আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই-২

বেশ ক’দিন ধরেই কনকনে শীত পড়েছে ঢাকায়। দেয়াল ঘড়িতে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২০/২১ এর মতো। এটাই কাত করে ফেলেছে আমাদের সবাইকে। আলমারি আর স্টোরে ফেলে রাখা পুরোনো শীতের কাপড়গুলি থেকে খুঁজে মাথায় টুপি দেয়া একটা পুলওভার বের করেছি। এখন সারাদিন ওটাই পরে বসে থাকি। ভাবছি এটা দিয়েই বাকি শীতটা পার করে দেয়া যায় কিনা! নতুন জামা কাপড় কিনতে আমার খুব আলসেমি লাগে। কেনাকাটায় আমি খুব খারাপ। পছন্দ আর দামাদামি কিছুই ঠিক মতো করতে পারি না।

রাসেলও আমার মতোই, গতবারের সুয়েটারটা খুঁজে বের করে ধুয়ে টুয়ে একেবারে নতুন করে ফেলেছে। আমাদের বাসায় সবচেয়ে বেশি জামাকাপড় মাসুদের। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দোকানে কোন শার্ট পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে কিনে ফেলে। ক’দিন পরেই সেটা আর আলমারি থেকে বের হয় না। আমরা শুরুতে বেশ বকাবকি করতাম, এখন আর করিনা। ওর জামা কাপড়ের মাপ আমার মতোই। আমি ওর গুলি দিয়ে বেশ কাজ চালিয়ে নেই। আগের বছরের সুয়েটারটা ওর এবার পছন্দ হচ্ছে না। ক’দিন ধরে তাই সবাইকে গুতাচ্ছে, ‘চল, চল, বসুন্ধরায় চল। শীতের কাপড় কিন্না আনি।’ আমি আর রাসেল রাজি না। শোয়েব রাজি হয়ে গেলো। ওর জ্যাকেটটার নাকি অনেক বয়স হয়ে গেছে। এবার বদলানো দরকার। রাতের মধ্যেই দু’জনে নতুন পুলওভার আর জ্যাকেট কিনে হাজির। সেটা গায়ে দিয়ে আমরা সবাই দল বেঁধে রাতের বেলায় আরেফিনের বিয়ের দাওয়াতে গেলাম।

এ বছর আমাদের ব্যাচে আবার বিয়ের ধুম পড়েছে। কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট দেখা গেলো একজন ফোন করে বলে দিচ্ছে ‘ওই , এতো তারিখ বিয়া করতেছি, অমুক জায়গায় চইলা আসিস।’ এই করতে করতে শুধুমাত্র এ বছরেই সাত জন মাথায় টোপর পড়ে ফেললো। আমরা অভাগা ব্যাচেলরের দল সেজেগুজে সেই সব বিয়ের সকল প্রোগ্রাম এটেন্ড করি আর বাসার ফিরে কার শ্যালিকার সাথে কার সিস্টেম দেয়া যায় সেই গল্প করি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সিনেমায় নায়কের বন্ধুর বিয়েতে নায়িকার সাথে পরিচয় হয়ে শেষমেষ প্রেম-বিয়ে হয়ে যায় এমন কতো দেখেছি। আফসোস, জিন্দেগীডা ফিল্মের লাহান হইলো না (কপিরাইট- সাইফ)।

