ছোটদি (৪)

[ মাঝে মাঝেই কিছু গল্প উপন্যাস পড়ে আমার খুব ইচ্ছে করে এর পরে কি হল কিংবা এই একই ঘটনা যদি অন্য কারো মুখ থেকে আসত তাহলে কি হত। আমার সাথে যদি লেখকদের চেনা জানা থাকত তাহলে আমি খুব অনুরোধ করতাম তাদের এই থিম নিয়ে লেখার জন্য। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছে নিমাই এর মেমসাহেব উপন্যাস (আমার খুবই প্রিয় একটা বই ) এর কথা। মনে হচ্ছিল সেখানে মেমসাহেবের ছোটভাই খোকন এর একটা গল্প বুঝি লুকিয়ে আছে। তার জবানীতে যদি মেমসাহেবকে বের করা আনা যেত। তাই আমার এই চেষ্টা। আমার এই প্রচেষ্টায় যে কারো সমালোচনা উপদেশ সানন্দে গ্রহণ করব]
ছোটদি (১)
ছোটদি (২)
ছোটদি (৩)

৪।
অনেক রাত এখন। হঠাৎ করে আজ এত ছোটদির কথা মনে পড়ছে তাই আপনার চিঠির উত্তর দিতে বসলাম। আপনার তো এখন খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। শরীরের যত্ন নিয়েন। নিজের জন্য না হোক আমার দিদিটার জন্য হলেও। আপনার জন্য সবসময় চিন্তা করত আমার দিদি এখনো নিশ্চয়ই করে।
স্কুল ফাইন্যালের পরপরই আমার বাবা মারা গেল। পরীক্ষা শেষ করে আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন রাত করে বাসায় ফিরতাম। দিদিরা ঝাড়ি দিত ঠিকই তবে তার মধ্যেও তেমন ঝাঁঝ ছিল না। মাঝে মাঝে বেশি দেরি হয়ে গেল শুধু ছোটদি বলত আমি প্রতিদিন তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকি আর তোর টিকিটির কোন খবর থাকে না। তার কিছু আগেই হয়ত আমি পেট ভরে পুরি আর চা খেয়ে এসেছি। সেদিন এমনই আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় ঢুকার মুহূর্তে জটলা দেখে দাড়ালাম। ভেতর থেকে কে যেন বলছিল,” খোকনটা এখনো আসল না”। ভিড় ঠেলে নিজের বাসায় ঢুকলাম আমি যেখানে আমি খুব কমই পা ফেলি। দেখলাম বাবার খাটকে ঘিরে সবাই বসে আছে। বড়মা চোখ মুছছে। দিদিদের মুখ শক্ত হয়ে আছে। আমি আমার সবসময়ের নির্ভরতার প্রতীক ছোটদির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম, “কি হয়েছে দিদি?” সবাই ততক্ষণে আমাকে দেখতে পেয়েছে। ছোটদি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। বোকার মত আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম দিদি বাবা কই? হাউমাউ কান্নার ফাঁকে যা বুঝলাম বাবা আমার হঠাৎ করেই অফিসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাবার এক কলিগ বাসায় নিয়ে আসেন। ওনার থেকে খবর পেয়ে যখন বড়মা দেখতে আসেন তখন আবার বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এরপর আর বেশি সময় কাউকে দেননি। কখন যে তার হার্ট এত দুর্বল হয়ে পড়েছে কেউ কবর রাখেনি। ছেলে হিসেবে কখনো তার কোন খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি সেদিন তাই খুব বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল। বাবা নাকি শেষ সময়ে কাকে খুঁজছিলেন চারপাশে। সবাই বলছিল তোকেই খুঁজছিল খোকন। একটুও কাঁদিনি আমি তখন। বোকার মত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ছাদে উঠে বসেছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছিল। কেন যেন বাবা মারা যাওয়ায় আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। এর আগে কখনো মনে পড়েনি। সেই চেহারা মনে করতে না পারা মহিলার কথা ভেবে দুচোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু করল। পেছন থেকে দিদিরা এসে আমার পাশে বসেছিল। কেউ স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। কাঁদতে দিয়েছিল আমাকে প্রাণ ভরে, সাথী হয়েছিল আমার কান্নার। ছোটদি আমাকে জাপটে ধরে মাথাটা আমার কাঁধে দিয়ে রেখেছিল।ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। মেঝদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়েই বললাম, “ আমার মা বহুদিন একা ছিল দিদি, আজ অনেক খুশি হয়েছে তাইনারে দিদি? আমার তো তোমরা সবাই আছ আমার মার যে আর কেউ ছিল না ওখানে”।
বড়মা এসে দাঁড়িয়েছিল পিছনে। “খুব খারাপ লাগছে খোকা”?
প্রথম বারের মত হাউমাউ করে কাঁদলাম আমি। “ আমি কেন একা হব বড়মা। আমার কেন খারাপ লাগবে। মা বলতে তো সবসময় তোমাকেই ভেবেছি। কোনদিন তো মায়ের কথা মনে পড়েনি আজ কেন এত মনে পড়ছে। মায়ের কেন কোন চেহারা আমার একটুও মনে নেই। যতবার চেহারা খুঁজতে যাই তোমার চেহারা চলে আসে”। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম আমি।
