আমার কাজলাদিদিরা – ১ ( সুমি আপু )

[ঠিক কবে মনে নেই কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই কেন যেন আমার একটা বড় বোনের শখ হয়ে গেল ( আজো গেল না )।
” মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?”
এই প্রশ্নটা আজীবন খুঁজে ফিরছি। একটু একটু যখন বড় হলাম গল্পের বই পড়া শুরু করলাম তখন এই ইচ্ছাটা দিনকে দিন বাড়তে লাগল। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, মেঝদি, পড়তে পড়তে ছোট্ট আমার কত দীর্ঘশ্বাস বের হল তার খবর কেউ রাখেনি। কেন যে আমার এত বোনের শখ আমি নিজেও জানিনা। আসলেই কি বোনরা অনেক বেশি আদর করে? আমার যেহেতু বোন নেই তাই আমার এই বিষয়ে অনেক কল্পনা অনেক রকমের চিন্তাভাবনা। যদি শুধু চিন্তার উপর পিএইচডি থাকত তাহলে আমি পেয়ে যেতাম। কত রকম চিন্তা যে করি আমার একটা বোন থাকলে এই করত ওই করত। পরবর্তীতে এক ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম উনার বড় আপু নাকি হোষ্টেলে থাকত উনি বাসায় এসেই প্রথমে নাকি আম্মুর সাথে একটা ঝগড়া করত কারন হচ্ছে তার আগেই নাকি উনি বোনের কাছে বিচার দিয়ে দিতেন অমুক দিন তমুক দিন মা ওনাকে মেরেছেন। আর আমি মনে মনে ভাবি ইশশ , আমি তো এইরকম একটা বড় বোন চেয়েছিলাম।
এই জন্যই মনে হয় ছোটবেলা থেকেই আমি আমার আশে পাশে সবসময় বড়বোন খুঁজেছিলাম। সেই খোঁজার ফলে আমার জীবনে অনেক গুলা আপুই এসেছে। কেউ কেউ আমাকে আসলেই ছোটভাইর মত আদর করেছে কাউকে কাউকে আমি নিজেই মনে মনে আপুর আসন দিয়েছি উনি হয়ত জানেই না।
সবার সাথে যে আজ যোগাযোগ আছে তাও না। কিন্তু মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে কারো কথা মনে পড়ে। সেই আপুদের গল্প আমার এই কাজলাদিদিরা।]

