জীবনের জার্নাল – ১৯

চলনে বলনে, পোষাক পরিচ্ছদে, কথা বার্তায়, সব কিছুতেই উইং কমান্ডার কীয়ানির একটা সফিস্টিকেশন ছিলো। অত্যন্ত সুদর্শন এই এয়ারফোর্স অফিসার চিত্রজগতে প্রবেশ করলেও যে তিনি বক্স অফিস তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতেন, সে কথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। ঐ সময়ে দেশের সিনেমাহল গুলোতে একটা জনপ্রিয় ইংরেজী ছায়াছবি The Night Of The Generals চলছিলো। সেই ছবির অন্যতম নায়ক Peter O’ Toole এর সাথে তাঁর চেহারা, চালচলন এবং স্বভাবের অনেক মিল ছিলো। লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে মাস্টার্স করা এই বিদ্বান ব্যক্তির রসবোধ এবং উপস্থিত বুদ্ধি ছিলো অত্যন্ত প্রখর। যার ফলে উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিকটও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যেকোন অনাকাংখিত পরিস্থিতি সামলে ওঠাতে তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। ৭১ এর শুরুতে রাজনৈতিক চরম অসন্তোষের সেই দিনগুলোতে যখন প্রথম প্রথম দেশে লাগাতার হরতাল পালন শুরু হয়েছিলো, তখন একদিন স্থানীয় গোড়াই কটন মিলস এর শ্রমিক কর্মচারী এবং এলাকার রাজনৈ্তিক নেতা কর্মীরা কলেজের গেটের সামনে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলো এবং কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার দাবী জানাচ্ছিলো। একথা শুনে কীয়ানী কলেজ গেট এর কাছে গিয়ে তাদের যুক্তি শুনেছিলেন এবং নিজেও কিছু যুক্তি পেশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর দায়িত্বে রয়েছে প্রায় তিনশ’ জন ক্যাডেট এবং আরো প্রায় একশ’ জন শিক্ষক, কর্মচারী এবং তাদের পরিবার। তিনিও চাচ্ছেন তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে কলেজটাকে সুষ্ঠুভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক, তবে হুট করে নয়। তাদের বাড়ী যাবার একটা ব্যবস্থা না করে এভাবে হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ করে দিলে তাদের বাড়ী ফেরা কষ্টকর হবে এবং পথে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন এবং তাদের আদেশ পেলেই তিনি সব ক্যাডেটকে তাদের নিজ নিজ বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে কলেজ বন্ধ করে দিবেন। সেদিন উত্তেজিত জনতা তাঁর কথা শুনে শান্ত হয়ে বাড়ী ফিরে গিয়েছিলো।

তর্কে বিতর্কে তাঁর সাথে পেরে ওঠার মত কোন জুড়ি মেলা ভার ছিলো। তাঁর উপস্থিত বক্তৃতাগুলো হতো ত্রুটিহীন, শুনলে মনে হতো অত্যন্ত নিখুঁত রিহার্সালের পর তিনি সেগুলো ডেলিভার করতেন। তাঁর সাথে কথায় পেরে ওঠা শক্ত ছিলো বলে কোন শিক্ষক বা কর্মকর্তা পারতপক্ষে তাঁর সাথে কোন তর্কে লিপ্ত হতেন না। তাঁর একটা কথা এখনো বেশ মনে পড়ে-“Popularity earned with loss of authority is cheap popularity”। তবে তিনি শৃংখলার ব্যাপারে তাঁর পূর্বসূরীর তুলনায় অনেক উদার ছিলেন। তিনি মুক্তমনা ছিলেন এবং কলেজের জীবনযাত্রায় মুক্তচিন্তার চর্চাকে উৎসাহিত করতেন। ক্যাডেটদেরকে বিতর্কে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আর লেখালেখিতে প্রেরণা দিতেন। এর আগের লেখাটায় বলেছি, তিনি ভারতেশ্বরী হোমস এর সাথে আমাদের কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনার একটা সেতুবন্ধন গড়ে দিয়েছিলেন। চার দেয়ালের প্রাচীরের মাঝ দিয়ে যখন এমন সুবাতাস বইতে শুরু করলো, তখন আমরা যুগপৎ বেশ বিস্মিত ও পুলকিত হয়েছিলাম। তাঁর সময়ে আমাদের একটা কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশ হবার কথা ছিলো। আমরা অনেকেই উৎসাহ নিয়ে আমাদের নিজ নিজ লেখা জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু সব লেখা জমা দেবার পরও এ ব্যাপারে আর কোন অগ্রগতির কথা শোনা যাচ্ছিল না। একদিন এ্যাসেম্বলীতে সিনিয়র ক্লাসের কোন একজন স্মার্ট ক্যাডেট, যাকে তিনি নিজেও বেশ পছন্দ করতেন, অনেক সাহস নিয়ে তাঁকে ম্যাগাজিন কবে নাগাদ আত্মপ্রকাশ করবে তা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “We haven’t got the rifle yet. Let’s first have the rifle, then we can think about the magazine”. আমি সহ বেশীরভাগ শ্রোতা সেদিন এই কথাটার মানে বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝেছিলাম যে কথাটায় হয়তোবা কোন সূক্ষ্ম কৌ্তুক আছে। তাই না বুঝেই আরো অনেক শ্রোতার মত আমিও সেদিন হেসেছিলাম। কোন প্রকাশনা, বার্ষীকি, সাময়ীকি, ইত্যাদি ছাড়াও Magazine কথাটার যে অন্য কোন মানে আছে, তা সেদিন জানতাম না। পরে অবশ্য জেনেছি এবং মন্তব্যটা ঘটনাত্তোর উপভোগ করেছি।

