জীবনের জার্নাল – ৯

10933813_10152545555877623_7983992424556605231_n
My Alma Mater, MCC, etched permanently in my heart. The foundation of my education was laid in this building by capable scholars and leaders. This is the front view of the main Academic Building of the then Momenshahi Cadet College, now known as Mirzapur Cadet College.
(Photo credit: Mahbub Shaheed Bhai, Cadet No. 3)

যতই রিক্সা এগোচ্ছিলো, ততই আমার ভেতরে উত্তেজনা বাড়ছিলো। আমরা সরু পীচঢালা যে পথ ধরে এগোচ্ছিলাম, তার ডানপাশ দিয়েই একটা মাটির পায়ে চলা পথ ধরে কিছু সাধারণ মানুষ যাতায়াত করছিলো। বৃষ্টিতে ভিজে সে পথটা ভীষণ কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিলো। আশেপাশে গাছপালা আর খাল নালা দেখছিলাম। পুরোপুরি গ্রামীণ পরিবেশে রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ সামনে দেখা গেল এক চমৎকার স্থাপত্যের সাদা বিল্ডিং। আরো একটু অগ্রসর হলে আরো কিছু বিল্ডিং নজরে এলো। সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স আর কালো টাই পরা কিছু জেন্টলম্যানকে দেখা গেলো, সাথে খাকী ইউনিফরম পরা কিছু সেনাসদৃশ ব্যক্তি। সবুজের মাঝে হঠাৎ এই শুভ্রতার আবির্ভাবে সবকিছুই কেমন যেন ঝলমলে হয়ে উঠলো। একটা জায়গায় এসে আমাদেরকে রিক্সা থেকে নামতে হলো। ব্যাগসহ আমাকে এবং আমার মত আগত অন্যান্য ক্যাডেটদেরকে একটা বড় হলরুমে নিয়ে যাওয়া হলো, যার নাম পরে জেনেছি ‘কলেজ অডিটোরিয়াম’। সেখানে আমাদেরকে আমাদের সাথে আগত অভিভাবক ও অতিথিদের থেকে পৃ্থক করা হলো। কে কোন হাউজে থাকবে তা জানিয়ে দেয়া হলো। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল ‘জিন্নাহ হাউজ, স্বাধীনতার পরে যেটাকে ‘ফজলুল হক হাউজ’ নামে নতুন নামকরণ করা হয়েছিলো।

একটা স্বাগত সম্ভাষণের পর আমাদেরকে হাউজে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত করা হলো, তার আগে সুযোগ দেয়া হলো আমাদের অভিভাবকদের সাথে শেষ কথাবার্তা সেরে ফেলার জন্য। ইতোমধ্যে দেখলাম আব্বা অন্যান্য কয়েকজন অভিভাবকের সাথে পরিচিত হয়ে আলাপরত। তাঁরই সমবয়সী একজনের সাথে তিনি এগিয়ে এসে আমাকে তাঁর পুত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সালাম দিলাম। পরে জেনেছি তিনি ছিলেন আমার সতীর্থ মুজিব(২৩০) এর বাবা। আব্বা আমাকে বললেন, কোন অসুবিধা হলে আমি যেন আ্মার শিক্ষকগণকে জানাই। এছাড়া তিনি আমাকে প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃ একটা করে চিঠি লেখার পরামর্শ দিলেন। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, এখানে আমার কোন অসুবিধে হবেনা, কারণ এখানকার সবাই ভদ্র ও মার্জিত। আমি আশ্বস্ত হলাম।

