পেপসোডেন্ট পোস্ট

তিন দিন আগেও আমার ধারণা ছিলো হৃদয় ভাঙ্গার ব্যাথার চেয়ে বড় কোন কষ্ট এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু গত তিন দিনে আমার ধারণা পাল্টাইছে। এখন আমি মোটামোটি নিশ্চিত পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে দাঁত ব্যাথার কষ্ট। বহুদিন আগে এক রুপবতী যখন টার্ন-আউটে ভেজাল থাকার কারণে আমার হৃদয় ভেঙ্গে খান খান (বলিউডের কিং ‘খান’ না কিন্তু ) করে দিয়ে অন্য একজনের সাথে ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করেছিলো তখনো আমি এতো কষ্ট পাই নাই যতোটা কষ্ট গত তিনদিনে আমারে নিচের মাড়ির ডান দিকের শেষ দাঁতটা দিচ্ছে।

প্রথমদিন ঘুম থেকে উঠে টের পাইলাম মুখের ডান দিকে নিচের মাড়ির দাঁতে কেমনজানি শিরশির ব্যাথা। এমন তো হইতেই পারে। এতো পাত্তা দিলাম না। দুপুর বেলা খাবার টেবিলে বসে বড়সড় একটা মুরগীর হাড্ডি নিলাম আয়েশ করে চাবাবো বলে। হাড্ডি খাওয়া নিয়া আবার আমাদের মধ্যে বেশ কাড়াকাড়ি হয়। কলেজে থাকতে হাড্ডি খাইতে চাইতাম না, সিনিয়ররা ফাইজলামি কইরা ব্যাকাতেরা মুরগীর হাড্ডি প্লেটে দিয়া দিতো। ওইগুলির নাম ছিলো ‘হেলিকপ্টার’। জুনিয়র থাকা অবস্থায় কাটাচামচ দিয়া সেই ‘হেলিকপ্টার’ খাইতে জান খারাপ হইয়া যাইতো। আমার মনে আছে একবার সেইরকম একটা হাড্ডি চামচ দিয়া সিস্টেম করতে পারি নাই, তাই উইড়া গিয়া ডাইনিং হলে আমার উলটা দিকে বসা মুরতুজা ভাইয়ের গায়ে পড়ছিলো। হাউজে আইসা উনার রুমের সামনে পুরা ৪ ঘন্টা হ্যান্ডস ডাউন হইয়া ছিলাম।

যাক সে কথা। এখন মুরগীর হাড্ডি আমাদের খুব প্রিয়। এখন তো আর কাটাচামচ দিয়া খাইতে হয়না। হাত দিয়া একদিকে ধইরা অন্যদিকের মাংশওলা অংশটুকু কচকচ কইরা চিবাইতে বড় আরাম। তো , দুপুরে খাবার টেবিলে বইসা বড়সড় একটা মাংশঅলা হাড্ডি নিলাম, সাথে সাথে রুম্মান বাগড়া দিলো।
‘অই ব্যাডা তোর জ্বালায় একদিনও আরাম কইরা হাড্ডি চিবাইতে পারি না। আইজকা এইডা আমি খামু, রাখ কইতাছি … তুই মাংশ খা।’ কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি ওর কথা পাত্তা না দিয়া হাড্ডি নিতে গেলাম, হালায় আমার সাথে কাড়াকাড়ি শুরু কইরা দিলো। বহুত কাড়াকাড়ির পর আমার জয় হইলো, আমি আয়েশ কইরা মুরগীর হাড্ডিতে একটা কামড় দিলাম আর সাথে সাথে আমার দুনিয়া আন্ধার হইয়া গেলো। ‘ও মা গো’ কইয়া এমন চিল্লান দিলাম যে পাশে বসা মাসুদ ডরে পানির গ্লাস ফেলে দিলো হাত থেকে। ফ্লোরে কাঁচের ভাঙ্গা গুড়া পড়ে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। হাসনাত ঝাড়ি দিলো, ‘কি হইছে তোর ? এমন ডেলিভারি কেইসের মহিলাদের মতো চিল্লান দিলি ক্যান? ‘ আমি কইলাম, ‘মামা, আমার দাঁতে কি জানি হইছে, কামড় দেয়ার সাথে সাথে ব্যাথায় চোখে মুখে আন্ধার দেখতেছি।’ রুম্মান খুব খুশি হইয়া কইলো, ‘খুব ভালো হইছে, আল্লার বিচার আল্লা করছে। এখন খা, আরো বেশি কইরা হাড্ডি খা।’ মেজাজটা খারাপ হইয়া গেলো, ঠিক মতো দুপুরে খাইতে পারলাম না।

