গানের ভেলায় বেলা অবেলায়……

১৯৬১-৬২ সালে আমরা ঢাকার কমলাপুরে থাকতাম। তখন আমার বয়স ৭/৮ বছর হবে। বাসার ঠিকানাটা এখনও মনে আছে-18, Republic Second Lane, Kamalapur, Dacca। আমরা ভাড়া বাসায় থকতাম। প্রতি মাসের ঠিক ২ তারিখে সন্ধ্যায় একজন টাকমাথা মধ্যবয়স্ক বাড়ীওয়ালা আসতেন। আব্বার কাছ থেকে গুণে গুণে ভাড়ার টাকা বুঝে নিয়ে একটা রসিদ লিখে দিতেন। তারপর বুকপকেট থেকে একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প বের করে জিহ্বার সাথে ঘসে রসিদটার উপর সেঁটে দিতেন। মাঝে মাঝে ইংরেজীতে লেখা রসিদটা আমার হাতে দিয়ে বলতেন, বাবু পড়তো! আমি ছোট ছোট শব্দগুলো আর টাকার অংকটা ছাড়া আর বেশী কিছু পড়তে পারতাম না, তবে পড়ার জন্য চেষ্টা ও আগ্রহ থাকতো প্রচুর। তিনি বলতেন, ভালোভাবে পড়াশুনা করবে। যেদিন তুমি সব লেখাগুলো ঝরঝর করে পড়তে পারবে, সেদিন আমি আমার পাওয়া এ টাকাগুলো সব তোমায় দিয়ে দেব। বলা বাহুল্য, তিনি যতদিন আমাদের বাড়ীওয়ালা ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত আমার বিদ্যের দৌড় ঐ লেভেলে পৌঁছায়নি। তবে শেষ যেদিন তিনি আমাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে যান, সেদিন তিনি তা থেকে কিছুটা অংশ আব্বার হাতে দিয়ে বলেছিলেন আমাকে কিছু একটা কিনে দিতে। স্মল কাইন্ডনেস, বাট আই স্টিল রিমেম্বার!

বাসার ঠিকানাটার ঐ রকম কঠিন নাম কেন ছিল, তা ঐ সময় যেমন বুঝিনি, পরেও তেমন আর জানার চেষ্টা করিনি। আমাদের বাসা থেকে সামান্য একটু দূরে, এখন যেখানে কমলাপুর স্টেশনের মূল প্ল্যাটফর্ম, তখন ঐ জায়গাটার নাম ছিল ঠাকুরপাড়া। ওখানে আব্বার কয়েকজন কলীগ বাস করতেন, আমার বড়ভাইদের কিছু বন্ধু বান্ধবও ঐ এলাকা থেকে খেলতে আসতেন। আমাদের বাসাটা ছিল এখন যেখানে ট্রেনের বগী ধোয়া হয়, তার ঠিক পশ্চিমে। মতিঝিল কলোনী তখনো ঠিকমত গড়ে উঠেনি। কয়েকটা বিল্ডিং এখানে সেখানে হয়েছিলো, তবে পুরো এলাকা জুড়ে অনেকগুলো ইটের স্তূপ ছিল। সদ্য কেনা কয়েকটা নতুন বিআরটিসি বাস (তখন নাম ছিল ইপিআরটিসি) কমলাপুর ডিপো থেকে গুলিস্তান আর কল্যানপুরে যাতায়াত করতো। কমলাপুর স্টেশনের সামনের বাঁকটাতে একটা বাস স্ট্যান্ডের সাইনবোর্ড ছিল, নাম “ঠাকুরপাড়া”। তখন বোধহয় একদিন কোলকাতায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে রায়ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে একদিন দেখি হলুদ রঙের বাস স্ট্যান্ডটার নাম বদলে কে যেন কালো কালিতে লিখে দিয়েছে “মুসলিম পাড়া”। তখন হিন্দু এলাকাবাসীদেরকে সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো বলে বড়দের মুখে শুনেছিলাম।