আব্বাকে পায়ে ধরে সালাম করার সময় আব্বা আমার মাথায় তার স্নেহের হাত বুলালেন। আমি বিগলিত হলাম, অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করলাম। তারপর আব্বা আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন। এখানে আসার সময় আমরা দুজনা একসাথে ছিলাম। এখন ফেরার পথে আব্বা একা। একা একা ফিরতে তার মনটা কতটা খারাপ লাগবে সেকথা ভেবে ব্যথিত বোধ করলাম। একটানা তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে, যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়। একসময় তাঁর অবয়বটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। তবে জগতে কোন ব্যথাই স্থায়ী নয়। বিধাতা মানুষের মনে যেমন ব্যথার অনুভূতি দেন, তেমনি ব্যথা ভোলারও যথেষ্ট উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন। আব্বা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবার পর আমি আমার নতুন ঠিকানায় আশ্রয় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম এবং আহ্বানের অপেক্ষায় রইলাম। এদিক সেদিক একটু হাঁটাহাঁটি করে দূর থেকে আমার ‘হাউজ’টাকে দেখে নিলাম। আর বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ আর সাদা ডাইনিং হলটাকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। ভাবতে থাকলাম, এমন গহীন গ্রামে এত সুন্দর দালান কোঠা আর খেলার মাঠ কে তৈরী করে দিলো?

আমার ‘হাউসে’ আসার পর থেকে মনটা ভালো হয়ে গেলো। আমাকে দোতলার মাঝামাঝি একটা ৮ বেডের রুমে রাখা হয়েছিলো। রুমে আমার জিনিসপত্র রেখে একটু বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, চোখ জুড়িয়ে গেল। সামনে তাকালেই দেখা যায় সাদা ডাইনিং হলটা আর আমাদের মতই আরেকটা হাউস, যার নাম তখন ছিলো লিয়াকত হাউস, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি হাউস। সবচেয়ে ভালো লাগলো ডানদিকে কোণাকুণি তাকাতে। বিস্তীর্ণ ফুটবল মাঠের উপর দিয়ে দেখা যায় দূরে কয়েকটি দালান, যেগুলো পরে জেনেছি শিক্ষক ও স্টাফদের আবাস ছিলো, আর তার ফাঁক দিয়ে আরও দূরে দেখা যায় নদীর মত কিছু একটা। আসলে ওটা ছিলো নীচু জলাভূমি, কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে যা ফুলে ফেঁপে নদীর আকৃ্তি নিয়েছিলো। আমাদের কক্ষের ৮ জনের মধ্যে ৬ জনই আমরা নবাগত ক্যাডেট, আর দরজার কাছের দুই বেডে আমাদের চেয়ে দুই ক্লাস জ্যেষ্ঠ দুই সিনিয়র ক্যাডেট, যথাক্রমে আবেদ আহাদ চৌধুরী ভাই এবং ইফতেখার আহমেদ (অথবা হাসান) চৌধুরী ভাই। প্রথমজন রুম ক্যাপ্টেন আর দ্বিতীয় জন তার সহকারী। তাদের উভয়কে মনে হলো অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং অতি সজ্জন ব্যক্তি। কয়েকদিন পরে অবশ্য টের পেয়েছিলাম যে দু’জন অতি সজ্জন ছিলেন ঠিকই, তবে মৃদুভাষী হিসেবে একজন ছিলেন আসলেই স্বভাবগত, আরেকজন আরোপিত। নতুন ক্যাডেটদের সামনে একটু ‘ভাব’ আনার জন্যই দ্বিতীয়জন মৃদুভাষী সেজেছিলেন। শ্রোতা পেলে তার মত আলাপী লোকের জুড়ি মেলা ভার, এটুকু বুঝতে আমাদের জন্য দু’তিন দিনই যথেষ্ট ছিলো।

চলবে…

ঢাকা
১২ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

১,৮৫১ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ৯”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap: :clap: :clap:

    পড়তে পড়তে কেবলই মনে হচ্ছে, আপনি কি গিংকো বিলোবা নিয়মিত খান নাকি, ভাইয়া?
    এতো ডিটেইলে কি করে লিখছেন অবাক হচ্ছি। প্রতিটি পর্বের কী চমৎকার দৃশ্যকাব্য। মুগ্ধ!

