বইমেলার টুকিটাকি

এবারের একুশে বইমেলায় নিজের বই বিক্রী হোক বা না হোক, কোন কোন দিনে বেশ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। যেমন একদিন একটা নয় দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে আমার “জীবনের জার্নাল” এর প্রচ্ছদের ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখছিলো। তার পরে কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে একটা চ্যাপ্টার পড়া শুরু করলো। দুই একটা পৃষ্ঠা একনাগাড়ে পড়লো। ততক্ষণে ওর মা কয়েকবার ওকে ডেকে পাশের একটা স্টলের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। মেয়েটি বই হাতে করে দৌড়ে ওর মায়ের কাছে গিয়ে বইটি দেখিয়ে কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। কিন্তু ওর মা ওকে বললেন, এত কঠিন বই তুমি বুঝতে পারবেনা। অথচ মেয়েটি কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ে বুঝে শুনেই কিনতে চেয়েছিলো। একটু জেদের মত করাতে ওর মা চোখ দুটো বড় করে শুধু ওর দিকে তাকালেন। অমনি মেয়েটি নিষ্প্রভ হয়ে ধীর পদক্ষেপে এসে বইটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললো, “আঙ্কেল, আমার আম্মা এটি কিনবেন না”। আমি ওকে বললাম, কোন দাম দিতে হবেনা, তোমার পছন্দ হলে তুমি এমনিতেই এটা নিতে পারো, আমি তোমাকে এটা গিফট করলাম। ও তখন আস্তে করে বললো, “না আঙ্কেল, আম্মা রাগ করবেন”। ওর মা যখন ওর দিকে চোখ বড় করে তাকিয়েছিলেন, তখন আমার সাথেও চোখাচোখি হয়েছিল। ঐ চোখ দেখার পর আমার আর সাহস হয়নি, মেয়েটির মাকে গিয়ে ও কথা বলি। মেয়েটি চলে যাবার পর এক যুবক বইটি হাতে নিয়ে প্রচ্ছদটার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি তাকে বইটি আমার লেখা বলে জানালাম। ছেলেটি কোন পৃষ্ঠা না উল্টিয়েই বললো, “আঙ্কেল, এত হাই থটের বই আমার মাথার উপর দিয়ে যাবে”। এজন্যেই বোধ হয় এ প্রবাদটি কোন এক কালে চালু হয়েছিলো, “Do not judge a book by its cover”.

জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল ওয়াহিদুজ্জামান স্যার এসেছিলেন ‘বইপত্র প্রকাশন’ এর স্টলে, মূলতঃ তাঁর এককালের ছাত্র বরিশাল ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেট গোলাম রাব্বী আহমেদ এর অনুরোধে। তিনি আগে যখন বরিশাল ক্যাডেট কলেজের প্রভাষক ছিলেন, গোলাম রাব্বী আহমেদ তখন তাঁর ছাত্র ছিলো। একই স্টল থেকে আমার আর ওর বই বিক্রীত হচ্ছিল। নিজ ছাত্রের বই তিনি বেশ উদারভাবে কিনছিলেন। এক পর্যায়ে গোলাম রাব্বী আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি যখন জানতে পারলেন যে আমিও এমসিসি’র এক্স ক্যাডেট, তখন তিনি বিনা প্রশ্নে আমার বইও পাঁচটা কিনে নিলেন। ধন্যবাদ, অধ্যক্ষ ওয়াহিদুজ্জামান, একজন এক্স ক্যাডেটের প্রতি আপনার এই সৌজন্য ও শুভেচ্ছা আমাকে মুগ্ধ করেছে, আমি অভিভূত হয়েছি।

বইমেলায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরেকটা উপলব্ধি হলো, মানুষ গল্প শুনতে চায়। বইএর গল্পে মানুষ তাদের জীবনের গল্পের প্রতিফলন দেখতে চায়। কেউ তা খুঁজে পায়, কেউ তা না পেয়েও সন্তুষ্ট হয়েই অন্যের গল্প শোনে। তাই বইমেলায় গল্প উপন্যাসের কাটতি প্রচুর। কিন্তু সে তুলনায়, কবিতার বই এর জৌলুষ অনেকাংশে নিষ্প্রভ। কাউকে কবিতার বই দেখিয়ে দিলে একটা কমন ডায়ালগ শোনা যায়, “আমি কবিতা একটু কম বুঝি”। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়া তো দূরের কথা, বই হাতে নিয়ে দেখতেই যেন তাদের ঢের আপত্তি। তাই আমি কাউকে আমার কবিতার বই “গোধুলীর স্বপ্নছায়া” সম্পর্কে কিছু বলতে অত্যন্ত নিরুৎসাহিত বোধ করতাম। আর এটা একটা আবেগের ব্যাপারও। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গল্পের চেয়ে কবিতায় বুঝি লেখকের আবেগ অনুভূতি একটু বেশীমাত্রায় জড়িয়ে থাকে। নিজের সৃষ্টিকে অবমূল্যায়িত দেখতে কেই বা চায়! তাই আমি শুধু দাঁড়িয়েই থাকতাম, কেউ সামান্য একটু আগ্রহ প্রকাশ করলে তবেই সাধারণতঃ আমি উৎসাহী হয়ে দু’কথা বলতাম। এরকম এক পরিস্থিতিতে একদিন সন্ধ্যায় আমি যখন ‘জাগৃতি প্রকাশনী’ এর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন লক্ষ্য করলাম এক দম্পতি এসে ঐ স্টলের বইগুলো দেখছেন। ভদ্রলোকটি দুই একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছিলেন, ভদ্রমহিলা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলেন। তাঁদেরকে দেখেই আমার কেন যেন একটা অনুমান হলো, তাঁরা কবিতা পড়েন। আমি একটু আগ্রহভরে আমার বইটির প্রতি তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ভদ্রমহিলা বইটির প্রচ্ছদে লেখা আমার নামটি দেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বইটির দিকে তাকালেন। এবারে একটু হেসে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ক্যাডেট কলেজ ব্লগে লেখেন না? আমি আপনাকে চিনি ভাইয়া”। শুরু হলো বই ছেড়ে অন্যসব আলাপচারিতা। আলাপে মনে হলো, উনি ব্লগের বেশ নিয়মিত পাঠক। ব্লগের আরো অন্যান্য কয়েকজন লেখক সম্বন্ধেও কিছু আলাপ হলো। ব্লগের মাধ্যমেই উনি আমার “জীবনের জার্নাল” এর সাথে পরিচিত ছিলেন। ওটার কথাও তিনি জিজ্ঞেস করলেন। জাগৃতি থেকে “গোধূলীর স্বপ্নছায়া কেনার পর ওনারা এলেন “বইপত্র প্রকাশন” এ, “জীবনের জার্নাল” সংগ্রহ করতে।

