ভারী জীবনের ভারবাহী কিছু মানুষের কথা…..

দিনটি ছিল শনিবার, ১১ জুন ২০২২। ড্যান্ডিনং স্টেশনে নেমে আমরা অন্য লাইনের একটি ট্রেন ধরার জন্য প্ল্যাটফর্ম বদল করতে যাচ্ছিলাম। স্টেশনটি সে সময়ে মোটামুটি জনশূন্য ছিল বলা যায়। কিছুদূর এগোতেই দেখি, প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে কে যেন শুয়ে আছে। তার পাশে একজন হাটু গেঁড়ে বসে তার মাথায়, গালে পরম মমতায় হাত বুলাচ্ছে। দু’জন ইউনিফর্মধারী স্টেশন সিকিউরিটি স্টাফ উদ্বিগ্ন চেহারায় শায়িত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছে এবং মৃদু পায়চারি করছে। আরেকটু কাছে এসে দেখলাম, শায়িত ব্যক্তিটি একজন বয়স্কা মহিলা, তাকে যত্নের সাথে পরিচর্যাকারী মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি ছিল খুব সম্ভবতঃ একজন যাত্রী। মহিলার কপালের এক পাশে একটু ক্ষতের মত দেখতে পেলাম, সেখান থেকে কিছুটা রক্ত ঝরে চামড়ায় বসে গেছে বলে মনে হলো। সিকিউরিটি স্টাফ দু’জনের পারস্পরিক কথোপকথন থেকে যা বুঝলাম, মহিলা বোধকরি কোন একটি ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন, শক্ত মেঝেতে পড়ে কপালের পাশে কেটে গেছে। খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়ালাম, ইতোমধ্যে তড়িঘড়ি করে কয়েকজন পুলিশ এসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করলো। আমরা আমাদের ট্রেনের খোঁজে অন্য প্ল্যাটফর্মের উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম।

আমার অনুমান ছিল, সেই বয়স্কা মহিলার বয়স ৭৫ এর মত হবে। গিন্নীকে জিজ্ঞেস করায় সে বললো, ৮০ বছর হবে। মহিলা শ্বেতাঙ্গিনী ছিলেন, সামান্য স্থূলদেহী, তবে বেশ লম্বা। গাল দুটো ফোলা ফোলা ছিল, চুলগুলো কাঁচাপাকা। চোখ দুটো বন্ধ ছিল, চেহারায় ছিল নিষ্পাপ শিশুর মত সরলতা। ঘুমের মধ্যে তিনি দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিলেন। যে ভদ্রলোক তার সেবা করছিলেন, তার মুখাবয়ব এবং দেহভঙ্গী দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তার মাতৃসম অসুস্থ মহিলাটিকে একটু আরাম দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সেদিন সারাটা পথ আমি ভাবছিলাম, আহা রে! এই বয়সেও তাঁকে ট্রেনে করে একা চলতে হচ্ছে! কে জানে, এই জীবনে তাঁর আপনজন বলতে কে কে আছে! স্বামী আছে কিনা, ছেলে মেয়েরাই বা কে কোথায়! এর আগেও আমি কয়েকবার অস্ট্রেলিয়ার স্টেশনগুলোতে বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছি। অবশ্য এখানে পুলিশের সাহায্য খুব ত্বরিত পাওয়া যায়, হাসপাতালগুলোতেও জরুরি চিকিৎসাও খুব সম্ভবতঃ তাদের জন্য ফ্রী। তবুও আমার কাছে মনে হয়েছে, এসব উন্নত দেশের সমাজে বয়স্ক লোকজনদের জীবনটা ভীষণ কঠিন, ভীষণ ভারী! পথ হাঁটতে বুড়োবুড়িদেরকে প্রায়ই দেখি, তাঁদের অন্যতম বিশ্বস্ত (কারো কারো জন্য একমাত্র) সঙ্গীঁ কুকুরটিকে হাঁটানোর জন্য হাঁটতে বের হয়েছেন। পোষা কুকুরের সাথে আনমনে কথা বলে তাঁদের দিন কাটে; কোন মানুষকে যদি শ্রোতা হিসেবে পান, কথার ডালি খুলে বসেন।

