মেলবোর্নের দিনলিপি – ৬ঃ মাউন্ট ড্যান্ডিনং রেঞ্জে এক পড়ন্ত বিকেলে

এর আগের পর্বটি দেখতে পাবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপি – ৫ঃ নতুন বছরের (২০২০) প্রথম কয়েকটা দিন

প্রতি বছরের জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসের প্রথম শুক্রবারে ব্রাইটন বীচের বেলাভূমি সংলগ্ন ভূমিতে খোলা আকাশের নীচে “Soul Night Market” এর আয়োজন করা হয়। Night Market বা “নৈশ বাজার” কেবল নামেই, আসলে এটা শুরু হয় মধ্যাহ্নের পর পরই, শেষ হয় সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। অনেকটা আমাদের গ্রামীন সাপ্তাহিক হাটের মত, একথা উল্লেখ করে এ বীচ ও বাজার সম্পর্কে এর আগের পর্বে কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম। এ বছরের প্রথম শুক্রবারটিতে (০৩ জানুয়ারী ২০২০) আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, মূলতঃ সাগর সৈকতে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াবার জন্য, “নৈশ বাজার” সম্পর্কে কোন কিছু না জেনেই। এ বীচ এবং বাজার, উভয়টিই সারমেয় বান্ধব। মেলবোর্নের সব বীচে, লেইকে কিংবা সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অরণ্যে কুকুর নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু এ বীচে সারমেয়কূলকে সগর্বে স্বাগত জানানো হয়েছে, যা বিজ্ঞপ্তির দ্বারা প্রবেশ পথের নোটিশ বোর্ডে এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে ঘোষিত হয়েছে।

১৮৫৩ সালের ৩০শে জানুয়ারী Henry Burn নামের ৪৩ বছর বয়সী একজন ব্রিটিশ লিথোগ্রাফার লিভারপুল থেকে সাগর পথ পাড়ি দিয়ে মেলবোর্নে এসে পৌঁছেন। তিনি এর আগে ইংল্যান্ডে Architectural Draughtsman বা স্থাপত্য নক্সাবিদ হিসেবে জীবিকা অর্জন করতেন। মেলবোর্নে পৌঁছার পর এই ব্রাইটনেই তিনি বসতি গড়েন এবং এখানে বসে বসে তিনি মেলবোর্নের সমুদ্রতীর ও তটরেখার ছবি আঁকতেন। বীচের যে অংশে বসে তিনি ছবি আঁকতেন, ১৮৬২ সালে তাঁর সম্মানে সে অংশটির নাম Henry Burn Brighton Beach রাখা হয়। তার আঁকা একটি ছবি আজও সেখানে শোভা পাচ্ছে।

০৬ জানুয়ারী ২০২০, আজ সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। ফযরের নামায পড়ে ব্যালকনিতে বের হয়ে বুঝলাম, আকাশ এত মেঘাচ্ছন্ন যতটা না জলীয় বাষ্পভরা মেঘের কারণে, তার চেয়ে বেশী অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সঞ্চারমান দাবানলের কারণে। বাতাসে বাতাসে ধোঁয়াগুলো ভেসে ভেসে অনেক দূর পর্যন্ত এসেছে। বাতাসে পোড়া পোড়া গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে এটাও মনে হলো যে শেষ রাতের দিকে কিছুটা হাল্কা বৃষ্টিপাত হয়েছে। আজ আরমানের (ছেলে) ডিউটি ভোর ছয়টা থেকে শুরু হবে, তাই সে খুব ভোরে উঠে এই শীতের মধ্যেই চলে গেল। ০৭ তারিখ বিকেলে হাঁটাহাঁটির সময় পথের আশে পাশে ফুটে থাকা বিভিন্ন কিছু ফুলের ছবি তুললাম। ০৮ তারিখ রাতে “বাওয়ার্চি” রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে একসাথে ডিনার করলাম। ০৯ তারিখে বিকেল তিনটায় রওনা হলাম “ড্যান্ডিনং রেঞ্জ” এর উদ্দেশ্যে। রেঞ্জটি মেলবোর্ন থেকে ৩৫ কিমি পূর্বে অবস্থিত, যেটি স্বল্প উচ্চতাসম্পন্ন কিছু পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। সর্বোচ্চ পাহাড়টির উচ্চতা ৬৩৩ ফুট, গাড়ী নিয়ে অনায়াসে যাওয়া যায়। সেখানে আগ্নেয়, পাললিক ও রূপান্তরিত-সব ধরনের শিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ১৯৭০-৮০ এর দশকে এটি মেলবোর্নের একটি অন্যতম পর্যটক আকর্ষক কেন্দ্র ছিল। ১৯৯০ সালে এলাকাটির সংস্কার সাধন করা হয়, কিন্তু সংস্কারের পর রেঞ্জে নির্মিত স্থাপনা এবং ল্যান্ডস্কেপ পর্যটকদের কাছে মোটেই দৃষ্টিনন্দন মনে না হওয়াতে সেখান থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেন। ধীরে ধীরে রেঞ্জটি পরিত্যাক্ত হতে থাকে, এবং ১৯৯৭ সালে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর, ২০০৪ সালে “পার্কস ভিক্টোরিয়া” এর সাথে এক চুক্তিবলে ৩৫ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান ডলার খরচ করে পুনঃসংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়, যা ঐ বছরেরই ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হয়। মাউন্ট ড্যান্ডিনং এর চূড়ায় “স্কাই হাই” নামে একটি আধুনিক রেস্টুরেন্ট স্থাপন করা হয়, যার ব্যালকনি থেকে মেলবোর্নের চারিদিকের খুব সুন্দর ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করা যায়। পর্যটক এবং প্রকৃতি প্রেমিকদের স্বল্পকালীন অবস্থানের জন্য সেখানে কিছু “স্কাই হাই এপার্টমেন্ট” এর ব্যবস্থাও রয়েছে। এখন যেখানে স্কাই হাই রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত, সে স্থানটিই ১৮৬১ সাল থেকে (সর্বোচ্চ হবার কারণে) মেলবোর্নের ভূ-জরিপ কেন্দ্র (survey point) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সংস্কারের পর ২০০৪ সাল থেকে এর নাম “Mount Dandenong Observatory” পরিবর্তন করে আনুষ্ঠানিকভাবে “SkyHigh Mount Dandenong” রাখা হয়।

