আমার কাজলাদিদিরা – ২ ( পিয়াপু )

আমার কাজলাদিদিরা – ১
[ঠিক কবে মনে নেই কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই কেন যেন আমার একটা বড় বোনের শখ হয়ে গেল ( আজো গেল না )।এই জন্যই মনে হয় ছোটবেলা থেকেই আমি আমার আশে পাশে সবসময় বড়বোন খুঁজেছিলাম। সেই খোঁজার ফলে আমার জীবনে অনেক গুলা আপুই এসেছে। কেউ কেউ আমাকে আসলেই ছোটভাইর মত আদর করেছে কাউকে কাউকে আমি নিজেই মনে মনে আপুর আসন দিয়েছি উনি হয়ত জানেই না।সবার সাথে যে আজ যোগাযোগ আছে তাও না। কিন্তু মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে কারো কথা মনে পড়ে। সেই আপুদের গল্প আমার এই কাজলাদিদিরা। ]
আমি এখন যদি কাউকে বলি যে ছোটবেলায় আমি একেবারেই চুপচাপ ছিলাম, কথাই বলতাম না খুব একটা, কেউ বিশ্বাস করে না। এমন কথাও প্রচলিত ছিল যে আমাকে নাকি বোম মেরেও কথা বের করা যায় না। কোথাও গেলেই আমার প্রথম কাজ ছিল আশে পাশে খুঁজে একটা গল্পের বই বের করে ফেলা। তারপর কোন এক কোনায় গিয়ে সেটা গেলা। সবাই আমাকে সেইরকমই জানত। ক্যাডেট কলেজে ঢুকে তখন সবে মাত্র সবার কাছে পাত্তা পেতে শুরু করেছি। ছোট্ট একটা বাচ্চা একা বাইরে থাকে সবার কাছে তাই ছুটিতে আসলে আমার অনেক দাম। সবাই এটা ওটা জানতে চায়। আমিও টুকটাক কথায় তার উত্তর দেই। তখন ক্লাস ৮ এ পড়ি। আব্বু মারা গেছেন মাত্রই। আমি ছুটিতে এসেছি তখন আব্বুর জন্য মিলাদ হবে। আমার আব্বু মারা যাবার আগে ১১ মাস অসুস্থ ছিল। তখন আমার এক দূর সম্পর্কের মামা আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। ছোট বেলা থেকেই আমরা ঐ বাসায় গিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকি কেন যেন ঐ মামীকে আমরা ভয় পেতাম। ওনার ভয়ে কত অখাদ্য যে খেতে হইছে ( শাকসব্জী ) ।
আব্বুর মিলাদ এর ব্যবস্থা সব করছেন ঐ মামা। আমার বড় ভাই আর আমি গেলাম সেখানে কি একটা কাজে। বড়ভাইয়া কথা বলছে মামী, মামাত ভাই আর বোনের সাথে। আমি সবসময়ের মতই একটা ম্যাগাজিন টেনে নিলাম। হঠাৎ পিয়া আপু এসে আমার থেকে সেটা কেড়ে নিল। বলল এত জ্ঞান অর্জন করতে হবে না কথা বল আমাদের সাথে। আপু ডিগ্রী পড়ে আর আমি সেভেন এর একটা ছেলে। ওনার সাথে আমি কি কথা বলব। কিন্তু সেই কেড়ে নেওয়ার মধ্যে কিছু একটা ছিল বুঝতে পারিনি। এই আপুও ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার ছোটভাইকে আদর করে। আর কয়েকদিন ধরেই দেখছিলাম গত ১ বছরেই পান্থ ( আমার বড়ভাই ) এর সাথে তার খুবই খাতির। পান্থভাইয়াও পিয়াপু বলতে প্রায় অজ্ঞান। আমার ভাইকে কখনো কারো এরকম ফ্যান হতে দেখিনি।
আব্বুর মিলাদের দিন রাতে আপুদের যখন বিদায় দিচ্ছি তখন আপু এসে আমাকে বলল , তপু পান্থ আমাকে তুমি করে বলে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবা। আমি তো হা হয়ে গেলাম। এরপর ১ সপ্তাহ ছিলাম ঢাকায়। এর আগে কখনো আমি ফোনে কথা বলিনি। সেই সময় ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে আপুকে ফোন করলাম। কথা বলতে গিয়ে তুমি আপনি এসবে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। মনে আছে কলেজে গিয়েও খালি ভাবতাম এতদিনে বুঝি আমার একটা কাজলাদিদি এসে হাজির হয়েছে।
অনেক ভেবে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার উপায় খুঁজে বের করলাম। কলেজে বসে প্রথম তাকে চিঠি লেখলাম। সেই চিঠির যে উত্তর পাব তা ঠিকই ভেবেছিলাম কিন্তু চিঠিটা যে আমাকে এতটা খুশি করবে তা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একদিন দেখলাম একটা খাম তার উপরে আমার নাম লেখা ঠিকই কিন্তু হাতের লেখাটা আমি চিনিনা। মনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই বাজছিল আজই হয়তবা … হলুদ রঙের খামটি তখন আমার কাছে আকাশের চাঁদ। খোলার আগে অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছি এইরকম লেখবে ঐ রকম লেখবে।
তারপর থেকে শুরু হল আমার চিঠি লেখা আমার পিয়াপু কে। মনের আনন্দে আমি শুধু আপু আপু লেখতাম। এক চিঠিতে মনে হয় আমি ১০-১৫ বার আপু আপু ডাকতাম। ছোট্ট বেলা থেকে মনের ভিতরে জমে থাকা ডাকটা চান্স পেয়ে যত বেশি ডাকা যেত তত ডাকতাম।
কলেজ থেকে ছুটিতে আসলে কখন পিয়াপুকে দেখতে যাব তাই ভাবতাম শুধু। কিন্তু তখনো আমার এই মুখচোরা স্বভাব চেঞ্জ হয়নি তাই গিয়েও খুব বেশি কথা বলতে পারতাম না। আমার থেকে আমার বড় ভাইই বেশি কথা বলত। আমিও অনুভব করতাম পিয়াপু আমার থেকে আমার বড় ভাইকেই বেশি আদর করে। ও সবসময় ঢাকায় থাকে প্রায়ই তার সাথে দেখা হয় এজন্য তার সাথেই বেশি ফ্রি। আর আমি ? চিঠিতেই আপু আপু সামনে আসলে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনা।
এইভাবে কেটে গেল অনেকদিন। কলেজে যতদিন ছিলাম প্রতি টার্মে তাকে চিঠি লেখতাম। পিয়াপু আমার চিঠির আপু। মনে আছে তখন ভাবতাম কলেজ থেকে বের হলে তো সবসময় ঢাকাতেই থাকব। আমার সাথেও আপুর সম্পর্কটা আস্তে আস্তে পান্থ ভাইয়ার মত হবে। কিন্তু কলেজ থেকে বের হয়ে যে কি হল চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল আমার আপুটাও কেমন যেন দূরে সরে গেল। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আরো ব্যস্ত হয়ে গেল। খুব মজা হত কোন বারই আমার জন্মদিন মনে রাখতে পারতনা আপু। আমি ফোন করে বলতাম কি আপু এবারও ভুলে গেলা।
একসময় বিদেশ চলে আসলাম। প্রথম চিঠি লিখেছিলাম আম্মু আর পিয়াপুকে। দুটা চিঠির একটাও গিয়ে পৌঁছায়নি। এরপর আর লেখা হয়নি। আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পিয়াপুর সাথে। তবুও বছরের দুটা দিন পিয়াপুকে ফোন দিতাম। তার জন্মদিনে উইশ করতে। আর আমার জন্মদিনে। সে মনে রাখতে পারতনা। আমিও আর বলতাম না যে আজ আমার জন্মদিন।একবার আমি কথা বলার পর পান্থ ভাইয়া ওকে ফোন দিয়েছিল। তখন তাকে বলল তুমি বুঝলা না কেন তপু তো গত কয়েক বছর ধরেই ওর বার্থডে তে তোমাকে ফোন দেয় তুমি কোনদিনও বুঝ না। বিশাল মন খারাপ হয়েছিল নাকি তার। ফোনেই কান্না করছিল। এরপর আমি আর কোন বার্থডেত তাকে আর ফোন দেইনি। আস্তে আস্তে ভুলতে বাধ্য হলাম কারণ যতদিন মনে হত কেমন যেন খারাপ লাগত। এবারো দেশে গিয়ে আপুর সাথে ফোনে কথা হল। সে অনেকবারই বলছিল আমি কিন্তু তপু তোমাকে অনেক আদর করি। দেখা করিনি ইচ্ছে করেই কি হবে দেখা করে।

