অথচ তাঁরা হতে পারতেন ফুটবলার

বন্ড, জেমস বন্ড। আয়ান ফ্লেমিংয়ের কালজয়ী চরিত্রের কালজয়ী সংলাপ। সিনেমার পর্দায় বেশ কয়েকজন অভিনেতাকে দেখা গেছে এই চরিত্রে। কিন্তু আজ আমরা যে ভদ্রলোকের কথা বলব তিনি বাকি সবার চেয়ে একটু আলাদা। সিনেমার ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সংলাপ প্রথম শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। লম্বায় ছয় ফুট দুই, জাতে স্কটিশ। জেমস বন্ড সিনেমার যারা ভক্ত তারা এরই মধ্যে চিনে ফেলেছেন ভদ্রলোককে। যারা চিনেননি আরো একটু জেনে নিন, ‘দ্য আনটাচেবলস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ইনি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার_অস্কার জিতেছেন ১৯৮৮ সালে। পিপল ম্যাগাজিনের জরিপে ৬৯ বছর বয়সেও হয়েছেন শতাব্দীর সবচেয়ে আবেদনময়ী পুরুষ! এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের চেহারাটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে? শন কনারি।

অস্কারজয়ী পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ একবার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে শুধু সাতজন সুপারস্টার অভিনেতা আছে। শন কনারি তাদের একজন।’ এই কথার পর কনারিকে নিয়ে আর কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তাহলে আর হঠাৎ তাকে নিয়ে গল্প ফাঁদা কেন! তার মানে কিছু কথা আছে।

ধরুন যদি বলি, অভিনেতা নয় আসলে কনারির হওয়ার কথা ছিল দুর্দান্ত ফুটবলার! বিশ্বাস করবেন না জানি। কনারি এবং ফুটবল? হতেই পারে না। পারে, বুসবি বেঁচে থাকলে এটাই বলতেন। বুসবিকে চিনেছেন তো? ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ইউরোপিয়ান কাপ জেতানো কোচ স্যার ম্যাট বুসবি। ইনিও স্কটিশ। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে বুসবি তখনো ম্যানইউর কোচ হননি। স্কটল্যান্ডের একটা স্থানীয় ফুটবল ক্লাবকে কোচিং করাচ্ছেন। আর কনারি? ফুটবল খেলতেন ‘বনিরিগ রোজ’ নামে স্কটল্যান্ডের এক জুনিয়র ক্লাবে, সঙ্গে শখের বসে টুকটাক অভিনয়। যথারীতি দুজনের দেখা হলো। বুসবির সেই ক্লাবের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলতে এসেছিলেন কনারি। খাঁটি সোনা চিনতে নাকি জহুরির এক নজরই যথেষ্ট। স্যার বুসবি এক নজর নয়, কনারির পুরো খেলা দেখলেন এবং ম্যাচ শেষে তাকে ডেকে পাঠালেন নিজের রুমে। ‘তুমি আমার দলের হয়ে খেল, সপ্তাহে ২৫ পাউন্ড করে দেব’_আকস্মিক প্রস্তাবটা পেয়ে দারুণ রোমাঞ্চিত কনারি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। ‘ফুটবলার হলে ত্রিশ পেরিয়ে একসময় আমাকে অবসরের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু অভিনয়টা হয়তো আমি করে যেতে পারব সারাজীবন’_ঠিক এ কথাটাই নাকি মনে এসেছিল তাঁর সেই সময়।

কনারি না হয় ভাবনা-চিন্তা করে ফুটবল ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বাধ্য হয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন এমন একজনও আছেন। অ্যান্টোনিও ব্যান্ডেরাস। ডেসপ্যারাডো ছবির এই স্প্যানিশ অভিনেতা ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বড় ফুটবলার হবেন। জন্ম স্পেনের মালাকা শহরে। পুলিশ অফিসার বাবা আর স্কুল শিক্ষক মায়ের চোখ রাঙানি কিছুই কৈশোরে ঘরে আটকে রাখতে পারত না তাকে। মালাকার অলিগলিতে ফুটবল খেলেই সারাদিন কাটত ব্যান্ডেরাসের। কিন্তু বিধিবাম! মাত্র ১৪ বছর বয়সে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেললেন ‘অরিজিনাল সিন’ ছবির নায়ক। এবার বাবা-মায়ের কঠোর আদেশ_’ফুটবল ছাড়ো।’ ছেড়ে দিলেন ব্যান্ডেরাস, মালাকা ছেড়ে মাদ্রিদ চলে গেলেন অভিনেতা হবেন বলে।