সংস্কারের অংশ হিসেবে নতুনভাবে ল্যান্ডস্কেপ করা এলাকাটির আশেপাশে প্রচুর গাছপালা রোপন করা হয়। ছোট ছোট কিছু কৃত্রিম ঝর্না সৃষ্টি করা হয়, পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার জন্য কিছু পাথর বিছানো, আঁকাবাঁকা পথ তৈরী করা হয়। নতুন এ উদ্যানটির নাম রাখা হয় “ইংলিশ গার্ডেন”। সেখানকার টেরাসে কিছু বাইনোকুলার রাখা আছে, যার ভেতর দিয়ে পর্যটকগণ দূর দূরান্তে দৃষ্টি মেলাতে পারেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সেটা দিয়ে সুদূর পোর্ট ফিলিপ এর সৈকত ও তটরেখা দেখা যায়। ‘স্কাই হাই’ এর প্রবেশ পথে কাঠের একটি “জায়ান্ট’স চেয়ার” রাখা আছে। কথিত আছে, বহু শতক ধরে Igor নামের এক ‘জায়ান্ট’ (সে মানুষ না পক্ষী সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই) এর প্রিয় জায়গা ছিল এটি। সর্বোচ্চ এ স্থানটিতে এসে বসে থাকা এবং চারিদিকের দৃশ্য দেখা সেই Igor এর অন্যতম পছন্দের কাজ ছিল। তাই কর্তৃপক্ষ তার জন্য এই বিরাট চেয়ারটি তৈরী করে রেখেছেন। কিছুটা কৌতুকের সাথে তারা একটি সাইনপোস্টে লিখেছেন, পর্যটকরা সেখানে ইচ্ছেমত বসতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, তবে যদি কখনো Igor সেখানে ফিরে আসে, তখন অবশ্যই তার সম্মানে তাদেরকে সে চেয়ারটি ছেড়ে দিতে হবে!

The Australiana Tree নামে এলাকাটিতে একসময় প্রচুর ইউক্যালিপ্টাস প্রজাতির গাম জাতীয় সুউচ্চ বৃক্ষরাজি ছিল। ২০০৬ সালে বজ্রাহত হয়ে বেশীরভাগ গাছ মরে যায়। লী রয় কঙ্কী নামের এক অস্ট্রেলীয় কাঠ শিল্পী ৮ মিটার উচ্চ গাছের ওপর থেকে ৩ মিটার কেটে ফেলে কর্তিত অংশটুকু দিয়ে পর্যটকদের জন্য আসনের ব্যবস্থা করেন এবং বাকী অংশে “টোটেম পোল স্টাইল” এ খোদাই করে একটি কাঠ-ভাস্কর্য তৈরী করেন। ২০০৬ সালের মে মাসে তিনি এ কাজটি সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া প্রাচীন বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে উদ্যানটিতে কিছু সাইনপোস্ট দেখা যায়, যেমন দ্য উইশিং ট্রী, দ্য উইশিং ওয়েল ইত্যাদি। কথিত আছে যে ঘন বৃক্ষে আচ্ছাদিত এ অঞ্চলটিতে একদিন বিলি লংটন নামে এক চার বছরের বালক খেলতে খেলতে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার শোকাহত পিতা তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে এ গাছটির গোড়ায় এসে ‘উইশ’ করে, সে যেন তার ছেলেকে খুঁজে পায়। কিছুক্ষণ পর গাছটির এক বৃত্তাকার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পায়, তার ছেলে বিলি অদূরের creek সংলগ্ন মাটিতে বসে আছে। সেই থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে এ গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কোন কিছু ‘উইশ’ করলে তা পাওয়া যায়। এটা অবশ্য খুব বেশীদিন আগের কথা নয়, ১৯০০ সালের কথা।