এখানে পথ চলতে চলতে এক বয়স্কা শ্রীলঙ্কান মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছে। আমাদের বাসার কাছেই তার বাসা, তাই হাঁটার পথে বেশ কয়েকদিনই দেখা হয়েছে, সেই সাথে পথে দাঁড়িয়েই টুকটাক কথাবার্তা। উনি প্রায়শঃ একাই হাঁটেন, এই বয়সে যা বিপজ্জনক। হাঁটাটা বিপজ্জনক নয়, কোন কিছু হলে নির্জন পথে পড়ে থাকবেন, এটাই একটা বিপজ্জনক সম্ভাবনা। আমাদের ছেলে তাই প্রথম দিনই আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিল, “তোমরা কখনোই একটু হাঁটার জন্যে হলেও একা ঘরের বাইরে বের হবা না। যখনই যাও, দু’জন একসাথে যাবা”। মহিলার চেহারায় একটা দুঃখী ভাব, কিন্তু কথায় সেটা সহজে প্রকাশ পায় না। জীবন যখন ভারী বোধ হয়, তখন সেটাকে মানুষ শুধু বয়সের কারণেই ভারী বোধ করে না, জীবনের ঐ পথটুকু বেয়ে চলতে চলতে পাওয়া নানা রকমের দুঃখ বেদনার অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনের ভারকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। মহিলা ধর্মে হিন্দু, এক ছেলে আর এক মেয়েসহ তিনি নিজ ধর্ম-কর্ম পালন করেই এখানে বসবাস করছেন। একদিন পথে দেখা হলো আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে; আমরা যাচ্ছি, তিনি ফিরছেন। তার হাতের একটি স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগে দেখতে পেলাম সামান্য কিছু ফুল। তিনি জানালেন, ফুল কেনার জন্যই তিনি অদূরে একটি বিক্রয়স্থলে গিয়েছিলেন। দেখে মনে হলো, হয়তো আহ্নিক পূজোর নৈবদ্য হিসেবেই তিনি ফুলগুলো কিনেছিলেন। সেদিন তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার পরলোকগত স্বামীর কথা পাড়লেন।

তার স্বামী ২০২০ এ কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার দুঃখ, মারা যাওয়ার সময় তিনি তার স্বামীর সেবাযত্ন করতে পারেন নি, কারণ হাসপাতালে করোনাক্রান্ত রোগীদের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ ছিল। এমন কি মারা যাওয়ার পরেও তিনি তার স্বামীর মৃতদেহ সৎকারে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা, তার মৃত মুখটিও দেখতে পারেন নি, কারণ সে সময়ে কর্তৃপক্ষের আয়োজনেই করোনায় মারা যাওয়া রোগীদের মৃতদেহ সৎকার করা হতো। সেখানে পরিবারের কোন ভূমিকা থাকতো না। পরিবারকে শুধু জানানো হতো, ব্যস এটুকুই যথেষ্ট ছিল। তার ছেলে একজন মালয়েশীয় খৃষ্টান মহিলাকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। মেয়েটার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না, এ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। ঘরে তিনজন মানুষ থাকে, তিন জনই একা একা!

সেদিন একটা ফুডকোর্টে আমরা কিছু হাল্কা লাঞ্চ কিনে বসার জায়গা খুঁজছিলাম। একটা টেবিলে দেখলাম বয়স্ক এক জোড়া দম্পতি বসে কিছু খাচ্ছেন। মহিলাটি আমার গিন্নীকে তাদের টেবিলে বসার জন্য ইশারা করলে আমরা সেখানেই বসে পড়লাম। সৌজন্য বিনিময়ের পর আমরা খাওয়া শুরু করলাম, একটু পরেই তাদের খাওয়া শেষ হলো। পুরুষটি বেশ বয়স্ক, বুড়ো বলা যায়। মহিলাটিকে বুড়ি না বললেও নিঃসন্দেহে প্রৌঢ়া বলা যায়। একটু পরে আমাদেরকে দেখিয়ে মহিলাটি লোকটিকে বললেন, ‘তুমি এঁদের সাথে বসে একটু গল্প করো, আমি ততক্ষণে একটু সওদা করে আসি’। এই বলে তিনি একটা ব্যাগ হাতে চলে গেলেন। বুড়ো ভদ্রলোকের সাথে কথা পাড়লাম। কথায় কথায় তিনি জানালেন, তিনি একজন ক্যাথলিক খৃষ্টান, আদি নিবাস হল্যান্ডে। গত প্রায় ৩৫ বছর ধরে স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। সাথের মহিলা একজন পাকিস্তানি, তিনিও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী। ষাটের দশকে তিনি পাকিস্তানে একজন খৃষ্টান ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করেছেন, সেখানে থাকা কালেই তাদের বিয়ে হবার পর সত্তরের প্রথম দিকে পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসেন। তিনি জানালেন, তার বয়স এখন ৮৭ বছর। তার স্ত্রী এখনও মোনাশ ইউনিতে কাজ করছেন। আন্দাজে মনে হলো, তার স্ত্রী তার চেয়ে অন্ততঃ ২০ বছর কনিষ্ঠ হবেন। ভদ্রলোকের সাথে সেদিন অনেকক্ষণ কথা হলো। তিনি এখনও থিওলজি এবং ফিলোসফির উপর পড়াশোনা করেন। জীবনের প্রচুর অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে সঞ্চিত। তিনি বলে গেছেন, আমি শুনে গেছি। সেসব নিয়ে হয়তো আরেকদিন কিছু লিখবো।

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৮ জুন ২০২২

৫৫৪ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ভারী জীবনের ভারবাহী কিছু মানুষের কথা…..”

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।