কোথায় পাবো তাদের-৭

১.

ভুগোলের নুরুল হোসেন স্যারের একটা অভ্যাস ছিলো। যে কোন জায়গায় প্রিন্সিপাল সোহরাব আলী তালুকদার কে দেখলে উনার হাত কচলানি শুরু হইয়া যাইতো। প্রিন্সিপালের যে কোনো কথার জবাব স্যার দুই হাতের তালু একটা আরেক টার সাথে ঘষতে ঘষতে দিতেন। আমাদের বদ্ধমুল ধারনা ছিলো এই রকম হাত কচলানোর ফলে স্যারের হাতের রেখা বলতে কিছু নাই। সেই জন্যে স্যার ক্লাস নিতে আসলেই আমরা নানা ভাবে উকিঝুকি দিয়া তার হাতের রেখা দেখার চেষ্টা করতাম। এই রকম অভ্যাসের কারনে প্রিন্সিপালের কোনো কথায় স্যার কোনোদিন না বলতে পারেন নাই। কিন্তু স্যার পড়াতেন বেশ ভালো।

তো একবার সেই নুরুল হোসেন স্যার একবার আমাদের ভুগোল ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা তখন একেবারে ছোট। খুব সম্ভবত নতুন ক্লাস এইটে উঠেছি। স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন ‘সৌরজগত’ আমাদের কে বুঝচ্ছেন পৃথিবী কিভাবে সুর্যের চারদিকে ঘুরে। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপরে ঘুরে আবার এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে সুর্যের চারদিকেও ঘুরে। এইটা আমাদেরকে বুঝানোর জন্য স্যার করলেন কি, নিজেই ঘুরতে লাগলেন। আবার নিজে ঘুরতে ঘুরতে লেকচার ডায়াসের চারপাশেও ঘুরতে লাগলেন আর আমাদেরকে বলছেন মনে করো আমি পৃথিবী আর লেকচার ডায়াসটা সুর্য।
প্রিন্সিপাল সোহ রাব আলী তালুকদার যাচ্ছিলেন ফর্মের পাশ দিয়ে। তিনি হঠাত দেখলেন নুরুল হোসেন স্যার এই রকম অদ্ভুতভাবে ঘুরছেন। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। ক্লাসে ঢুকে বললেন
-কি ব্যাপার নুরুল হোসেন সাহেব মাথা ঘুরাইতেছে নাকি?
-না স্যার ,এই আর কি। স্যারের হাত কচলানো শুরু হইয়া যায়।
-এই রকম চরকির মতো ঘুরতেছেন যে?
-স্যার ওদের কে পৃথিবী কিভাবে ঘুরে দেখাইতেছিলাম।
-আমি ত ভাবলাম আপনার মাথা ঘুরাইতেছে, পইরা যাবেন যে কোন সময়।
-স্যার জি স্যার
-যান যান মাথায় একটু পানি দিয়া আসেন। কখন কি হয়ে যায়।
-জি স্যার।

ক্লাস থেকে বের হয়ে নুরুল হোসেন স্যার দৌড়ে গেলেন মাথায় পানি দিতে।

২.

চারুকলার দেবব্রত মল্লিক স্যার যখন প্রথম আমাদের কলেজে জয়েন করেন তখন তিনি বেশ গাট্টা-গোট্টা, ছোটখাটো টাইপের মানুষ। হঠাত দেখলে তাকে স্যার বলে মনে হইতো না। কেমন ক্লাস টুয়েলভ ক্লাস টুয়েলভ মনে হইতো। স্যার ছিলেন তিতুমির হাউজের সঙ্গে এটাচড। এবং গনহারে সবাইকে তুই করে বলতেন।

সেবার ইন্টার হাউজ ফুটবলের আগে আমাদের অল্টারনেটিভ জুনিয়র ব্যাচের একজন (অরা তখন মাত্র কলেজে এসেছে, ক্লাস সেভেন) তার গাইডকে জিজ্ঞেস করলো
-ভাইয়া আমি যদি হাউজ টিমে ফুটবল খেলতে চাই তাইলে কি করতে হবে?
-ওই যে কোনায় হাউজ প্রিফেক্টের রুম আছে। তার কাছে গিয়া বলবা ভাইয়া আমি ফুটবল ভালো খেলি, হাউজ টিমে খেলতে চাই।
-ভাইয়া আমি তো হাউজ প্রিফেক্ট কে চিনি না।
-আরে দেখবা একটু ছোটখাটো, মোটা সোটা একজন ভাইয়া আছেন। উনিই হাউজ প্রিফেক্ট। তাকে বললেই হবে।