প্রিন্সিপাল কীয়ানির স্ত্রী ও কন্যা ক্লাস সেভেন এর বাচ্চাদের ইংরেজী পড়াতেন। স্ত্রী পড়াতেন ফর্ম ‘এ’ তে আর তার সুন্দরী কন্যা হুমায়রা পড়াতেন ফর্ম ‘বি’ তে (ফর্মগুলো উল্টাপাল্টা ভাবে হয়তো উল্লেখিত হলো। ভুল হয়ে থাকলে কেউ সংশোধন করে দেবে, এ আশা আছে)। এ নিয়ে ফর্ম ‘বি’র ক্যাডেটদের গর্বের আর ফর্ম ‘এ’র ক্যাডেটদের মনস্তাপের অন্ত ছিলোনা। একদল আরেকদলকে বলতো, তোদের পড়ায় বুড়ী, মোদের পড়ায় ছুঁড়ী। ‘ম্যানার্স এন্ড এটিকেট’ এর উপরেও তাঁরা কথা বলতেন। কীয়ানিদের একটা পোষা বিদেশী কুকুর ছিলো। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে কীয়ানিরা বিকেলে বা সন্ধ্যায় একসাথে হাঁটতে বের হতেন। বেশীরভাগ সময় মিসেস কীয়ানিই কুকুরটাকে হাঁটাতেন, তবে কোন কোন সময় তাঁদের সুদর্শনা কন্যা হুমায়রা কীয়ানিও হাঁটায় এবং হাঁটানোতে যোগ দিতেন। সাধারণতঃ গেমস পিরিয়ডের পরে ক্যাডেটরা যখন হাউসে ফিরে যেতো, তখনই ফাঁকা রাস্তায় তারা কুকুর নিয়ে বের হতেন। যেদিন হুমায়রা একা রাস্তায় বের হতেন, সেদিন হাউসগুলোর বারান্দায় ক্যাডেটদের লাইন পড়ে যেতো। তারা যেন স্বর্গের অপ্সরাকে মর্ত্যে সাক্ষাৎ বিচরণ করতে দেখে সম্মোহিত হয়ে যেতো। বারান্দার ফ্লাইপ্রুফ নেটের আড়াল থেকে ক্যাডেটরা তাকে পরিস্কার দেখতে পেতো, কিন্তু তিনি বা তাঁরা রাস্তা থেকে ক্যাডেটদেরকে দেখতে পেতেন না, পেলেও আবছা আবছাই দেখতে পেতেন। অন্যদিন যেখানে বাথরুমে কার আগে কে যাবে এ নিয়ে যুদ্ধ বেঁধে যেতো, হুমায়রা যেদিন বের হতো, সেদিন বাথরুমগুলো অনেকটা খালি পড়ে থাকতো। অনেক ক্যাডেট সেদিন সান্ধ্য গোসল ছাড়াই প্রেপের (Prep Time) জন্য তৈ্রী হতো।

