জীবনের জার্নাল – ২৮

‘জীবনের জার্নাল’ এ গত কয়েকটা পর্ব ধরে আমাদের শিক্ষকদের কথা বলে চলেছিলাম। এখনো অনেকের কথা বলার বাকী রয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর ওনাদের কথা বলতে চাচ্ছিনা, আজ আমার নিজেরই কিছু কথা বলবো। তখন জীবনের এমন একটা সময় পার করছিলাম, যখন মানুষ কিছু বৈপরীত্যের সম্মুখীন হয়। কিশোর মনে অনেক প্রশ্ন আসে, যেগুলো সবাইকে জিজ্ঞেসও করা যায়না, যেগুলোর উত্তর সবাই দিতেও চায়না। এই বয়সের একটা কালজয়ী বর্ণনা দিয়ে গেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর “ছুটি” গল্পে, ফটিক চরিত্রটির মাধ্যমেঃ
বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ে কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।

ক্যাডেট কলেজে গিয়েই সপ্তম শ্রেণীতে এই গল্পটা আমাদের পাঠ্যসূচীতে পাই। উপরের কথাগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য মনে হতো। গল্পটা পড়তাম আর অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, কবিগুরু কি করে আমার মনের কথাগুলো এতটা নিখুঁতভাবে বলে গেলেন! আমার বয়সটাও তখন ঠিক ওরকমই ছিলো। মনে অনেক প্রশ্ন থাকতো, কিন্তু সহজে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। আমি স্বভাবগতভাবে কথা কম বলতাম, আর যারা মুখে কথা কম বলে থাকে, তারা মনে মনে ভাবে অনেক বেশী। কিছু কিছু ভাবনার ব্যাখ্যা পেতে একাকীত্ব খুঁজে নিতাম, যদিও বন্ধুদের সঙ্গ আমি খুবই উপভোগ করতাম। আমাদের ৮ জনের কক্ষে কোন গসিপ শুরু হলে আমিই প্রথম নিঃশব্দে আমার পড়ার টেবিল বা শয্যা ছেড়ে (যখন যে অবস্থায় গসিপ শুরু হতো) গসিপ সূচনাকারীর পাশে গিয়ে বসতাম। তার সব কথা গিলতাম। তবে কিছু বলতে গিয়ে বুঝতাম, যা বলতে চাই, তা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনা। তাই শোনা গল্পগুলো পরে আবার নিজের মত করে নিজেকেই বলতাম, এবং তাতে একা একা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতাম। আমার অবস্থাটা বোঝাতে আবার কবিগুরুর আরেক কালজয়ী গল্পের ‘বলাই’ চরিত্রটির উল্লেখ করতে হয়ঃ
ফাল্গুনে পুষ্পিত শালবনের মতোই ওর অন্তর-প্রকৃতিটা চার দিকে বিস্তৃত হয়ে ওঠে, ভরে ওঠে তাতে একটা ঘন রঙ লাগে। তখন ওর একলা বসে বসে আপন মনে কথা কইতে ইচ্ছে করে, যা-কিছু গল্প শুনেছে সব নিয়ে জোড়াতাড়া দিয়ে।