সেই জুনিয়র হাউজ প্রিফেক্টের রুমের সামনে গেল। ঘটনাক্রমে ওইখানে তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন দেবব্রত মল্লিক স্যার। সাইজ দেখে সে ভাবলো এইটাই হাউজ প্রিফেক্ট।
-স্লামালিকুম ভাইয়া।
-কি?? দেবব্রত স্যার আতকে উঠলেন তাকে কেউ ভাইয়া বলছে এইটা শুনে।
-ভাইয়া আমি খুব ভালো ফুটবল খেলি। হাউজ টিমে জুনিয়র গ্রুপে খেলতে চাই।
-এই তুই হ্যান্ডস ডাউন হ। বেন্ড হ। বেন্ড হ বলতেছি। স্যারের রাগ তখন দেখে কে।
আচমকা এই রকম আক্রমনে ওই জুনিয়রও দিশা হারা হয়ে গেল। সে হ্যান্ডস ডাউন হলো এবং কিছু না বুঝে বললো
-সরি ভাইয়া।
-আবার ভাইয়া বলে…
এইবার ওই জুনিয়র ভাবলো হাউজ প্রিফেক্টদের বোধ হয় ভাইয়া বলার নিয়ম নাই। সে অন্য ভাবে ট্রাই করলো।
-সরি প্রিফেক্ট । আমার ভুল হয়ে গেছে প্রিফেক্ট। আমি আসলে হাউজ টিমে খেলতে চাই এইটা বলতে এসেছিলাম।
-কি কইলি তুই? আমি প্রিফেক্ট। দাড়া… এই বাবুলাল বেত বের কর।
বাবুলাল আমাদের হাউজ বেয়ারার নাম।

এর পরে ওই বেচারার কি হইছিলো আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন। হাউজ টিমে খেলার সখ তার সেই দিনই চলে গিয়েছিলো।

৩.

ইংরেজির এনায়েত হোসেন স্যার ছিলেন একটু পাগলা টাইপের। বাধা-ধরা পড়াশুনার ব্যাপারে স্যারের প্রবল আপত্তি ছিলো। বই পড়ানোর চেয়ে বইয়ের বাইরের পড়াশুনার প্রতি স্যার বেশ জোর দিতেন। ফলে স্যার পরীক্ষা নিলে তার প্রশ্নগুলিও ব্যাতিক্রম হতো। আর আসল ঝড়-ঝাপ্টা যেতো আমাদের উপর দিয়ে। আমরা গনহারে ফেইল করতাম।

সেবার পাক্ষিক পরীক্ষায় স্যার প্রশ্ন করলেন – why ‘আমার একটি কলম আছে’ should not be ‘my have a pen’ ? Why it is ‘I have a pen’ ? সোজা বাংলায় এর মানে হইল- ‘আমার একটি কলম আছে’ এটার ইংরেজি কেন ‘my have a pen’ না হয়ে ‘I have a pen’ হলো? প্রশ্ন পইড়া আমাদের মাথায় হাত। এর উত্তর কি? ফলাফল ২৭ জনের ২৭ জনই ফেইল।

২৫ নাম্বারের পরীক্ষা, তাতে ১০ পাইলে পাস। দুই একজন পাসের কাছাকাছি গেছিলো। বাকিরা ১ , ২ ০ এই রকম নাম্বার পাইছি। খাতা দেওয়ার পর আমাদের আরিফ গেল স্যারের কাছে।
-স্যার আমারে আর এক টা নাম্বার বাড়াইয়া দেন
-এক বাড়াইয়া দিলে কি পাস হবে? তুমি কতো পাইছ?
-স্যার ৪।
-এক দিলে কি হবে? তোমার তো পাস হবে না।
-স্যার ১ দিলে পাচ হবে। ৫ একটা রাউন্ড ফিগার। ৪ দেখতে কেমন দেখা যায়? রাউন্ড ফিগার হইলে দেখতে ভালো লাগবে।

