জীবনের জার্নাল – ৮

সাত জুলাই সাতষট্টি, দিনটি ছিলো শুক্রবার, বাংলা ক্যালেন্ডার মোতাবেক ২৩শে আষাঢ়। তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিলো রোববারে, শুক্রবার ছিলো অর্ধদিবস, জুম্মার নামাযের জন্য বেলা ১২টায় অফিস আদালত ছুটি হয়ে যেতো। আমাকে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে রেখে আসার জন্য আব্বা ঐ দিনটা ছুটি নিয়েছিলেন। সকাল থেকেই আমর মনটা খুব খারাপ ছিলো। কলেজে যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো, বাসার সবাই আমার সাথে ততই সদয় আচরণ করা শুরু করেছিলো। এমনকি ভাইবোনদের সাথে সচরাচর যেসব বিষয়ে খুনসুটি হতো, সেসব বিষয়ে তারা আমাকে ছাড় দিতে শুরু করলো। অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশী বেশী পাওয়া এই আদর আপ্যায়ন আমাকে কেন জানি আরও বেশী ব্যথিত করে তুলছিলো। আম্মা সেদিন পোলাও কোর্মা রেঁধেছিলেন। আমি যা যা খেতে পছন্দ করতাম, মেন্যুতে তার অধিকাংশই ছিলো। কিন্তু কি আশ্চর্য, খেতে বসে দেখি আমার সে পছন্দের খাবারগুলো কিছুতেই গলা দিয়ে নীচে নামছেনা। ঢোক গিলে গিলে আর পানি খেয়ে খেয়ে কোনমতে গিলে উঠলাম।

কলেজের নির্দেশানুযায়ী বানানো নতুন পোষাক পড়ে নিলাম। পকেটে নতুন রুমাল। রওনা হবার সময় সবার চোখে পানি। আম্মার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। বাসার সবাই একে একে নানা ধরনের মায়া লাগানো উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আমার ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছিলো। দুপুর দুটোর দিকে আমি আর আব্বা বাসা থেকে রওনা হয়ে ফুলবারিয়া রেল স্টেশনের পেছনে (এখনকার গুলিস্তানের পেছনে) এসে নামলাম। তখন টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বাসগুলো ওখান থেকেই ছাড়তো। আর টাঙ্গাইল জেলায় কোন রেলপথ ছিলনা। আমার মত আব্বাও এর আগে কখনো টাঙ্গাইল জেলার কোথাও যান নাই। সেজন্য তিনি একদিন আগে এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছিলেন, কিভাবে কিভাবে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে যেতে হবে। আড়াইটার দিকে বাস ছাড়লো, সেটা ছিলো ইপিআরটিসির (বর্তমানে বিআরটিসি) একটা বাস। তখন আজকের দিনের মত মহাখালী টু এয়ারপোর্ট রাস্তাটা ছিলোনা। টাঙ্গাইল ময়মনসিংহের বাসগুলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতো। পুরনো ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন পার হয়ে কুর্মিটোলা দিয়ে এয়ারপোর্ট এর কাছে গিয়ে উঠতো। ওখান থেকেই মোটামুটি নিরিবিলি রাস্তা শুরু হতো। উত্তরার অস্তিত্ব ছিলনা, একেবারে টঙ্গীতে গিয়ে কিছু জনবসতি ছিলো। রাস্তাগুলো খুব সরু ছিলো। বিপরীতমুখী যানবাহনগুলো একে অপরকে অতিক্রমের সময় একটু স্লো হয়ে রাস্তার একপাশে দু’চাকা নামিয়ে অপরকে যেতে দিতো। যানবাহনের স্বল্পতার কারণে কদাচিৎ ওভারটেকিং এর প্রয়োজন হতো।

