বরুনা প্রবালের গল্প – ০২

আবারো টলে উঠলাম দিয়েগোর কথায়, মিসিং এবং পুলিশ ইনভেস্টিগেশন, মানে কোন হালকা ব্যপার না। এর পর সব বলে গেলো দিয়েগো একটানা।

এই এপার্টমেন্টে তেমন একটা ভাড়াটে বদল হয় না মাসে মাসে। নির্ঝঞ্ঝাট এবং বন্ধুবৎসল বলতে যা বোঝায়, প্রবালকে সে দলে ফেলা যায় কোন চিন্তা ছাড়াই। তাই প্রবাল চলে যাওয়ার পর দিয়েগোর মন কিছুটা খারাপ ই ছিলো। গত তিনদিন আগে পুলিশের আগমনে দিয়েগো স্বাভাবিক বলে ভাবলেও, যখন তারা বললো একজন পুরানো টেনান্ট সম্পর্কে জানতে চায়, সাথে সাথে আমার মতো দিয়েগোর ও চমকে ওঠা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। সাদা পোষাকে একজন ইনভেস্টিগেটর আর ইউনিফর্মে একজন পুলিশ অফিসার প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট কথা বলেছে দিয়েগোর সাথে, প্রবালের পাশের এপার্টমেন্টের দুইজন ছাত্র ছাত্রী ভাড়াটিয়ার সাথে ও। যাবার সময় প্রবালের খালি এপার্টমেন্টের দরজা সিল করে দিয়ে গেছে POLICE INVESTIGATION লেখা হলুদ টেপ দিয়ে। তাদের মুখ থেকে যতটুকু জানা গেছে, প্রবালের গাড়ী পর্তুগাল সীমান্তের কাছাকাছি প্যাস্টোরেস এবং মার্টিয়াগো গ্রামের সংযোগ রাস্তায় ব্রীজ থেকে এ্যাগুয়েডা নদীতে পড়ে গিয়ে নিমজ্জিত হয়েছে, আনুমানিক তিনদিন আগে। এমনিতেই গ্রামের রাস্তা তার ওপর কাছাকাছি বড় কোন শহর না থাকায় মোটামুটি জনবিরল ই বলা যায় রাস্তাটাকে। স্থানীয় কিছু লোক রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ব্রীজের রেইলিং ভাঙ্গা, টায়ারের বেঁকে যাওয়া ছাপ দেখে মার্টিয়াগো গ্রামের পুলিশ ষ্টেশনে প্রথমে জানায়।

এ্যাগুয়েডা নদীর ওই অংশে পরপর দুটো বাঁকের কারনে ওখানে স্রোতটা ঘুর্নির মতো ঘুরে খরস্রোতে রুপ নেয়। ওখানে ব্রীজ ভেঙ্গে পানিতে পড়া গাড়ী খুজে পেতে পুলিশের লেগেছে ৬ ঘন্টা, তাও পাওয়া গেছে প্রায় ২০০ মিটার ভাটিতে। গাড়ীর ট্রাঙ্কে রাখা একটা মাত্র ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র অক্ষত পাওয়া গেছে, যার মধ্যে গত মাসের এই এপার্টমেন্টের ভাড়ার রশিদ ও ছিলো। গাড়িতে কাউকে পাওয়া যায় নি, তাই মিসিং এর তালিকায় চলে গেছে আমাদের প্রবাল, মুক্তা আর টুকটুক। পুলিশের কাছ থেকে প্রশ্ন ছিলো বেশী, যেটুকু না জানালেই নয় তার থেকে বেশী ওরা কখনোই বলে না, এটাই এখনকার নিয়ম। তাই জানা হলো না, এখান থেকে বেরিয়ে দিন তিনেক প্রবাল সবাই কে নিয়ে কোথায় ছিলো, ওর সাথে গাড়িতে কে কে ছিলো, ও কি গাড়িতে আদৌ ছিলো কিনা। ঘড়িতে দেখলাম রাত প্রায় দশ টা বাজে, কাছাকাছি কোন হোটেলে যাবো বলে ভাবছি, এই সময়ে দিয়েগোর আবেদন “তুমি আজ আমার সাথে থাকলে কোন আপত্তি আছে?”