এখনো মনে পড়ে, বর্ষা আসার আগে আগে আমাদের এলাকার অনতিদূরে মুগদাপাড়ার দিকে নৌকা বানানোর ধুম পড়ে যেত। বর্ষার সময় নৌকাই ঐসব এলাকায় যাতায়াতের জন্য একমাত্র বাহনে পরিণত হতো। দূর দূরান্ত থেকে নৌকা বোঝাই করে নানারকমের পণ্যসামগ্রী স্টেশনের ওপারে আসতো। পরে বিক্রেতারা মাথায় করে সেসব নিয়ে আমাদের এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রী করে বিকেলে নৌকা নিয়ে ফিরে যেত। অনেক বেদে বেদেনীরাও সে সময় এসে আমাদের সাপের খেলা দেখাতো আর মা খালাদের কাছে কাঁচের চুড়ি টুরি বিক্রয় করতো। পোকা খাওয়া দাঁতের ছেলেমেয়েদেরকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁত থেকে জীবন্ত পোকা বের করে দেখাতো আর নানা ছলে বলে এটা ওটা বিক্রয় করতো। পরে অবশ্য জেনেছি এসব কিছুই ছিল স্রেফ ভাওতা। দাঁতে কখনো পোকা হয়না।

তখনো তিতাস গ্যাস ছিলনা। তাই নৌকার অন্যতম প্রধান পণ্য ছিল সুন্দরী গাছের চেরা কাঠ, যা রৌদ্রে শুকিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করার জন্য গৃহিণীরা বেশী করে কিনে স্টক করে রাখতেন। তখন রেলের লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার সেগুন কাঠের কালো কালো স্লিপার স্ট্যাক করে রাখা হতো। কালো, কারণ সেগুলোকে আলকাতরা মেখে রাখা হতো। সেই স্লিপারের গন্ধ এখনো যেন আমার নাকে লেগে আছে। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের এলাকা ও তার আশে পাশে বেশ কিছু গুণী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি বসবাস করতেন। তার মধ্যে একজন বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত রাশভারী ব্যক্তি ছিলেন, যাকে সবাই “ইন্সপেক্টর সাহেব” বলে ডাকতেন। তিনি মনে হয় রেলওয়ে এস্টেট অফিসের কোন ইন্সপেক্টর হয়ে থাকবেন। তাঁর অনেকগুলো ছেলেপুলে ছিলো। তাদের মধ্যে দুই একজন আমার ফুটবল খেলার সাথী ছিল। তারা প্রথমে আমার উপরের ক্লাসে পড়তো, পরে একসাথে আর তার পরে আমার নীচের ক্লাসে পড়তো। তাদের তুলনায় আমি একটু শার্প ছিলাম বলে হয়তো, খালা (ইন্সপেক্টর পত্নী) আমায় খুব আদর করতেন, আর তাদেরকে বলতেন, সব সময় আমার সাথে খেলতে। এতে, বয়সে ছোট হলেও ওদের কাছে আমার মর্যাদাটা একটু বেড়ে যেত।

অনতিদূরে থাকতেন বিখ্যাত বিল্লাহ পরিবার। শিমূল বিল্লাহ, তার ভাই দিনু বিল্লাহ এবং আরো কয়েকজন মিলে সবসময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজন করতেন, গানের আসর বসাতেন। বাসার কাছেই থাকতেন কৌ্তুকাভিনেতা রবিউল। একটু দূরে শাহজাহানপুরে থাকতেন কবি বেনজীর আহমেদ এর পরিবার। কমলাপুর বাস ডিপোর কাছে থাকতেন পল্লীকবি জসিম উদ্দিন এর পরিবার। কমলাপুর বৌদ্ধমন্দিরে বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় অনেক সুধী সমাবেশ ঘটতো। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে ফানুস উড়ানো হতো। প্রখ্যাত লোকগীতি শিল্পী আব্দুল আলীমও সপরিবারে আমাদের এলাকায় থাকতেন। তাঁর দেহের রঙ খুব কালো ছিলো, তাই বোধহয় তিনি বেশীরভাগ সময় সাদা রঙের পাঞ্জাবী পাজামা পড়তেন। কাঁধে একটা চাদর ঝোলানো থাকতো। তাঁকে কখনো প্যান্ট শার্ট পড়তে দেখিনি। তিনি খুব নিরীহ প্রকৃতির এবং মিষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর দেহের রঙ আর মিষ্টি গলার কারণে পাড়ার অনেকে তাঁকে নিজেদের মধ্যে “কোকিলা” নামে ডাকতেন। এক শ্রাবণ দিনে ক্রমাগত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে সামনের রাস্তায় অনেক পানি জমে গিয়েছিলো। প্রায় ঘরের দুয়ারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। জনাব আব্দুল আলীম তাঁর পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে পানি মাড়িয়ে আসছিলেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, পাশের বাসার এক ন্যাংটো পিচ্চি তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়েই জমা পানির মধ্যে সশব্দে মূত্রত্যাগ করে মজা পাচ্ছে। আলীম চাচা তাদের বাসাটা অতিক্রম করার সময় একটু থেমে বলে গেলেন, “হায় হায় ভাতিজা! সারাডা দ্যাশ পানিতে ভাইস্যা যাইতাছে, এর মধ্যে তুমি দিলা আরও খানিকডা বাড়াইয়া!”