এতো দুঃখের মধ্যেও আমরা পুরা ফর্ম হেসে দিলাম।

৩,৬২৭ বার দেখা হয়েছে

৩৯ টি মন্তব্য : “কোথায় পাবো তাদের-৭”

  1. বন্য (৯৯-০৫)

    আমাদের কলেজে প্রিন্সিপাল স্যার যখন হাটতে বাইর হইত..তখন একদল স্যার লগে থাকত তেল মারতে..
    দেখতাম আর টাশকি খাইতাম...
    বুড়া বুড়া সব স্যার
    হাটতে পারতেসেনা...
    তাও খালি হাটতেসে আর হাটতেসে... :boss: :boss:

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ৫ একটা রাউন্ড ফিগার। ৪ দেখতে কেমন দেখা যায়? রাউন্ড ফিগার হইলে দেখতে ভালো লাগবে।

    =)) =))
    কামরুল ভাই... :boss:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    দেবব্রত স্যারের কাহিনী আজও ভুলতে পারি নাই। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। প্যারেন্ট্‌স ডে'র পরদিন চারুকলা ক্লাসে স্যার আমারে বলে, এই তুমি, গতকাল আমাকে দেখে সালাম দেও নাই ক্যান। সে কোনদিক দিয়া গেয়ে আমি খেয়ালও করি নাই। প্যারেন্ট্‌সের সাথে কোথাও যাওয়ার সময় হয়ত পাশে সে পড়ছিল। আমারে কিছু বলতেই দিল না। যে গুটিকয়েক স্যারের হাতে সরাসরি চড় খাইছি দেবব্রত তাদের একজন। উনি কখন যে কি করে ফেলতেন কেউ বুঝতেই পারত না।
    ম্যাচিউরিটি আসছে জেনে ভাল্লাগল 🙂

    জবাব দিন
  4. এহসান (৮৯-৯৫)

    ইংরেজির এনায়েত হোসেন স্যার ছিলেন একটু বিকল্প ধারার মানুষ; পাগলা টাইপের না। একদিন বই পড়া নিয়ে কথা হইতেসে; স্যার জিগায় কি পরতেসো আজকাল। কইলাম "শেষের কবিতা"। আমারে জিগায় কি বুঝলা। আমিতো অমিতের প্রশংসা করতেসি। স্যার কয় কিস্যু বুঝ নাই। "শেষের কবিতা" এর নায়ক হইল শোভনলাল। এরপর বিভিন্ন সময়ে আমি "শেষের কবিতা" এই পরযন্ত ৮বার পরলাম। একেকবার মনে হইল একেক রকম। এখন আমি বিশষাস করি শোভনলালই "শেষের কবিতা" এর নায়ক। স্যারের সাথে পৃথু ঘোষরে নিয়েও কথা হইসে। তখন নিজেরে একটু আতেঁল প্রমান করের জন্য "শেষের কবিতা", "মাধুকরী" পরেছিলাম। অনেক কিছুই মাথার উপর দিয়ে গেসিলো। কিন্তু অনেকদিন পরে ২০০৫ এ আবার যখন "শেষের কবিতা" পরছিলাম, স্যারের কথা মনে পরসিলো, আসলে কিছু interesting স্যার ছিল; যাদের আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

    জবাব দিন
  5. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    সরি প্রিফেক্ট । আমার ভুল হয়ে গেছে প্রিফেক্ট।
    স্যার ১ দিলে পাচ হবে। ৫ একটা রাউন্ড ফিগার। ৪ দেখতে কেমন দেখা যায়?

    :khekz: :khekz:
    আসলেই ভাই... কোথায় পাব তাদের?? 🙁

    জবাব দিন
  6. ইফতেখার (৯৫-০১)

    এই পোষ্ট পইড়া আমি কইলাম গ্রাড ল্যাব এর মধ্যে হাসতে হাসতে গড়াইয়া পইরা যাইতেসি ...

    আশে পাশের শাদা আর কালা চামড়া গুলা আমারে পাগোল ভাবলে কইলাম আপনের দোষ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : এহসান (৮৯-৯৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।