জীবনের জার্নাল – ১০

আগে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমাদের ভাইভা আর মেডিকেল টেস্ট শেষ হবার পর পরই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের পোষাক আশাকের মাপযোখ নেবার জন্য কলেজ থেকেই এক টেইলর মাস্টারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিলো। তিনি বেশ মনযোগ দিয়ে আমাদের শরীরের মাপযোখ নিচ্ছিলেন আর তা রেজিস্টারে লিখে রাখছিলেন আমাদের পোষাক তৈ্রীর জন্য। তখন আমাদেরই মধ্যকার একজন, হ্যাংলা পাতলা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাধারী ছোটখাট ধরণের কাজী ইকবাল হোসেন (১৮৮), খুব ফুরফুরে মেজাজে ফড়িং এর মত এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আর অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। ভাইভার প্রথম দিনেও সে এতটাই কথা বলছিলো যে তত্তাবধানকারী শিক্ষক তাকে ‘টকেটিভ’ বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন। তাকে খুব স্মার্ট আর সবজান্তা বলে মনে হচ্ছিলো। অনতিবিলম্বে সে অন্যান্য সতীর্থদের কাছ থেকে সেই ইউওটিসি গ্রাউন্ডেই (এখন বোধহয় ওটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়াম বলে) ‘চাল্লি’ উপাধি অর্জন করেছিলো, যা আজীবন তার মাথায় শিরোপা হিসেবে রয়ে যায় এবং আজও আছে। আমি নিশ্চিত যে আজ এই ৪৮ বছর পর আমাদের অনেকেই তার আসল নামটা স্মরণ করতে না পারলেও, চাল্লি বললেই সহজে তাকে চিনে যাবে এবং তাকে নিয়ে অফুরন্ত গল্পের বাক্স খুলে বসবে। সেই ইউওটিসি গ্রাউন্ডেই সে কলেজ থেকে পাঠানো কল আপ লেটারের লেফাফাটি হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছিলো। তার বাবা তখন কোন একটা সেন্ট্রাল জেলের ‘জেলার’ (Jailor) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তো আর কম্পিউটার ছিলোনা, ঠিকানাগুলো লেখা হতো হস্তলিপিতে। কোন এক করণিক হয়তো ভুলে তার বাবার ঠিকানায় Jailor শব্দটির স্থলে Tailor লিখেছিলো। অথবা হাতের লেখার কারণে J টাকে T এর মত দেখাচ্ছিলো। আর এটা নিয়েই সে আসর গরম করে তুলেছিলো। মাপ নেয়া সেই টেইলর মাস্টারকে দেখিয়ে সে বলে বেড়াচ্ছিলো, “My father is not a tailor like him, he is a Jailor”! আমরা বেশ মজা পাচ্ছিলাম, বোধকরি সেও পাচ্ছিলো। ওর কাহিনী সবিস্তারে বলার জন্য আলাদা একটা চ্যাপ্টার এর প্রয়োজন পড়বে। তাই আপাততঃ ওর প্রসঙ্গটা এখন তোলা রইলো।

সেই টেইলরের প্রসঙ্গটা টানলাম এই জন্য যে হাউসে এসে আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমাদের সবার বেডের উপরে (বেড বলতে ছিলো জুট টেপ লাগানো এক চারপয়) সদ্য বানানো আমাদের ইউনিফর্ম ও অন্যান্য পোশাকাদি সুন্দর করে লে-আউট করে রাখা হয়েছে। আমরা কয়েকটা পোষাক, ক্যাপ, বুট ইত্যাদি পরিধান করে দেখে নিলাম, কেমন লাগে। যে টেইলরের কথা এতদিনে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, তার নিখুঁত হাতের বানানো পোষাক আমাদের চেহারাই পাল্টে দিয়েছিলো। পাশেই ছিলো একটা কাবার্ড, যার উচ্চতা আমার চেয়ে সামান্য বেশী ছিলো। বড়ভাই দু’জন আমাদেরকে বেশ নিষ্ঠার সাথে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন, কি করে কাবার্ডে কাপড় চোপড়, বইপত্র ইত্যাদি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। প্রতি রবিবারে সাপ্তাহিক “প্রিন্সিপালস ইন্সপেকশন”, আর প্রতি সোমবারে “প্রিন্সিপালস প্যারেড” হবে। সেখানে কারো খুঁত ধরা পড়লে হাউসের নম্বর কাটা যাবে আর এজন্য অপরাধীকে হাউসের আর বাদবাকী সবার রোষানলে পড়তে হবে, একথা ভাইয়েরা জানিয়ে দিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। আর আবেদ ভাই অতি মৃদুস্বরে জানিয়ে দিলেন, রুম ক্যাপ্টেন হিসেবে এজন্য তাকেও লজ্জিত ও অপদস্থ হতে হবে।

