জীবনের জার্নাল – ২৭

আমার শিক্ষকেরাঃ
জনাব মোঃ আব্দুল গফুর
গফুর স্যার আমাদের ফিজিক্স পড়াতেন। তিনি অতি সহজ সরল জীবন যাপন করতেন, কথাবার্তায় স্পষ্টভাষী ছিলেন, নিয়মনীতি পালনে ও রক্ষায় কঠোর ছিলেন। হোমওয়ার্ক নিয়মিতভাবে দিতেন এবং নিয়মিত ভাবে তা পরীক্ষাও করতেন। ল্যাবেও বেশ সিরিয়াস ছিলেন, কোন ফাঁকিজুকি পহন্দ করতেন না। তিনি ক্লাসে কদাচিৎ হাসতেন, আর একটু নাকি সুরে কথা বলতেন। বাহ্যিকভাবে তিনি খুব কঠোর থাকলেও অন্তরে তিনি ক্যাডেটদের প্রতি স্নেহপ্রবণ ছিলেন। এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে একদিন আমার এক বন্ধু দুষ্টুমি করতে করতে হঠাৎ আমার ফিজিক্স প্র্যাক্টিকাল খাতার একটা পাতা একেবারে মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। নিতান্ত অনিচ্ছাকৃ্তভাবে এটা ঘটে যায়। আমার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। অনেক কষ্ট করে কোনরকমে পাতাটা জোড়া লাগিয়ে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে গেলাম। ভেবেছিলাম, স্যার হয়তো বলবেন পুরো খাতাটা পুনরায় লিখে আনতে। সেটা বললে নির্ঘাত আমার অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হতো, কেননা খাতাটা পুনর্গঠন করতে যে সময় লাগতো, তাতে অন্যান্য বিষয় পড়াশোনার সময়ের ঘাটতি হতো। তিনি গম্ভীরভাবে খাতাটা রেখে দিয়ে বললেন, “ফাঁডা কপাল জোড়া লাগলেও, একটা দাগ থাইক্যা যায়।” কথাটা বাস্তবিকই সত্য ছিলো। ফিজিক্স প্র্যাক্টিকালে আমি অন্যান্যদের চেয়ে ৪/৫ নম্বর কম পেয়েছিলাম। তবে সেটা অন্য অপশনটার চেয়ে ভালো ছিলো। তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেও ঐ ৪/৫ টি নম্বর রেজাল্ট হাতে পাবার পর আমার যথেষ্ট আফসোসের কারণ হয়েছিলো।

জনাব আলী আহমদ
আলী আহমদ স্যার আমাদের এ্যালজেব্রা পড়াতেন, মাঝে মাঝে পাটিগণিত আর জ্যামিতি/ত্রিকোণমিতিও পড়াতেন। কক্সবাজার নিবাসী এই স্যারের ফর্সা মুখে সবসময় একটা মনোমুগ্ধকর হাসি লেগেই থাকতো। তিনি সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা দিতেন। পারতপক্ষে কখনো বকাঝকা দিতেন না, আর এক্সট্রা ড্রিল দেয়ার তো প্রশ্নই উঠেনা। হোমওয়ার্ক ভালো করে করলে তিনি খুব inspiring comments লিখতেন। ক্লাসওয়ার্কে ভালো করলে প্রায়ই এক্সিলেন্ট, সুপার এক্সিলেন্ট ইত্যাদি কমেন্ট দিয়ে আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন। হাসিমুখ ছাড়া তাঁকে কেউ কখনো দেখেছে কিনা বলতে পারবোনা। তিনি আমাদেরকে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও প্রচুর উৎসাহ দিতেন। তাঁর বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ এর মত, এখনো স্যার কর্মঠ ও সক্রিয় জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। তিনি এখন আমেরিকা প্রবাসী।

জনাব মোঃ আব্দুল আজিজ
আজিজ স্যারও আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। মাঝে মাঝে তিনি বেশ রসিকতা করতেন। শিক্ষকদের মধ্যে তিনি প্রবীণতম ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে যখন কলেজ অনেকদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে খুললো, তিনি তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এ সময়টা তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় ছিলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সময়, চারিদিকে ছিলো বিশৃঙ্খ্লা। যুদ্ধের সময় আমাদের কলেজের কিছু আসবাবপত্র লুটপাট হয়েছিলো। সাপোর্ট স্টাফ যারা চলে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে অনেকে তখনো ফিরে আসে নাই। যারা এসেছিলো, তাদের মধ্যেও শৃঙ্খ্লার অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কেউ কারো কথা শুনে না। এমতাবস্থায় কলেজ খোলা হলে চারিদিকে অসন্তোষ বিরাজ করছিলো। ক্যাডেটদের মধ্যেও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিলো। এসব সামাল দিতে গিয়ে স্যার হিমসিম খেয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠতে লাগলো। আমরা আগেই দেখেছিলাম, স্যারের মাঝে মাঝে, বিশেষ করে শীতের সময়ে মানসিক চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিত। তার উপর এমন মানসিক চাপে স্যারের আবার মানসিক চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। কলেজের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কানে গেলো। তড়িঘড়ি করে আরেকজন সিভিলিয়ান অধ্যক্ষকে রাঙামাটি কলেজ থেকে বদলী করে আমাদের কলেজে আনা হলো। তিনিই ছিলেন কলেজের ইতিহাসে ক্যাডেট কলেজের বাইরের কোন অধ্যক্ষ।