আমি আগেই কোন একটা পর্বে বলেছি, কোন খেলায় আমি ভালো না হলেও সব খেলায় আমার প্রবল আগ্রহ ছিলো। অনেকটা Jack of all trades, master of none এর মত। ক্যাডেট কলেজে গিয়ে আমি প্রাণভরে খেলাধুলার অবারিত সুযোগ পাই। আমি সেটা খুবই উপভোগ করেছি। তবে কোন ইন্টার হাউস প্রতিযোগিতায় মূল দলে আমি সুযোগ পেতাম না। সেজন্য এসব প্রতিযোগিতাকে আমি অপছন্দ করতাম। তাই বলে আমার উৎসাহে কখনো ভাটা পড়েনি। দু’দলে ভাগ হয়ে কোন ফ্রেন্ডলী ম্যাচ খেলার সময় আমি স্বেচ্ছায় অনেকদিন প্রতিযোগী উভয়দলের দ্বাদশ খেলোয়ার হিসেবে (ক্রিকেটে) সারাদিন ধরে ফিল্ডিং করেছি, কোন ব্যাটিং পাইনি। তাতে কিছু মনে করিনি। যদি কোন ছুটির দিনে কোন খেলার সুযোগ না পেতাম, তবে আমি অন্যভাবে নিজের সুখ খুঁজে নিতাম। একা একাই চলে যেতাম কলেজ গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে। পথে ক্যাডেট কিংবা এনসিও স্টাফ ছাড়া আর যাদের সাথে দেখা হতো, তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিতাম। যেমন নিরাপত্তা প্রহরী, এম আই রুমের মেডিক্যাল স্টাফ, পিয়ন, প্লাম্বার, মেস ওয়েটার ইত্যাদি। এরাও ওপথে চলাচল করতো কারণ আমাদের ডাকঘরটা ছিল কলেজ গেটে। চিঠিপত্র ডাকবাক্সে ফেলার জন্য সবাইকে ওপথে হাঁটতে হতো। একটা বিষয় খেয়াল করেছিলাম যে সিনিয়র কিংবা সতীর্থদের সাথে আলাপ জুড়াতে আমি অপারদর্শী হলেও, ওদের সাথে বেশ স্বচ্ছন্দ্যে আর সাবলীলভাবে কথা বলে যেতাম। একা বসে থাকা বা ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমার আরেকটা প্রিয় জায়গা ছিলো রসায়ন ল্যাবের সামনের চত্বরটুকু। একেবারে শুনশান নীরবতা বজায় থাকতো। কাঁঠাল গাছগুলোর ফল একেবারে মাটি থেকে ধরা শুরু হতো। টুনটুনি, চড়ুই, দোয়েল, বুলবুলি ইত্যাদি পাখির অভয়ারণ্য ছিলো ঐসব কাঁঠাল গাছ। আমি শুধুই বসে বসে তাদের দেখতাম। জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগতো। একদিন সমমনা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসে গাছের ডাল ভেঙ্গে অনেকক্ষক্ষণ ধরে ডাংগুলি খেলেছিলাম। অপ্রত্যাশিত এ খেলাটা সবাই খুব উপভোগও করেছিলাম।
নির্জন দুপুরে মাঝে মাঝে প্রিন্সিপালের অফিসের পেছনে গিয়ে দূর থেকে আসা মেঠো পথের দিকে তাকিয়ে মোষের গাড়ীর আসা যাওয়া দেখতাম। রাতে ডিনারের পর আমাদের ফ্রী টাইম ছিলো। ক্লাস ৭/৮ এ থাকতে রাত সাড়ে আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত সময়টা নিয়মিত ভাবে কমন রুমে গিয়ে ইনডোর গেমস খেলতাম। সবার আগে দৌড়ে গিয়ে টেবিল টেনিস ব্যাট দখলে নিতাম। তা না পারলে ক্যারম বোর্ড, আর তাও না পারলে দাবা। মাঝে মাঝে রেডিওটা দখলে নিতে পারলে রেডিও সীলন (তখন শ্রীলঙ্কার নাম ছিলো সীলন–Ceylon) কর্তূক প্রচারিত ”বিনাকা গীতমালা” নামের ভারতীয় হিন্দী গানের আসর শুনতাম, কিংবা আকাশবাণী কার্সিয়াং থেকে প্রচারিত হিন্দী ও বাংলা গানের অনুরোধের আসর। নবম শ্রেণীতে উঠার পর ওসব ততটা ভালো লাগতোনা। তখন ঐ সময়টাতে হেঁটে হেঁটে কলেজের গেট পর্যন্ত যেতাম, যাওয়া আসার মাঝামাঝি পথে একটা ছোট কালভার্ট পড়তো। সেই কালভার্টের রেলিঙ এর উপর বসে কিছুক্ষণ গলা ছেড়ে গান গাইতাম। গানের উপর আমার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা, কিন্তু তখনকার জনপ্রিয় কোলকাতার বাঙলা গানগুলো আমার ঠোঁটে ঠোঁটে থাকতো। আমার এ পায়চারীর নিত্যসঙ্গী থাকতো সোহরাওয়ার্দী হাউসের জয়নুল আবেদীন (অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল) এবং মাঝে মাঝে নজরুল হাউসের হাসান তৌফিক চৌধুরী (প্রাক্তন সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরীর ছোটভাই)। জয়নুল এর গানের গলাটা সত্যিই খুব ভালো ছিলো। আমরা যে কালভার্টটির উপর হাসপাতালের দিকে মুখ করে বসে গান গাইতাম, তার ঠিক পেছন দিয়েই চলে গেছে সমান্তরাল মেঠো পথ, তারকাঁটার বেড়ার ওপারে। কদাচিৎ হাটুরে লোকজন হ্যারিকেন হাতে নিয়ে হেঁটে কিংবা গরু/মোষের গাড়ীতে করে বাড়ী ফিরতো। ডিনারের পর হাঁটার সময় আরেকজনকে প্রায়ই দেখতাম একা একা আনমনে হাঁটতে। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে এক ক্লাস সিনিয়র শাহাদৎ হোসেন সেলিম ভাই। পরে তিনি তাঁর নামটা ঈষৎ পরিবর্তন করে সা’দাত হোসেন সেলিম রাখেন। তিনি ঢাকা ক্লাবের পরপর তিনবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি দেশের একজন বিখ্যাত পাখিপ্রেমিক। তাঁর গৃহে অনেক পোষা প্রাণী রয়েছে বলে শুনেছি। আমার অবশ্য পশুপাখি পোষার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই।