আরেফিনের বিয়ের গেটে বেশ চিল্লা-ফাল্লা হলো। পাত্রীপক্ষ গেট ধরেছে। পার হতে হলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। আমরা পাঁচশ টাকা থেকে দামাদামি শুরু করলাম। এসব কাজে জাকারিরা আবার একেবারে এক্সপার্ট। নিজের বিয়ের গেটে ও বেশ ভালো ছোলানি খেয়েছিলো। সেই জ্বালা এখনো যায় নাই। সেটা মেটাতেই ও আমাদের সবাইকে নিয়ে আরেফিনের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ চড়া গলায় পাত্রী পক্ষের সবার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো। ‘পঞ্চাশ হাজার টাকা !! মামা বাড়ির আবদার নাকি? পাঁচশ টাকার এক পয়সা বেশি দিমু না।’ পাশ থেকে শোয়েব ওকে গিয়ার দিচ্ছে , ‘আচ্ছা যান আরো একশ টাকা বাড়াইয়া দিলাম, ছয়শ।’ ও পাশ থেকে পাত্রীর বান্ধবী আর ছোটো বোনেরা খোঁচাচ্ছে, ‘দুলাভাই কিপটুস, দুলাভাই ফকির।’ এর মধ্যে বেশ ক’জন দেখতে শুনতে একটু সিনেমার নায়িকার মতো। তাদেরই একজন জাকারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দিয়ে দেন না ভাইয়া, একটু বেশি টাকা দিলে কি এমন ক্ষতি?’ নায়িকার চাহনিতে মনে হয় কিছু একটা ছিলো। জাকারিয়া একলাফে দশ হাজারে চলে গেলো। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার শাটার টিপছি। শেষমেষ কতোতে আপোস হলো বুঝতে পারলাম না। তবে শোয়েব কে দেখলাম জাকারিয়াকে বেশ ঝাড়ি দিচ্ছে, ‘কি মামা? এট্টু সুন্দর কইরা কথা বললো আর তুই গইলা গেলি? আমি একশ কইরা বাড়াইতেছিলাম তুই একলাফে দশ হাজার গেলিগা।’
‘দেখ, আমি বিবাহিত মানুষ আমার নামে উলটা পালটা কথা কইবি না।’
এইসব হাঙ্কি পাঙ্কির মাঝে আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরেফিনের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। করমর্দন করার সময় মাসুদ আরেফিনের হাত ধরে ‘মামা তুমি তো জিনিস একটা, এক্কেরে কড়া শীতের মধ্যে বিয়া করতেছো, হা হা হা।’ বলে ইঙ্গিতপুর্ণ ভাবে আমাদের দিকে তাকালো। আর আমরা সবাই শীতে বিয়ের উপকারিতা নিয়ে আরো একদফা গভীর আলোচনা করতে করতে বাসায় ফিরে এলাম।

বাসায় ফিরে আসর জমিয়ে আড্ডা চললো অনেক রাত পর্যন্ত। কলেজের শীত থেকে শুরু করে সামনের নির্বাচন কোন কিছু আড্ডা থেকে বাদ যায়নি। হুইস্কির বোতল খোলার পর লেপ মুড়ি দিয়ে আড্ডা আরো জমলো। উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে কৃষি না শিল্প কোনটায় বেশি মনোযোগ দিতে হবে সেই নিয়ে বিতর্ক পৌছে গেলো চরমে। শেষ-মেষ কোনো সিদ্বান্তে পৌছানো যাবে না বুঝে আমি আর শোয়েব এসে বসলাম সিনেমা দেখতে।

রায়হানের কাছ থেকে কিছু ছবি এনেছিলাম দেখার জন্য। তার একটা চালালাম। নো বডি নোজ (nobody knows) জাপানী ছবি। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চারজন একেবারে অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী ছেলেমেয়ের কি দারুন অভিনয়। পরিচালক হিরোকাযু কোরিদা (Hirokazu Koreeda) দারুন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে ছবির প্রায় সব বিভাগে। সিনেমাটোগ্রাফী , শট ডিভিশন, আবহ সঙ্গীত সব কিছু চমৎকার। এক কথায় মাস্টারপিস। ছবি শেষ করে imdb তে রিভিউ পড়তে গিয়ে দেখলাম এটা সত্য ঘটনা। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আসল ঘটনাটা যাদের জীবনে ঘটেছে তাদের জন্য খুবই দুঃখ লাগছে। আমার ধারনা আপনারা কেউ দেখলে আমার মতো আপনাদেরও মন খারাপ হয়ে যাবে। একটুও না ভেবে সবাইকে দেখতে সাজেস্ট করছি।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো সিসিবিতে বেশ কিছুদিন কিছু লিখি না। কিছুই মাথায় আসছে না দেখে পোস্ট এডিটর খুলে যা ইচ্ছে তাই লিখতে বসে গেলাম। হুইস্কির নেশা এখনো আছে কিনা বুঝতে পারছি না। তাই কি লিখছি নিজেই জানি না। খুব বেশি এলোমেলো হয়ে গেলো কি? আর হলেই বা কি ক্ষতি। সিসিবি আমার নিজের বাড়ি। এখানে আমি এলোমেলো হতেই পারি।

৪,৩৮৪ বার দেখা হয়েছে

৫৭ টি মন্তব্য : “আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই-২”

  1. এহসান (৮৯-৯৫)

    কামরুল ভাল লেখা কিনা জানি না কিন্তু সহজ লেখা। আমি সহজ সাদাসিধে লেখা পছন্দ করি। জাফর স্যার সাদাসিধে কথা লিখে কিন্তু ওইগুলাতে hypocracy মিশানো থাকে। তোমার লেখায় hypocracy নাই। আর আউলা অথবা এলোমেলো লেখার জন্যই তো ব্লগ নাইলে তো পেঙ্গুইন থেকে বই পাবলিশ করতে হবে।

    জবাব দিন
  2. নতুন জামা কাপড় কিনতে আমার খুব আলসেমি লাগে। কেনাকাটায় আমি খুব খারাপ। পছন্দ আর দামাদামি কিছুই ঠিক মতো করতে পারি না।

    আমারও এই অবস্থা। তবে কামরুল ভাই, আমাদের কপাল মন্দ আছে, কারণ মাথায় টোপর পরার পর কিন্তু এই আলসেমি আর চলবো না।। কী কন?

