জীবনের জার্নাল – ২৪

12077386_10206498642680049_769358395_n
JRS এর এই ছবিটা ২০১৪ এর মধ্য জুলাই এ তোলা হয়েছে, লন্ডনে।

কিংবদন্তী শিক্ষক JRS
এমসিসি তে এসে প্রথম যেদিন থেকে ক্লাসে যোগদান করলাম, সেদিন থেকেই জেনেছিলাম এখানকার শিক্ষকগণ তাদের নামের আদ্যোক্ষর দিয়ে পরিচিত। যেমন নাজমুল আহসান-NA, নূরুল ইসলাম-NI, হায়দার আলী-HA, ইত্যাদি। প্রথম দিনের ইংরেজী ক্লাসের শিক্ষক হিসেবে ক্লাস রুটিনে দেখলাম নাম লেখা আছে JRS। কল্পনা করতে থাকলাম, নামটা কি হতে পারে! জাবেদুর রহমান, জিয়াউর রহমান জাতীয় কিছুর সাথে S দিয়ে কোন নাম? কৌ্তুহল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ঘন্টা বাজার পর যিনি ক্লাসে এলেন, তাঁকে দেখে একাধারে বিস্মিত ও চমৎকৃ্ত হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর মুখের দিকে, তিনি কী বলেন তা শোনার জন্য। তিনি একজন বিদেশী, হ্যাংলা পাতলা কিন্তু দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্তি সুদর্শন পুরুষ, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন। প্যান্টের পেছনের হিপ পকেটে হাত ঢুকিয়ে শরীরটাকে ব্যালেন্স করে হাঁটেন। পরে জানতে পেরেছিলাম, কোন একটা দুর্ঘটনার কারণে তাঁর শিরদাঁড়ায় সমস্যা হয়েছিলো, সে কারণে তিনি বেশীক্ষণ মেরুদন্ডটাকে একেবারে সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে বা হাঁটতে পারতেন না। প্রথম ক্লাসে শিক্ষকগণের নিজেদেরকে পরিচিত করানোর রেওয়াজ ছিল। তিনি বাম হাত হিপ পকেটে রেখে ডান হাতে চক ধরে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে উল্টো ফিরে ক্যাপিটাল লেটার্সে তাঁর নাম বড় বড় করে লিখলেনঃ JAMES ROGER SIMPSON। এতক্ষণে আমার কৌ্তুহল দূর হলো।

তিনি জানতেন, আমাদের ক্লাসে রাজধানীর নামী দামী ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়া কিছু চোস্ত ইংরেজী জানা ছাত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিলো মফস্বল জেলাশহর থেকে আগত অখ্যাত বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রও। শেষোক্ত শ্রেণীর ছাত্রদের বোঝার সুবিধার্থে তিনি তাঁর কথাগুলোকে অত্যন্ত ধীরে এবং পরিস্কার ভাবে উচ্চারণ করছিলেন, যেন সবাই বুঝতে পারে তাঁর কথা। তাদের প্রতি তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। এর পরেও প্রথম প্রথম তাঁর অনেক কথাই তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেত। প্রথম ক্লাস থেকেই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লেগেছিলো তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য। তাঁকে ভালো লাগার আরেকটা কারণও ছিলো। আমরা প্রথম কয়েক সপ্তাহেই বুঝে গিয়েছিলাম যে তিনি ৭ম-৮ম শ্রেণীর শিশুতোষ বালকদেরকে শারীরিক শাস্তি দেয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। ছোট খাটো ব্যত্যয়ের জন্য তিনি এক্সট্রা ড্রিল (ইডি) দিতেন না। বড় জোর এক্সট্রা প্রেপ দিতেন। কিন্তু বড়দের শৃঙ্খ্লার ব্যাপারে তিনি আপোষহীন ছিলেন। আমার আবছা মনে পড়ছে যে ৬৯ সালের শেষের দিকে অথবা ৭০ এর প্রথম দিকে একবার একাদশ শ্রেণীর (২য় ব্যাচ) বড়ভাইদের একসাথে অনেককে তিনি ইডি দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে অনেকটা বিদ্রোহের ভাব দানা বাঁধছিলো। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষও চাচ্ছিলেন কিছুটা নমনীয় হতে। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত নমনীয় হননি। আমার এ লেখাটা যদি ২য় ব্যাচের কোন মেকান এর নজরে পড়ে এবং তিনি যদি এ ব্যাপারটাতে একটু আলোকপাত করেন তবে খুশী হবো।

