আমার বন্ধুয়া বিহনে-৩

আমার বন্ধুয়া বিহনে-২
ক্লাস সেভেনে কলেজে জয়েন করার কিছুদিন পর আমরা প্রথম যে আন্ত-হাউজ প্রতিযোগিতা পেয়েছিলাম সেটা ছিলো ফুটবল। এবং সেখানে আমাদের ব্যাচের রুম্মান জুনিয়র গ্রুপের সেরা ফুটবলার। জুনিয়র গ্রুপ মানে সেভেন থেকে নাইন। সেখানে সেরা প্লেয়ার সব সময় ক্লাস নাইন থেকে হয় সেটা বাকি কলেজ জীবনের পুরোটা সময় দেখে এসেছি। কিন্তু সেই প্রথম (এবং সম্ভবত শেষ) ক্লাস সেভেনে নতুন গিয়েই কেউ সেরা ফুটবলার হয়ে গেলো।
আমাদের হাউজ মাস্টার এম.এইচ.মাহবুব স্যার যতোটা না অবাক হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম আমরা এবং সত্যি কথা বললে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিয়াল আমি। হবো নাইবা কেনো! আর কেউ না জানুক আমারতো জানা উচিত ছিল। কারন আমি তখন রুম্মানের রুমমেট। ও যে এতো ভালো ফুটবল খেলে এটা ফুটবল কম্পিটিশন না হলে বুঝতেই পারতাম না। কি ড্রিবলিং, কি পাস আর প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ছাড়িয়ে কি দারুন বেরিয়ে যাওয়া। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিলো সেরা ফুটবলারের খেতাব একমাত্র ওকেই মানায়। গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠলো। আমাদের চেয়ে আমাদের ফর্ম মাস্টার পি.কে রায় স্যার এক ডিগ্রী উপরে। শত দোষের মধ্যেও তার একটা গুন ছিলো নিজের ফর্মের ক্যাডেটদের নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছাস। উনি সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন ‘আমি অনেক আগেই জানতাম রুম্মান বেস্ট ফুটবলার হবে। কার ফর্মের ছেলে দেখতে হবে না?’ উনি অনেক আগেই কিভাবে জানতেন সেটা অনেক পরেও আমরা জানতে পারিনি। আমরা শুধু আশায় বুক বাঁধলাম। এরকম ফুটবলার থাকলে আমাদের হাউজ তো প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন হবে। আমাদের আর ঠেকায় কে?

এবং সবার আশায় গুড়েবালি দিয়ে রুম্মান ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দিলো মানে একেবারে ছেড়েই দিলো। তারপর আর কোনদিন গেমস টাইমে রুম্মান ফুটবল মাঠে গিয়েছে কিনা আমরা মনে করতে পারি না। হাউজ টিমে অনেক জোরাজোরি করেও খেলানো যায়নি। আন্ত-ক্যাডেট কলেজ ফুটবল মিট ‘৯৯-এ আমাদের ব্যাচের যে দলটা রানার্স-আপ হয়েছিলো সেখানেও রুম্মান নামের কেউ ছিলো না। ও কেন ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছিল সেটা আজো আমরা কেউই জানি না। শুধু এটুকু জানি এমন করে ফুটবল ছেড়ে ছুঁড়ে দেয়া এক মাত্র রুম্মানকেই মানায়।

*** *** *** *** ***

ক্লাস সেভেনে রুম্মানের কঠোর সঙ্কল্প ছিল ও কোনদিন সিগারেট ছুয়েও দেখবে না। ‘ওই জিনিস মাইনষে খায় নাকি? হুদাই ফুসফুসের ক্ষতি করা। ভুলেও এই অভ্যাস করিস না’ -সিগারেট প্রসংগ উঠলে ও এইভাবে সবাইকে হুশিয়ারি দিতো। আমরা কেউই তখনো সিগারেট ধরিনি। কিন্তু মনে মনে যারা সুযোগ পাওয়া মাত্র ধরে ফেলার বাহানা খুজতাম, তারা রুম্মানের এই হুশিয়ারি শুনে একটু দমে যেতাম। কোনদিন ধরে ফেললেও যে রুম্মানের কাছ থেকে সতর্ক থাকতে হবে সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ ছিলো না।

