দুটি ক্ষুদ্র সাফল্যের কথা…

আমি গত ৪/৫ বছর যাবত “Serving The Humanity” নামের এক সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছি। এটা মুলতঃ কিছু প্রাক্তন এমসিসি ক্যাডেটদের নিয়ে গঠিত, যারা জনদরদী মনোভাবাপন্ন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশায় প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি এর বাইরেও কিছু পরোপকারী উৎসাহী ব্যক্তিদের নিয়ে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার দূরমুট নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথমে খুবই ছোট্ট পরিসরে একটা স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো এলাকার মূলতঃ নারী ও শিশুদের কাছে অন্ততঃ গড় মানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা। এটা জানা কথা যে গ্রাম ও চর এলেকার হতদরিদ্র নারীদেরকে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হবার আগে পর্যন্ত পরিবারের কেউ ডাক্তারের কাছে নেয়না। তাই মূলতঃ তাদেরকে লক্ষ্য করেই আমা্দের এ উদ্যোগ ছিলো। সেখানে টিনছাদসহ একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা হয়, যার জন্য জমি দান করেছে এমসিসিরই দুই প্রাক্তন ক্যাডেটের (সহোদর) পরিবার। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে যে কেউ সেখানে ঔষধসহ (নির্দ্দিষ্ট তালিকার অন্তর্গত) চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। খুবই আনন্দের বিষয় যে সেখান থেকে এখন গড়ে মাসে প্রায় ১৪০০-১৫০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই হতদরিদ্র নারী ও শিশু। ঐ প্রজেক্ট থেকে সেখানে শিশুদের জন্য কৃ্মিনাশক (Deworming) কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়।

যাহোক, এই ক্লিনিক সম্বন্ধে জানানোটা আমার এ লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিলনা, অন্য কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তাই প্রথমে এসব কথা বলে নিলাম। ক্লিনিকটার জন্য যখন একটা পাকা ঘর বানাতে হবে, তখন ইট বালু সিমেন্ট ইত্যদি কেনা হলো। দ্রুতই কাজও শুরু হলো। ইট ভাঙ্গার কাজে মূলতঃ নারী ও শিশুরা যুক্ত হলো। একজন প্রাক্তন ক্যাডেট যিনি এই প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি, ইটভাঙ্গারত সেই নারী ও শিশুদের কিছু ছবি তুলে পোস্ট করে দিলো গ্রুপ মেইলে, যেন গ্রুপের ডোনাররা কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হন। ব্যস, এখান থেকেই শুরু হলো এক নতুন মোড়, কাজের এক নতুন শাখা। দেশী প্রবাসী ডোনাররা (এক্স ক্যাডেট, এমসিসি ও তাদের কিছু বন্ধুবান্ধব) প্রশ্ন তুলতে থাকলো, শিশুদের কেন এ কাজে নিয়োগ করা হলো। সেখান থেকেই শুরু হলো নতুন চিন্তা ভাবনা। ক্লিনিকের পাশাপাশি এই শিশুদের কাছে শিক্ষাকে কিভাবে সহজলভ্য করা যায়, সে নিয়ে চিন্তা ভাবনা। সিদ্ধান্ত হলো, এসব শিশুকে আমাদেরই উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি করানো হবে। পাশেই একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো, খুবই জীর্ণ শীর্ণ দশা। প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলা হলো। তিনি রাজী হলেন দুপুরের পর একটি কক্ষ ছেড়ে দিতে, আমাদের ব্যবস্থাপনায় একজন শিক্ষক নিয়োগ করে সেখানে ঐসব শিশুদের জন্য ক্লাস নেয়া হবে। আমি নিজে সেখানে ব্যক্তিগত পরিদর্শনে গিয়ে অবাক হয়ে যাই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা দেখে। বিদ্যালয়ে মাসের প্রায় ২৮ দিনই ছাত্র বা শিক্ষক কেউই আসেনা। শুধু সরকারের ভাতা পাবার জন্য মাসে দুই একদিন এসে সবাই রেজিস্টারে সই করে যায়। বাকী দিনগুলোতে বিদ্যালয়ের মাঠে ও বারান্দায় গরু ছাগল ভাগাভাগি করে বিচরণ করে, আর শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক কক্ষে কুকুর ও ছাগল ভাগাভাগি করে সুখনিদ্রা যায়।

পরের বছরই আমরা সেখানে অবস্থিত ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত একটা কিন্ডারগার্টেনের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের শিশুদেরকে সেখানে ভর্তি করে দেই। সুখের কথা, আজ আমাদের নির্বাচিত প্রায় ৮০ জন শিশু ও বালক বালিকা সেখানে আমাদের অর্থায়নে শিক্ষালাভ করছে। আরও অনেক ডোনার আরও অনেক শিশুকে স্পনসর করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট সম্ভব নয় বলে আমরা আপাততঃ আর এর কলেবর বাড়াচ্ছিনা। ভর্তি হওয়া শিশুদেরকে ফ্রী টিউশন ছাড়াও বিনামূল্যে দুই জোরা করে স্কুল ইউনিফর্ম, স্কুলব্যাগ, স্টেশনারি দেয়া হয় এবং লেখাপড়া ও খেলাধূলায় উৎকর্ষতা প্রদর্শনের জন্য বার্ষিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করা হয়। আমরা তাদের অভিভাবকগণকে তাদের শ্রম দ্বারা উপার্জিত আয় থেকে  বঞ্চিত হবার জন্য ক্ষতিপূরণ অফার করেছিলাম। কয়েকমাস নেবার পরে তারা তাদের সন্তানদের অভাবনীয় সাফল্য ও পরিবর্তন দেখে কতজ্ঞতাস্বরূপ তা নিতে বিনয়ের সাথে অস্বীকৃ্তি জানায়। আমাদের সমাজের এই দরিদ্র শ্রেণীর আত্মসম্মানবোধ ও কৃতজ্ঞতাবোধ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। এর ক্ষুদ্রাংশও যদি আমাদের মত স্বার্থলোভী, সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে থাকতো!