দেখতে দেখতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চললো। রুম ক্যাপ্টেন জানালেন, হুইসেল বাজলেই আমাদেরকে ডিনারের জন্য ‘ফল-ইন’ হতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার ড্রেসটা পড়ে নিলাম, অর্থাৎ সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, নেভী ব্লু রঙের একটা সুন্দর ডিনার বেল্ট আর টাই। মুশকিল হলো নবাগত ৬ জনের মধ্যে ৪ জনই আমরা টাই এর নট বাঁধতে শিখি নাই। বাকী ২ জন বাসায় রিহার্সেল দিয়ে এসেছিলো, তা সত্ত্বেও একজন কোন রকমে নট জাতীয় কিছু একটা বানালো যা একটুতেই খুলে গেলো, তবে অপরজন, অর্থাৎ আবদুল্লাহ (১৯৩) একাই খুব সুন্দর একটা নট বাঁধতে পেরেছিলো। বড়ভাইয়েরা প্রথমদিন আমাদের নট বেঁধে দিয়ে জানালেন যে এর পর থেকে শেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের নট আমাদের নিজেদেরই বেঁধে নিতে হবে। আর শেখানো হবেনা। আমি ভয়ে প্রথম দিনের সেই বাঁধা নটটা প্রায় একমাস ধরে কোনদিন খুলিনি। পরে বন্ধু আবদুল্লাহ সুন্দর করে আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে টাই এর নট বাঁধা শিখিয়ে দিয়েছিলো, যে শিক্ষা আজীবন আমার ঝুলিতে রয়ে গেছে। এজন্য আবদুল্লাহকে ঘটা করে কোনদিন ধন্যবাদ জানাইনি, তবে এই ছোট্ট ইহসানটুকুর জন্য নিশ্চয়ই প্রকৃ্ত বিনিময়দাতা তাকে পুরস্কৃত করবেন। আর আমার এ লেখাটা যদি কোনদিন আবদুল্লাহ’র নজরে আসে, তবে সে সহজেই আমার অন্তরের উষ্ণ কৃ্তজ্ঞতাটুকু অনুভব করে নিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