তিনি একজন অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট ছিলেন, কিন্তু একজন অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট যে কি জিনিস তা বোঝার মত সম্যক ধারণা তখন আমাদের ছিলোনা। তবে এখন ভেবে অবাক হই যে সেই তখনকার দিনে, অর্থাৎ ১৯৬৬-৬৯ সালের মত সময়ে একজন ব্রিটিশ অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট কি ভেবে তাঁর নিজ দেশের লোভনীয় কর্পোরেট চাকুরীর মোহ উপেক্ষা করে শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গোড়াই (মির্জাপুর) এর মত একটা ঘোর মফস্বলে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন! প্রথম দিকে তিনি আমাদের শুধু গ্রামার পড়াতেন। গ্রামারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে তাঁর কথা মনযোগ দিয়ে শুনলে গ্রামার পরীক্ষার আগে আর বই ধরতে হতোনা। বোঝার সুবিধার্থে তিনি নানারকমের কেরিকেচার করতেও দ্বিধা করতেন না। যেমনঃ sit up (শোয়া থেকে উঠে বসা) আর sit down (দাঁড়ানো থেকে বসা) এর পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে একদিন তিনি আমাদের চঞ্চল বন্ধু ফাহিয়ানকে বল্লেন, ‘Fahian, stand up!’ ফাহিয়ান উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললেন, ‘Now sit down!’ ফাহিয়ান চেয়ারে বসে পড়লো। তারপর তিনি বললেন, ‘Now sit up!’ ফাহিয়ান এবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কী করবে তা বুঝতে না পেরে দুই হাত দিয়ে পশ্চাদ্দেশে চেয়ারটা চেপে ধরে আস্তে আস্তে চেয়ারসহ উঠে দাঁড়াতে থাকলো। তিনি মুচকি হাসতে শুরু করলেন, আর আমরা ক্লাসের বাকী সবাই না বুঝেই তাঁর সাথে হাসতে থাকলাম। তবে আমরা এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে ফাহিয়ান যা করছিলো sit up বলতে নিশ্চয় তা বুঝায় না। তিনি তখন তাকে টীচার্স প্লাটফর্মে (দুটো চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো উঁচু জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে টীচাররা লেকচার দিতেন) ডেকে নিলেন এবং শুয়ে পড়তে বললেন। ফাহিয়ান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে তিনি তাকে বললেন, Now you sit up, without standing. এবারে ফাহিয়ান এবং সেই সাথে গোটা ক্লাস বুঝে ফেললো, sit up মানে শোয়া থেকে উঠে বসা।

ঢাকা থেকে আমাদের কলেজে যাওয়া আসার পথে চন্দ্রা বা মৌচাকের কাছাকাছি নূরবাগ নামে একটা জায়গা ছিল। রাস্তা নির্মাণে কোন ত্রুটির কারণে ঐ এলাকাটা দিয়ে যখন গাড়ী চলতো, তখন যাত্রীরা খুব ধাক্কা খেতেন। একদিন ক্লাসে পড়ানোর সময় দুটো ইংরেজী শব্দ Jerk আর Bump বোঝাতে গিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা যখন ছুটিতে ঢাকা যাই, তখন ঐ জায়গাটা দিয়ে যাবার সময় কোন কিছু অনুভব করি কিনা। আমরা সহজেই বুঝে ফেললাম, তিনি কোন জায়গা আর কোন অনুভূতির কথা বলছেন, কেননা জার্কিং এর জন্য জায়গাটা কুখ্যাত ছিল। তিনি বুঝিয়ে বল্লেন, আমরা যে ধাক্কা খাই, সেটা হলো Jerk, আর যে কারণে খাই তা হলো রাস্তায় Bump থাকার জন্য।

