শুধুই একটি গল্প

কাজ শেষ করে বাসায় যাবার জন্য উশখুশ করছি ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। যাহ শালা এখনই দেখা যাবে কোন এক কাজের ফোন দিবে আমাকে আটকে আরো ঘন্টা দুয়েকের জন্য। ধরব না ধরব না ভেবেও শেষে ফোন তুললাম। যতটা বিরক্তি আনা যায় তা ফুটিয়ে বললাম হ্যালো।
-কিরে শালা আছিস তাহলে এখনো অফিসে, আমার বাসায় চলে আয়।
রাতুল আমার ভার্সিটি জীবনের বন্ধু। কিন্তু আজ আমার একদমই কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
-নাহ দোস্ত আজ না আমি বাসায় যাব। অনেক কাজ আছে আমার বাসায়।
-শালা কাজের গুষ্ঠি কিলাই। বহুত খারাপ অবস্থা এদিকে এক্ষুনি চলে আয় আমার এখানে।
– কি হয়েছে।
-দীপা আর ওর ছেলে আমার বাসায়। তাড়াতাড়ি আয় বুঝতে পারছি না কি করব। বিশাল হাউকাউ হচ্ছে।
-মানে? কি বলিস?
-আরে শালা আগে তো আয় আমি ছাড়ছি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দীপা ওর বাসায় নাহয় বোঝা গেল দীপার ছেলে কিভাবে আসল। আর বাসায় যাওয়া হল না আমার। তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে তখনই রাতুলের বাসার দিকে পা চালালাম।

দীপা আমাদের ক্লাশমেটদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল। আর সবার মত আমিও ওর প্রতি দুর্বল হয়েছিলাম। সবার সাথেই খুব মিশত ও। কিন্তু আমরা সবাই বুঝি মনে মনে চাইতাম এই সুন্দরী শুধু আমার দিকেই তাকাক আমার সাথেই কথা বলুক। ভার্সিটিতে থাকতেই হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে পালাল অরূপ নামের এক ছেলের সাথে। নাটক করত অরূপ। অল্প কিছুদিনের পরিচয়েই নাকি ও বুঝতে পেরেছিল এই তার জীবনের ধ্রুবপুরুষ। খুব রাগ হয়েছিল আমার হয়তবা আমাদের সবারই। কেন অরূপ আমি নয় কেন। শিল্প সংস্কৃতি না করলে বুঝি ভালবাসা যায় না। এরপর বহুদিন ওর কোন খবর পাইনি। শুনেছিলাম ওরা দুজন কুমিল্লাতে থাকে। দীপা আমাদের জীবন থেকে হারিয়েই যেত যদি না দুবছর পরই ও আবার ঢাকায় ফিরে এসে আমাদের খবর না দিত। রাতুলের থেকে খবর পেয়ে আমিও গিয়েছিলাম সেদিন । নতুন ভার্সিটি শেষ করে চাকরী খুঁজছিলাম আমরা সবাই। খুব কাঁদছিল দীপা। অরূপ নাকি একটা লম্পট। আগেই নাকি তার বিয়ে করা বউ ছিল সেসব লুকিয়ে নাকি দীপাকে বিয়ে করেছিল। যখন দীপা জানতে পেরেছে তখন নাকি সে মা হতে চলেছে। তাও থাকতে চেয়েছিল দীপা কিন্তু ইদানিং নাকি অরূপ আবার আগের স্ত্রীর কাছে যাওয়া শুরু করেছে ওকে একদমই পাত্তা দিচ্ছেনা। তাই সব ছেড়ে চলে এসেছে ও। ওর পক্ষে নাকি আর সম্ভব নয় অরূপের কাছে থাকা। ছেলেটার কি হবে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল জানিনা। এটুকুই। মা এর কোন ছাপ নেই ওর চোখেমুখে। আজ ১০ বছর পরে কি হচ্ছে রাতুলের বাসায় বুঝতে পারছিনা আমি।