হঠাৎ কান ফাটানো এক হুইসেল এর শব্দে চমকে উঠলাম। পরে জেনেছিলাম, এমন কর্ণ বিদীর্ণকারী হুইসেল গোটা দশেক স্টাফদের মধ্যে কেবল একজনই বাজাতে পারতেন, তার নাম হাবিলদার মেজর আব্দুল আজিজ, ওরফে নিক্কু। বলা বাহুল্য নিক্কু উপাধিটা ক্যাডেটদের তরফ থেকে দেয়া ছিলো। কেন, সেকথায় আসবো পরে। হুইসেল শোনার সাথে সাথে আমরা সবাই তড়িঘড়ি করে হাউস এর সামনের রাস্তায় ‘ফল-ইন হ’লাম। ছোটবেলায় ‘মুকুল ফৌজ’ এর প্যারেড করায় ‘ফল-ইন’ কথাটার সাথে আগেই পরিচিত হয়েছিলাম, কিছুটা ‘লেফট-রাইট, এবাউট টার্ণ, রাইট টার্ণ, লেফট টার্ণ’ ইত্যাকার ওয়ার্ডস অব কমান্ডের সাথেও পরিচিত ছিলাম। ডাইনিং হলে যাবার জন্য তখন দুই হাউসের মাঝখানে এখনকার মত কাভার্ড ওয়াক ওয়ে ছিলোনা। হাল্কা ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে অনভ্যস্ত পায়ে সবার সাথে মার্চ করতে করতেই ডাইনিং হলে প্রবেশ করলাম। আমাদের কলেজে সপ্তাহে সপ্তাহান্তে (উইক এন্ড নাইট) অর্থাৎ শনিবার রাত্রে পোলাও দেয়া হতো। যতদূর মনে পড়ে, বোধকরি নবাগত সম্বর্ধনা উপলক্ষে সেদিনটা শুক্রবার হওয়াতে শনিবারের পরিবর্তে ঐ সপ্তাহের পোলাওটা শুক্রবার রাতেই দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আগেই বলেছি, সেদিন দুপুরে বাসা থেকেও পোলাও খেয়ে এসেছিলাম, কিন্তু মন খারাপ করা আবেগের কারণে খুব সামান্যই খেতে পেরেছিলাম। মাঝে অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়াতে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিলো। মনে আছে, কলেজের প্রথম ডিনারটা বেশ তৃপ্তির সাথেই খেয়েছিলাম।

খাওয়া শেষ করার পর আমরা এক এক করে পিঁপড়ার মত সারি বেঁধে ডাইনিং হল ত্যাগ করলাম। খাওয়ার শুরুতে আর শেষে কলেজ ক্যাপ্টেন কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে দোয়া পাঠ আমাকে চমৎকৃত করেছিলো। উল্লেখ্য যে তখনো কলেজে আলাদাভাবে ডাইনিং হল ক্যাপ্টেন এর পদ সৃষ্টি করা হয় নাই। আর কলেজ ক্যাপ্টেনকে তখন কলেজ ক্যাপ্টেন নয়, ‘সিনিয়র ক্যাডেট’ হিসেবে সম্বোধন করা হতো। হাউসে ফিরে আসার পর রুম ক্যাপ্টেন আমাদেরকে হাউস কমন রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম, বেশ কিছু ইংরেজী আর বাংলা সংবাদপত্র স্ট্যান্ডের উপর কাঠের মার্জিন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুটো দাবার বোর্ড, দুটো ক্যারম বোর্ড আর একটা টেবিল টেনিস এর সরঞ্জাম দেখতে পেলাম। দূরে কোণায় বোধকরি একটা থ্রী ব্যান্ড রেডিওও ছিলো। এসব দেখে খুব খুশী হলাম। একপাশে একটা জায়গায় নামাযের ব্যবস্থাও দেখতে পেলাম। উল্লেখ্য যে তখনো কলেজে কোন মাসজিদ নির্মিত হয়নি। আর এখনকার মত তখন মাগরিব এর নামায পুরো কলেজ এক জামাতে পড়ার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। নামায পড়া উৎসাহিত করা হতো বটে, তবে কলেজের দৈনন্দিন অবশ্য করণীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা। আমরা জুম্মার নামাজ পড়তাম স্টাফ রুমে আর তার সামনের বারান্দাটাতে। মেহেন্দীর লাল রঙে রঞ্জিত শ্মশ্রুমন্ডিত একজন হুজুর আমাদের নামাযে ইমামতি করতেন। নবাগত সপ্তম শ্রেণীর যারা পবিত্র ক্বোরান পাঠ জানতোনা, হুজুর তাদেরকে শুক্রবার বিকেলে ক্বোরান পাঠ শিক্ষা দিতেন। যারা জানতো, তাদেরকেও আবশ্যিকভাবে উপস্থিত থাকতে হতো। তাদের কোন কাজ থাকতোনা বলে তারা একটু আধটু দুষ্টুমি করতো। হুজুর রেগে গেলে আমাদেরকে “হায়েনার দল” বলে সম্বোধন করতেন, একথা বেশ মনে আছে।