পপ তারকা হুলিও ইগলেসিয়াস রিয়ালের বয়সভিত্তিক দলের গোলরক্ষকও ছিলেন। কিন্তু তারও ‘গ্যালাকটিকোদের’ মূল দলে খেলার স্বপ্নটা শেষ হয়ে গিয়েছিল এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায়। খেলবেন কি করে, জীবনে হাঁটতে পারবেন কি না এই নিশ্চয়তাই দিতে পারছিলেন না ডাক্তাররা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন নিজের ভাগ্যকে দোষ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তখন একদিন নার্স সময় কাটানোর জন্য ইগলেলিয়াসকে এনে দিলেন একটা গিটার। শুরু হলো টুং টাং। স্রেফ কপাল জোরে একসময় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন ইগলেলিয়াস, কিন্তু ততদিনে গিটার কথা বলতে শুরু করেছে তার হাতে। প্রথম অ্যালবাম ‘ইয়ো কান্তো’ বাজারে আসার পর বিক্রি হলো এক লাখেরও বেশি। ‘বেনিডর্ম ইন্টারন্যাশনাল সং ফেস্টিভালে’ পুরস্কার পেলেন সেরা গীতিকার হিসেবে। ব্যস, আর ফিরে যাওয়া হলো না বার্নাব্যুর ফুটবল মাঠে।

ফুটবল মাঠ হাতছানি দিয়ে ডাকত আলবেয়ার কামুকেও। নোবেল বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক, দার্শনিক। ‘দ্য প্লেগ’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’-এর লেখক ‘ইউনিভার্সিটি অব আলজিয়ার্স’-এ পড়ার সময় গোলরক্ষক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় দলের। কিন্তু দরিদ্র কৃষকের সন্তান হয়ে অবসরে ফুটবল খেললে কি মানায়? পেটের দায়ে গৃহশিক্ষক, গাড়ির মেকানিক এমন অনেক পেশাই বেছে নিতে হয়েছে তাকে, শুধু বেছে নিতে পারেননি ফুটবলটা। যেটুকু স্বপ্ন ছিল, সেটাও শেষ হয়ে গেল ২৭ বছর বয়সে যক্ষ্মা হওয়ার পর। সুস্থ হয়ে পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, কিন্তু ততদিনে শেষ হয়ে গেছে ফ্রান্সের হয়ে খেলার স্বপ্ন। শুধু ফুটবলের কাছে তাঁর ঋণটা নাকি রয়ে গিয়েছিল সারা জীবন, ‘কর্তব্য পালন আর নৈতিকতা দুটো জিনিস আমি শিখেছি ফুটবল খেলে’_একটা লেখায় একবার বলেছিলেন এই স্বনামধন্য সাহিত্যিক।

ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে কেউ হয়েছেন নায়ক, কেউ গায়ক, কেউ সাহিত্যিক, কেউ ক্রিকেটার। কিন্তু ক্যারল জোসেফ বুজতিলার নিয়তি তাকে বানিয়েছে ধর্মগুরু। হ্যাঁ, এটাই তার আসল নাম। এ নামেই তাকে চিনতেন পোল্যান্ডের বাদুভিচ শহরের লোকজন। গোলরক্ষক ছিলেন তিনি নিজের শহরের ফুটবল দলের। ‘ক্রাকোভিয়া ক্রাকোফ’ নামে পোলিশ ফুটবল ক্লাবের সমর্থক ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। পোপের দায়িত্ব নেওয়ার পরও ফুটবলের খোঁজ রাখতেন নিয়মিত, আর খোঁজ রাখতেন গোলরক্ষকদের। হাজার হলেও তার নিজের পজিশন। মৃত্যুর বছর চারেক আগেও এক ফুটবলারের বিয়েতে নিজের আশীর্বাদবার্তা পাঠিয়েছিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল।

সেই ফুটবলারের নাম জানতে নিশ্চয়ই ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে? আয়ারল্যান্ড এবং ম্যানচেস্টার সিটির গোলরক্ষক শে গিভেন।

*****
একই সঙ্গে কালের কন্ঠ স্পোর্টসে প্রকাশিত

২,১২১ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “অথচ তাঁরা হতে পারতেন ফুটবলার”

  1. তারেক (৯৪ - ০০)

    কস্কি মমিন! এইসব জানা ছিলো না। 🙂
    আসলে আমারও ফুটবলার হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু এক ঝড় এসে আমার সেই স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে গেল। একদিন শীতের সকালে মাঠে গিয়ে ফুটবল ভেবে একটা বাস্কেটবলকে সজোরে লাথি মারতেই... যাক সে কথা। তোকে জানায়ে রাখলাম, বছর তিরিশ বাদে লিখে ফেলিস। 😛


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    আমার ফুটবলার হওয়ার কথা না থাকলেও আমার মিতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল ঢাকা লিগে খেলতেন। ফুটবল ক্রিকেট দুইটাতে সুযোগ থাকলেও তিনি ক্রিকেটকে বেছে নিয়ে, পোস্টে উল্লেখিতদের মত না হোন অন্তত বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজীবন সুপারস্টারদের একজন।

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    যাক তাও কামরুলের একটা লেখা পাওয়া গেল। নায়িকাদের না নিয়া খেলোয়াড়দের নিয়ে লেখায় তোমার ব্যাঞ্চামু কিনা ভাবতাছি!! দেখি কাইয়ুম কি কয়..........

    বিষয় নির্বাচন আর লেখাটা ভালো হইছে। :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ওরে কত অজানা রে... 😮
    কিন্তু বস, লিষ্টে ভিভ রিচার্ডস এর নাম নাই দেখে কষ্ট পাইলাম... 😛
    আর স্টিভ বাকনার ও একসময় গোল্কিপিং করত... ;))


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।