-আয় কমল এত দেরী করলি কেন?
-তুইও আছিস দেখি কি ব্যাপার বলত দীপা কই? অভিকে দেখে বললাম আমি। দীপা আর অভি এখন একসাথে আছে। কেউ বলে বিয়ে করেছে কেউ বলে করেনি। আমরা ওদের ঘাটাইনি কখনো।
-আর বলিস না আমি তো ফেঁসে গেলাম দীপার কথা শুনে।
-কি হয়েছে।
-কিছুদিন হল দীপা পাগলের মত হয়েছে। সারাক্ষণ এক কথা ওর মুখে আমার সন্তানকে এনে দাও। কোত্থেকে খবর পেয়েছে অরূপ এখন ঢাকায় থাকে ব্যাস সেই থেকে ওর মাথা খারাপের মত অবস্থা। একবার খালি নাকি দেখবে ।
-তুই কি করলি।
– কি আর করব খোঁজ লাগালাম এরপর খবর পেলাম । সেই ছেলে যেই স্কুলে পড়ে সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসলাম রাতুলের বাসায়। স্কুলটা ওর বাসা থেকে কাছে কিনা। দীপা আসার পর থেকে পাগলামি করছে।
-ও কই?
-পাশের রুমে কাঁদছে।
-কেন? বাচ্চাটা কই?
– আরে আর বলিস না সেই পিচ্চি কি এখন দীপাকে চিনতে পারবে? দীপা যতই ওকে আদর করতে যায় বাচ্চাটা ভয় পেয়ে কান্না করে। চল নিজেই দেখ।
রুমে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা খুব ছোট্ট বাচ্চা বসে আছে খাটের উপর। এখন কাঁদছে না কিন্তু একটু আগেও যে কেঁদেছে তা বুঝা যাচ্ছে। আর দীপা পড়ে আছে মেঝেতে। আমি ঢুকতেই বলল
– কমল দেখ না আমার ছেলেটা আমাকে চিনতে পারছে না কেন পারছে না কেন ও আমাকে মা ডাকছে না। একবার শুধু একবার আমি ওর কাছ থেকে মা ডাক শুনব।
আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে দীপার দিকে। দীপা মনে হয় জোর করে ওকে আদর করতে গিয়েছিল। দীপার লিপস্টিকের দাগ ওর গালে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে।
বাচ্চাটার কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-আমার নাম বিপুল। আব্বুর নাম অরূপ আর আম্মুর নাম রেনু।
-খুব সুন্দর নাম তো তোমার।
-তোমরা কি ছেলেধরা? আমাকে কি করবে তোমরা।আমি আম্মুর কাছে যাব।
বোঝাই যাচ্ছে এই ছেলের মায়ের অভাব নেই। তার বাসাতেই মা আছে। দীপাকে ওর প্রয়োজন নেই। আমি একবার দীপার দিকে তাকালাম। দীপার ও কোন অধিকার নেই এই ছেলের কাছ থেকে মা ডাক শোনবার।
-বিপুল এই যে মহিলাটা উনি কি তোমার আম্মুর মত?
-নাহ উনি কেন আমার আম্মুর মত হবে। আমাকে প্লিজ বাসায় দিয়ে আসুন। আমি আম্মুর কাছে যাব।
-তুমি হারিয়ে গেলে কি তোমার আম্মু খুব কাঁদবে।
-অনেক কাদঁবে। আম্মু আমাকে খুব আদর করে।
-এই যে মহিলা ওনারও তোমার মত একটি ছেলে ছিল। সে হারিয়ে গিয়েছে। সেজন্য তোমাকে দেখে তার খুব নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছে। তুমি কি তাকে একবার গিয়ে আম্মু ডাকতে পারবে? এরপরই আমরা তোমাদের বাসায় যাব।
অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটি। কিন্তু আস্তে আস্তে উঠে দীপার কাছে গেল সে।
-তুমি আর কেঁদনা। তোমার ছেলেকে এই আংকেলরা খুঁজে দিবে দেখ। আমি তোমাকে আম্মু ডাকলে তুমি কান্না থামাবা?
এই কথা শুনে দীপা কাদঁতে লাগল দুহাতে জড়িয়ে ধরল পিচ্চিটাকে। অনেকক্ষণ পরে আমি ওকে ছাড়িয়ে নিলাম। অভিকে বললাম যাহ এইবার ছেলেটাকে দিয়ে আয়। দীপা কিছু বলল না। ছেলেটা যাবার সময় ওকে বলল
-আমি যাই তুমি আর কেঁদ না।
অভি ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছে। দীপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে পাগলের মত। ওকে আমি স্বান্ত্বনা দিচ্ছি না। শুধুই আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে দিচ্ছি। একসময় ঐ দীপা আমার কাছে আসলে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম আর আজ ওকে ধরেও আমার মুখে কোন ভাবান্তর হচ্ছে না। আজ যে ও কোন মেয়ে নয় একজন মা।

২,৯৩৫ বার দেখা হয়েছে

৩৫ টি মন্তব্য : “শুধুই একটি গল্প”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আমি কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না।