আমি তখন ক্লাস ৩ তে পড়ি। সবেই আমরা সিলেট থেকে ঢাকাতে এসেছি। থাকি পোস্তাগোলার দিকে জায়গার নাম জুরাইন। সেখানে আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকি তার পাশের বাসাতেই একটা আপু ছিলেন। আমার ৩-৪ বছরের বড় হবেন। উনি মনে হয় তখন ৭ এ পড়েন। আমাদের তখন একটা বিশাল পিচ্চি কাচ্চার দল । প্রায় ১০-১২ জন আমরা সেখানে। সবাই মিলে এটা ওটা খেলি। ছোটবেলায় আমি বউচি থেকে শুরু করে হেন খেলা নাই যা খেলিনাই। কুতকুত ও খেলেছি এবং ভাল বউ ছিলাম (বউচি খেলার ) । সেই প্রথম মনে হয় আমার আপু বানানো শুরু। যদিও ঐ আপু আমার থেকে আমার ছোটভাইকেই বেশি আদর করেন। কেন যেন সবসময় এইটাই হয়েছে। আমার ফ্যামিলির মধ্যেও যত খালাত ভাই বোন আছে সবাই দেখি হয় আমার বড় ভাই নয় আমার ছোট ভাইকেই বেশি আদর করে। সেই জন্য ছোটবেলায় আমি অনেক কম আদর পেতাম।
যাইহোক সেই আপুকে আমি তখন থেকেই মনে মনে আপু হিসেবে ভাবতাম। কেমন যেন মনে হত ইশশ এই আপুটা যদি কনক( আমার ছোট ভাই ) থেকে আমাকে বেশি আদর করত। কখনো বলা হয়নি তাকে। একদিন হঠাৎ শুনলাম ওই আপুরা আমেরিকা চলে যাবে। আমি তখন ক্লাস ৪ পাশ করে ৫ এ উঠব। ওনারা সপরিবারে আমেরিকা চলে গেলেন। আমার আর কোন দিন তাকে বলা হল না তুমি আমার আপু হবে?
এরপর থেকে আমি অনেকদিন ভাবতাম আমি কোন একদিন আমেরিকা যাব , সুমি আপুর সাথে আমার দেখা হবে। তখন তাকে আমি বলব আপু সেইসময় আমার খুব মনে হত আপনি যদি আমাকে কনকের থেকে বেশি আদর করতেন। সবচেয়ে অবাক হয়ে গেলাম প্রায় ১২ বছর পরে যখন আমি জাপানে থাকি হঠাৎ করে আম্মু বলল সুমির ফোন নম্বর আছে। সাথে সাথেই আমি ফোন নাম্বার নিয়ে ডায়াল করলাম আমেরিকায়। খুব এক্সাইটিং লাগছিল। এত বছর পরে আপু কি আমাকে চিনতে পারবে? এখনো আগের মত আছে কিনা?
প্রথমদিন ফোনে পেলাম না কিন্তু ওনার গলা শুনা গেল। মেসেজিং এ দেখি বেশ দুঃখ প্রকাশ করল ফোন ধরতে না পারার জন্য। দেখলাম নাহ সুমি আপুর গলা চেঞ্জ হয়নি। আবার একদিন ফোন করলাম এরপর পেলাম সুমি আপুকে। দীর্ঘ ১২ বছর পর আবার ওনার সাথে আমার কথা হল। প্রথম অনেকক্ষণ আমরা পুরান আলাপ করলাম। ছোটবেলার সেইসব স্মৃতি আরো কত কি। এরপর মাঝে মাঝেই ফোন করা হত। তখন বলতাম আপু ছোটবেলায় আমি এইরকম ভাবতাম। উনি বলল কে বলল আমি তোমাকে কম আদর করতাম। তোমাকেও আদর করতাম তো কিন্তু কনক বেশি ছোট ছিল তো সেই জন্য। আমি বলি ওইটাই তো আসল সমস্যা ও ছোট বলে আমার আদর অনেক জায়গাতেই কমে যেত। পৃথিবীতে আসলেই কত কি যে ঘটে নইলে সুমি আপুর সাথে যে আমার আবার কখনো যোগাযোগ হবে কখনো চিন্তাই করিনি। হয়তবা এইবার দেশে গেলে ওনার সাথে আমার দেখাও হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর উনি নাকি বাংলাদেশে যাবেন। বেশ আশা নিয়ে বসে আছি আপু সেই আগের মতই আছে কিনা।
(-চলবে)

(ডিসক্লেমারঃ অনেকদিন আগে সচলে প্রকাশিত )

৩২ টি মন্তব্য : “আমার কাজলাদিদিরা – ১ ( সুমি আপু )”

  1. কনক রায়হান (৯৮-০৪)

    মাই ডিয়ার এল্ডার ব্রাদার আমার মনে হয় ছোটবেলায় আমি আর বড়ভাইয়া যতটা বেশি আদর পেতাম সেইটা তুমি এখন সুদে আসলে অনেক বেশি গুনে সবার কাছ থেকে পাও।
    এইটা হলো সমতা বিধান... 😛

    জবাব দিন
  2. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    এমন একটা কাজলাদিদির সাথে কয়েকবছর আগে দেখা হয়েছিল। সমস্যা হলো তার কাছে আমি এখনও তেমন ছোট্টই রয়ে গেছি। তারা মোটে বিশ্বাসই করতে চায় না আমিও বড় হয়েছি। কারো কারো কাছে আমার শৈশব এখন অক্ষত আছে .....যে শৈশব আমার নিজের কাছেই হারিয়ে গেছে.....

    লেখাটা চমৎকার লাগলো।

    জবাব দিন
  3. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    লেখাটা অনেক টাচিং...আগেই পড়া মনে হয়...তবু, অনুভূতিটা ছুঁইয়ে গেল...

    মানুষে মানুষে কত ফারাক!
    আমার কলেজের এক বন্ধুরাও শুধু ভাই-ভাই ছিল, কোন বোন ছিল না...

    ফলাফলঃ পৃথিবীর কোন মেয়েকেই ও বোনের চোখে দেখতে শিখে নাই...দেখতো শুধু অন্য চোখে ;;)


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফৌজিয়ান (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।