জীবনের জার্নাল – ৩১

কলেজ হাসপাতালে কয়েকদিনঃ
সেই সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম টার্মেই গণজ্বরে ভোগার পর আল্লাহ’র রহমতে আমার আর কোনদিন তেমন অসুখ বিসুখ হয় নাই। বন্ধু বান্ধব কিংবা ছোট বড় কেউ কেউ মাঝে মাঝে হাসপাতালে কয়েকটা দিন থেকে এসে খবর দিত, সেখানে থাকতে তাদের খুব ভালো লেগেছে। ওদের কথা শুনে মনে মনে খুব ইচ্ছে হতো, কয়েকটা দিন আমিও যদি হাসপাতালে থেকে আসতে পারতাম! শীঘ্রই সে সুযোগও এসে গেলো। একদিন সন্ধ্যায় গলাব্যথা অনুভব করলাম। তখন নতুন বিল্ডিং এ হাসপাতাল চালু হয়েছে এবং মেডিকেল অফিসার হিসেবে ডাঃ হাফিজুল হাসান যোগদান করেছেন। তিনি সাধারণতঃ টনসিলের ব্যথা হলে “ওরাসিন কে” (মাইল্ড এন্টিবায়োটিক) আর কিছু প্যারাসিটামল টাইপের (তখন নাম ছিলো নভালজিন) ট্যাবলেট দিয়ে তিন দিনের বিশ্রাম (এ্যটেন্ড ‘সি) দিতেন। পরদিন সকালে আমি যখন তাঁর কাছে রিপোর্ট করলাম, তিনি খুব ভাল করে আমার মুখের ভেতরে টর্চ লাইটের আলো ফেলে পরীক্ষা করে বললেন, আমাকে ইনজেকশন নিতে হবে আর হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। শুনে আমি তো মহা খুশী! হাউসে ফিরে এসে কিছু টয়লেট্রী আর লুকিয়ে আনা কিছু গল্পের বই নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে এলাম। আসার সাথে সাথেই প্রথম ইনজেকশনটা আর এন্টি বায়োটিকের ডোজ শুরু হলো। ততক্ষণে জ্বর অনেক বেড়ে গেছে। হাসপাতালে থাকার অন্যতম আকর্ষণ ছিলো কিছুটা উন্নত মানের খাবার আর অঢেল অবসর। কোন প্যারেড পিটি নেই, কোন হোমওয়ার্ক নেই, কোন প্রেপ আওয়ার (বাধ্যতামূলক ঘন্টা ধরে বই খুলে পড়াশুনা করা বা পড়ার ভান করা) নেই। সেখানে এক ধরণের হাল্কা স্যুপ দিত, যা জ্বরের মুখে খুব ভাল লেগেছিলো। হাসপাতালের চারপাশে প্রচুর গুইসাপের আনাগোনা ছিলো। ওগুলো অনেকটা পোষ মানার মত হয়ে গিয়েছিলো, কাউকে ভয় পেত না। নীল, হলুদ বর্ণের অনেক পাখি গাছে গাছে ওড়াওড়ি করতো। দুপুর থেকে সারাটা বিকেল আমি জানালায় বসে বসে এসব দেখতাম আর গল্পের বই পড়তাম। তখনই জীবনের প্রথম ডায়েরি লেখা শুরু করলাম, কারণ লেখার নিশ্চিত নিরাপত্তা ছিল। সারাদিন বলতে গেলে প্রায় একাই থাকি, শুধু ঔষধ পত্র আর পথ্য খাবার সময় হলে মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ডাকাডাকি করতো। এ ছাড়া আমি কী লিখছি বা না লিখছি, তা নিয়ে উঁকিঝুঁকি করার মত কেউ ছিলনা। ডর্মে লিখতে পারতাম না বন্ধুদের জ্বালায়। তা ছাড়াও হাউস টিউটর এর ভয়ও তো ছিলই। কবিতাও লিখেছিলাম কয়েকটা, যার একটা একজনকে পাঠিয়েছিলাম এবং সে সেটা খুব এপ্রিশিয়েট করেছিলো। এভাবেই পাঁচ পাঁচটা দিন হাসপাতালে খুব সুখে শান্তিতে কাটিয়ে অবশেষে নিজ ডেরায় ফিরে এসেছিলাম।