প্রায় ৪৮ বছরের পুরনো স্মৃতি। সবকিছু ভালো মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে তখনকার ক্লাস টেন এর ছাত্র হিসেবে হুমায়রার ব্যাপারে আমরা ছিলাম নিতান্তই “অনলুকার্স” (দর্শক)। তার কিছুটা কাছে ঘেঁষার বা সাহচর্য লাভ করার এখতিয়ার ছিলো কেবল একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর বড়ভাইদের। আমাদের জন্য ভারতেশ্বরী হোমস এর সমবয়সী ছাত্রীদের সাথে কিছু উৎসুক দৃষ্টি বিনিময় আর কলম বন্ধুত্বের অনুরোধ জানানোই যথেষ্ট ছিলো। হুমায়রার বয়স তখন হয়তোবা বিশ কিংবা বিশোর্ধ্ব হয়ে থাকতে পারে। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মহিলা ছিলেন। তিনি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন, নিজেও বোধকরি গাইতে পারতেন, যদিও তার গান শোনার সৌভাগ্য আমার কোনদিন হয়নি। শুনেছিলাম, কোন একটা আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য যখন আমাদের কলেজের একটি দল অন্য একটি কলেজে গিয়েছিলো, তখন সেখানকার একটি গালা নাইটে হুমায়রা, এডজুট্যান্ট কাইয়ুম মালিক এবং আমাদের কলেজের প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সঙ্গীতশিল্পী আলমগীর ভাই সেখানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। একবার আমাদের কলেজের বড় কোন একটা অনুষ্ঠানের দিনে পাকিস্তানী হুমায়রা বাংলাদশী সাজে সেজেছিলেন। তিনি সুন্দর করে একটা গোলাপী রঙের শাড়ী পড়েছিলেন, সাথে ছিলো ম্যাচিং করা অনুষঙ্গ, যেমন লিপস্টিক, নেল পলিশ আর হাতব্যাগ। ঐ সাজে তাকে অপরূপ লাগছিলো, আর তিনি প্রজাপতির মত অজস্র বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যতদূর জেনেছি, তিনি আজীবন অবিবাহিতা রয়ে গেছেন এবং সম্ভবতঃ এখনো লাহোরে কোন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হুমায়রার সাথে ঘনিষ্ঠ এক সিনিয়র ভাই আমার কাছে মন্তব্য করেছেন, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিক এর উচিত ছিলো হুমায়রাকে বিয়ে করা।

এমসিসিতে যখন কীয়ানির অনুপ্রেরণায় অন্যান্য ক্লাবের সাথে মিউজিক ক্লাবও গঠিত হলো, তখন হুমায়রা মাঝে মাঝে সেখানে গীটার শেখাতে আসতেন। ঐ সময়ে আলমগীর ভাই কলেজের সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একজন ভাল গীটার বাদকও ছিলেন বটে। মিউজিক ক্লাবের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনকারী সতীর্থরা বলতো যে হুমায়রা ঐ সময়ে আলমগীর ভাইয়ের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। আমরাও আলমগীর ভাইয়ের চালচলনে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। তিনি একটু উদাস উদাস ভাব দেখাতেন। রবিবারে ছুটির দিনে ইনস্পেকশন এর পর সবাই যখন খেলার মাঠে অথবা ক্যান্টিনে যেতো, আলমগীর ভাই তখন একা একা জানালায় বসে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। অবশ্য আলমগীর ভাই এরও এক ক্লাস সিনিয়র দু’জন বড়ভাই খুব সুন্দর গীটার বাজাতেন আর ইংরেজী গান গাইতেন। এরা দু’জন ছিলেন তৎকালিন কলেজ ক্যাপ্টেন শফিক চৌধুরী ভাই আর কামরুন নূর ভাই, যিনি বর্তমানে আমেরিকাতে এক আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে জীবন যাপন করছেন এবং নাম পরিবর্তন করে নিজেকে আরজুনা নূর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তিনি moodspace.com এর স্বত্বাধিকারী। গুগলে গিয়ে Guru Arjuna সম্বন্ধে খোঁজ করলে তার কাজ সম্পর্কে জানা যাবে। বয়সে তার চেয়ে ২০ বছরের ছোট, স্ত্রী ক্রিস্টিনাকে নিয়ে তিনি লস এঞ্জেলিস ও হাওয়াইয়ে বসবাস করেন। এদের দু’জনের সাথেও সঙ্গীতানুরাগী হুমায়রার খুব ভাল সখ্যতা ছিল বলে আমরা শুনতাম।

চলবে…

ঢাকা
১২ অগাস্ট ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

১,৮৭৪ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ১৯”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ৩য়। ;;)

    আমরা কলেজে থাকাকালীন এরকম কোন প্রিন্সিপ্যাল পাই নি... :((
    মানে যার সুন্দরী মেয়ে আছে, আর কি! ;))


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "আমাদের জন্য ভারতেশ্বরী হোমস এর সমবয়সী ছাত্রীদের সাথে কিছু উৎসুক দৃষ্টি বিনিময় আর কলম বন্ধুত্বের অনুরোধ জানানোই যথেষ্ট ছিলো" - এরকম কলম বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়াতে উভয়পক্ষের মাঝে ভাষা চর্চা বেড়ে গিয়েছিলো।

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ঘটনার বর্নন ছাড়াও এই পর্বে উপস্থাপিত মনঃজাগতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো ভাল লাগলো।
    তাছাড়া আসর মাতানো কোনো নাটকিয়তা ছাড়াই এভাবে ধরে রাখতে পারাটা আসলেই খুব ভাল লাগছে...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।