শুধু দুপুর বেলা না, এইভাবে সারাদিন গেলো। শক্ত কিছু মুখে দিয়া চাবাইতে পারি না। ব্যাথায় টনটন করে।
আমার ব্যাক্তিগত ডাক্তার হইতেছে আমাদের ব্যাচের শরীফ। উত্তরায় বাংলাদেশ মেডিকেলের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টে আছে। ছোট থেকে বড় , যে কোন কিছু হইলেই আমি প্রথমে ওর শরণাপন্ন হই। এইবারও হইলাম। ফোন দিয়া কইলাম ‘মামা, আমার দাঁতে কি জানি হইছে , খুব ব্যাথা করতেছে, একটু আইসা দেইখা যা।’ শরীফ আসলো। মুখের মধ্যে টর্চ দিয়া দেইখা রায় দিলো, ‘তোর আক্কেল দাঁত উঠতেছে, তাই ব্যাথা করে, ঠিক হয়ে যাবে।’ দুইটা ট্যাব্লেট দিয়া কইলো, ‘এই দুইটা খাইলেই ব্যাথা সাইরা যাবে, চিন্তা নাই।’

আমি ট্যাব্লেট খাইলাম। তারপর একদিন যায়, দুই দিন যায়। ব্যাথা আর কমে না। এইবার তো আর হেলাফেলা করা যায় না। সোজা এপয়েন্টমেন্ট নিয়া চইলা গেলাম স্কয়ার হাস্পাতালের পাশে ‘হিরোশিমা ডেন্টাল ক্লিনিকে’র বড় দাঁতের ডাক্তারের কাছে। মুখের ভিতর টর্চ, ছুরি, কাঁচি দিয়া অনেক্ষণ গুঁতাগুঁতি কইরা ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘হুম, আপনার আক্কেল দাঁতই উঠতেছে, কিন্তু ওইখানে দাঁত উঠার জায়গা নাই, কিন্তু ঐটা সব ভেঙ্গেচুড়ে উঠতেছে। তাই ব্যাথা করে।’
এখন উপায়?
ফেলে দেন
ফেলে দিবো মানে?
মানে আক্কেল দাঁতটা পুরোপুরি উঠার আগেই ফেলে দেন, ঐটা মানুষের কোন কাজেই লাগে না।
কন কি? আক্কেল দাঁত ফেলে দিমু?
নইলে ওইখানে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
তাইলে দেন ফালাইয়া
আজকে হবে না, সোমবার আসবেন। সার্জারীর টাকা পয়সা নিয়ে আসবেন।
সার্জারী মানে?
মানে এই দাঁত নরমালি ফেলা যাবে না, সার্জারী লাগবে
জি, মানে কি রকম টাকা লাগবে?
পাঁচ হাজার

আমার চোখ আকাশে উঠলো। শালার এক দাঁত ফেলতে পাঁচ হাজার!! ঠাডাইয়া একটা থাবড় দিলে মানুষের দাঁত পইড়া যায়! আর হালায় আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা চায়! সোমবারে আসবো, এই প্রতিশ্রুতি দিয়া ডাক্তারের চেম্বার থেইকা ফিরা আসলাম।

বাসায় আসার পর আম্মা ফোন দিয়া জিগাইলো, ‘ কিরে বাবা কেমন আছিস?’ বললাম, ‘ভালো না আম্মা, ‘আক্কেল দাঁত উঠতেছে, ব্যাথায় চারিদিকে আন্ধার দেখতেছি।’
‘ওই একটু ব্যাথা করবেই, পুরোটা উঠে গেলে ঠিক হয়ে যাবে’
‘না আম্মা, খুব ব্যথা, ডাক্তার বলছে ওইটা ফেলে দিতে’
‘আরে বেয়াক্কেল কস কি? আক্কেল দাঁত আবার কেউ ফেলে নাকি? ওই দাঁত উঠতেছে মানে এতোদিনে তোর আক্কেল-বুদ্ধি কিছু হবে।’
‘ধুর আম্মা! কি যে কন না, আমার যে কি ব্যাথা করতেছে এইটা আপনারে বুঝাইতে পারতেছিনা’
বুঝাইতে হবে না, আমি জানি। তোর বাবার আক্কেল দাঁতই উঠছে কয়দিন আগে। ব্যাথায় ‘ও মা গো, বাবাগো’ বইলা চিল্লাইতো’

এতো দুঃখের মধ্যেও আমি হেসে দিলাম। আক্কেল দাঁত ফেলবো না, এই প্রতিশ্রুতি দিয়া ফোন রেখে দিলাম।

আপাতত খুব কষ্টে আছি। দাঁত ব্যাথার কষ্ট কোনরকমে সহ্য করে যাই।
কিন্তু ডাইনিং টেবিলে রুম্মান যখন আমারে দেখাইয়া দেখাইয়া মুরগীর হাড্ডি চিবায় , তখন আর সহ্য হয় না।

৫,৪৭৮ বার দেখা হয়েছে

৬৮ টি মন্তব্য : “পেপসোডেন্ট পোস্ট”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে দাঁত ব্যাথার কষ্ট।

    :thumbup: :thumbup:

    কামরুল ভাই কি এই কষ্টে বিবাগী হয়ে দাড়ি রাখালেন নাকি?


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মা তো ঠিকই কইছেন, আর কতোদিন বেয়াক্কেল থাকবা!! :grr: :grr: :grr:

    তবে একাধিক টিপস : এই আক্কেল দাঁত উঠতে যেমন ভুগাইতাছে, পরেও ভুগাইবো। ওইডা অসুস্থও হয় তাড়াতাড়ি। তখন আবার যুদ্ধ কইরা ফালাইতে হয়। আমি বোধহয় সবগুলাই ফালাইয়া দিসি!