গঙ্গার পানির কোন বিরাম নেই। এত রাতেও কলকাতার রাস্তায় হাজার মানুষের ভিড়ের একটুও কমতি নেই। শ্মশানের পাশে ঠিকই বসেছে জুয়া আর নেশার আড্ডা। শুধু নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে আমরা গুটিকয়েক প্রাণী বিধাতার হাতের পুতুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। তাতে অবশ্য বিধাতার কিছু এসে যায় না। সে তার নিজের হিসাবে ঠিকই আবার ঘটায় একই ঘটনা।
বাবার মৃত্যুর পর আচার রীতি পালনের পর আমি বেশ কিছুদিন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা যেই রুমে থাকত সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম একা একা। ছোটদি তখন নতুন চাকরী পেল। কলেজে পড়ানো শেষ করে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার পাশে বসে থাকত। কখনো ওর কলেজের মজার মজার গল্প বলে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করত। খেতে না চাইলে নিজ হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিত।আরো অনেক বেশি করে আদর পেতে থাকলাম ওর কাছ থেকে।
বেশিদিন থাকে নি আমার এই বৈরাগ্য ভাব। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে আমি দুরন্ত হয়ে উঠলাম। বহির্জগতের সাথে আমার পরিচয় ঘটল সর্বান্তকরণে। কিছু নতুন বন্ধুবান্ধব তাদের নিয়ে কফি হাউসে আড্ডা আমার নেশা হয়ে উঠল। শুরু হল আমার দেশোদ্ধারের চিন্তভাবনা। রক্তে যৌবনের গান শুনতে পেলাম আমি। পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকার থেকে দেশ এর জন্য, অন্যায় এর প্রতিরোধের চিন্তা আমার রক্তে নাচন লাগাল। আমি রাজনীতিতে মেতে উঠলাম। পুরান বন্ধুরা বলত এইসব রাজনীতি হল এই বয়সের হিরোইজম। ওদের কথা তখন আমার গায়ে হূল ফুটাত। ওদের জন্য মায়া হত এখনো ঘরের ননীর পুতুল রয়ে গেল। ভর্তি ফি বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে এইসব নিয়ে নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দিত আমাদের রক্ত টগবগ করে উঠত। মিছিল মিটিং শেষে নিজের হাতে পোষ্টার লেখতাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত। দেখতাম আমার ছোটদি একা জেগে আছে হয়ত কোন গল্পের বই পড়ছে। আমি আসারা সাথে সাথে খাবার টেবিলে খাবার গরম করে দিত। অপরাধীর মত ওর পাশে বসে পড়তাম খেতে। তখন শুরু হত ওর আমাকে বোঝানো পালা। একসময় ওর উপদেশের মুড শেষ হত। শুরু হত আমাদের ভাইবোনের গল্প।
আলাপে প্রায়ই আপনার কথা উঠে আসত। আপনার কথায় স্বপ্নীল হয়ে উঠত আমার দিদির মুখ। দিদিকে আপনি একটা শাড়ী দিয়েছিলেন। ও যেদিন সেটা পড়ে কলেজে যাচ্ছিল আমি আর মেঝদি ওকে খুব খেপাচ্ছিলাম। লজ্জায় আমার দিদি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে বেঁচেছিল। এরপর প্রতিদিন দিদি কলেজে বের হওয়ার সময় আমরা ওকে জিজ্ঞেস করতাম কিরে তোর সাংবাদিকের শাড়ী পড়লি না যে। লজ্জা লাল হয়ে আমার দিদি বলত, “ মারব এক থাপ্পড়” । দিদির হাতে কখনো আমার থাপ্পড় খাওয়া হয়নি কিন্তু ও এত সুন্দর করে বলত মারব এক থাপ্পড়। প্রথম বেতন পেয়ে দিদি লিষ্ট করছিল কার জন্য কি কিনবে। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল পিচ্চি তোর কি লাগবেরে। কি সব বলেছিলাম মনে নেই কিন্তু যেদিন ও শপিং করে ফিরল তখন দেখি কাকে দিয়ে একটা সাইকেল নামাচ্ছে। বললাম কার জন্য এই সাইকেল । সেই কবে আমি কখন ওর কাছে সাইকেল চেয়েছিলাম ও নাকি বলেছিল চাকরী করে আমাকে সাইকেল কিনে দিবে আজ তাই আমার জন্য সাইকেল কিনে এনেছে। তখন বলেছিলাম তুই কিরে দিদি আমি এখন বড় হয়েছি না সাইকেল না কিনে আমাকে একটা বাইক কিনে দিতি। আজ ও সেই সাইকেল আমার রুমের পাশে থাকে। আমি চড়ি না তাতে কিন্তু প্রতি সপ্তাহে সেটাকে ধুয়ে মুছে চকচকে না করে রাখলে আমার শান্তি হয় না।

১৭ টি মন্তব্য : “ছোটদি (৪)”

  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    দোস্ত খবর কি তোর সময়ের প্যাচে পড়ে তোর সাথে দেখা করা হলো না। আর তোর আমার সময়ের ডিফারেন্সও পাক্কা ১২ ঘন্টা 🙂
    মেমসাহেব নামটা শুনে বাককার ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। তোর মনে আছে বই মেলায় বাককার ভাইকে নিয়ে আমরা সবাই মিল্যা যে জুক্স করছিলাম?

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।