সনাক্তকরণ চিহ্নঃ
কলেজে লক্ষ্য করেছিলাম, কালবোশেখীর সময় প্রথম প্রথম বিকেলের দিকে ঝড় ঝঞ্ঝা শুরু হতো। এতে আমাদের বিকেলের খেলাধুলা সব পন্ড হয়ে যেতো। দিনে দিনে ঝড় ওঠার সময়টা একটু একটু করে পিছিয়ে যেতো। একদিন সন্ধ্যায় ব্যাপক ঝড় বাদল শুরু হলো। বিদ্যুত নিমেষে চলে গেলো। পরের দিন একটা পরীক্ষা ছিলো, তাই আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজেরাই সুবোধ বালকের মত পড়তে বসে গেলাম। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। ডিনারের সময় ঘনিয়ে আসছিলো। সাধারণতঃ এরকম সময়টাতে হাউস মাস্টার হাউস টিউটরদের নজরদারি একটু শিথিল হয়ে আসে। আমার এক রুমমেট আমার টেবিলে এসে মোমের আগুনে মূলতঃ টিন দিয়ে তৈরী একটা শু হর্ণ অনেকক্ষণ ধরে গরম করছিলো। আমি পড়ায় গভীর মনোনিবেশ করেছিলাম, তাই তার কার্যকলাপের প্রতি ততটা খেয়াল ছিলনা। হঠাৎ সেই বন্ধুটি দুষ্টুমি করে আমার একটা হাত টেনে সেই তপ্ত শু হর্ণটি আমার হাতে চেপে ধরে। আমি তীব্র চিৎকার করে উঠি। সাথে সাথে সবাই আমার টেবিলের দিকে ছুটে আসে। গরম টিনের পাত যে জায়গাটায় চেপে ধরেছিলো, সেখানকার চামড়া উঠে যায়। খবর পেয়ে একটু পরে হাউস টিউটর যতক্ষণে এলেন, ততক্ষণে ব্যথা কিছুটা সহ্য হয়ে গেছে। তাঁকে কী বলা হবে তা সবাই মিলে আগেই সাব্যস্ত করে রেখেছিলাম।

তাঁকে তাই বলা হলো, অর্থাৎ অসাবধানতা বশতঃ জ্বলন্ত মমবাতি আমার হাতে পড়ে গিয়েছে। তিনি এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করলেন না, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তিনি দেখতেও চাইলেন না, কোথায় ‘জ্বলন্ত মোমবাতি পড়ে গিয়েছিলো’, বরং যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “এটুকুতেই এত জোরে চীৎকার করতে হয়?” রাতেই বিদ্যুতবিহীন পথে হাসপাতালে হেঁটে গিয়ে হাতটা ড্রেসিং করে এনেছিলাম। ড্রেসিং করার সময় যখন সেখানে টিংচার আয়োডিন লাগায় তখন অসহ্য ব্যথা হয়েছিলো। পরবর্তীতে হাতটা আমাকে বেশ ভুগিয়েছিলো। ঠিকমত পরিচর্যা না হওয়ায় ক্ষতটা পেকে গিয়েছিলো। দীর্ঘ চিকিৎসার পর অবশেষে সেটা ঠিক হয়ে আসে, কিন্তু জীবনের জন্য একটা কাজ সহজ করে দিয়ে যায়। সেটা হলো, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়া সহ জীবনে যেখানে যত জায়গায় কোন ফর্ম পূরন করেছি, “সনাক্তকরণ চিহ্ন” পূরণ করার সময় বেশী খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। চট করে লিখে দিয়েছি, “বাম হাতে পোড়া দাগ”। বলা বাহুল্য, দাগটি আজ অবধি বিদ্যমান। আর আমার সেই বন্ধুটি, যে আমার অন্যতম বেস্ট ফ্রেন্ডও ছিলো, কিছুকাল আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছেন এবং আমরা আজও খুব ভাল বন্ধু।

ঢাকা
৩১ জানুয়ারী ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৪,৩৯০ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ৩১”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    দুবার পা ভেঙে ও দুবার হাম হাম হওয়ায় ও আরেকবার হাত পুড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে থেকেছিলাম বেশ কিছুদিন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    যতদিনে এই লেখা পড়ছি, ততদিনে হয়ত বই বেরিয়ে গেছে। ভাবছিলাম, বই বেরুলে এই লেখাগুলির মূল্য কিছুমাত্র হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে কীনা। বইটিকে যদি ভুমিষ্ট মানবশিশুর সাথে তুলনা করি, তবে এই লেখাগুলোর একেকটি ভ্রুণসঞ্চার থেকে শুরু করে সেই মানবশিশুটির প্রতিমুহূর্তের বেড়ে উঠবার ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন। আর এই মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যগুলো, যা লেখাগুলিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে, বইতে হয়ত আসে নি। এখানেই ব্লগের অনন্যতা। মিথস্ক্রিয়ার কারণে সেটি অনেক প্রাণবন্ত, অনেক জীবন্ত!


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      এখানেই ব্লগের অনন্যতা। মিথস্ক্রিয়ার কারণে সেটি অনেক প্রাণবন্ত, অনেক জীবন্ত! - অবশ্যই ব্লগ বই এর চেয়ে অনন্য, অনেক বেশী প্রাণবন্ত। পাঠকের মন্তব্য লেখকের লেখার আকর্ষণ অনেক বাড়িয়ে দেয়।
      চমৎকার এই মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ, মোস্তফা।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।