জীবনের জার্নাল – ১৭

তৃতীয় এ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন এ কাইয়ুম মালিক, আর্টিলারীঃ
ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদের কলেজের এ্যাডজুট্যান্ট থাকা অবস্থাতেই মেজর পদবীতে উন্নীত হয়েছিলেন। পদোন্নতির পর তাঁর বদলির আদেশ আসে। আর্টিলারী কোর এর ক্যাপ্টেন এ, কাইয়ুম মালিক তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। নতুন এ্যাডজুট্যান্ট দেখতে খুব ইয়ং লুকিং ও সুদর্শন ছিলেন, নম্রতা ভব্যতার দিকেও একটু এগিয়েই ছিলেন বলতে হয়। তার তুলনায় আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন আনোয়ার একটু বেশী রাফ এ্যান্ড টাফ ছিলেন হয়তো এ কারণে যে তিনি আমাদের সিনিয়র ভাইদেরকে কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর কঠোর প্রশিক্ষণ পরিবেশের সাথে এখান থেকেই কিছুটা ধাতস্থ করে তুলতে চেয়েছিলেন। যাই হোক, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিক তার সুআচরণ আর খেলাধূলার প্রতি অতি উৎসাহের কারণে ক্যাডেটদের মাঝে, বিশেষ করে সিনিয়র ভাইদের মাঝে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন। গেমস পিরিয়ডে তিনি নিয়মিতভাবে ক্যাডেটদের সাথে খেলাধূলায় অংশ নিতেন। কোন আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতা সামনে থাকলে তিনি গেমস পিরিয়ডের পরেও অতিরিক্ত সময় ধরে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত দলের সাথে খেলে প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি নিজে খুব ভাল হকি খেলতেন, অন্যান্য খেলাতেও পারদর্শী ছিলেন।

তিনি বেশ সংস্কৃতিমনাও ছিলেন, মোটামুটি ভালো গানও গাইতে পারতেন। তখনকার দিনে একটি তুমুল জনপ্রিয় উর্দু গান ছিলো, “যাব কয়ি পেয়ারসে বুলায়েগা, তুমকো এক শাকসি ইয়াদ আয়েগা…”। গানটি ছিলো ‘জিন্দেগী কিতনি হাসিন হ্যায়’ সিনেমার, গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কন্ঠে গীত। সেই গানটির মাঝখানে একটা লাইন ছিলো, “যাব কয়ি সিতারা টিমটিমায়েগা, তুমকো এক শাকসি ইয়াদ আয়েগা…।” তিনি এই গানটি খুবই দরদ দিয়ে গাইতেন। তার সময়ে আমাদের হকি টীম সম্ভবতঃ রাজশাহীতে (অথবা ফৌজদারহাটে) গিয়েছিলো আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে। খেলা শেষে ফিরে আসার আগের রাতে মেজবান কলেজ এক প্রীতিভোজ আর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছিলো। সেই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আমাদের এ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিক “যাব কয়ি পেয়ারসে বুলায়েগা” গানটি গেয়ে আসর মাত করেছিলেন। শ্রোতাদের সারিতে তখন নাকি একজন সুদর্শনা রূপসী উপবিষ্ট ছিলেন। গানের মাঝে যখন ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিক “যাব কয়ি সিতারা টিমটিমায়েগা” অংশটি গাইতেন, তখন নাকি তাঁর আর সেই রুপসীর চোখের তারাগুলো একসাথে মিটমিট করে জ্বলে উঠতো। আমিতো কখনো কোন কলেজ টীমে খেলিনি, তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি এতসব জানলাম কী করে? গর্বের সাথে বলতে চাই, তখন কলেজ হকি টীমে আমাদের ক্লাসের ওমর আহমেদ আদেল (ওয়াসিম নামে অধিক পরিচিত) সেই নবম শ্রেণী থেকেই দাপটের সাথে খেলতো। তার বাবা আলমগীর মোহাম্মদ আদেল আন্তর্জাতিক মানের হকি আম্পায়ার ছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজেও ভালো হকি খেলতেন। সেই আদেল যখন প্রতিযোগিতা শেষে কলেজে ফিরে এসে আমাদের কাছে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলো, তখন আমি মনযোগ দিয়ে তা শুনেছিলাম। এ ছাড়াও আরো অন্য সিনিয়র ভাইদের মুখেও আমি একথা শুনেছিলাম।

