অপ রূপ কথা

[একটা রূপকথার গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। সেটা লেখার জন্য ভাবতে গিয়ে ভাবলাম ছোটবেলায় কার থেকে আমি রূপকথা শুনেছি। ভেবে দেখলাম আমাকে কেউ গল্প শোনায় নি ছোটবেলায়। নিজে নিজেই গল্পের বই পড়ার আগ পর্যন্ত তাই গল্প শোনা হয়নি আমার। কিন্তু রাতে কেও গল্প শোনাচ্ছে কখনো বা ভূতের কখনো বা রাজপুত্র-কন্যাদের সে ফিলিংসই আলাদা। সেরকম ফিলিংস এর জন্য একটা রূপকথা শোনার গল্প লেখতে গিয়ে দেখি একটা যা-তা লেখা হয়েছে। পাবলিশ করব কিনা ভাবতে ভাবতে অনেক টাইম পার হয়েছে, বহুদিন কিছু লেখি না তাই এই অপ রূপকথা কে অপরূপ কথা বলে চালিয়ে দিলাম।]

-পিচ্চি আমার উপর খুব রাগ হয়েছে ভাইয়া? তখন খুব মেজাজ খারাপ ছিল এইজন্য তোকে বকেছি রাগ করিস না ভাইয়া দেখ আমার কত খারাপ লাগছে।
অভিমানে চোখ ভারী হয়ে আসা পিচ্চিটা তাকায় না আপুর দিকে।
এবার কিন্তু নিজেই মুখটি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের দিকে ফেরায় আপু, খুব বেশি রাগ হয়েছে সোনা? আয় আর পড়তে হবে না ঘুমাবি। আজ আমার সাথে ঘুমাবি তুই, আমি তোকে গল্প শোনাব।
এবার পিচ্চি ঠিকই কেঁদে দেয়। চোখ মুছতে মুছতে আপুর কোলে উঠে পড়ে।