    জবাব দিন
  2. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    পর্বে পর্বে লেখা যেন আরো সুচয়িত, আরো পরিশীলিত হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি বিমুগ্ধতা আপনার ভেতরের কিশোরটিকে একটু একটু করে কিভাবে পরিবর্তিত করে তুলছে, স্তবকে স্তবকে সেসবের আরো বিস্তারিত বর্ণনা পেতে চাই।

    এসব রচনায় সাধারণতঃ লেখকের মনে লিখেই পোস্ট করবার একটা তাড়া কাজ করে। রেশ টেনে নিয়ে ধীরে এগুলে আখেরে ভাল ফল দেবে। ধন্যবাদ, স্যার।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      মোস্তফা, তুমি ঠিকই বলেছো। একটা লেখা শেষ হলে পোস্ট করার আর তর সয় না। লেখাগুলো যে খুব ভেবে চিন্তে লিখছি, তা নয়। অনেকটা দিন আনি দিন খাই এর মতো। অনেকে ব্যক্তিগত ই মেলে অথবা টেলিফোনে নানারকমের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছে, অনেক পরামর্শও দিচ্ছে, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমার পরামর্শটাও বেশ সময়োপযোগী হয়েছে। আমিও ভাবছিলাম এরকম কিছু একটা।
      আসলে আমি গদ্যলেখা আগে কখনো লিখিনি, যদিও প্রবন্ধ লিখেছি কিছু। এ লেখাটা আমি লিখছি কিছু বলার তাগিদে, স্মৃতিগুলো ম্লান বা এলোমেলো হয়ে যাবার আগেই। সিসিবিতে এসে আমি উপলব্ধি করেছি, এখানে অনেকে যেমন অনেক কিছু বলতে চায়, তেমন শুনতেও চায়।

      জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    সেই প্রথম দিন । আট জনের রুমে চার জন আমরা নতুন ক্লাস সেভেন । তিন জন ক্লাস এইট আর এক জন ক্লাস নাইনের, যিনি রুম প্রিফেক্ট ।
    আমিই রুমে প্রথম এলাম । তারপর বাকী তিন জন ।
    বাবা মা এক এক করে এক জনকে রেখে সেই বেরিয়ে যাচ্ছেন অমনি সে কেঁদে আকুল হচ্ছে । আর আমি প্রতিবার কাবার্ডে মুখ লুকিয়ে হাসছি ।
    মুক্ত পাখীর মতোন আমার সেদিন বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস বুকের ভেতর সমুদ্রের ঢেউওয়ের মতোন আছড়ে পড়ছে ।
    বাকী সব কথা যেনো সেই অনুরণন ।
    আপনার লেখার কল্যাণে যেনো আবার সেই জীবন আর একবার ...

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাদের সময় (১৯৯৫) শুরুতেই কালচারাল ফাংশন ছিল।
    এরপর টি ব্রেক। টি ব্রেকের পর অভিভাবকগণ বিদায় নিয়েছিলেন।
    আমার অবশ্য ডিটেইলস কিছু মনে নেই।
    ফ্রেন্ড সার্কেলে আলোচনা শুরু হলে আবছা আবছা মনে পড়ে...

    আপনি কি করে এত মনে রেখেছেন, খায়রুল ভাই??? 😮


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    তোমাদের অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
    মনের একটা ভালো কোয়ালিটির শ্লেট দিয়েই বোধ হয় জীবনটা শুরু করেছিলাম। সেখানের প্রতিটা আঁচড় এখনো জ্বল জ্বল করে। আশা আছে, যখন একদিন নাতি নাতনিরা ঘরে আসবে, তাদেরকেও জীবনের এসব গল্প শোনাতে পারবো।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      খুবই ইন্টারেস্টিং ছবি।
      গাছ-পালা শুন্য খোলা মাঠে বিশাল এক দালান, একলা দাঁড়িয়ে।
      আমাদের কলেজের এরকম পুরোনো কিছু ছবি দেখে বেশ মজা পাই।
      এখনকার গাছে ভরা জঙ্গল হয়ে ওঠা ছবিগুলো থেকে বিশাল বৈপরিত্য।
      এক্ষেত্রেও তাই হবে নিশ্চয়ই


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।