এতকিছুর অবতারণা একটা গানের সূত্র ধরে। নীচে দেওয়া লিঙ্কের প্রথম গানটা তো জীবনে বহুবার শুনেছি। আজও সারাদিন ধরে লিঙ্কের সবগুলো গান কয়েকবার করে শুনলাম। প্রথম গানটা শুনতে শুনতে মনে ভাবের জোয়ার এসে গেল। মনে হলো, এসব ভক্তিগীতি যেন সারাটা জীবন উপেক্ষিতই থেকে গেল! অথচ কতোনা বিশুদ্ধ ও পবিত্র এসব গানের কথা! গান শুনে শুনেই আজ আমার সারাটা দিন কেটে গেল। মন ভারী হয়ে এলে কিছু পছন্দের রবীন্দ্র সঙ্গীতও শুনি। আল্লাহ’র প্রশংসার কথাগুলো মাঝে মাঝে চোখে জল নিয়ে এলো। আর গায়কের কথা স্মরণ করে ঘুরে বেড়ালাম স্মৃতির অলিগলিতে। স্মৃতিতাড়িত হয়ে এভাবেই লিখে ফেললাম শৈশবের কিছু এলোমেলো স্মৃতিকথা- আজকের এই লেখা।

আব্দুল আলীমের গানের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=keO32zdtbZY

আমার প্রিয় একটা গান যেখান থেকে শিরোনামটা নিয়েছি (ওটাও শুনেছি কয়েকবার):

ঢাকা
১৮ জানুয়ারী ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৫,৪৫০ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “গানের ভেলায় বেলা অবেলায়……”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    স্মৃতিতাড়িত হয়ে এভাবেই লিখে ফেললাম শৈশবের কিছু এলোমেলো স্মৃতিকথা- আজকের এই লেখা।

    লেখাটা পড়ে পাঠকও স্মৃতিকাতর হতে বাধ্য হবে, ভাই।
    দারুণ লাগল।
    আর নিজের ছেলে-বেলার কিছু ফ্ল্যাশ-ব্যাক যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল।


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমার মনেহয় স্মৃতিকথায় কি কি ঘটেছে, তা থেকে অনেক বেশি মূল্যবান হলো সেসময়কার একটা ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারা।
    কবির চৌধুরির লিখায় ব্যাপারটা চমৎকার ভাবে পেয়েছিলাম।
    এখানেও আরেকবার পেলাম....
    🙂 🙂 🙂


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    খায়রুল ভাই, প্রাঞ্জল লেখা আর দারুণ উপস্থাপনায় ভাজে আজকের যুগের হয়েও চারিপাশের পরিবেশকে অনুধাবন করতে একটুও কষ্ট হয়নি। খুব ভালো লেগেছে!!!


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    অসাধারণ লেখা।
    আর অসাধারণ আপনার স্মৃতিশক্তি।
    স্যালুট।
    রবিউল কে খুব ভালো লাগতো।
    বিল্লাহ দের নাম শুনেছি।
    জসিম উদ্দিন ওখানে থাকতেন জানতাম।
    আব্দুল আলীম এর গান খুব ভাল লাগে। (সম্পাদিত)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      অনেক ধন্যবাদ রাজীব, এতটা মন দিয়ে লেখাটা পড়ে এতটা উদারভাবে প্রশংসা করার জন্যে। আসলে পেছনের স্মৃতি আওড়াতে আমার সমস্যা হয়না, সমস্যা হয় সাম্প্রতিক স্মৃতি স্মরণ করতে। অনেক সময় আজ সকালে কী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছি, সেটা কেউ জিজ্ঞেস করলেও সমস্যায় পড়তে হয়। হয়তো স্মৃতিভ্রমের (ডিমেনশিয়ার) পূর্বাভাস!

      জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আর একটা খারাপ কথা শুনেছিলাম মানে পড়েছিলাম আর কি।
    জসিম উদ্দিন গরু পালতেন। তার স্ত্রী নাকি দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করতেন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    গীতিকার দের নাম সেভাবে আসে না।
    কিন্তু জসিম উদ্দিন এর লেখা গানগুলো অসাধারণ।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।