জনাব এম এ আজিজ
রাঙামাটি কলেজ থেকে বদলী হয়ে আসা আমাদের এই নতুন অধ্যক্ষের নামও ছিল এম এ আজিজ। তিনি ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। তখন শিক্ষকের অভাবে তিনি অধ্যক্ষ হয়েও আমাদের ইংরেজীর ক্লাস নিতেন। একদিন ক্লাসে এসে তিনি একটা সাধারণ এ্যসেসমেন্ট এর জন্য আমাদেরকে কিছু কাজ দিলেন। আমি সেটাতে ভালো করার জন্য তাঁর প্রশংসা পেলাম। একজন নবাগত অধ্যক্ষের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে সেদিন বেশ উৎফুল্ল হয়েছিলাম। তাঁকে বেশ পছন্দ করা শুরু করলাম, কিন্তু কলেজের টালমাটাল বিশৃঙ্খ্ল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তাঁর অসহায়ত্ব দেখে দুঃখবোধ করতাম। তিনিও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না। ঐ সময়ে বেসামরিক প্রশাসন থেকে বেশ একটা জোর চাপ আসছিলো ক্যাডেট কলেজগুলোকে উঠিয়ে দেবার জন্য। আবার সদ্য স্বাধীন একটা দেশের সামরিক একাডেমী গঠনের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে একদিন একটা তথ্যসন্ধানী দল কলেজে সরেজমিন এসে নানারকম তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা শুনছিলাম যে আমাদের কলেজটাকে সামরিক একাডেমী বানানো হবে। ঠিক এ সময়ে একদিন জেনারেল ওসমানী অসুস্থ হয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হলেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকায় চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি তিনি সময় পেলেন সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলাপের। পরে হাসপাতাল শয্যা থেকেই তিনি ক্যাডেট কলেজগুলোকে রাখার স্বপক্ষে একটা নিবন্ধ লিখে পাঠান, যা পরদিন দেশের উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি ক্যাডেট কলেজগুলোকে রাখার স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। এর কিছুকাল পরে আমরা আবার আমাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদেরকে অধ্যক্ষ হিসেবে পেতে শুরু করি।

চলবে…

ঢাকা
১৭ নভেবর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৪,৬৫৭ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ২৭”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অনেক অজানা কথা প্রকাশিত হচ্ছে।
    ঘটবার সময়ে এগুলোকে মূল্যহীন মনে হলেও এখন এগুলোর অনেক মূল্য আছে।
    একসময় এই কথাগুলো আরও অনেক বাড়বে।
    আমি নিশ্চিত, সে সময়ে অনেকেই খায়রুল ভাই-এর এই জার্নালগুলোকে শক্তিশালি রেফারেন্স হিসাবে উপস্থাপন করবেন।

    শিক্ষকগনের কথা জানাটা আমাকে কিন্তু খুবই আকর্ষণ করছে।
    তাই লিখে জান, আরও বেশী বেশি করে ওনাদের কথা.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      ধন্যবাদ পারভেজ, সামনে আরও কয়েকজন শিক্ষকের কথা থাকবে। বোরিং লাগলে জাস্ট বীয়ার উয়িথ মি।
      আমার এসব কথা নিছক স্মৃতিকথা। কোন দালিলিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে নেই। বিশ্বাস অবিশ্বাস করাটা পাঠকের পূর্ণ এখতিয়ারে।

      জবাব দিন
      • পারভেজ (৭৮-৮৪)

        বোরিং লাগার তো প্রশ্নই ওঠে না, খায়রুল ভাই।
        আমি আসলে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের এই পেশাটা বেছে নেয়ার পিছনের কারন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাবছি।
        খুব ইউজুয়াল কোন পেশা কিন্তু না, সেই জন্যই এই ভাবনা।
        শিক্ষকগনকে নিয়ে আপনার এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবনার অনেক নতুন রশদ দিচ্ছে...


        Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

        জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আপনার ল্বখা ইসিএফে শেয়ার দেয়ায় একটা কমেন্ট আসলো রুসায়াত এর। আমি এখানে দিয়ে দিলাম আপনার মন্তব্য জানার জন্য।
    কিপ ক্যাডেট কলেজ নামে একটা লেখা এখানেও আছে ৭২ এর দিকে ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ও পরে তা বজায় রাখার ব্যাপারে। সেই লেখাটাও পরের কমেন্টে দিয়ে দিচ্ছি।

    রুসায়াত,

    " আমি অন্যরকম কিছু পড়ছিলাম, ক্যাডেট কলেজগুলা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত এত সহজ ছিল না। তখনকার কিছু আওয়ামী নেতাদের সাথে ততকালিন ক্যাডেটদের একটা ঝামেলা হইছিল ফৌজদরহাটে, কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিয়া, এবং সেখান থেকেই লীগের প্রবল ক্যাডেট বিরোধিতা শুরু। ৭১ পরবর্তী সময়ে আর্মি এবং মুজিববাহিনীরর বিরোধ এর মাঝেই ক্যাডেট কলেজ গুলা পরছিল বইলা আমার ধারনা। যাইহোক আগের লেখাটা পড়ার পর জিনিস্টা এত সহজ মনে হয় নাই, ওইটা সম্ভবত ততকালীন ক্লাস ১২ এর কোন ভাই এর লেখা ছিল।"


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      তখনকার কিছু আওয়ামী নেতাদের সাথে ততকালিন ক্যাডেটদের একটা ঝামেলা হইছিল ফৌজদরহাটে, কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিয়া, এবং সেখান থেকেই লীগের প্রবল ক্যাডেট বিরোধিতা শুরু। ৭১ পরবর্তী সময়ে আর্মি এবং মুজিববাহিনীরর বিরোধ এর মাঝেই ক্যাডেট কলেজ গুলা পরছিল বইলা আমার ধারনা। -- এ ব্যাপারে আমার কোন স্পষ্ট ধারণা নেই, তবে তখনকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব, কোনটাই ছিলনা।
      সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনে তখন পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের পক্ষ বিপক্ষে সহানুভূতিশীল/বিরূপ মনোভাবের লোকজনদের সমাবেশ ঘটেছিলো। একদিন আমাদের কলেজের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত স্থানীয় এক মান্যবর প্রধান অতিথি আমাদেরকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছিলেন (অর্থাৎ তার ফরমাল ভাষণের বাইরে), “আপনারা বিকেল বেলা খেলাধুলা করবেন, আর আপনাদের বাপচাচার বয়সী কর্মচারীরা আপনাদের খেলার জন্য বল এগিয়ে দেবে, এটা ঠিক নয়, এটা হবেনা”।
      আমি আমার মূল লেখায় যা বলেছি, তা আমার স্মৃতি থেকে লেখা, কোন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে নেই। জেনারেল ওসমানীর লেখাটা আমি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, সেটাকে তখন আমার খুব কনভিন্সিং এবং আপীলিং মনে হয়েছিলো। আর স্বাধীনতার পর প্রথম সামরিক প্রিন্সিপাল (বর্তমানে প্রয়াত) উইং কমান্ডার এ,কে,এম, বদিউর রহমান স্যার তাঁর প্রথম ভাষণে আমাদেরকে এ কথাটাই বলেছিলেন বলে আমার মনে আছেঃ "Unfortunately for General Osmany but fortunately for us, he (the former) fell ill and got admitted in CMH. He got ample time to focus on this matter during his brief stay at CMH. He wrote an article in the local newspapers and spoke to various authorities in support of keeping the Cadet Colleges. His article received the attention of the highest authority and that is why and how I stand here today" ... (or words to that effect).

      জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        ধন্যবাদ ভাইয়া।
        আমি ইচ্ছা করেই ওখানে কমেন্ট টার উত্তর দিই নাই।
        যেহেতু এর সাথে রাজনীতি জড়িত তাই বিষয়টা অল্প সময়ে বাজে দিকে টার্ন নিতো।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "কীপ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পেইন" লেখাটা পুরো পড়লাম, তবে ৭৬টি মন্তব্যের একটাও পড়ার সময় পেলাম না। "কীপ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পেইন" নামে বা উদ্দেশ্যে ক্যাডেট, তাদের অভিভাবক এবং ক্যাডেট কলেজের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ক্যাডেট কলেজ রাখার স্বপক্ষে জোর চেষ্টা তদ্বির চলছিলো, সে ব্যাপারে অবহিত ছিলাম। আমাদের কলেজেরও কিছু সিনিয়র ভাইরা দৌড়াদৌড়ি করছিলেন বলে শুনেছি। তবে স্পষ্টতঃ কারো অবদানের কথা আলাদাভাবে এখন আর মনে পড়ছেনা।
    এরপর জেনারেল তার পিএস-কে ডেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্যাডেট কলেজের গুরুত্ব এবং ক্যাডেট কলেজের কার্যকারিতা বিষয়ে ইংরেজিতে একটি নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনাটি টাইপ করে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই পিএস ওসমানীর সামনে নিয়ে আসেন। এই টাইপ করা লেখাটি পড়ে ওসমানী তাতে স্বাক্ষর করেন। এরপর ফাইল হাতে নিয়ে উঠে দাড়ান আর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “বয়েস, উইশ মি লাক”। -- সচিবালয়ে এত দ্রুত (কয়েক মিনিটের মধ্যে) কাজ হবার কথা বিশ্বাস করাটা কঠিন। তবে হতে পারে, জেনারেল ওসমানী যে নিবন্ধটি লিখেছিলেন, তার পিএস যদি সেটার একটা কপি সংরক্ষিত রাখেন, এবং সেটাকেই সামারী করে নোট লিখে আনেন, সেটা খুবই সম্ভব।
    অবশেষে সকাল ১০:৩৫ এর দিকে জেনারেল রেড ফোনে বঙ্গবন্ধুকে পান। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, “ক্যাডেট কলেজ বিলুপ্ত করে দেয়ার ব্যাপারে তাকে কে পরামর্শ দিয়েছে এবং তার (ওসমানীর) অগোচরেই কিভাবে ক্যাডেট কলেজ বিলোপের মত কাজটি সম্পাদিত হল?” বঙ্গবন্ধুর সাথে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলার সময়ে তার বিরক্তি ও উদ্বেগ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। তিনি ফোনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাডেট কলেজের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ক্যাডেট কলেজ বিলোপ বিষয়ক পিও টি বাতিল করে দেয়ার কথা বলেন। -- সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর কোন কেবিনেট মন্ত্রী এভাবে কথা বলতে পারেন, এটা আমি কল্পনা করতে পারিনা। নিঃসন্দেহে এ ধরণের কথাবার্তা ঔদ্ধত্য হিসেবে গণ্য হতো। আর জেনারেল ওসমানী একরোখা আর একগুঁয়ে হিসেবে সুপরিচিত হলেও, উদ্ধত বা বেয়াদব হিসেবে পরিচিত ছিলেন না।
    রেড ফোন রেখে দেয়ার আগে ওসমানীর শেষ কথা ছিল, “ক্যাডেট কলেজ থাকলে আমি থাকব, অন্যথায় পদত্যাগ করবো।”-- এভাবে একজন কেবিনেট মন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেন না।
    যাই হোক, লেখাটা তো বানানো নয়, স্মৃতি থেকে লেখতে গিয়ে হয়তো একটু আবেগের মিশেল হয়েছে। "কীপ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পেইন" হয়েছিলো, এটা সত্য। পাইওনীয়ার ক্যাডেট কলেজ হিসেবে এফসিসি'র সিনিয়র ভাইদের অগ্রণী ভূমিকা পালন ও বিশেষ অবদানের কথাও অস্বীকার করছিনা। তবে আমি যা বলেছি, সেটাও সত্য বলেই আমার মনে হয়। জেনারেল ওসমানী তার হাসপাতাল শয্যা থেকেই নিবন্ধটা লিখেছিলেন, এটাকে সত্য বলে মানি, কারণ কথাটা আমাদেরকে আমাদের প্রিন্সিপাল বলেছিলেন। আর শুধু কয়েকজন ক্যাডেটের সাথে উপস্থিত আলোচনা করে জেনারেল ওসমানী এমন ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটাও অবিশ্বাস্য। সামরিক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি, জেনারেল ওসমানী পূর্ণ হোমওয়ার্ক করেই মাঠে নেমেছিলেন।
    এ ব্যাপারে আমি আর কোন মন্তব্য রাখতে চাই না।

    জবাব দিন
  4. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    অনেকদিন পর সুযোগ পেয়ে, বাকি জার্নাল গুলি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। খায়রুল ভাইয়ের এই লেখাটা আর মামূলী স্মৃতিচারনের স্তরে নেই। এর মূল্য অন্যরকম। পারভেজ যেমন বলেছে, এই ধরনের লেখার দালিলিক মূল্য বা প্রয়োগ হতে পারে। ছোটবেলার স্কুলের কথা কত শত শত লেখায় উঠে এসেছে। বেশিরভাগ লেখাই কিন্তু টাইপ্ট, শুধু নিজের কথা, আর বেছে বেছে দু'একজন শিক্ষক, আর অতি বাঁদর বা পাগল কিসিমের দু একজন ছাত্র। এই লেখাতে চরিত্রের সংখ্যা ও বৈচিত্র দু'ই অনেক বেশি। :boss:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।