একদিন ডিনার শেষে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে হাউসের সামনের রাস্তায় ইতস্ততঃ পায়চারী করছিলাম। রাতের আকাশে তখন চাঁদ ও মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছিলো। মাঝে মাঝে বিজলীও চমকাচ্ছিলো। উল্লেখ্য যে তখনকার দিনে ডিনারের পরের সময়টুকু আমাদের জন্য ফ্রী টাইম ছিলো। যে যাকিছু নিজের পছন্দমত করতে পারতো। পায়চারী করতে করতে হঠাৎ দেখি ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিকও রাস্তায়। তিনি সেই চমৎকার আবহাওয়াটা উপভোগ করতে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। পোষাকে আশাকে তিনি সবসময় বেশ পরিপাটি থাকতেন। সেই রাতের বেলায় পায়চারী করতেও তিনি খুব ওয়েল ড্রেসড হয়ে বের হয়েছিলেন। আমাদেরকে দেখে কাছে ডেকে নিলেন। অনেক ইনফরমালভাবে আমাদের অনেক ব্যক্তিগত তথ্যও জেনে নিলেন। আমাদের মধ্যে কেউ গান জানি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর নেতিবাচক হওয়াতে মৃদু ভর্ৎসনাও করলেন। এমন রোমান্টিক আবহাওয়া পেলে বোবার কন্ঠেও সঙ্গীত বেজে ওঠে বলে তিনি জানালেন। আমাদের মধ্যে কেউ একজন তাঁর ফ্রেন্ডলী মুডের সুযোগ নিয়ে তাঁকে অনুরোধ করে বসলো একটা গান শোনানোর জন্য। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, তিনি সেই রাতে রাস্তার একটু পাশে সরে গিয়ে ফুটবল মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে খালি গলায় শুরু করলেন সেই গান, “যাব কয়ি পেয়ারসে বুলায়েগা, তুমকো এক শাকসি ইয়াদ আয়েগা…”। তিনি যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে এই গানটি করছিলেন, তখন আমার মনে হয়েছিলো, আকাশের বুকে তিনি পাকিস্তানে রেখে আসা তাঁর কোন প্রিয়জনের মুখ খুঁজছিলেন।

এই ভদ্রলোকটিরও যে মেজাজ আছে, তা আমরা টের পেলাম কিছুদিন পরেই। আমাদের হাউস (ফ হ) থেকে ক্লাসরুমগুলোতে যাবার পথে মেইন কম্পলেক্সে ঢুকেই হাতের বামে যে সিঁড়িটা ছিলো, সেটার সাদা দেয়ালে কে যেন লাল কালিতে (খুব সম্ভবতঃ ইটের টুকরা দিয়ে) লিখে রেখেছিলো মাত্র দুটো শব্দঃ Complete! Complete! মনে হয়, আগের দিন কলেজ অডিটোরিয়ামে বসে টিভি দেখে আসার সময় কেউ একজন ঐ কম্মটি করেছিলো। কে সেই উদাত্ত আহ্বানটুকু লিখে রেখেছিলো, তা আজ অবধি মনে হয় অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। কিন্তু যেই সেটা লিখে থাকুক না কেন, আজ পশ্চাৎদৃষ্টে মনে হয় সে এক মস্ত দার্শনিকই ছিলো বটে। ‘Complete! Complete!’ শব্দ দুটি দিয়ে লেখক কী কমপ্লিট করতে আহ্বান জানিয়েছিলো, তা এক অজানা বিস্ময়ই রয়ে গেছে, তবে তা নিয়ে দিন দিনান্তে গবেষণার অন্ত ছিলনা। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মালিকও পুরো কলেজকে ফল ইন দিয়ে বারংবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘Complete! Complete!’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তবে তখন তাঁর এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কেউ ছিলোনা। রেগে মেগে তিনি স্ল্যাং ব্যবহার শুরু করলেন, ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু খারাপ কথাও বললেন, কিন্তু সবাই নিরুত্তর। এর পরে তিনি আমাদের গণশাস্তি দিয়েছিলেন, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত ছিলনা বলেই আমার মনে হয়েছিলো।