“চলো, তোমার সাথে আরো কথা আছে” দিয়েগোর এপার্টমেন্টে যেতে যেতে বললাম। মাথার একাংশ ভার ভার লাগছে, ঠিকমত চিন্তা ও করতে পারছিলাম না। প্রথম কাজ প্রবালের এপার্টমেন্টে ঢোকা, যদিও জানি বন্ধু দিয়েগো এতে কোন ভাবেই অনুমোদন, সায় অথবা সাহায্য করবে না। তার ওপর পুলিশের টেপ তো আছেই। দিয়েগোর ওখানে শাওয়ার শেষে বেরিয়ে দেখি ডিনার রেডি, মেডিটেরেনিয়ান সালাদের সাথে বিফ ষ্টেক। এখনো মনে রেখেছে দিয়েগো আমার পছন্দের কথা, একটু আশা জাগলো, হয়তো ওকে সাহস করে বলতে পারি প্রবালের এপার্টমেন্টে ঢোকার আবেদনটা। এরই মধ্যে মনে হলো প্রথম কথাগুলো, আগের কাজ আগে। ঢাকায় জানানো হয়েছে কিনা, ঢাকা থেকে কোন খবর এসেছে কিনা, ইউনিভার্সিটি র বন্ধু বান্ধব সবার কাছে খোজ খবর নেয়া হয়েছে কিনা? তিনদিন অনেক সময়, আর এদেশে পুলিশ অনেক তৎপর ও প্রযুক্তি নির্ভর। পুলিশের কি দোষ, আমি ই তো ভুলে গেছি বন্ধুর সেলফোনে কল দিয়ে দেখতে, হয়তো কোথাও গিয়ে আটকা পড়েছে, চার্জ ছিলো না, এখন হয়তো চার্জ দেয়া হয়ে গেছে, ভেবে কল দিলাম। যান্ত্রিক উত্তর, এই সাবস্ক্রাইবার এই মুহুর্তে ফোনে নেই, বীপ এর পরে আপনার মেসেজ রাখুন। আমার কল দেয়া দেখে দিয়েগো বললো, গত তিনদিনে প্রতি ঘন্টায় সে অন্তত একবার কল দিয়েছে। যান্ত্রিক আর যান্ত্রিক, আর কিছু নেই।

খেতে খেতে চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, প্রবালের কাছ থেকে শেখা টেকনিক। আমার হাতে আছে আরো আড়াই দিন, কাজ আছে অনেক, কোনটা আগে আর তারপরে কোনটা এভাবে সাজিয়ে নিলাম। মনে আছে আমি আর প্রবাল পুলিশ পুলিশ খেলতাম, অস্ত্র ছাড়া পুলিশ, বুদ্ধির খেলা, চোখের কোনে আবারো পানির উদ্রেক। দিয়েগোর থেকে অনেক কষ্টে লুকালাম। আমার আজ রাতের কাজ – কোন ঢেউ না তুলে ঢাকায় যোগাযোগ করা, কোন প্রমান না রেখে প্রবালের এপার্টমেন্টে ঢোকা, মিমির সাথে কথা বলা কিন্তু কোন কিছু না জানানো, আর সব হয়ে গেলে মাতাল হওয়া। প্রতিটা মুহুর্তের চিন্তায় প্রবাল এসে যাচ্ছে, আবারো খেই হারিয়ে ফেলছি চিন্তার, নাহ, প্রবালের টেকনিক ছাড়া কাজ হবে না, বন্ধু মিসিং তো কি, টেকনিক তো শিখিয়ে দিয়েছে আমার জন্য। ও বলতো, আমরা দুজন যখনই কোন কাজের জন্য ভাবতে বসি, সবসময় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, যার জন্য প্রায়ই কিছু কিছু জিনিস বাদ পড়ে যায় পরিকল্পনার মধ্যেই। তাই টেকনিক টা হচ্ছে, যখনই মনে হবে কাজটার পরিকল্পনা বেশ গুছিয়ে এনেছি, তখনই দুই ধাপ পিছিয়ে যেতে হবে, বের হয়ে যাবে কিছু বাদ পড়লো কিনা। চিন্তায় পেছানো অনেক সময় খুব কঠিন, তাই একমাত্র সফল উপায় নিজেকে গালি দেয়া, তুই অকর্ম্মার ধাড়ি, নালায়েক, ফান্ডেখান ইত্যাদী। হাসিও পেলো, আমরা কতোই না কিছু করেছি একসাথে, প্রবাল তুই কই লুকিয়ে আছিস? কেন লুকিয়ে আছিস, ওদেরকে কেন লুকিয়ে রেখেছিস? যদি পেয়ে যেতাম সব উত্তর, ঘাড় ধরে বের করে এনে দিতাম কষিয়ে দুটো।

১,২৫১ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “বরুনা প্রবালের গল্প – ০২”

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।