    জবাব দিন
    • তাই নাকি ? চলবো না নাকি? 😉 তুমি অলরেডি জাইনা ফেলছো? :bash:
      এক কাম করো তুমি আগে টোপর পইড়া দেখো তো কি অবস্থা? কপাল ভালো হইলে গ্রীন সিগন্যাল দিও। :hatsoff:

      জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    লেখা ভালো ছিল বস 😀


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. তারেক (৯৪ - ০০)

    কস্কি মমীন!
    ২০ শুনে কঠিন লোভ হইতেছে। এইখানে ২০ হইলে ব্যাপক আরাম লাগে, চোখেরও আরাম হয়, রাস্তাঘাটের মাইয়াগো দেখলে মনে হয়, জামা-কাপড় আবিষ্কার এখনও অন দ্য প্রসেসে আছে, পুরাপুরি হইয়া সারে নাই। 😛
    *
    জাকারিয়ার কাহিনি তো ভাল লাগলো না। ওরে কইস এইবার যেন রিটায়ার্ড করে, তোরে বা শোয়েবরে যেন একটু চান্স দেয় মাঝে মাঝে। 😉
    *
    সুমি আপুর বিয়েতে তোর সেই টু-পিস থ্রি-পিস এর কাহিনি মনে আছে রে? ঐটা লিখে ফেল এইখানে। :clap:
    *
    এই আউলা ঝাউলা লেখাটাই খুব ভাল লাগলো। কদিন ধরেও আমিও খুব আউলে ঝাউলা আছি।
    এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমারো শীতবস্ত্র কেনা দরকার...কিন্তু দোকানে যাবার কথা ভাবলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়...তখন আর শীতবস্ত্র প্রয়োজন পড়ে না... 😀

    এর মধ্যে বেশ ক’জন দেখতে শুনতে একটু সিনেমার নায়িকার মতো
    আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার শাটার টিপছি

    কামরুল ভাই, আরেফিন ভাইয়ের বিয়ার ছবি দেখব... 😉


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    এইখানে ২০ হইলে ব্যাপক আরাম লাগে, চোখেরও আরাম হয়, রাস্তাঘাটের মাইয়াগো দেখলে মনে হয়, জামা-কাপড় আবিষ্কার এখনও অন দ্য প্রসেসে আছে, পুরাপুরি হইয়া সারে নাই।

    ওরে দুষ্টু,
    আর কত চোখের আরাম কইরা বেড়াইবা?
    এইবার একটু নজরের হেফাযত করলে হয়না?...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  7. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    অফটপিক@কামরুল,

    আগেও কোন একটা পোস্টে যেন জিজ্ঞেস করসিলাম, "প্রজাপতিকাল" কি তোমার নাটক?
    কালকেও কামরুলতপুর সাথে এইটা নিয়া কথা বলতেসিলাম...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
    • আমার দেখা ছিলো না।
      আজকাল টিভি দেখি না খুব একটা। পরিচিত কেউ কাজ করলে বা কেউ ফোন করে তার কাজ দেখতে বললে দেখা হয়।
      এখন মনে হচ্ছে সময় করে প্রজাপতিকাল দেখে ফেলতে হবে।

      রিভিঊটা ভালো লিখেছিস। আমি তো কাজ করতে গেলে এতো কিছু মাথায়ই রাখতে পারিনা। 😀 😀

      জবাব দিন
      • সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
        তয় ভালো হইলে কন, আমার নামে চালাইয়া দেই 😉

        কামরুল,
        অসুবিধা নাই...আমি অলরেডি "আমার ছোট ভাইয়ের নাটক" বইলা অনেক জায়গায় এইটা চালায় দিসি 😛
        আমি সিউর, তোমার কাজগুলা এইটার চেয়েও পাংখা হবে :thumbup:

        কনফু,
        আমি তোমার পোস্টটা দেখসি...রিভিউটা অসাধারণ হইসে...একদম যেন মনের কথাগুলাই লিখসো...


        "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
        আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।