আলাপচারিতায় জানলাম, ভদ্রমহিলার নাম সেলিনা, পেশায় একজন প্রকৌশলী। ভারতের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কিছুদিন বুয়েটের ফ্যাকাল্টিতেও ছিলেন। তবে এই পরিচয়ের চেয়ে তাঁর অন্য একটা পরিচয় আছে। যখন তিনি জানালেন যে তিনি এমজিসিসি’র এক্স ক্যাডেট, তখন সাথে সাথেই এই স্বল্প পরিচয়ের পরিসরেও তাঁর সাথে আলাপচারিতাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাঁর স্বামী আকাশও প্রকৌশলী, বুয়েট থেকে পাশ করা। তাঁরা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে দুজনাই সপ্তাহ দুয়েকের জন্য দেশে এসেছেন। এর মাঝেই প্রাণের টানে সময় করে নিয়ে একদিন বইমেলায় আসা। সেলিনা ও আকাশ, সেদিন আপনাদের সাথে অত্যন্ত অল্প সময়ের আলাপচারিতাটুকু ভালো লেগেছে। আমার বই দুটোর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রবাসে আপনারা ভালো থাকুন, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করে দেশেরও মুখ উজ্জ্বল করুন, এই কামনা ও দোয়া রইলো।

ঢাকা
১৪ মার্চ ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

12717434_10153291258797623_5902040083830171272_n
আমার বই “গোধূলীর স্বপ্নছায়া” হাতে প্রকৌশলী সেলিনা আর তাঁর স্বামী প্রকৌশলী আকাশ। তাঁরা উভয়ে আমেরিকা প্রবাসী, বইমেলা চলাকালে কিছুদিনের জন্য স্বদেশে এসেছিলেন।

12742658_10153291259267623_199571417105524468_n
আমার বই “গোধূলীর স্বপ্নছায়া” এবং “জীবনের জার্নাল” হাতে প্রকৌশলী সেলিনা আর তাঁর স্বামী প্রকৌশলী আকাশ, আর আকাশের পাশে বিসিসি’র এক্স ক্যাডেট গোলাম রাব্বী আহমেদ, যার বই “প্রার্থনা ও প্রেমে কোন শরিক রাখতে নেই” একই প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। বইটি আকাশের ডান হাতে ধরা।

12745455_10153289106752623_210598069813063350_n
জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ এর অধ্যক্ষ জনাব ওয়াহিদুজ্জামান এর সাথে……

৪,৬৩১ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “বইমেলার টুকিটাকি”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ১ম B-) ।

    আপনার ব্লগের সাথে ছবির বসিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আপনার লেখা পড়ার আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    চমৎকার লেখা।
    ওয়াহিদুজ্জামান স্যার চমৎকার মানুষ।
    তবু কোন কারণ ছাড়াই স্যারকে ভয় পেতাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. সেলিনা (৮৮-৯৪)

    ধন্যবাদ ভাইয়া,
    আপনার সাথে এবং রাব্বীর সাথে দেখা এবং কথা হয়ে অনেক ভালো লেগেছে।
    আর এত চমৎকার পরিচয়ে আরো বর্তে গেলাম।
    বই মেলাতে এত অল্প সময়ের জন্য গিয়ে আমার মন ভরেনি, আবারো যাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পারিনি।

    জবাব দিন
  4. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

    আমরা ওয়াহিদুজ্জামান স্যারকে বোধহয় পেয়েছি দু'বছর।
    আঁকার ক্ষমতায় আমাদের দেখা শ্রেষ্ঠ চারুকলা শিক্ষক।
    যতদূর মনে পড়ে স্যারের গানের গলাও দারুণ ছিল।



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  5. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ছবি আর লিখা মিলিয়ে জব্বর এক বইমেলা ভ্রমন হয়ে গেল এতদিন পরেও।
    এই লিখাটার সেই গুন আছে, যেজন্য এটা কে সবসময়েই টাটকা বলে মনে হবে!!!


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।