    আরেকটা পথ হলো আক্কেল দাঁত উঠার পথ করে দেওয়া। সম্ভবত মাড়ি কিছুটা কেটে ওই পথটা বানাতে হয়। চাইলে কালকা ফোন কইরো। আমি আরেক ডাক্তারের খোঁজ দিমুনে। হয়তো পয়সাও কম নিবো। 😉 😉 😉


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. শাওন (৯৫-০১)

    কামরুল ভাই, হেলিকপ্টার খাওয়া বাদ দেন। সামনে ভাগ্য ভালো হইলেতো বস নরম কোন জায়গায় কামড় দিতে হইব 😀 :)) =)) । কি দরকার আর হেলিকপ্টার টাইপ হাড্ডি খাইয়া আক্কেল দাঁতের বারোটা বাজানো।
    যাক এই দাঁত ব্যাথার মাঝেও যে জটিল একটা পোষ্ট দিছেন এইজন্য একটা জটিল ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। :salute:


    ধন্যবাদান্তে,
    মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
    প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১

    ["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]

    জবাব দিন
  4. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    আমিও ভুগসিলাম ......... ব্যথাটা উঠলে দুনিয়াদারীর আর কিছুই চোখে লাগে না। সানাউল্লাহ ভাই যেটা বলসে, সেটা ট্রাই করে দেখো। মাড়ির কিছু চামড়া কেটে দিলেই দাঁত উঠে যাবে। তবে সেটার ব্যথাও থাকবে তিন দিনের মতন।

    জবাব দিন
  5. আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

    আমি মাড়ি কেটে দাঁতের রাস্তা করে দেয়ার পক্ষপাতি।
    তবে পয়সা খরচ করে এসব অস্ত্রপচার করা কি দরকার? ঐ জায়গা দিয়া কলমের পিছন সাইড কামড়ান। আমারও সেইম কেস হইসিল, কলম কামড়ায় কামড়ায় সাইজ করে দিসি। ব্যথা হয়, একটু সহ্যক্ষমতা বাড়ায় নেন।

    আপনার খরচ বাঁচায় দিলাম; ট্রিট কই?

    জবাব দিন
  6. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    কামরুল ভাই,
    আমার কিন্তু আরো সিরিয়াস অবস্থা ছিল। ২ বছর আগে একটা আক্কেল দাত সিজার করে ফেলতে হয়েছে। আর আরেকটা আক্কেল দাত ফুটা কইরা ভেতরের সব কিছু ডাক্তার ফেলে দিয়েছে। ওটা এখন মৃত অবস্থায় আছে। ইনশাল্লাহ ওটাও ফেলে দিব।

    দাতের ব্যাথা যে কি জিনিস সেটা আমি বুঝি ভাইয়া। তাই সমব্যাথি।

    জবাব দিন
  7. আরিফ (৯২-৯৮)

    কামরুল,
    আক্কেল দাত যখন বেয়াক্কেল এর মত উঠা শুরু করে তখন ফেলে দেয়া ছাড়া কোন গতি নাই। আমার একটা দাঁত উপর দিকে না উঠে সামনের দাঁতে ঠেলা দেয়া শুরু করছিল। সার্জারী করে ফেলে দিতে হয়েছে। মোট তিনটা ফেলছি। একটাই সম্বল।

    জবাব দিন
  8. ভাই,
    একটা কথা আছে,... ...

    আমার মোট দাঁত গুইন্না দেখলাম ৩৪ টা ,
    একবার না -- বন্ধুদের দিয়াও গুনাইলাম অবিশ্বাস কইরা।

    আমার তো আক্কেল দাঁত অনেকগুলা তাইলে।
    আমি কি বেশি আক্কেল সম্পন্ন ??
    😉 😉

    আমার আক্কেল দাঁত উঠার টাইমের কষ্ট না-ই কই... ...
    ব্যথায় কা-ত-র
    :(( :((

    জবাব দিন
  9. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ভালো বলছো। আমার আক্কেল দাঁত উঠছে পুরা আড়াই বচ্ছর ধইরা। একটু উঠে আবার বন্ধ হই যায়, আবার একটু উঠে, এই হইলো গিয়া অবস্থা। আরে ব্যাথা, উরে মারে মা।

    যাউজ্ঞা, আক্কেল দাঁত উইঠা সারছে আলহামদুল্লিলাহ, একটা না, দুই দুইটা আক্কেল দাত আমার। আমার দাঁত এখন সাক্কুল্যে হইলো গিয়া ৩২। তাই আমি যাই বলি ফইল্লা যায়, কেউ হাসির কথা বললে আমি আক্ষরিক অর্থেই ৩২ পাটি দাঁত বের করে হাসি। বেশির ভাগ মানুষের দাঁত হইলো গিয়া ৩০। তাদের দেখে আফসোস করি। আহারে এগো দুইটা দাঁত শর্ট আছে 😀


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।