অজানা পথে অচেনা সাথী, স্মৃতির আকরে আজো আছে গাঁথি……

চাকুরী জীবনে বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেছি, কখনো কর্তব্য পালন উপলক্ষে, কখনো বা কর্তব্য পালন শেষে বহির্বাংলাদেশ ছুটি নিয়ে আশে পাশের দুই একটি দেশ ঘুরে দেখেছি। পাশের দেশ ভারত থেকে শুরু করে পশ্চিমে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, আর পূর্বে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ আগেই দেখা ছিলো। অবসর গ্রহণের পর সস্ত্রীক ও সবান্ধব এক সপ্তাহ ধরে নেপাল ঘুরে এসেছি। তার পরের বছর ভাবলাম, বহুদিন ধরে আমেরিকা প্রবাসী আত্মীয় স্বজন ও কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধব তাদের আতিথেয়তা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে। হাতে সময় যেহেতু অঢেল, এবারে তাদের ডাকে একবার সাড়া দেয়া উচিত।

ক্যাডেট কলেজের এক ছোট ভাই ট্রাভেল এজেন্সীর ব্যবসা করে। তার সাথে একসাথে কিছু সমাজকল্যানমূলক কাজও করেছি। তাকে একদিন এই পরিকল্পনার কথা জানাবার সাথে সাথে সে আমাকে উৎসাহিত করলো আর সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলো। অনলাইন আবেদন করে অতি সহজে খুব দ্রুতই আমেরিকার মাল্টিপল ভিসা পেয়ে গেলাম। যেরকম ভাবনা, সেরকম কাজ। সেই ছোটভাইকে বলার এক সপ্তাহের মধ্যে দুবাই এ থাকার তিনদিনের ভিসাসহ এমিরেটস এয়ার লাইন্সের ঢাকা-দুবাই-ডালাস এর টিকেট হাতে পেয়ে গেলাম। তারপরে আমেরিকান এয়ার লাইন্সের কানেকটিং ফ্লাইটে আমার গন্তব্য কলাম্বাস ওহায়ো বিমান বন্দর। ওহায়োর এথেন্স শহরে আমার আপন ভাগ্নে মিঠু সপরিবারে থাকে। সে ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। তার দাবী, আমেরিকায় যেখানেই যাইনা কেন, আগে যেন তার বাসায় উঠি এবং বেশ কিছুদিন থাকি। আগে থেকেই ও বলে দিয়েছে, আমরা সেভাবেই যেন আমাদের সফরসূচী প্রনয়ণ করি।

১২ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সকাল দশটায় দুবাই এর উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক ঢাকা ছাড়লাম। সেই মরুর দেশে বসেই পান্তা ইলিশ খেয়ে (বন্ধুর কারণে বাধ্য হয়েছিলাম, যদিও আমি আজকের এই প্রহসনমূলক আরোপিত শহুরে কালচারে বিশেষ উৎসাহী নই) সবান্ধব পহেলা বৈশাখ পালন করে ১৫ তারিখ মধ্যরাতে এমিরেটস এয়ার লাইন্সের দুবাই-ডালাস ফ্লাইটে চড়লাম। ডালাসেই ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। হাতে থাকবে মোট সাড়ে তিন ঘন্টা সময়। তারপরে আমেরিকান এয়ার লাইন্সের কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে হবে। ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে গিয়ে হেনস্তা হবার নানারকম কাহিনী অনেকের কাছে শুনেছিলাম, তাই মনে মনে একটু ভয়ও ছিল। এই মৃদু আশঙ্কা নিয়েই প্লেন ছাড়ার পর আলো নিভিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা শুরু করলাম। দ্রুত ঘুমিয়েও পড়লাম। কিন্তু প্লেন যাচ্ছে পশ্চিমে, রাতের পরিধি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো, রাত আর যেন শেষ হয়না!

যাহোক, পরেরদিন যথাসময়ে ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। সাথে ল্যাপটপ থাকাতে ঘাটে ঘাটে আমার অবস্থানের কথা বিশ্বকে জানাতে অসুবিধে হয়নি। ভাবখানা এই যেন গোটা পৃথিবী আমার অবস্থান জানার জন্য বিশেষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আসল উদ্দেশ্য তো ঢাকায় রেখে আসা ছেলেদেরকে আর বৌমাদেরকে আমাদের খবর জানানো, আর ও প্রান্তে যে আমাদেরকে রিসিভ করতে বিমান বন্দরে আসবে, সেই মিঠুকে জানানো।