তারপর অনেক দিবস রজনী গত হয়েছে। কাঁধের এপ্যুলেটে একটা একটা করে দাগ বেড়ে চারটা হয়েছে। এবং ততোদিনে সিগারেট সহ টুক-টাক আরো অনেক কিছুই ধরে ফেলেছি, কিন্তু সেই অপকর্ম করার সময় রুম্মানের কাছ থেকে পালিয়ে থাকি। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে কে আর ঝাড়ি খেতে চায়। তেমনি একদিন বিকেলে গেমস থেকে ফিরে সিগারেট নিয়ে বাথরুমে গেলাম টানার জন্যে। হায় হায়, দেখি আয়েশ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে রুম্মান সিগারেট টানছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
কিরে তুই সিগারেট খাচ্ছিস?
হুম, তো কি হইছে
না কিছু হয় নাই, কিন্তু তুই না বলছিলি, কোনদিন সিগারেট ধরবি না?
যা! আমি আবার কখন বলছিলাম, এই সব ফালতু কথা রুম্মান বলে না
আরে মুশকিল! তুই না বলতি সিগারেট খাইলে ফুসফুসের ক্ষতি হয়?
আরে ধুর, সিগারেট খেয়ে আবার কেউ মরে নাকি? আর এতো বড় হইছি এখন সিগারেট না খাইলে খামু কি?
আমি মাথা ঝাকালাম।
‘হুম, ঠিক বলছিস।’ তারপর ও আমার দিকে আধাটানা সিগারেটটা বাড়িয়ে দিলো। ‘নে ধর, টান দে।’ আমি ওর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আয়েশ করে টান দিলাম। ও আমাকে বললো “এই যে টান দিলি এইটা রে কি বলে জানোস?
না জানিনা
আরে গাধা, এরে কয় সুখটান।

আমি ফিক করে হেসে দেই। সিগারেটে সুখটান দেই আর ভাবি, এমন করে সিগারেট ধরে ফেলা একমাত্র রুম্মানকেই মানায়।

**** *** *** *** ***

হাউজ মাস্টারস ইন্সপেকশন। আমরা রুমের সব ময়লা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করছি। স্যার-ম্যাডামরা এসে বারবার তাড়া দিচ্ছেন। জলদি করো, জলদি কর। শুধু রুম্মান ঝাড়া-মুছা বাদ দিয়ে খালি গায়ে তোয়ালে পড়ে গান গাইছে, ‘নিঃস্ব করেছো আমায় কি নিঠূর ছলনায়………’ (মাইলসের এই গানটা রুম্মানের খুব প্রিয় ছিলো)।সিতারা ম্যাডাম রাউন্ড দিচ্ছিলেন। তার নজরে পড়লো, একটা ছেলে ইন্সপেকশনের কাজ বাদ দিয়ে গান গাইছে। উনি রুমে ঢুকে বললেন,
রুম্মান ঝাড়া-মুছা বাদ দিয়ে গান গাইছো কেনো?
কই ম্যাডাম, আমি গান গাইছি না তো।
আমি তো শুনলাম তুমি গুনগুন করতেছো
আমি গুনগুন করবো কেন ম্যাডাম, আমি কি মৌমাছি নাকি?

বলে রুম্মান আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। পাশে দাঁড়িয়ে আমি ভ্যাক করে হেসে দিলাম। ভাবগতিক সুবিধার না দেখে ম্যাডাম তাড়াতাড়ি অন্যদিকে হাঁটা দিলেন। রুম্মান আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দোস্ত কেমন সিস্টেম দিলাম দেখলি? আমার সাথে পাকনামি !!

আমি তখনো ম্যাডামের অপ্রস্তুত চেহারা দেখছি আর ভাবছি, এমন করে সিস্টেম দেয়া একমাত্র রুম্মানকেই মানায়।

*** *** *** *** *** *** ***

বহুদিন পরের কথা।
বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই তখন চুটিয়ে প্রেম করছে। এর মধ্যে দু-একজন আবার ধুম-ধাম বিয়েও করে ফেললো। আমরা কতিপয় অভাগা বিরস মুখে তাদের সাথে বসে তাদের বিড়াল মারার গল্প শুনি আর নিজের মাথার চুল ছিঁড়ি। এমনি এক আসরে একদিন এই কথা সেই কথার পরে রুম্মান বলে বসলো, ‘যতো যাই বলো মামা, আমি কোনদিন শহরের মেয়ে বিয়া করুম না।’
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, ‘ক্যান ,শহরের মেয়ের সমস্যা কি?’
ভাই, এরা খুব জটিল হয় রে ভাই। খালি সারাক্ষন প্রেম ভালোবাসার কথা কইতে হয়।
তাতো হবেই, বউরে ভালোবাসার কথা না কইলে কারে কইবি?
আরে, বাসর রাইতে তো তাইলে প্রেম-ভালোবাসার কথা কইতে কইতেই রাত ভোর হইয়া যাবে? বিড়াল কখন মারুম?
তাইতো!! তাইলে কি করা যায় বলতো?
মামা, বিয়া করতে হইবো গ্রামের মেয়ে দেইখা, পিঠে হাত দিলেই বুঝবে খেলা শুরু হইতেছে।

আমরা সবাই একমত হলাম, এমন থিওরি দেয়াও একমাত্র রুম্মানকেই মানায়।

১০,৫৬৬ বার দেখা হয়েছে

১১৮ টি মন্তব্য : “আমার বন্ধুয়া বিহনে-৩”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    পিরা গেলাম এক্কেরে পিরা গেলাম =)) =)) =)) =)) =))
    রুম্মান ভাইরে :salute: :salute: :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)
    মামা, বিয়া করতে হইবো গ্রামের মেয়ে দেইখা, পিঠে হাত দিলেই বুঝবে খেলা শুরু হইতেছে।