JRS এর একটা দুই দরজা বিশিষ্ট মিনি অস্টিন গাড়ী ছিল। প্রতি সপ্তাহান্তে তিনি স্ত্রী আর তখনকার ৩/৪ বছরের পুত্র সন্তানকে নিয়ে ঢাকা চলে আসতেন। তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ইংরেজী ভাষা প্রসারের এক কর্মসূচীতে ঢাকা এসেছিলেন। একই কর্মসূচীতে মিঃ জনসন নামে আরেকজন ব্রিটিশ শিক্ষকও তাঁর সাথে এসেছিলেন, কিন্তু পরেরজন কখনো আমাদেরকে পড়ান নাই। তিনি পড়ানোর চেয়ে খেলাধূলায় বেশী আগ্রহী ছিলেন এবং ক্যাডেটদের সাথে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। JRS যখন গাড়ী চালিয়ে ঢাকা আসতেন, মাঝে মাঝে মিঃ জনসনও তাদের সাথে চলে আসতেন। সেদিনের সেই শিশুটি এখন একজন বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে উচ্চপদে কর্মরত। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্নতত্ত্বের উপর একজন বিশেষজ্ঞ বলে বিবেচিত। উল্লেখ্য, আমাদের কলেজ ছেড়ে আসার পর JRS দীর্ঘদিন বাহরাইনে শিক্ষকতা করেছিলেন। তিনি তাঁর কর্মজীবনের একটু শেষের দিকে এসেই ১৯৮৮ সালে Ph.D ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি Norwich, London এ (লন্ডন থেকে ট্রেনে দুই ঘন্টার দূরত্বে) বসবাস করেন এবং ৭৭ বছর বয়সে এখনও University of East Anglia তে অধ্যয়নরত বিদেশী ছাত্রদেরকে ইংরেজী পড়ান। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই নরউইচে সক্রিয় অবসরোত্তর জীবন যাপন করে চলেছেন। তাঁরা মূলতঃ শিল্প সাহিত্য বিষয়ে এবং স্থানীয় চার্চের কর্মকান্ডে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখেন।

লেখাটার শুরুতে উপ শিরোনাম দিয়েছিলাম “কিংবদন্তী শিক্ষক JRS”। এরকম একজন কিংবদন্তী শিক্ষকের কথা মাত্র একটি পর্বে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর সম্বন্ধে বাদবাকী কথাগুলো পরের পর্বে বলে শেষ করবো বলে মনস্থির করলাম। আমার জীবনে তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন কিংবদন্তী শিক্ষক। ছাত্রজীবনে আমি ইংরেজী ভাষার যা কিছু শিখেছি, তার জন্য আমি দু’জনের কাছে আজীবন ঋণী। প্রথমজন আমার মরহুম পিতা, অপরজন JRS। তাঁরা উভয়ে আমার ইংরেজী শিক্ষার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন, বাকীটা শিখেছি ব্যক্তিগত পড়াশোনার মাধ্যমে, যার বেশীরভাগই ছিলো ট্র্যাশ। কিন্তু ইংরেজীর কারণে জীবনের বহু বৈতরণী পার হওয়া আমার জন্য অনেক সহজ হয়েছে। শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজীর কারণে বিএমএ’র পাসিং আউট অর্ডার মোটামুটি ভালো ছিলো, এনডিসি করার সময় এসাইনমেন্ট হিসেবে রিসার্চ পেপার এবং পলিসি পেপার, দুটোই বেস্ট পেপার এওয়ার্ড পেয়েছিলো। এ দুটো সাফল্য তাই আজ আমি তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করলাম। আর এখন পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, ইংরেজীর কারণেই আমার সেনাবাহিনীতে যোগদানের বন্ধ হওয়া দরজাটা হঠাৎ করে খুলে গিয়েছিলো। কিভাবে, সেটা যথাসময়ে বলবো।

চলবে…

ঢাকা
০৮ অক্টোবর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৪,২৭৭ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ২৪”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজীর কারণে বিএমএ’র পাসিং আউট অর্ডার মোটামুটি ভালো ছিলো, এনডিসি করার সময় এসাইনমেন্ট হিসেবে রিসার্চ পেপার এবং পলিসি পেপার, দুটোই বেস্ট পেপার এওয়ার্ড পেয়েছিলো। এ দুটো সাফল্য তাই আজ আমি তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করলাম।"
    এইখানটায় এসে আমিও আবেগাপ্লুত না হয়ে পারলাম না...
    খায়রুল ভাই, আপনার জন্য শত শত :
    :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।