অক্ষমতার লজ্জা – পর্ব ১

কাশবনের মধ্যে দৌড়াতে গিয়ে প্রথমে ই কনুই থেকে কব্জী পর্যন্ত সরলরেখার মতো দাগ পড়লো, এর পরেই ঘামের বেয়ে আসা ধারায় হালকা জ্বলুনী। হাসিব কে কিন্তু তারপরেও ধরতে পারলাম না। এখন না পারলে আর পারা সম্ভব ও না। কারন সামনে চরের বালির বিস্তৃতি। ওখানে দৌড়ানো আমার কাজ না। মশা – হাসিব কে আমরা ছোটবেলা থেকে এ নামেই ডাকি, আমাদের নিয়ে এসেছে ওর নানাবাড়ীতে। এসেই প্রথম কাজ, অনেক দিনের পুরোনো পরিকল্পনা মোতাবেক পাটখড়ি জ্বালিয়ে বড়দের মতো সিগারেট টানা।

তখন তো আর এখনকার মতো এত “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরন” লেখা থাকতো না সিগারেটের প্যাকেটে। আর পাট-শলা তো প্যাকেটেও থাকতো না। কাজেই দম বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেই যে বড়দের মতো ভঙ্গী করে কাশতে কাশতে ঐ ধুয়া গেলা – এখনো হাসি সে দিনগুলোর কথা ভেবে। আমি ভোটেবাবু – কিঞ্চিত নাদুস নুদুস ছিলাম বটে, মশা – হাসিব আর গাতক – আবীর এই তিনজনে মিলে প্রতিযোগিতা টা ছিলোই সবকিছু তে। ওরা দুজন ততক্ষনে অনেক এগিয়ে চরে এই দৌড় প্রতিযোগিতায়। কি আর করা, উচু একটা ঢিবি দেখে বসে পড়লাম। শ্রান্তি তে চোখ বুজে আসছে।

আচমকা “me go to school tomorrow, vaiya go, why me stay home” শুনে তন্দ্রার রেশ টা কেটে গেলো। দেখি আমার ছোটছেলে বড়ভাই এর সবগুলো ক্লাস ওয়ার্ক এর খাতা ছিড়ে কাগজগুলো আমার হাতে দিয়ে আদরের সাথে প্রস্তাব টা পেশ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তন্দ্রার ঘোর কাটতেই টের পেলাম ছোটজনের কপালে আজ মার আছে। মা এর কাছে খাবে সলিড “মাইর” আর বড়জনের কাছে চিপা “মাইর”। তিন বছর হয় নি শুভ্রর এখনো, কিন্তু সৌরভের দেখাদেখি স্কুলে যাবার প্রবল একটা ইচ্ছা। ওদের এ সময়টাতে আমি কি করেছিলাম? নাহ, তিন বছরের সময়টাকে মনে করতে পারি না এখন।

যদিও দুই বছরের একটা স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে। সাইরেন বাজার সাথে সাথে মা আমাকে কোলে করে এক নিঃশ্বাসে খালার সাথে বাঙ্কারের মতো গর্তের ভেতরে চলে এলেন। সাথে সাথেই মাথার ওপরে উড়োজাহাজের শব্দ, দূরে কোথায় যেন বোমা ফোটার শব্দ। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বলতে এইটুকুই। ছোট রাজপুত্রের কান্না শুনে আবারো বাস্তবে ফিরে এলাম। এটা তার ভয়ের কান্না, শুভ্রর অভ্যাস এটা। অপকর্ম করবে নিঃশঙ্ক চিত্তে, কিন্তু ফলাফল অনুধাবনে সচেতন হলে আগেই কান্নাকাটি করে সবার সহানুভুতি আদায়ে সচেষ্ট হবে। আজকালকার বাচ্চাদের আই কিউ নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষন আছে, যা সাধারনভাবে খুবই আশাব্যঞ্জক, কিন্তু ঠিকভাবে পরিচালিত না করতে পারলে ভয়ের কারন ও হতে পারে।

ইদানিং এই একটা বদ-অভ্যাস হয়ে গেছে। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। হবেই না বা কেন? জীবনের হিসেব যে মেলে না। প্রতিদিন যা ভাবি, হয় তার অর্ধেক ও সত্যি হয় না, কিংবা বেশীর ভাগই অন্য ফলাফল দেয়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবার সময় ভাবি, আজ এটা করবো, ওটা করবো। বেশীর ভাগ ভাবনাই পুর্নতা পায় না। কেন জানি না, আজ মশার কথা খুব মনে পড়ছে। মশা, আমার ছোটবেলার বন্ধু হাসিব। ডায়েরীটা খুলে আমাদের ত্রিমুর্তির গ্রুপ ছবিটা আবার ও দেখলাম। হাসিব আর ফিরে আসবে না, মন খারাপ হবার বদলে আবারো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