    থিওরি পছন্দ হইছে :clap: :clap: :clap:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. রবিন (৯৪-০০/ককক)
    বিয়া করতে হইবো গ্রামের মেয়ে দেইখা, পিঠে হাত দিলেই বুঝবে খেলা শুরু হইতেছে।

    কি শুনাইলি রে। একেবারে পিরা গেলাম :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :goragori: :khekz: :khekz: :khekz:

    জবাব দিন
  4. সিরাজ (৯৪-০০)
    আমি গুনগুন করবো কেন ম্যাডাম, আমি কি মৌমাছি নাকি?

    :)) :)) :))

    amader akta valo somoy chilo HSC ar pore......suvechaa coaching thake mone ase ki vabe mithha kotha bole sob gulare nia hajir hoitam mess a.......
    rumman football charse karon or nijer mathai to akta bisal *****ball hoia gese akon....ai koste....

    জবাব দিন
  5. তাইফুর (৯২-৯৮)

    তোগো লেখা ত চ্রম হইবই ... হইছেও ... চ্রম :clap: :clap: :clap:

    ততোদিনে সিগারেট সহ টুক-টাক আরো অনেক কিছুই ধরে ফেলেছি

    টুকটাক আর কি ধরছিলিরে বাবা ??


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  6. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    এমন করে ফুটবল ছেড়ে ছুঁড়ে দেয়া এক মাত্র রুম্মানকেই মানায়।
    এমন করে সিগারেট ধরে ফেলা একমাত্র রুম্মানকেই মানায়।
    এমন থিওরি দেয়াও একমাত্র রুম্মানকেই মানায়।

    রুম্মান পুলাডারে আমার পসন্দ হইসে, লেখাও :clap: :clap: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  7. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    এই পোলা আমার আইডল, আমি সারা জীবন এইরকম হইতে চাই।

    "আমি ইচ্চা হইলেই করতে পারি, কিন্তু করুম না কারন আমার ইচ্চা হয় না"

    রুম্মানরে আমার :salute: পাঠায় দিও।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  8. তানভীর (৯৪-০০)

    কামরুল, তোর এই পর্বটা আগের দুইটার তুলনায় একটু খারাপ হইলেও ওভারঅল ভালো হইসে! তোর লেখার সাবলীলতা আগের মতই সুন্দর আছে!
    এই সুন্দর লেখাগুলার জন্য তোকে :salute:

    জবাব দিন
    • পলাশ (৯৪-০০)
      ন্যাড়া হওয়ার পর রুম্মানের চেহারায় একটা জিদান-জিদান ভাব আইসে।

      সহমত।
      সিরাজ... তোর পাঙ্গা শেষ নাকি??? বাংলায় লিখা শুরু করলি যে??? সায়েদ ভাই রে এত ভাল মত কইলাম... কিসসু করতেয়াল্লোনা...

      এই পর্বটাও ভাল হইসে। কিন্তু সমস্যা হইসে - আগের গুলা আতিরিক্ত ভাল অইয়া গেছিল।

      হককথা... :boss:

      জবাব দিন
      • যান আফনেরেও যাস্ট ফেরেন্ড বানাই দিমুনে

        সিরাজ ভুলেও ওর ফাঁদে পা দিস না।

        ধুরু এইটা কি বললাম, "ফাঁদে পাদিস না।" বললে লোকে কি না কি মনে করে। 😉 😉

        সিরাজ ভুলেও মাস্ফু'র কথায় কান দিস না। ও এর আগে আহসান ভাইরেও এই লোভ দেখাইসে। লেডি জিম থেইকা জাস্ট ফেরেন্ড জোগাড় কইরা দিবে। দেয় নাই।

        বেচারা আহসান ভাই সেই দুক্ষে সেই যে কমান্ডো করতে গেলো আর আইলো না। 😉 😉

        জবাব দিন
    • জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

      বস আমি কিন্তু আপনার দলে... O:-)
      "সিরাজ ভাই, এগিয়ে চলুন আমরা আছি আপনার পিছে..." B-)
      নাহ্‌, পিছনে থাকাটা ঠিক হবে না...কলি-কাল! লোকে খারাপ ভাবতে পারে... :-B

      সো কারেকশন,

      'আমরা আছি আপনার আশে-পাশে...' 🙂


      ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

      জবাব দিন
  9. সিরাজ (৯৪-০০)
    সিরাজ ভাই, এগিয়ে চলুন আমরা আছি আপনার পিছে…”
    নাহ্‌, পিছনে থাকাটা ঠিক হবে না…কলি-কাল! লোকে খারাপ ভাবতে পারে…

    :goragori: :goragori: :goragori:

    সবাই একটা লিস্ট করো...।কারে কারে :frontroll: :frontroll: আর :chup: :chup: পাঙ্গামু...।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পলাশ (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।