কমন রুম দেখার পর যার যার বেডে ফিরে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। বাসা থেকে আনা স্লীপিং ড্রেসটা পড়ে নিলাম। লাইন ধরে দাঁত ব্রাশ করে এলাম। আমাদেরকে জানানো হলো, রাত ঠিক দশটায় বিউগল বাজানো হলে সাথে সাথে রুমের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে হবে। বিউগল যথাসময়ে বাজলে আমরা লাইট অফ করে দিয়ে যার যার বেডে শুয়ে পড়লাম। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। আব্বা ফিরে যাবার পর থেকে সতীর্থ সবার সাথে মিলে মিশে যাওয়ায় একবারের জন্যও তাঁর কথা মনে হয়নি। শোয়ার পর যেন এক সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। সারাদিনের কর্মযজ্ঞের ছবি সেলুলয়েডের ফিতের মত চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে শুরু করলো। আম্মা ও ভাইবোনদের কথাও খুব করে মনে পড়তে লাগলো। ভাবতে থাকলাম, ওরাও নিশ্চয়ই তখন আমার কথা ভেবে মন খারাপ করছে। আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো। সাথে আকাশ চেরা বিজলীর চমকানি আর তার পরপরেই বজ্রের হুঙ্কার। আমাদের হাউসটার আশে পাশে অনেকগুলো শেয়ালের বাসা ছিলো। তারা তারস্বরে চীৎকার শুরু করে দিলো। আমার বিছানাটা ছিলো জানালার ঠিক পাশেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো একটুখানি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই, কিন্তু সিনিয়রের ভয়ে সাহস হচ্ছিল না। এক সময় মনে হলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একজনের ফিসফিসানিতে মনে হলো সে জেগে আছে, কিন্তু কথা বলার কোন উপায় নেই। সিমপ্যাথেটিক ডেটোনেশন হলো। আমার দুটো চোখ দিয়েও নীরবে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। মোচড়ানো ভেজা বালিশটাকে এপাশ ওপাশ করেও আর অনেক দোয়া দরুদ পড়েও সারারাত চোখে ঘুম আনতে পারলাম না। প্রথম রাতটা বলতে গেলে নির্ঘুম কাটালাম। ভোরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেলে আমি চুপি চুপি পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
231195_10150177372617623_2356074_n
এই ছবিটা বোধহয় ঠিক ৭ম শ্রেণীতে থাকাকালীন তোলা নয়। যতদূর মনে পড়ে, এটা ৮ম কি ৯ম শ্রেণীতে থাকাকালীন তোলা হয়েছিলো।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে একটা ইংরেজী কবিতা লিখেছিলাম গতবছরে, যা ইতোপূর্বে ফেইসবুকে প্রকাশিত হয়েছিলোঃ

At MCC – Our First day

Khairul Ahsan

MCC
Just three letters,
Represent my Alma Mater,
Momenshahi Cadet College,
A name permanently etched
In my heart, and will so remain,
And shine for ever, will never wane.

It was a day of torrential rain,
The Seventh of July, Nineteen Sixty Seven.
We, a raw bunch of fifty six pre-teen agers,
Set out from our home amid rain and thunders,
For an unknown place that was called as Gorai
With the Gojari trees around, rising very high,
Some offshoots of River Gorai, flowing nearby.

By the afternoon our parents had departed,
Leaving us in the care of the Staff appointed.
We were lined up, as the NCOs got us sorted
As per our Houses, to where we were escorted.
When darkness fell, our Room Captains came
And showed us our bed, a taped steel frame,
A chair, desk and cupboard, each on our name.

After dinner we were taken to the Common Room
Where we could play ping pong, chess and carom.
For the news seekers there were few newspapers
Rest of the room was occupied by just onlookers.
Then at the strike of ten when a bugle was sounded
The lights were put out as we were quite astounded
To see everyone quit all and rush to their own bed.

