প্যাঁচালী মদন

তখন আমরা ক্লাস ১১ এ। আর তার আগে বা সেইসময়ই কোন টিভিতে যেন প্যাঁচালী মদন অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। হিন্দী এমটিভি বাকরা টাইপের দেবাশীষ বিশ্বাস করত। রাস্তা ঘাটে যাকে তাকে মদন বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে সেটার নাম হয়েছিল নদু মানে নন্দদুলাল। এই জিনিস যে ক্যাডেট খাবে তা আর বলা লাগে না। কলেজে এসে শুরু হল আমাদের নানা প্ল্যান। ছোট খাট মদন তো আমরা সবসময় বানাচ্ছি। তখন জুনিয়র প্রিফেক্ট দেবার সময়। আমাদের চৌধুরী প্ল্যান করল সব। বদরুদ্দোজা আমাদের সুরমা হাউসের জেপি হবে মোটামোটি শিউর। টার্গেট করা হল তাকে। সেকেন্ড প্রেপে কয়েকজন একটু আগে আসল। ওরা সবাই এ ফর্মে। আমাদের বি ফর্ম থেকেও মোটামোটি যারা একটু হর্তা কর্তা টাইপের তাদেরকে ডেকে নেওয়া হল। ১১ এ ফর্ম পুরা থমথমে। দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভিতরে খুব জোর মিটিং চলছে। অনেকেই আস্তে আস্তে ফর্মে ঢুকছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারছেনা ব্যাপার কি? কারণ প্ল্যান জানে শুধু ২-৩ জন। সবাইকে বলা হচ্ছে সিরিয়াস ব্যাপার আছে । ব্যাচের ব্যাপার কেউ আর ফাজলামি করতে পারছে না। একে একে সবাই আসল। তখন চৌধুরী গেল ডায়াসের সামনে। গিয়ে গা জ্বালাময়ী লেকচার শুরু করল। আমাদের ব্যাচের গোপন খবর এডজুট্যান্ট এর কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এবং এডজুট্যান্ট আজ ডেকেছিল কার কাছে কি অবৈধ জিনিস আছে উনি সব জানেন সবাইকে ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিতে বলেছেন। এর পিছনে আছে একজন স্পাই। এবং আমরা স্পাইটাকে চিনতে পেরেছি। তাকে কি করা হবে সেটা নিয়েই আজকের মিটিং। সবার মাথা খারাপ এবং সবাই ভয়ে ভয়ে পাশের জনের দিকে তাকাচ্ছে। সেই সময় কে যেন একটু ফাজলামি করতে গিয়ে কঠিন ঝাড়ি খেয়ে ফেলল । ব্যাচের এমন দুর্দিনে ফাজলামি।
হঠাৎ করে চৌধুরী জিজ্ঞেস করল বদরুদ্দোজাকে, ” তুই কিছু বল”। অবাক বদরুদ্দোজা জিজ্ঞেস করছে আমি কেন? সবাই বদরুদ্দোজার দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই বুঝে গেছে কে সেই স্পাই। সবার চোখে একই প্রশ্ন। বদরু তুই? বদরু সব বুঝতে পারছে কিন্তু কোনভাবেই কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা। প্রথমে সে একটু রেগে গেল। তারপর দেখল পাবলিক কিছু বলছে না শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছে। কতক্ষণ সে চিল্লাফাল্লা করল। তখন কিছু ছেলের উক্তি , আমার যে ওয়াকম্যান আছে সেটা তো তুই ছাড়া কেউ জানেনা। আমি যত সহজে সময়গুলা বর্ণনা করছি সেই সময় গুলা আসলেই এইরকম ছিলনা। আশা করি সবাই কল্পনা করতে পারছেন কারণ এইরকম মুহূর্ত দেখার অভিজ্ঞতা থাকার কথা। ততক্ষণে পার হয়ে গেছে অনেক সময়। আমাদের মিটিং মুলতবি করা হয়েছে। স্পাইকে কি করা হবে, ব্যাচ থেকে বয়কট করা হবে নাকি এইসব স্বিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে। আর ঐদিকে বদরু ঘুরে বেড়াচ্ছে এর ডেস্ক থেকে তার ডেস্কে। কেউই তার সাথে কথা বলছে না। একসময় বদরুদ্দোজা চলে গেল বাথরুমে। ক্যাডেটদের প্রিয় জায়গা কত দুঃখ সুখের কাহিনী দেখেছে বাথরুম।
সেই ফাঁকে চৌধুরী ফর্মের সবাইকে জানিয়ে দিল এটা প্যাঁচালী মদন ছিল। একটা প্ল্যাকার্ড বের করল যেখানে লেখা আছে প্যাঁচালী মদন আর ক্যামেরা। ছবি তোলা হবে আজ। সব ঠিকঠাক বদরু ফিরে আসলেই সবাই একসাথে প্যাঁচালী মদন বলে উঠবে। কিন্তু কিসের কি বদরু তো আর আসে না। ৫-১০ মিনিট পরে সবার চিন্তা হল। আমরা ৭-৮ জন গেলাম বাথরুমে। বাথরুমে কেউ নাই শুধু একটার দরজা ভিতর থেকে লাগানো। সেখানে আমরা কান পাতলাম বদরুদ্দোজাকে ডাকা হল কেউ কোন কথা বলে না শুধু কান্নার আওয়াজ। আমরা বাহির থেকে ওকে বুঝাতে লাগলাম। কেউ কেউ হাসতে লাগল। কিন্তু বদরুদ্দোজা আর বের হয় না। অনেক কষ্টে তাকিয়ে বুঝিয়ে বের করা হল কিন্তু তার কান্না কেউ আমরা থামাতে পারছিনা। কাঁদতে কাঁদতেই ও বলছে আর ১০ মিনিট পরেই সে কলেজ থেকে পালাত। কাউকে যখন কোন ভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছে না আর এইরকম ভাবে কলেজে থাকার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না। অনেক ভাবে স্যরি বলে তাকে আমরা ফর্মে নিয়ে আসলাম। এরপর ওর কান্না থামল ওকে বলা হল পোজ দে প্ল্যাকার্ড লাগা গলায় তোর ছবি তোলা হবে। চোখে চিকচিক করা জল নিয়ে মদন মার্কা একটা হাসি দিল আমাদের বদরুদ্দোজা আর আমরা সবাই তখন হৈহৈ করছি।
অনেকদিন ধরে এই লেখাটা লিখব ভাবছিলাম কিন্তু গুছিয়ে আনতে পারছিলাম না। অনেক মজা পেয়েছিলাম সেদিন কিন্তু কিছুদিন আগে একটা ভাইয়ার অভিমান মার্কা স্পাই এর লেখা পরে খুব খারাপ লেগেছিল। ওনার ব্যাচে নাকি উনি এখনো বয়কট। আমাদের ব্যাচটা অতটা জিনিয়াস ব্যাচ ছিল না তবে এইসব ঝামেলায় ও পড়তে হয়নি আমাদের আল্লাহ বাচাইছে। সেদিন বুঝেছিলাম , সেই ঘটনা যদি সত্য হত তাহলে কি হতে পারত।