টঙ্গীর পর থেকেই রাস্তা খালি। জয়দেবপুর (বর্তমানে গাজীপুর) চৌ্রাস্তার পর থেকে সবকিছু একেবারে শুনশান, শুধু বাসের চাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। মৌচাক এর কাছাকাছি থেকে শুরু হলো গজারীর বন। আকাশে চলছিলো মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা। ধীরে ধীরে এ্যাংজাইটি অব দ্য আনসার্টেন- অজানার আশঙ্কা আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। যতই গজারীর বনের গভীরে প্রবেশ করছিলাম, ততই যেন সাইলেন্স অব দ্য গ্রেভ- ক্ববরের নীরবতা আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলছিলো। ভাবছিলাম, এই অজ পাড়াগাঁয়ে আমি দিনের পর দিন থাকবো কী করে! গন্তব্য যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলো, আব্বার অস্থিরতাও তত বাড়ছিলো। বারে বারে বাসের কন্ডাক্টরকে নানা প্রশ্ন করছিলেন। একটা জায়গায় এসে দেখলাম রাস্তার উপর বাজার বসেছে। তখন আম কাঁঠালের সীজন ছিলো। রাস্তা জুড়ে শুধু আম আর কাঁঠালের ছড়াছড়ি। জায়গাটার নাম কালিয়াকৈর। জানালা দিয়ে দেখলাম, রাস্তার পাশেই একটা সিনেমা হলও ছিলো। সেদিনের দেখা সেই সিনেমা হলের প্রসঙ্গ পরে আরো আসবে। বাসের কন্ডাক্টর ঘোষণা দিল, ক্যাডেট কলেজ আর দশ মিনিটের পথ। ঘোষণা শুনে আমি নড়ে চড়ে বসলাম।

মাত্র দেড় ঘন্টার মাথায় আমরা সেদিন ফুলবাড়িয়া থেকে পাবলিক বাসে করে ক্যাডেট কলেজ স্টপে পৌঁছেছিলাম। অথচ আজকের এই ডিজিটাল যুগে নিজস্ব গাড়ীতেও সে পথ মাড়াতে কম করে হলেও তিন ঘন্টা সময় গুনতে হয়। অথচ পীচ ঢালা পথ অনেক মসৃণ হয়েছে এবং চারগুণ প্রশস্ত হয়েছে। সত্যিই, মনুষ্য শক্তি আর শ্রম ঘন্টার কি নিদারুন অপচয়! এদিকটায় যদি সমাজবিজ্ঞানীরা একটু খেয়াল দিতেন! যাহোক, বাস থেকে নেমে জানলাম, সেখান থেকে কলেজের অভ্যর্থনা এলাকা অনেকটা পথ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌ্তুহলী দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে তাকাতে থাকলাম। একটা ত্রিকোনাকৃতির খোলা প্রাঙ্গণে রড-সিমেন্ট-পাথরের ঢালাই করা কংক্রিটের নির্মিত একটা সাদা রঙের বিশাল তীরের ফলার (Arrowhead) উপর লাল রঙে জ্বল জ্বল করে লেখা ছিলো, “MOMENSHAHI CADET COLLEGE”। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ঐ তীরটা একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিচিহ্ন (Landmark) ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেলো, তবু কোন রিক্সা চোখে পড়লোনা। পথচারীরা জানালো, রিক্সা মাত্র গুটি কয় ছিলো, তবে তারা অভ্যাগতদের ফেরী করতে ব্যস্ত, প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাই আমরা ব্যাগ হাতে করে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদের গিয়েই অবশ্য একটা খালি রিক্সা পেয়ে তাতে চড়েছিলাম। কলেজের গেটে দেখলাম খাকী পোষাক পড়া প্রহরী দাঁড়িয়ে। প্রহরীরা আমাদের দেখে গেট খুলে দিলো। সেই বিশাল তালাবদ্ধ গেটখোলা ছিল আমার জীবনের একটা প্রশস্ত ফটকের প্রতিকী উন্মোচন।
MCC Gate-R

চলবে…

ঢাকা
১১ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

২,৪০৫ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ৮”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    অনেক গুলি লাইনই মনে রাখার মত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে পথের বর্ণনা। অসাধারণ হচ্ছে স্যার। পড়তে পড়তে নিজেকেই স্মৃতির অংশ মনে হুচ্ছে।


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভাই,
    ২৮ বছর এবং সম্পূর্ণ আলাদা একটি কলেজের পার্থক্য হওয়া স্বত্ত্বেও অনেক কিছুতেই মিল খুঁজে পেলাম।
    আমার ৭ বছরের বড় ভাই একই কলেজের (ও '৯৪ তে বের হয়েছে, আমি '৯৫ তে ঢুকেছি!), হবার কারনে অপরিচিত ভাবটুকু ছিল না। এই যা পার্থক্য!