হাসিবের কি দোষ ছিলো? ওর স্ত্রী, শান্তার কি দোষ ছিলো, ফূটফুটে একটা মেয়ে লাবনী, ওর কি দোষ ছিলো। কাকে প্রশ্ন করবো? উত্তর যেখানে মরিচীকা, প্রশ্ন তো মরুভুমিকেই করতে হয়। অনেক করেছি এই প্রশ্ন। নিজের কাছে করেছি, মনে মনে করেছি, জানাজা পড়তে আসা রাজনৈতিক নেতাদের কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেতে দেখে তাদের উদ্দেশ্যে সরোষে করেছি, আরেক জানাজায় দাঁড়িয়ে হাসিবের এক বন্ধু কে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে করেছি। বৃথাই চেষ্টা, আজ পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাই নি। হাসিবের বাবা আজো সজল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হাসিব কে হারিয়ে তিনি শান্তা কে নিজের মেয়ের মতো করে পেয়েছেন। কিন্তু হাসিব যে আর ফিরে আসবে না সেটা চরম সত্য বলে জেনেও কেন যে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। তবে আমি নিশ্চিত যে তিনি বিচার চান না। এই একটি কথা আজো চাচার মুখে শুনি নি।

বাবা মারা যাবার পর ওনার কাছেই ছুটে গিয়েছি কারনে অকারনে। বাবার ভালো বন্ধু ছিলেন, সেজন্য কিনা জানি না, হাসিব আর আমাকে কখনো খুব একটা আলাদা করে দেখেন নি। এই বৃদ্ধের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নি আজো। বাবার বন্ধু পিতৃসম এই আশরাফ চাচার একটা কথা খুব কানে বাঁজে। অনেক কথা শোকে বিহ্বল হয়ে বলেছিলেন ” বাবা, বলোতো, ছেলেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না বানিয়ে সেনাবাহিনী তে পাঠিয়ে কি ভুল করেছিলাম? যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হলে ধরে নিতাম আমি সক্ষম পিতা, ড্রেনের পাইপ থেকে টেনে তোলা লাশ আমার ছেলেটা কি এতোই অক্ষম ছিলো নিজেকে রক্ষা করতে? নাকি আমি ই অক্ষম পিতা, এতো কিছু থাকতে কেন ছেলেকে দেশরক্ষা করতে পাঠিয়েছিলাম” আবার ও চিন্তায় ছেদ পড়লো, সৌরভ আর শুভ্র র চিপা “মাইর” আর কান্নার শব্দে। ঊঠে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আশরাফ চাচার এই অক্ষমতার মধ্যে আমার ভুমিকা কতটুকু, কি করেছি, কি করতে চেয়েছি, চাইলেও পেরেছি কিনা?

অক্ষমতার এই লজ্জার দায় কি আমি এড়াতে পারবো? যতবার ই চিন্তা করি, সব ভাবনা গুলো জট পাকিয়ে যায়। কেন এর উত্তর পাই না? কিন্তু হাল ছেড়ে দিতে ও মন চায় না। এর উত্তর আমাকে বের করতেই হবে ………

[ক্রমশ…]

২,০৩৩ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “অক্ষমতার লজ্জা – পর্ব ১”

  1. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    ভাইয়া,
    লেখাটা চালিয়ে যান।
    লেখা পড়ে ভাল লাগল অনেক।

    কিন্তু শেষে এসে যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন - সেই কাতরতায় দারুন ভাবে জর্জরিত এই আমিও।
    আল্লাহ ঐ ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া সব্বাইকে বেহেশ্ত নসীব করুন।


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম... লেখাটা ছুয়ে গেল।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ভাবছিলাম লেখাটা স্মৃতিকাতর কোন ভালো লাগা লেখা হবে শেষে এসে চোখে পানি চলে আসল। আর কতদিন পরে আমি অমানুষ হব , এসবে আর খারাপ লাগবে না। অমানুষ না হলে দেশের এসব নিয়ে থাকা সম্ভব না।

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    আবার একটা মোচড় দিয়ে উঠলো মনের মাঝে। যতবার লেখাটা পড়ছি, বারবার যেন ছিন্নভিন্ন হচ্ছি। ........................


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।