সৌভাগ্যক্রমে, ডালাস ইমিগ্রেশন এর পুলিশদেরকে যথেষ্ট বন্ধুভাবাপন্ন ও সহায়ক মনে হলো এবং প্রায় বিনা বাধায় দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করে ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলাম। আমাদের হাতে যেহেতু কানেকটিং ফ্লাইট ধরার সময় যথেষ্ট ছিল, সেহেতু কোন তাড়াহুড়ো করিনি। সবকিছুই ধীরে সুস্থে করেছি। আমাদেরও ইমিগ্রেশন কাজ শেষ হলো আর কানেকটিং ফ্লাইট এরও চেক-ইন শুরু হলো। তাই দ্রুত চেক-ইন করে মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন শুধু অপেক্ষা প্লেনে ওঠা, শেষ গন্তব্যে অবতরণ এবং ভাগ্নের সাথে তার বাসায় গমন। কিন্তু কে জানতো, বিদেশ বিভূঁই এ এবারে আমার নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পালা শুরু হবে।

আমাদের যখন বিমানে ঢোকা শুরু হবে, ঠিক তখনই শুরু হলো এক অভিনব বিপর্যয় কাহিনী। প্রথমে বলা হলো, কি একটা computer glitch এর কারণে প্লেন ছাড়তে কিছুটা বিলম্ব হবে। কখন ছাড়বে, তা শীঘ্রই জানানো হবে। মনিটরে আধ ঘন্টা করে করে সময় পেছানো হচ্ছে। ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে কয়েক মিনিট পরে পরেই একেকটা বিমান নামে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অবতরণ করা বিমান গুলোর যাত্রীদের দিয়ে লাউঞ্জটা ভরে গেলো এবং গিজিগিজ করতে লাগলো। নানা জায়গা থেকে সব যাত্রীরা এসে নামছে, কিন্তু কেউই কানেকটিং ফ্লাইট ধরে বের হতে পারছেনা। ভীড়ের চোটে দম বন্ধ হবার উপক্রম। অনেকেই মেঝের উপর শুয়ে বসে থাকলো, ঠিক যেমন আমাদের কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাঝরাতে অন্তর্মুখী/বহির্মুখী যাত্রীরা শুয়ে বসে থাকে। মনিটরে আর কোন নতুন সময় দেখানো হচ্ছিলনা। সব মিলিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তা। কিছুক্ষণ পর পর এক বিশাল বপুর কৃষ্ণ মহিলা কি যেন ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে, যার পরিস্কার অর্থ আমি উদ্ধার করতে পারছিলাম না। আমরাও একসময় মেঝেতে বসে পড়লাম। পাশে বসা এক মহিলাকে দেখলাম নিবিষ্টমনে তার স্মার্টফোনে কি যেন টেক্সট করছে। তার বয়স হয়তো আমার বড় ছেলের চেয়ে কিছুটা বেশীই হবে, অর্থাৎ ত্রিশের আশে পাশে। তার বেশভূষা, দৈহিক গড়ন আর চলন বলন দেখে তাকে মহিলা না বলে তরুণী বলাই সমীচীন। তাকে আস্তে করে তার গন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করে জানলাম, তার আর আমাদের গন্তব্য একই। তাকে খুলেই বললাম যে আমি ঐ কৃষ্ণ মহিলার ঘোষণার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিনি। সে মুচকি হেসে বললো, প্লেন ছাড়তে অনেক দেরী হবে, সন্ধ্যা গড়াবে। কথাটা শোনার পর আমার মুখে হয়তো কোন আশঙ্কার ছায়া সে দেখতে পেয়েছিলো, আবার মুচকি হেসে আশ্বস্ত করলো, কোন দুশ্চিন্তা না করতে।

দেখতে দেখতে বেলা দু’টো পার হলো। তরুণীটি জিজ্ঞেস করলো আমরা লাঞ্চ করেছি কিনা। বল্লাম, না করি নাই। সে আমাদের কাছ থেকে বোর্ডিং পাস দুটো চেয়ে নিলো। উঠে গিয়ে সেই ঘোষিকাকে কি যেন বললো। পরে তাকে নিয়ে আরেকটা অফিসে ঢুকলো। সেখান থেকে ফিরে এসে আমাদেরকে কয়েকটা কুপন দিয়ে বললো, কুপনের তালিকায় উল্লেখ করা যেকোন রেস্টুরেন্ট থেকে আমরা লাঞ্চ করে নিতে পারবো। প্লেন ছাড়তে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে আমরা বাকী কুপন দিয়ে ডিনারও করতে পারবো। সে জানালো, সে ইতোমধ্যে লাঞ্চ করে ফেলেছে। তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা লাঞ্চ করতে এগোলাম।