And that’s when came the discomforting moments,
As memories of home began unfolding in segments
Like a celluloid tale in our tender minds’ canvases.
With subdued weeping, some counted life’s curses.
Some eyes turned red and some pillows got wet,
The jackals crying outside made some more upset.
Some wise souls wondered: Is this the life of a cadet?

And thus slowly came to an end our first day at MCC,
The next day began with a rush that we didn’t foresee.
The rush to visit washroom before the morning ‘Fall In’
And to get dressed up for PT and wait to be called in.
The first night’s woes were soon to be forgotten,
Our Houses became our home, a family we had gotten.
And our lives got tied to orders, both oral and written!

Dhaka
15 May 2014
Copyright Reserved.

চলবে…

ঢাকা
১৪ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

২,৮৬৯ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ১০”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    হুজুরের মুখে 'হায়েনার দল' সম্বোধন? তাও আবার সেভেনের বাচ্চাগুলোকে? খুব হার্শ শুনালো, জানেন। আমার ছোটবেলায় আরবি পড়ার প্রথমদিকে হুজুর নারকোল শলার কাঠিতে মারলে হাতে ব্লিস্টার পড়ে গিয়েছিলো। হুজুর ওয়াজ ফায়ার্ড ইমেডিয়েটলি। এরপর যে হুজুর এলেন তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবেনা। এতটুকু একটা মানুষ ছিলাম কিন্তু হুজুর আপনি সম্বোধনে ডাকতেন। পড়া পারলে বলতেন, আপনি আমার আম্মা ছাড়া আর কেউ না। পড়া না পারলে বলতেন, আপনি আমার শ্বাশুড়ি আম্মা! 😀

    ক্যাডেট কলেজে আমাদের কেউ কখনো এসব নামে ডাকাডাকি করেননি। কলেজে কেউ আমাদের কোরান পড়াননি। মাগরিবের নামাজ ছিল বাধ্যতামূলক আমাদের। তিনতলায় আমাদের প্রেয়ার রুম ছিল। কলেজে মসজিদ ছিলনা আমাদের সময়ে।

    আপনার ডিটেইলগুলো দারুণ। ক্যাডেট নাম্বারও সব মনে আছে দেখছি। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। 🙂

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      কথাটা একটু হার্ষ শোনায় বটে, কিন্তু উনি বোধকরি সেরকম হার্ষ কোন কিছু মীন করতেন না। এগুলো হুজুরদের কিছু কমন টার্মিনোলজী। যেমন, ওনারা পশু বলবেন না, বলবেন জানোয়ার। তবে আমাদের ঐ হুজুর একটু নরম সরম গোছেরই ছিলেন। অন্য হুজুরদের মত কখনো বেত হাতে নেয়া দেখিনি। আমাদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে শুধু বিরক্তিভরে বলতেন, "হায়েনার দল"! হুজুর আজ পরপারে। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন!
      "পড়া পারলে বলতেন, আপনি আমার আম্মা ছাড়া আর কেউ না। পড়া না পারলে বলতেন, আপনি আমার শ্বাশুড়ি আম্মা!"
      চমৎকার তার এনালজী। 😀
      আমি আমার ব্যাচের সবার ক্যাডেট নাম্বার এখনো মুখস্ত বলতে পারি। ব্যাচের জন্য যখন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, তখন কোন লিস্ট দেখতে হয়না, কারণ ১৮০ থেকে ২৩৫, সবার নাম্বারই মুখস্ত আছে। এবং কে কোথায় আছে, কী করছে, সবই বলতে পারি, শুধু যারা পরপারে চলে গেছে তাদের ছাড়া। তবে শুধু দু'জন, ২১৭ আর ২২৬, এরা কে কোথায় আছে তা কেউ জানে না। জীবিত আছে না ম্রহুম, তাও কেউ বলতে পারেনা।

      জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাদের সময়ে ('৯৫-'০১) পোলাও দিত শুধু বৃহস্পতিবার। নামেই পোলাও, মানে পোলাও এর চাল হলেও ঘি, তেলসহ হাবিজাবি তেমন কিছুই থাকত না। অথচ তারপরও কলেজের মতন সুস্বাদু পোলাও আমি অন্য কোথাও খাই নি, মায়ের হাতেও না!