৩৫ টি মন্তব্য : “আমার কাজলাদিদিরা – ২ ( পিয়াপু )”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    শুরুতে তোমার ক্লাস নিয়ে একটু খঁটকা লেগেছে (ক্লাস ৭ নাকি ৮!)
    যাইহোক, লেখা বরাবরের মতনই হৃঁদয় ছুঁয়ে গেল...


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    মনের আনন্দে আমি শুধু আপু আপু লেখতাম। এক চিঠিতে মনে হয় আমি ১০-১৫ বার আপু আপু ডাকতাম। ছোট্ট বেলা থেকে মনের ভিতরে জমে থাকা ডাকটা চান্স পেয়ে যত বেশি ডাকা যেত তত ডাকতাম।

    অসাধারণ ... কামতপু ... অসাধারণ


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    দারুণ লাগলো।
    দোস্ত শরীর ভালো হইছে?
    আমার শরীর খারাপ তাই মাঝে ছিলাম না।
    তোর লেখা পড়ে তো অনেক খারাপ লাগলো।
    কাগলা দিদির খোজ আমি যে করিনা তা না ,
    কিন্তু তোর লেখায় মন বিষণ্ণ হে গেল এক কাজলা দিদির জন্য...........

    জবাব দিন
  4. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    আমার এক কাজলা দিদির নাম মলি আপু। ছুটিতে এসে আমি নিজের বাসায় যতক্ষন সময় কাটাতাম তার কাছাকাছি সময় কাটাতাম মলি আপুদের বাসায় ওনার সাথে গল্প করে। কলেজ থেকে বের হবার পরও অনেক গল্প করেছি কিন্তু আমার স্নাতক পড়াশুনা শুরু হয়ে যাবার পর থেকে আর নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারি নি। আমরা বাসা বদল করি আর আপুরও বিয়ে হয়ে যায়, তাই এখন আর তেমন যোগাযোগ নাই। 🙁

    জবাব দিন
    • কামরুলতপু (৯৬-০২)

      @সামিয়া
      ঠিক হয়নাই খুব খারাপ খুব খারাপ। এজন্য তোমার ব্যাঞ্চাই
      @তৌফিক
      বোন যে দিলি আপুর কন্টাক্ট তো দিলি না। চরম ফাঁকিবাজির জন্য তোর ব্যাঞ্চাই।
      @কাইউম ভাই
      ভাইয়া আপনার গিয়ারে অনেক বোন নিয়ে লেখা দেওয়া হইছে এবং পাইপলাইনে আরো অনেকগুলা ...

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।