    আজ যে ও কোন মেয়ে নয় একজন মা।

    আল্লাহ যেন কোনো মা'কে সন্তানহারা না করে। সকল মা'কে :salute: :salute: :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    মা যে কত বড় একটা আশীর্বাদ তা বোধহয় ......
    আল্লাহপাক কোন মা কে সন্তানহারা না করুক আর কোন সন্তানকে মা হারাবার অনুভুতি না দিক... :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:
    বস হইছে ভাই...হেভভী ফিলিংস উঠছে লেখা ডা পইরা :salute: :salute: :salute:

    জবাব দিন
  3. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    দীপা আর অভি এখন একসাথে আছে। কেউ বলে বিয়ে করেছে কেউ বলে করেনি।

    কেন যে আমার চোখ দুইটা শুধু ঈঙ্গিতপূর্ণ লাইনে আটকায়া যায় :boss:

    লেখাটা খুব সুন্দর হইসে :clap:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    পাঠক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সব গল্পকে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নেই।আমার সেই সীমাবদ্ধতা থেকেই বলছি-"দীপা" জাতীয় মেয়েদের পরিণতি দেখলে মায়া হয়-কিন্তু হাজারটা ভাল ছেলে থাকা সত্বেও অরূপ জাতীয় লম্পটদের বেছে নেয়া এই মেয়েগুলার এমন পরিণতি প্রাপ্য নয় এ কথাও আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারিনা।

    আজ যে ও কোন মেয়ে নয় একজন মা।

    বস,এই এক লাইনে এসে দীপা টাইপ চরিত্রের প্রতি একবিন্দু মমতা না থাকা এই আমার ভেতরেও মমতা এনে দিলেন।মায়াই লাগছে এখন।

    লেখকের সার্থকতা তো এখানেই!হায় রে,এইটা যদি আমি পারতাম!!

    জবাব দিন
  5. তানভীর (৯৪-০০)
    আজ যে ও কোন মেয়ে নয় একজন মা।

    তপু, তোমার লেখা আমার সবসময়ই ভালো লাগে। এই লেখাটাও তার ব্যতিক্রম না।

    এইভাবে লিখে আমাদের ব্লগটাকে আরো সুন্দর করে যাও, এই শুভকাম্না রইল।

    জবাব দিন
  6. আন্দালিব (৯৬-০২)

    শেষলাইনে একটা পেরেক মেরে দিলি! 😉

    মাতৃত্ব নিয়ে একটা গল্প আমিও পোস্টাইলাম। তারপরে দেখি তুইও কাছাকাছি বিষয়ে লিখেছিস! আমাকেও কয়েকদিন ধরে একটা জ্বালাইছে! মনে হয় গ্রেট মেন থিঙ্ক অ্যালাইক- কথাটা ভুল না! B-) B-)

    কেমন আছিস?

    জবাব দিন
    • কামরুলতপু (৯৬-০২)

      আমি কোন লেখা দিয়েই সবসময় আপনার কমেন্টের অপেক্ষায় থাকি ভাইয়া। ধন্যবাদ । আমার আগের লেখায় আপনি কমেন্ট দেন নাই দেখে ভাবছিলাম আপনি কই গেলেন।

      জবাব দিন
      • কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

        ছোটদি অবশ্যই পড়েছি। কমেন্ট করা হয়নি শুধুমাত্র ঈদের পর একসাথে অনেকগুলো লেখা পড়ার জটে পড়েই।

        আমি কোন লেখা দিয়েই সবসময় আপনার কমেন্টের অপেক্ষায় থাকি ভাইয়া।

        খুব ভালো লাগলো ভাইয়া এটা পড়ে। আমার নিজের কোনো বোন নেই, তাই তোমার লেখাগুলো প্রথম থেকেই টানতো খুব। আরো বেশি করে লিখে যাও ভাইয়া। মন খারাপ থাকলেও আমাদের ভুলে যেওনা। এতদূরে থেকে হয়তো মন ভালো করে দিতে পারবোনা, কিন্তু ছোট ভাইয়ের মন খারাপের ভাগীদারতো অন্ততঃ হতে পারবো।


        সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

        জবাব দিন
  7. তাইফুর (৯২-৯৮)

    চমৎকার গল্প, চমৎকার ফিনিশিং।
    সাবাশ তপু। :hug:
    দৈনন্দিন সাধারণ ঘটনা গুলো তোরা এত সুন্দর করে ক্যাম্নে উপস্থাপন করিস ... :dreamy:


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাইফুর (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।