১১ টি মন্তব্য : “প্যাঁচালী মদন”

  1. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    কলেজে থাকাকালীন সময়ে ক্যাডেটদের কাছে প্রিফেক্টশীপ ব্যাপারটা সব সময়েই নেগেটিভভাবে বিবেচিত হোত বলে অনুভব করে এসেছি। বিশেষ করে ওপেন ফোরামে কেউ মুখ ফুটে স্বীকারই করতে চাইত না যে সে কোন একটা প্রিফেক্ট হতে চায়, উপযুক্ত যোগ্যতা বলে নেতৃত্ব দিতে চায়। যদিও বা কেউ বলে ফেলত তাহলে তাকে আর কিছু না হোক একটা ভালো রকম টিজিং হজম করতে হোত। বোধ করি এর পিছনে কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানো যাবে না। "বয়কট" শব্দটা আমার জন্য এক বিকট বিভৎস দুঃস্বপ্ন। একান্ত প্রার্থনা এটা যেন কাউকেই কখনো তাড়া না করে।

    চাকুরী জীবনের শুরুতে প্রিফেক্টশীপকে অনেক ভালোভাবে ডিল হতে দেখেছি। দেখে ভালো লেগেছে। বিএমএ'তে পুরো প্রক্রিয়াটাই অনেক বেশি পজিটিভ।