    ওহ আরেকটি ব্যাপার। আমরা তখন মাগুরা থাকতাম। মাত্র ৩০ কিমি জার্নি করে মন ভরত না। মনে হত ইশ, যদি আরও বেশি দূরত্ব হত... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ঢাকা থেকে মির্জ্জাপুর যেতে যে গজারি বনটা পড়তো, সেটা কতটা গা ছমছমে ছিল, তার বর্ননা একবার শুনে ছিলাম ব্রিঃজেঃ (অবঃ) মোস্তফা কামাল খান-এর কাছে।
    স্যার তখন আমার কমান্ডার আর আমি ব্রিগেড কমান্ড পোস্টে জিটু (আই এন্ড সিবি) হিসাবে এটাচড। আমাদের কমান্ডপোস্ট ছিল আবার কালিয়াকৈরেই।
    মাঝে মাঝে ওনার সাথে রেকীতে বেরুতাম আর উনি বর্ননা করতেন, কোথাকার টেরেইন ২৫-৩০ বছর আগে কেমন ছিল।
    ও মাই গড, সেটাও দেখি ১৮-১৯ বছর আগের ঘটনা...
    আজ আপনার বর্ননা শুনে সেদিন মানষচোক্ষে দেখা শাল-গজারির বনটা আবার ভেসে উঠলো মনে...

    অবশ্য পুরো দৃশ্যটাই যে কেবলই মানষ চোক্ষেই দেখা, তাও কিন্তু না।
    দুটো ঘটনা বলি:
    (১)
    সত্তর সালে প্রথম ট্রেনে শ্রীপুর গিয়েছিলাম। ওখানকার রেঞ্জারের বাসায়।
    ঢাকা পেরুনোর পর থেকে কি যে জঙ্গল চারিদিকে, এখনো মনে আছে কিছু কিছু।
    আর রেঞ্জারের বাড়িটা তো ছিল ঘোর জঙ্গলে।
    সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম, রেঞ্জার সাহেবের ঘোড়া দুইটাকে দেখে।
    উনি আবার বন চড়ে বেড়ান ঘোড়ার পিঠে উঠে।
    ব্যাপারটায় এতই আন্দোলিত হয়েছিলাম যে দীর্ঘদিন ধরে "বড় হয়ে রেঞ্জার হওয়াটা" আমার জীবনের লক্ষ হয়ে দাড়িয়েছিল...
    (২)
    ৭৩ সালে আব্বা তখন এসিস্ট্যান্ট এটর্নি জেনারেল। ১০-১২ হাজার টাকায় ৬২ মডেলের একখানা মরিস মাইনর কিনলেন।
    আবার সখ হলো, ড্রাইভিং শিখবেন।
    বেশ কদিন পাশা সাহেব নামের এক গ্যারেজ মালিকের কাছে তালিম নিয়ে এক সকালে চললেন লং রোড ড্রাইভিং প্র্যাকটিসে।
    আব্বা গাড়ি চালাচ্ছেন আর পাশা চাচা পাশে বসে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
    পিছনে আমরা তিন ভাই আর আম্মা বসে বসে রাস্তাঘাট দেখছি।
    রাস্তাটাও সেই একই রাস্তা, টঙ্গি পেরিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হয়ে কালিয়াকৈরের দিকে।
    কতটা গিয়েছিলাম বলতে পারবো না ভাল করে তবে আব্বার কাছে একবার "এখন আমারা ক্যাডেট কলেজের কাছাকাছি" এটা শুনেছিলাম।
    সে সময়কার শাল-গজারি বনের ভিতর দিয়ে চলাচলটাও কম গা ছমছম করা ছিল না...

    অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে আপনার এই জার্নাল পড়তে বসে......... (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এতটা দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, পারভেজ।
    ব্রিঃজেঃ (অবঃ) মোস্তফা কামাল খান আমারই ব্যাচমেট। ওর বাবা ঐ সময়ে ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন বলে এমমসিসি-ময়মনসিংহ এবং এমসিসি ঢাকা উভয় রুটের টেরেইন তার নখদর্পনে ছিলো।
    আমার বাড়ী উত্তরবঙ্গে হওয়াতে আমি সাধারণতঃ ট্রেনে করে দিনের বেলায় দ্রুতযান এক্সপ্রেসে এবং রাতের বেলায় নর্থ বেঙ্গল মেলে যাওয়া আসা করতাম। জয়দেবপুরের পর থেকেই শুরু হতো ঘন শাল গজারী বন। সে সময় শ্রীপুর, কাওরাইদ, রাজেন্দ্রপুর ইত্যাদি স্টেশনগুলো পার হবার সময় দিনের বেলাতেও কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসতো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।