পাই আমি।মনভালো হয়না শুধু মায়ের, আসন্ন বিচ্ছেদব্যথায় সে সবসময় কাতর হয়ে থাকে।

ট্রেনে উঠে যতক্ষণ পারা যায় আমার প্রিয় নরসিংদীর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। বৈশাখী মেলা জমে উঠেছে রেললাইনের দু’ধারের বিশাল মাঠে।ইশ,মেলায় যাওয়া হলনা এবার! আমার গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে আছে সৃষ্টি। গতকয়েকদিন যাবৎ অস্বাভাবিকরকম শান্ত হয়ে আছে ও। স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি ভুলে সারাক্ষণ লেগে আছে আমার গায়ে গায়ে। পিচ্চি ভাইটার জন্য মায়ায় আমার বুকটা ভরে উঠে। বাম হাতটা দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি আমি। মামনি-পাপা বসেছে আমাদের মুখোমুখি সীটে। দু’জন স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে,কিন্তু মনের মেঘের ছায়ায় কালো হয়ে আছে মুখ। জোর করে চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকাই আমি। ট্রেন এগিয়ে চলে হেলেদুলে।

রাতের ফেনী শহরে যখন ট্রেনটা পোঁছাল, তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। নতুন জায়গা, বেশ কৌতুহল নিয়েই চারপাশটা দেখতে শুরু করি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ক্লান্ত যাত্রীরা ব্যাগ টেনে নিয়ে এগোচ্ছে, রিকশাওয়ালাদের মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যস্ততা। চট্টগ্রামমুখী যাত্রীরা ট্রেনে উঠছে হুড়মুড়িয়ে, কেউ কেউ রাস্তার দু’ধারের হোটেলগুলোর দিকেও এগোচ্ছে। কাল দুপুর পর্যন্ত হোটেলে কাটাবো আমরা। সিএনজিতে উঠে মা জিজ্ঞাসা করে,”ক্ষুধা লেগেছে আম্মু?” আমি মিনমিন করে বলি,”না না ঠিক আছে।“ মা হেসে ফেলে,”এত সংকোচ নিয়ে তুই অখানে টিকবি কেমন করে?” ওখানে কি তোর মা থাকবে? সোনামণি, নিজেরটা বুঝতে হবেনা?যাই খেতে দিবে,পেটভরে খেয়ে নিবে, স্বাদ যাইহোক। কেমন?” আমার কেমন যেন অসহায় বোধ হয়, মা প্লেটে তুলে না দিলে,নিজে বসে থেকে না খাওয়ালে একা একা খাওয়ার কথা তো আমার কল্পনাতেই আসেনা! এখন থেকে আমাকে তাই করতে হবে? আমার বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। সেটা টের পেয়েই বোধহয় মা আমাকে কাছে টেনে নেয়, মায়ের বুকে মুখ গুঁজে প্রথমবারের মত আমি হু হু করে কেঁদে ফেলি। মাও কাঁদতে থাকে বাচ্চাদের মতো। ড্রাইভার আঙ্কেল অবাক হয়ে বারবার ফিরে তাকান আমাদের দিকে।

মা সারারাত বুকে চেপে ধরে রাখে, মনে হয় যেন একটু ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো কোথাও। সকালটা চারজনে গল্প করে কাটিয়ে দেই আমরা, টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ চলছে, স্কোর দেখি ফাঁকেফাঁকে। দুপুরে মা ভাত মাখিয়ে খাওয়িয়ে দেয়। ব্যাগট্যাগ নিয়ে দুপুরের দিকে রওয়ানা দিলাম ক্যাডেট কলেজের দিকে। কলেজটা মূল শহর থেকে দূরে, দেখতে দেখতে দোকানপাট সরে গিয়ে সবুজগাছপালা আর ধানক্ষেত জায়গা করে নেয় রাস্তার দু’ধারে। “ধানক্ষেতের মধ্যে ক্যাডেট কলেজ”- কথাটা মনে করে ঢোক গিলি কয়েকবার। মা মাঝেমাঝেই ধমক দিচ্ছে মৃদুস্বরে। “অত ঝুঁকে বসে না মা,পড়ে যাবি তো!” মা যে কী না!ক্লাস এইটের এতো বড় মেয়ে মেয়ে বুঝি পড়ে যাবে সিএনজি থেকে? হঠাৎ পাপা চিৎকার করে বলে,”খেয়াসোনা, ঐ যে দেখো তোমার ক্যাডেট কলেজ!” পাপার কথায় চমকে তাকাই গলা বাড়িয়ে, একরাশ সবুজের মধ্যে মরুভূমির মতো একটু জায়গা,তাতে আধুনিক কয়েকটা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। কাজ যে এখনও শেষ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে, ছাদে ইয়াবড় কতোগুলো রড বের হয়ে আছে। কোন বাউণ্ডারি ওয়াল নেই। কিছুটা বিস্ময়,কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকি কলেজটার দিকে।

সৃষ্টি সিএনজির ভেতর থেকে ওর ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে বলে,” আপু,ওই দেখো  ক্যাডেট কলেজ!”

(চলবে)

২,৪১৬ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম (পর্ব ২)”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আপু খুব সুন্দর :clap: :clap:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    খেয়া,
    মজার ব্যাপার। আমার শশুর বাড়ি থেকে ৩ মিনিটের হাঁটা পথ তোমাদের ফেনী ক্যাডেট কলেজ। ওখানে 'দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের' আমলের এয়ারপোর্টের বিশাল একটা পরিত্যাক্ত রানওয়ে ছিল। (হয়ত তোমাদের প্যারেড গ্রউন্ড এর একটা অংশ পরেছে রানওয়ে)

    বউ সহ কত জনকে গাড়ী চালানো শিখিয়েছি ওই পরিত্যাক্ত রানওয়েতে ! শশুর বাড়ি খুব কম যাওয়া হত। আমি জানতাম না আমার প্রিয় স্যার ' ফয়জুল হাসান' তোমাদের প্রিঞ্চিপাল! আমাদের সময়ের নতুন ঝকঝকে তরুন শিক্ষক। আমার প্রথম গীটার শিক্ষার গুরু!

    ভাল হচ্ছে তোমার স্মৃতি রোমন্থন! শুভেচ্ছা রইলো । - ভাইয়া। (সম্পাদিত)


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন
  3. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    ধানক্ষেতের মধ্যে যে কলেজ, সেই কলেজ দেখতে গেছিলাম ইলেভেনে। টাশকি খায়া গেছিলাম। দারুণ লিখসে মেয়েটা :boss: :boss: :boss:


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খেয়া (২০০৬-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।