    "প্যাচালী মদন" 😮 প্ল্যাকার্ড সমৃদ্ধ ছবিটা দিয়ে দাও না......আরেকটু হাসি 😛 😀 :))।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  2. সায়েদ ভাইয়ের কথা শুনে আমার বয়কট হবার কথা মনে পড়ে গেল।
    আমার বয়কট হবার কাহিনী বলি। আমি খুব বেশি টিজ করতাম পোলাপানকে ক্লাস সেভেন থেকেই। :grr: :grr: :grr:
    আর প্রচুর টিজ নেম বানাতাম। ক্লাস সেভেন এইট মোটামুটি ভালই চলল। সবাই সবাইকে টিজ করে।
    ক্লাস নাইনে ওঠার পর ব্যাচের কয়েকজনের (যারা সবচেয়ে বেশি টিজ খাইত ব্যাচে)মনে হল, আমরা এখন যথেষ্ট বড় আর ম্যাচিউরড হয়ে গেছি। আমাদের এখন টিজিং এর মত ছেলে মানুষী মানায় না। টিজ বন্ধ করতে হবে। যারা টিজ করে তারা সবাই ইম্ম্যাচিউরড, পার্সোনালিটিলেস। এখন সবারই উচিত পার্সোনালিটি নিয়ে চলা। ব্লা ব্লা ব্লা...

    রিফাত, সাদী , আহসান , আশেক আর আমি এই কয়জন ছিলাম টিজের পক্ষে। কিসের কি পার্সোনালিটি! কাউকে টিজ না করে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় এটা আমাদের মাথায় ঢুকছিল না। এটা নিয়ে কয়েকদিন ব্যাচ গরম। শেষে একটা কনফারেন্স বসল। সিদ্ধান্ত হল, আমরা এই কয়জন ব্যাচ থেকে বয়কট কারণ আমরা টিজ করি কারণ আমাদের পার্সোনালিটি নাই :)) :)) :))

    লাভ নাই মামা, কারণ, পরের দিনই গেমস টাইমে ওদের দলে ভাঙন ধরল। কারণ টিজ ছাড়া যে আমাদের ব্রেকফাস্ট হজম হয়না সেটা ওরা ভালভাবেই টের পেল। আমাদের দল ভারি হতে লাগল। লাইটস আউটের আগেই আবার সবকিছু আগের মত। =)) =)) =))
    কয়েকজনের টিজ নেম নিয়ে আবার গান বানানো হল। সবাই মিলে গলা ফাটায়া সেই গান গেয়ে শুরু হল আবার টিজের রাজত্ব।

    জবাব দিন
  3. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    আয় হায়...কয় কি... আমি তো অহনো টিজ নামের উপরই চলতাছি...আমার বন্ধুরা আমার বাপ-মা'র দেয়া নামটা ভুইলাই গেছে। এমনকি, কলেজের বন্ধুদের কল্যাণে নামটা কলেজের গন্ডী ছাড়িয়ে বিএমএ তে ও চলে গিয়েছে...। বিএমএ'র বন্ধুরাও এখন আমাকে আর আমার বাপ-মা'র দেয়া নামে ডাকেনা। বর্তমানে কারো বাসায় ফোন করলে ফোনটা যদি ভাবী ধরেন, আর আমি যদি কুশল বিনিময়ের পরে পরিচয় দিতে গিয়ে বলি যে "ভাবী আমি আহসান বলছি" তাহলে কেউ কেউ বলেন "ভাই ঠিক চিনতে পারছিনা"...বা "ভাই ও আসলে বলবো..." কিংবা কেউ আবার কনফিউজডভাবে বলেন "ও আচ্ছা..." অর্থাৎ, অপরিচিত কারো সাথে কথা না বাড়ানোর অতি ভদ্র কৌশল। কিন্তু যখন আমি আমার সেই বিশেষ নামটি বলে জানতে চাই আমায় চিনতে পারছেন কিনা, তখন ভাবীদের অতি পরিচিত এবং কাছের মানুষের মত কন্ঠস্বর শোনা যায়,"আরে ভাই আপনি??? আগে বলবেনতো...।"

    বয়কট, আর স্পাইং কিংবা ব্যাচের ইউনিটি রিলেটেড ব্যাপারগুলা নিয়া ফান করা জিনিসটা খুবই মারাত্মক এবং ভয়ংকর একটা ব্যাপার...।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুলতপু

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।