যাহোক, যে দুটি সাফল্যের কথা বললাম, তা নিছক সিন্ধুর মাঝে দু’ফোঁটা বিন্দুসম, কিন্তু তাহলেও তো এগুলোকে সাফল্যই বলা যায়, তাই না? শুধু স্বেচ্ছাশ্রম আর স্বেচ্ছা অনুদানের ভিত্তিতে অর্জিত এটুকু সাফল্যের কথা বললাম এজন্য যে, ‘বাংলাদেশে কোন কিছুই সহজে করা যায়না’, এ ধরণের কথা শুনে কেউ যেন কখনো নিরুৎসাহিত না হন। ইচ্ছে থাকলে প্রতিকূলতার মাঝেও অনেক কিছু করা যায়। আর দশে মিলে চেষ্টা করলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

 

 

খায়রুল আহসান
ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

২,৪৭৮ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “দুটি ক্ষুদ্র সাফল্যের কথা…”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন কাজ খায়রুল ভাই। আমরা সবাই যদি এভাবে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসতাম!


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার দূরমুট নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে

    ভাইয়া, ঐ অঞ্চলে কমপক্ষে ১৫ বার যাওয়া হয়েছে, শাহ কামাল (রঃ) এর মাজারে। আমার আম্মা প্রতিবছর নিয়ম করে সেখানে সিন্নি দিতে যান, এখনও 🙂 [ইসলামপুরের উত্তর-পশ্চিমাংশে যমুনার তীর ঘেষে আমাদের বাড়ি]।

    খুবই ভালো লাগল আপনাদের মহতী এই উদ্যোগের কথা জেনে। (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      ধন্যবাদ মাহমুদ, অনুপ্রাণিত হ'লাম। হ্যাঁ, ওখানেই আমাদের ক্লিনিকটা। এর পরে গেলে খোঁজ নিয়ে দেখো। প্রতিবছর বৈশাখ মাস জুড়ে সেখানে মেলা বসে, আসছে বৈশাখেও বসবে। শাহ কামাল (রঃ) এর মাজারের খেদমতগার আমাদের কলেজের রুশো (১৩ তম ব্যাচ) আর ফয়সালদের (দশম ব্যাচ) পরিবার। মাজার থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই ক্লিনিকটির অবস্থান। নদী সিকস্তি পরিবারগুলোই এর মূল সেবা গ্রহীতা।

      জবাব দিন
      • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

        মাজারে সিন্নি দেয়াটিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিভাবে দেখা হয় আমার খুব জানতে মন চায়। আমি জানি এটি একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা সংস্কার (কুসংস্কার বলে আবার কারো কোমল অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাইনা)। তবুত্ত যেহেতু সিসিবিতে মাজারের মত স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার এলোই তবে আলোচনা করতে তো আর অসুবিধে নেই। ধূপটুপ দেয়ার কথা তো পড়েছি, আগরবাতি গোলাপজলের কথা জানি। কবরের ওপর মখমলের লাল গিলাফের ছবি দেখেছি। লাল সালু আমাদের পাঠ্য ছিল একাদশে। আমরা কি এখনো লাল সালু এরাতেই আছি?

        এটি কি শিরক নয়? মাহমুদ তুমি কি ব্যাখ্যা করবে, প্লিজ?

        মাজারের খেদমতগারের কি ভূমিকা, আহসান ভাইয়া বলবেন কি বুঝিয়ে, প্লিজ?

        আমি নিজে কৌতুহল মেটাতে আটরশির পীরের প্রেমিসিসে গিয়েছিলাম। ঝাপসা প্রায় স্মৃতি থেকে আটরশির পীরের ভন্ডামীর গল্পটি বলতে পারি কেউ যদি শুনতে চান সিসিবিতে।

        জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    খায়রুল ভাই,
    আপনার এই 'ক্ষুদ্র' উদ্যোগের কথা জানতে পেরে নিজেও উৎসাহ বোধ করছি।
    আপনার লেখার শেষদিকে স্থানীয় জনগণের আত্মসম্মানবোধের যে পরিচয় পেলাম তাতে দেশের মানুষ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ফের প্ররোচিত হচ্ছি।

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য মূলতঃ এমসিসি ক্যাডেটদের অর্থায়ন আর স্বেচ্ছাশ্রমের দ্বারা পরিচালিত (অবশ্য কয়েকজন দানশীল, নন ক্যাডেট ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের অনুদানও গ্রহণ করা হয়েছে) যে স্কুলটির কথা এ আলোচনার শেষাংশে উল্লেখ করেছি, সেই স্কুলের শিশু কিশোরদের জন্য এক্স ক্যাডেট'স ফোরাম (ইসিএফ) গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের "টয়েজ আর ইয়োরস (TRY)" প্রকল্পের আওতায় কিছু খেলনা দান করে। এমসিসি/১৭ ব্যাচের স্কোয়াড্রন লীডার জিয়াউদ্দিন ফারুক (অবঃ) সকলের পক্ষ থেকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে শিশুদের মাঝে খেলনাগুলো বিতরণ করে। খেলনাগুলো পেয়ে শিশুদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়, তা বলাই বাহুল্য।
    আজ সিসিবিতে পারভেজ এর "টয়েজ আর ইয়োরস (TRY)" প্রকল্পের উপর লেখা একটি পোস্ট দেখে ভাবলাম, বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।