ডর্মে যখন কেউ থাকতোনা, তখন চিঠি লিখতে বসতাম। আমার চিঠি আব্বা আম্মার জন্য আনন্দের কারণ হবে, শুধু একথা ভেবেই প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত একটা করে চিঠি লিখে যেতাম, সংক্ষেপে হলেও। আব্বাও নিয়মিতভাবে আমার চিঠির জবাব দিয়ে যেতেন। পরে জেনেছি, তিনি আমার চিঠিগুলো সযত্নে গুছিয়ে রাখতেন। আম্মাও মাঝে মাঝে লিখতেন। ভাই বোনেরাও লিখতো। মাঝে মাঝে কিছু কাজিনদের সাথেও পত্র বিনিময় হতো। সপ্তাহে একদিন টিভি দেখার অনুমতি ছিল, তবে টিভির পর্দায় মাঝে মাঝেই ঝিরিঝিরি আসতো বলে মজা পেতাম না। সে সময়ের ফিলিপ্স এর একটা বিজ্ঞাপন খুব ভালো লাগতো-“Won’t you come in to my house tonight? No, neighbor no!” ডাইনিং হলের সামনের খোলা জায়গাটাতে মাঝে মাঝে Outdoor screen লাগিয়ে projector এর মাধ্যমে প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হতো। ঐ সমস্ত একঘেঁয়ে প্রামাণ্য চিত্রগুলো আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে দেখতাম। একবার এরকম একটা ফিল্ম দেখার সময়ে মাঝখানে হঠাৎ করে “The Beach Wear” নামে একটা ফিল্ম শুরু হয়ে যায় যেখানে বিকিনি পড়া নারী মডেলদের প্যারেড দেখানো হচ্ছিলো। ঘুমাক্রান্ত অনেকেই সাথে সাথে এর ওর কনুই এর গুতো খেয়ে নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু তাদের এ জাগরণ বৃথায় পর্যবসিত হয়ে যায়, যখন হঠাৎ পেছন থেকে প্রিন্সিপাল কর্ণেল আনসারীর এক হুংকার শোনা যায়, “Stop it!” তাঁর এক হুংকারে প্রজেক্টর বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাডেটরা চোখ কচলাতে কচলাতে সারি বেঁধে হাউসে ফিরে আসে।
12557663_10207068688850847_183007908_o
এই কালভার্ট এর রেলিং এ বসে আমি আর জয়নুল রাতের বেলা গলা ছেড়ে গান গাইতাম। আজ, ১৫ জানুয়ারী ২০১৬ তারিখে, জয়নুল কলেজের দ্বাদশ রিইউনিয়নে যোগ দেয় নাই। ওর জায়গায় নিউ ইয়র্ক থেকে আগত মুকুল ছবির জন্য প্রক্সি দিলো।

চলবে….

ঢাকা
১৮ নভেবর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৩,৭৫৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ২৮”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    সব ব্যাচেই এরকম নিভৃতচারি দু'চার জন থাকেন/থাকে।
    পড়ছিলাম, আর আমার এরকম দু'বন্ধুর কথা ভেসে উঠছিল মনের পর্দায়...

    শুধু কনটেন্টই না, উদ্দেশ্যেও আগের কয়েকটা পর্ব থেকে ভিন্নতর।
    ঐপর্বগুলি নতুন নতুন তথ্য পাবার একটা আগ্রহ জাগিয়েছিল। এটায় একটা বিরতি পাওয়া গেল।
    স্মৃতিচারণার এটাও এক বাঁক।
    কিছু কিছু কথা বলতে হয়, এমনি এমনিই.........
    পাঠককে রেসপাইট দিতে। (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।