বেলা চারটার দিকে মনিটরে জানানো হলো, আমেরিকান এয়ার লাইন্সের সকল ফ্লাইট ঐ দিনের জন্য বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এয়ার লাইন্সের একজন উর্দিধারী ব্যক্তিকে অনুরোধ করলাম আমাদের রাত কাটানোর জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করে দিতে। সে হ্যাঁ না কিছুই না বলে অপেক্ষা করতে বললো। কিছুক্ষণ পরে এসে লোকটি জানালো যে আমাদের ফ্লাইট নির্ধারিত হয়েছে পরেরদিন সকাল দশটায়। কিন্তু হোটেলের ব্যাপারে সে তখনো কোন সিদ্ধান্ত পায়নি। আশে পাশে তাকিয়ে দেখি সেই সাহায্যকারী মেয়েটি আর নেই। কিছুটা অসহায় বোধ করতে থাকলাম। একটা কফিশপে গিয়ে দু’কাপ কফি কিনলাম। হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটা এসে পুনরায় হাজির। সে বললো, আইনতঃ তোমরা হোটেল, পরের দিনের ব্রেকফাস্ট আর হোটেলে যাওয়া আসার জন্য ফ্রী ট্রান্সপোর্ট পাবে। তবে তারা সবাইকে সে সুবিধেটুকু দিতে গড়িমসি করছে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি তোমাদের জন্য এ ব্যবস্থাটুকু করে দিয়ে তবে বিদেয় নিতে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমাদের মনটা ভরে গেলো। ঠিকই একটু পরে এসে সে আমাদের হাতে পরের দিনের ব্রেকফাস্ট কুপন এবং বেস্ট ওয়েস্টার্ণ হোটেলে থাকার জন্য একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বললো, একটু পরে হোটেলের গাড়ী এসে আমাদের নিয়ে যাবে। আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম। সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে তা acknowledge করলো।

টার্মিনালের বাইরে এসে দেখি আমাদের গাড়ীর জন্য দীর্ঘ লাইন। পাশে আরেকটা জায়গায় তুলনামূলকভাবে একটা ছোট লাইনে সেই মেয়েটিও তার হোটেলের গাড়ীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে তাকে পুনরায় সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিয়ে আসলাম। ওর লাইনে পরপর কয়েকটি গাড়ী এসে সবাইকে তুলে নিয়ে গেলো, কিন্তু গাড়ীতে জায়গা থাকা সত্তেও সে উঠলোনা। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সে একাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। বুঝলাম, সে হয়তো বা আমাদের যাবার অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের হোটেলের গাড়ীও এসে গেলো। সে এগিয়ে এসে আমাদেরকে কোস্টারে লাগেজ তুলতে সাহায্য করলো। তারপর হাসিমুখে বিদায় নেবার আগে সে বলে গেলো যে আমাদের সাথে টুকটাক আলাপচারিতাগুলো তার বেশ ভালো লেগেছে, আমাদেরকেও ভালো লেগেছে। আমরাও তাকে আমাদের বিস্ময় ও মুগ্ধতার কথা জানাতে কার্পণ্য করলাম না। দ্রুত তার সাথে একটা ছবিও তুলে রাখলাম। যতদিন আমেরিকায় থাকি, আমরা যেন আমাদের অবস্থান এবং ভ্রমণগুলো পুরোপুরি উপভোগ করতে পারি, সে বারে বারে সে কামনার কথাই জানাতে থাকলো। কয়েক ঘন্টা আমাদের সাথে সহ অবস্থানের মাধ্যমে ভ্যালেরী আমাদের মনে চিরস্থায়ী একটা আসন গড়ে নিয়ে গেলো। আজ যেমন তার কথা স্মরণ করছি, আমি জানি আরও বহুদিন ধরে তা করবো।

ঢাকা
২১ জানুয়ারী ২০১৫
কপিরাইট সংরক্ষিত।

১,৭৫৪ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “অজানা পথে অচেনা সাথী, স্মৃতির আকরে আজো আছে গাঁথি……”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap:

    চলতি পথে অনেক ভ্যালেরী আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় এখানে। আমেরিকানরা বন্ধুভাবাপন্ন জাতি। এগিয়ে গিয়ে কথা বললে ঠিকই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে ওরা।

    আপনার আটলান্টা ভ্রমণ কাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছি।

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আমার বিদেশ ভ্রমণ কখনোই স্মুথ হয়নি। বরাবরই কোন না কোন ফাপরে পড়েছি। আপনার লেখাটা চমৎকার হয়েছে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আহারে, খুব কষ্ত গেছে। এইসব ভোগান্তি না না পড়লে বোঝানো যায় না, বোঝাও যায় না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।