    আমাদের প্যারেড হত শনিবার এবং বুধবার। প্রথমে প্রিন্সিপ্যাল প্যারেড ফিক্সড ছিল না, পরে এক সিভিল প্রিন্সিপ্যাল আসার পর শেষ দুই বছর প্রতি শনিবার প্রিন্সিপ্যাল প্যারেড হত।

    আমাদের লাইটস অফ বেল হত ১০ঃ৪৫ মিনিটে।
    ক্লাস সেভেন, এইটের কোরআন ক্লাস হত সপ্তাহে দুই দিন- আফটারনুন প্রেপ এর সময়ে।

    ১১ নম্বরের অপেক্ষায় থাকলাম! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      আমাদের সময় পোলাও যদিও দু'দিন দেয়া হতো, তবে সপ্তাহের মাঝখানেরটা (মঙ্গলবার) হতো সাদামাটা ধরণের। কিন্তু সপ্তাহান্তেরটা (শনিবার) হতো দারুণ! ডাইনিং হলের ভেতরে ঢোকার আগেই পোলাও এর গন্ধ নাকে আসতো আর ক্ষিদেটা বেড়ে যেতো। ডাইনিং টেবিলে ভিনেগার থাকতো। ওটা সবকিছুর স্বাদ কেন জানি অনেকটা বাড়িয়ে দিতো।
      ১০ঃ০০টার লাইটস আউট খুব কড়াকড়িভাবে পালন করা হতো, তবে স্বাধীনতার পরে সবকিছুই শিথিল হয়ে যায়। এর জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী ছিলাম, কেননা আমরা তখন সিনিয়র ক্লাসে ছিলাম।
      আমাদের সময়ে প্রেপগুলো নিজ রুমেই করতাম, ক্লাসরুমে যেতে হতোনা। তবে হাউস মাস্টার আর হাউস টিউটর এর পায়চারী খুব নিয়মিত ছিলো।

      জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      এর আগের লেখাটায় জুনায়েদ এর একই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম, "মনের একটা ভালো কোয়ালিটির শ্লেট দিয়েই বোধ হয় জীবনটা শুরু করেছিলাম। সেখানের প্রতিটা আঁচড় এখনো জ্বল জ্বল করে। আশা আছে, যখন একদিন নাতি নাতনিরা ঘরে আসবে, তাদেরকেও জীবনের এসব গল্প শোনাতে পারবো।"
      একই কথা এখানেও বলা যায়।

      জবাব দিন
  3. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    আপনাদের সময় বুট দেয়া হতো? আমরা তো যদ্দুর মনে পড়ে আমাদের তো অক্সফোর্ড প্যাটার্নের এক প্রকার কালো রঙয়ের শক্ত সু-এর গোড়ালিতে ঘোড়ার নালের মত অর্ধচন্দ্রাকৃতি ইস্পাতের প্লেট স্পাইক দিয়ে গেঁথে দেয়া হতো। আমরা সেসবের ভিন্নতর ব্যবহার খুঁজে নিয়েছিলাম। এই ধরুন, দীর্ঘ বারান্দার অর্ধেকটা-মত পথ দ্রুত দৌড়ে এসে তারপর স্কি করে বাকীটুকু পাড়ি দেয়া। মাঝে মাঝে তাল সামলাতে না পেরে পতাত মোজাইক-মেঝেতল। অথবা সিনিয়রদের ওপর গোস্বা করে কিংবা হয়ত অকারণেই সবাই মিলে ডাইনিং হলে খচখচ শব্দ করা।