গণশাস্তির সময়ে আমাদেরকে সেই প্রথম দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজ গেটের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। পুরো কলেজ যখন মেইন রোডের উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছিলো, তখন ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলগামী জনৈক বিদেশী তার জীপগাড়ীটি থামিয়ে কী হচ্ছে তা কৌ্তুহলভরে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন আমাদেরই ব্যাচমেট কাজী ইকবাল হোসেন ওরফে “চাল্লি”, যে তার ক্যাডেট নাম্বার “১৮৮” সংখ্যাটি দ্বারা অধিক পরিচিত ছিলো, দৌড়াতে দৌড়াতেই উত্তর দিয়েছিলো, “We are being treated like animals”. ঐ পরিস্থিতিতে এরকম একটা স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর দিতে পারাটা যুগপৎ স্মার্টনেস ও গাটস এর পরিচায়ক ছিলো। আমরা তার এই দুটো গুনের পরিচয় পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। তার আরও বিবিধ গুনাবলীর কথা পরের দিকের লেখাগুলোতেও উঠে আসবে বলে আশা করি। হাউসে ফিরে এসে আমাদের মধ্যে অনেকে তাদের প্যারেন্টস কে চিঠি লিখেছিলো তাঁরা যেন কলেজে এসে তাদেরকে বাড়ী ফিরিয়ে নেয়। আমার একজন রুমমেট অতিশয় আবেগ মেখে তার বাবাকে চিঠি লিখে জানালো, ” We were made to run a long distance. Whosoever had slowed down, was whipped like a dog” – or words to that effect. বলাই বাহুল্য, কথাগুলো ছিলো অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত।

চলবে…

ঢাকা
০২ আগস্ট ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

২,৯৫৪ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ১৭”

  1. ফারাবী (২০০০-২০০৬)

    ভাল লেগেছে স্যার। স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে সেই যুগের ফীলটা পাওয়া যায়, যেটা খুবই সুখপাচ্য। সেই যুগ আর এই যুগের ক্যাডেটদের জেনারেশন গ্যাপ এত বেশী হওয়া সত্ত্বেও চিন্তার প্যাটার্নের এই অদ্ভুত মিল দেখে সত্যিই মজা লাগে।

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    তিনি যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে এই গানটি করছিলেন, তখন আমার মনে হয়েছিলো, আকাশের বুকে তিনি পাকিস্তানে রেখে আসা তাঁর কোন প্রিয়জনের মুখ খুঁজছিলেন।

    “We are being treated like animals”. ঐ পরিস্থিতিতে এরকম একটা স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর দিতে পারাটা যুগপৎ স্মার্টনেস ও গাটস এর পরিচায়ক ছিলো

    স্যার, ইচ্ছে করলে চমতকার এসব উদ্ধৃতি দিয়ে মন্তব্য ভরে ফেলা যায়। আপনার এই লেখার কোন লাইনই ফেলনা নয়। অসাধারণ


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    গণশাস্তির ধরণ শুনে উলটো মজাই লাগল।
    আমাদের কলেজে প্রতি বছর ক্রস কান্ট্রি কম্পিটিশনের কয়েকদিন আগে প্র্যাকটিস ক্রস কান্ট্রি হত। ঐদিন আমরা হৈ হৈ করতে করতে কলেজের এক গেট দিয়ে বের হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে চক্কর মেরে আরেক গেট দিয়ে ঢুকতাম। আমাদের কাছে তো ওটা অনেকটা আউটিং এর মতন ছিল!

    কমপ্লিট! কমপ্লিট!
    এটা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রহস্য ছোট গল্প হতে পারে।
    কে কমপ্লিট করল? কি কমপ্লিট করল? কিভাবে কমপ্লিট করল?...?? 😀

    সাথেই আছি।
    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ‘Complete! Complete!’ এর রহস্য আমরা কলেজে থাকা পর্যন্ত খুলে নাই। হয়তো এ পর্যন্ত তা রহস্যই রয়ে গেছে। আমার এ লেখাটা পড়ার পর আমার চেয়ে তিন ব্যাচ কনিষ্ঠ এক ছোটভাই ফোন করে জানিয়েছিল যে ‘Complete! Complete!’ এর পরে নাকি লেখা ছিল - written by Nabi Newaj. ওর কথাটা শুনে আবছা মনে পড়লো, হ্যাঁ, এরকম হয়তো কিছু একটা লেখা ছিল। তবে বলাই বাহুল্য, সে সময়ে Nabi Newaj বলতে কলেজে কেউ ছিলনা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।