একইভাবে সেখানে রয়েছে একটি ‘উইশিং ওয়েল’, যার পানি মানুষ একই বিশ্বাসে পান করতো বলে জানা যায়। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফিরে আসি।

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৭ মার্চ, ২০২০


“Stood for a picture with a stone sculpture,
Of a loving mother embracing her child,
Hard stone that evoked soft feelings of love!”

টেরাসে রাখা এসব বাইনোকুলার দিয়ে পর্যটকগণ দূর দূরান্তে দৃষ্টি মেলাতে পারেন

উইশিং ট্রী

হাঁটার পথে দেখা ফুল

মেলবোর্নের ড্যান্ডিনং রেন্জের “স্কাই হাই ইংলিশ গার্ডেন” এ ঘুরে বেড়ানোর সময় কঠিন বাস্তবতার মাঝে মুখে হাসি ধরে থাকা এই নিঃসঙ্গ ফুলটি আমার চোখে পড়ে।


হাঁটার পথে দেখা অস্ট্রেলীয় ম্যাগপাই

ভাবুকদের জন্য এক আদর্শ জায়গা

“উইশিং ওয়েল”

অস্ট্রেলীয় কাঠ শিল্পী [sb]লী রয় কঙ্কী[/sb] এর কাঠ-ভাস্কর্য, বিবরণ পোস্টে।


“জায়ান্ট’স চেয়ার”

The Path That We Took

A narrow path it was,
Gravel strewn,
Lay quietly without any passer by.
A loose chain was hanging
Without any explicable purpose,
Just to look like a prohibitive fence, perhaps.
Tree boughs deviating from the main trunk
Gave the semblance of a ‘welcome arch’.

We took that path at the ‘English Garden’
Of the Mount Dandenong on a Summer afternoon.
A narrower stream barely visible,
Quiely flowed along, nourishing the plants.

On a wooden culvert I stood for a while,
Listening to the chirping birds,
Watching the frolicking, fluttering butterflies,
Forgetting for a moment, my fellow companions.

Time was running out,
Yet we sauntered on, without hurry.
Stood for a picture with a stone sculpture,
Of a loving mother embracing her child,
Hard stone that evoked soft feelings of love!
Unoccupied tables and benches on the wayside,
Made of sawed wood of ‘Australian Tree’s
Invited us for a much needed rest.

We sat for a while at the mouth of the defile
And read billboards explaining legends
Of a ‘Wishing Well’ and a ‘Wishing Tree’,
A history that we carried with us as memory!

Poet’s Notes: Visited ‘Sky High English Garden’ at the Mount Dandenong Range, Melbourne, Australia on 09 January 2020. The pictures were taken at the entrance of the garden. The poem is written in memory of the quiet time passed there.

Dhaka
27 April 2020


The Path That We Took


“Tree boughs deviating from the main trunk
Gave the semblance of a ‘welcome arch’.”

“On a wooden culvert I stood for a while,
Listening to the chirping birds,
Watching the frolicking, fluttering butterflies,
Forgetting for a moment, my fellow companions.”


“Unoccupied tables and benches on the wayside,
Made of sawed wood of ‘Australian Tree’s
Invited us for a much needed rest.”

২,১৭১ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “মেলবোর্নের দিনলিপি – ৬ঃ মাউন্ট ড্যান্ডিনং রেঞ্জে এক পড়ন্ত বিকেলে”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    তথ্যচিত্র সহযোগে উপস্থাপিত আপনার ভ্রমণকাহিনীটি পড়ে অসাধারন লেগেছে। অনেক অজানাকে জানা হল। প্রকৃতির নির্জন-শান্ত রূপ আর বৈচিত্র্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      আজকাল অনেকে পোস্ট পড়ে নীরবে প্রস্থান করে। তুমি লেখকের সম্মান ও সৌজন্যে দুটো কথা বলে যাও। তোমার এ বিরল সৌজন্যপ্রকাশে আমি মুগ্ধ হই। তোমাকে শুধু ধন্যবাদ জানানোই যথেষ্ট নয়, আল-মামুন।
      পোস্টের প্রশংসায় প্রাণিত হয়েছি। তোমার আগ্রহে উৎসাহিত।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।