    লেখা আরো গতিশীল হচ্ছে। চলুক, সাথেই আছি।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      এখনকার আর্মি বুট আর তখনকার অক্সফোর্ড সু'জ এর মাঝামাঝি এক ধরণের মোটা সোলওয়ালা জুতো দেয়া হতো, যেটাকে আমি বুট বলেছি। ডিনারের পোষাকের সাথে পায়ে পড়ার জন্য ছিলো আলাদা এক জোড়া অক্সফোর্ড সু'জ। আমাদের সেই বুটের সাথেও হর্স সু আকৃ্তির নাল পড়িয়ে দেয়া হতো। আমরাও ওগুলো পড়ে রাস্তা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে খট খট করে হেঁটে যেতে আনন্দ পেতাম, মাঝে মাঝে তোমাদের মত বারান্দায় স্কী করার প্রয়াস নিতাম। নাল লাগানো হিলওয়ালা বুট পড়ে ড্রিল করার সময় একটা আলাদা জোশ আসতো।

      জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "A chair, desk and cupboard, each on our name."
    এইটা পড়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
    যখন রুমে গেলাম, আমিও এসবই পেলাম। পেয়ে কি যে খুশি হলাম!
    কারন সেই প্রথম আমার নিজের জন্য একটা খাট পাওয়া (বাসায় জন্মের পর থেকেই শেয়ার করছি, ছোট ভাইএর সাথে)
    নিজের কাবার্ড। (এটা কখনোই ছিল না। বাসায় কাপড় থাকতো হয় আলনায় নয়তো ট্রাংকে।)
    নিজের একটা টেবিল আর চেয়ার (এটাও বাসায় নিজের ছিল না। ভাইদের সাথে শেয়ার করেছি চিরটা কাল)

    প্রথমবার এত সব সম্পদের মালিকানা পেয়ে কি যে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম আব্বা চলে যাবার আগেই, বলার না!!!
    অথচ, সবাই যাবার সাথে সাথে দেখি, কে একজন এসে প্রথমে টেবিল নিয়ে চলে গেল! আরেকজন এসে চেয়ার নিয়ে চলে গেল!!
    সদ্য সম্পদ হারানো আমি প্রচন্ড খেদ নিয়ে ডর্ম লিডারের কাছে গিয়ে বিচার দিলাম, "ইকবাল ভাই, আমার টেবিল চেয়ার সব নিয়ে যাচ্ছে তো!!!"
    উনি বললেন, হ্যাঁ ওগুলো তোমার দরকার নাই। ওগুলো ওদেরই। তোমরা পড়াশুনা করবে প্রেপে, রুমে না। ওগুলো সিনিয়াররা ব্যবহার করবে।"

    দুটো কারনে টেবিল চেয়ার শর্ট পড়তো, ১) ভাঙ্গা যত সহজে হতো, রিপ্লেসমেন্ট তত সহজে আসতো না, ২) একটু সিনিয়াররা একাধিক টেবিল নিজেদের দখলে রাখতেন।
    এইভাবে যা কম পড়তো, সেটা ক্লাস সেভেনকে না দিয়ে পুষিয়ে যেতো।

    তাইলে শুরুতে ছিল কেন?
    ঐ যে প্যারেন্টস দের দেখানো, "দেখুন কত দারুন জায়গায় থাকবে আপনার সন্তান। নিজের চেয়ার আছে, টেবিল আছে..."
    আসলে ঠনঠন...

    এখন ভাবি, এই অসততাটুকু দিয়ে শুরুটা না হলে কি এমন ক্ষতি হতো?


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      অনেক ধন্যবাদ পারভেজ, তোমার প্রথম দিনের স্মৃতিটা এখানে শেয়ার করার জন্য। আমি দুঃখিত যে তোমার এ মন্তব্যটার জবাব আগে দেয়া হয়নি। কি করে যে সেটা বাদ পড়ে গেলো বুঝতে পারছিনা।
      তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক পড়ে কলেজে ঢুকেছো। তোমাদের সময় আসতে আসতে বোধহয় ফার্নিচার ভাঙ্গাভাঙ্গি শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তাই শর্ট পড়াও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আমরা নতুন ফার্নিচার পেয়েছিলাম।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।