-এই আপুসোনা তুই বলেছিস গল্প শোনাবি।
– হ্যা বলছিরে সোনা, একটু ঠিক করে নেই। পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প ঠিক করে আপু।
এক জংগলে এক খুব দুখী একটা মেয়ে ছিল। তার এই পৃথিবীতে কেউ নাই। একা একা একটি কুড়েঘরে থাকে মেয়েটি…
-ওর কোন পিচ্চিসোনা নাই আপুসোনা?
-ঐ গাধা পিচ্চিসোনা থাকলে কি আর ও দুখী হয়?
-আহারে, তারপর?
-সেই মেয়ে একা একা জঙ্গলে থাকে খাবার জোগাড় করে রান্না করে ,খাওয়া দাওয়া করে আর গুনগুন করে গান করে। রাতের বেলায় ওর গলায় খুবই করুণ গান চলে আসে। সেটা শুনে পশুপাখিরা পর্যন্ত চোখে পানি চলে আসে।
– ও কি রাজকন্যা আপুসোনা?
– আরে না। ও একেবারেই সাধারন একটা মেয়ে। রাজকন্যারা তো খুব সুন্দর হয় এই মেয়ে তো এত সুন্দর না, আমার মত অনেকটা।
– তুই সুন্দর না এটা কে বলেছে? তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর।আপুসোনাকে জড়িয়ে ধরে বলে পিচ্চি।
-এইজন্যই তো বলেছিলাম ওই মেয়ের যদি একটি পিচ্চিসোনা থাকত তাহলে কি আর ও দুখী হত। হুমম তারপর শোন সেই মেয়ে কিন্তু মনে মনে একটা রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা করে। ও ভাবতে থাকে একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে নিয়ে যাবে ।
-কেন?
-একবার এক খুব বুড়ো একটা লোক ওর কুড়েঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিল । মেয়েটি তখন খুব আদর করে বুড়োটার সেবা করেছিল। বুড়ো খুশি হয়ে বলেছিল মা আমি তোকে বর দিলাম তোর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে। মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে বলেছিল তুমি কি সন্ন্যাসী? বুড়োও হেসে বলেছিল সন্ন্যাসী না হলে কি বর দেওয়া যায় না? তুই এত লক্ষী একটি মেয়ে তোর বর লাগবে কেন তোর এমনিতেই রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে।
-তাহলে তো আর বিয়ে হবে না রাজপুত্র আসবে না। পিচ্চির সুচিন্তিত মতামত।
-কেন?
– ওমা তুমি দেখি কিছু জাননা সন্ন্যাসী না হলে কি আর বর কাজ করে?
– করেরে পিচ্চি করে। তুই যদি খুব ভাল কিছু কাজ করিস আর কেউ যদি মন থেকে তোর জন্য দোয়া করে তাহলে কাজ করে। আমিই তো বর পেয়েছি।
– তাই কবে আপুসোনা? তোর সাথে সন্ন্যাসীর দেখা হয়েছিল বুঝি?
– উহু। সন্ন্যাসী না অনেক আগে তখন তুই ছিলি না। আমিও এরকম এক বুড়ো ফকিরকে পানি দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল খুকী তোমার কি চাই।
-কি চাইছিলি তুই?
-আমি বলেছিলাম , আমার পুতুল আমার সাথে কথা বলে না আমার একটা জীবন্ত পুতুল চাই।
-পেয়েছিলি আপুসোনা জীবন্ত পুতুল?
– হ্যা পেয়েছি। তার অল্প কিছুদিন পরেই পেয়েছি।
– কি বলিস আপুসোনা আমাকে দেখাস নি তো।
পিচ্চিটাকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয় আপুসোনা ” তোকে কিভাবে দেখাই , তুইই তো আমার সেই জীবন্ত পুতুল ” । বোকার মত হাসে পিচ্চি আপুসোনার আদর পেয়ে।
– তারপর কি হল ঐ মেয়েটার।
– ওহহ, তো সেই মেয়ে বসে থাকে রাজপুত্রের আশায় মনে মনে ভাবে হতেও তো পারে সেই বৃদ্ধ লোকটি কোন ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী। রাজপুত্র তো আর আসে না। একদিন এক ছেলে আসল তাকে দেখে কিছুতেই রাজপুত্র মনে হয় না। মেয়েটিকে দেখে মায়া লেগে গেলে ছেলেটির। সে প্রতিদিন সেখানে আসা শুরু করে দিল। মেয়েটি কিন্তু তার সাথে খুব একটা কথা বলে না কারণ সে যে রাজপুত্রের আশায় থাকে। ছেলেটি নানাভাবে মেয়েটিকে খুশি করতে চায় কোনদিন হয়ত জংলী ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে নিয়ে আসে কোনদিন আবার নিয়ে আসে লাল টকটকে গোলাপ। মেয়েটি সেগুলো হাতে নিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবে। ছেলেটি মন খারাপ করে আস্তে আস্তে চলে যায়। একদিন সত্যি সত্যি কিন্তু এক রাজপুত্র এই মেয়েটির দুয়ারে আসল। রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে এসেছে তার ঘোড়া এবং সে দুজনই ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত। মেয়েটি খুশিতে আত্মহারা এতদিনে তার মনের মানুষ আসল বুঝি। সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল রাজপুত্রের সেবা করে দেবার জন্য। কিন্তু রাজপুত্র তো রাজপুত্র তার এতে মন গলবে কেন। প্রথমেই মেয়েটির দেওয়া পেয়ালায় করে সে পানি খেতে অস্বীকার করল। সে সোনার গ্লাস ছাড়া কোনদিন পানি খায়নি। মেয়েটি একটু দমে যায়। তারপরও রাজপুত্রের জন্য জীবন দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে সে। রান্না করে খাওয়াবার চেষ্টা করে রাজপুত্র কে। ক্ষিদেয় কাতর রাজপুত্র খাবার সময় তাই আর সোনার থালার আবদার করে না কিন্তু খাওয়া শেষেই তার রাজরক্ত আবার ফুটে উঠে টগবগ করে। সে মেয়েটিকে ডাকে, ” এই তুই এসে আমার পা টিপে দেয়”। একটু অবাক হয়ে উঠে মেয়েটি রাজপুত্রের এহেন কথা শুনে। কিন্তু রাজপুত্রের সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। এমন ৪-৫ টি দাসী প্রতিদিন ওর সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়। মেয়েটি রাজপুত্রের পা টিপে দিতে দিতে চোখের পানি ফেলতে থাকে। সেই ছেলেটি যেটি মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছি সে কিন্তু চুপিসারে এসে দেখে মন খারাপ করে চলে গেছে। রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে চলে গেল ঘোড়া হাঁকিয়ে। মেয়েটি সেই থেকে কাঁদছে। এমন সময় মেয়েটির সামনে এসে দাড়াল সেই ছেলেটি। এসে ওকে তুলে নিল বুকে। মেয়েটির কান্না বেড়ে গেল দ্বিগুন। ছেলেটি মেয়েটির কান্না মুছে দিল ঘরে নিয়ে গেল এবং বের করে দিল আজকে আনা এতদিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোলাপ। এরপর বলল তোমাকে ভালবাসার একটু অধিকার দাও আমায় দেখবে আমি রাজপুত্র না হতে পারি , হাতি ঘোড়ায় ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু আমার ভালবাসায় কোনদিন ঘাটতি পাবে না। মেয়েটি দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল আমাকে ক্ষমা কর আমি আসল রাজপুত্র চিনতে পারিনি তুমিই আমার জীবনের রাজপুত্র।

-কিরে পিচ্চিসোনা ঘুমিয়ে পড়লি।
সাড়াশব্দ না পেয়ে আপু দেখল পিচ্চি তাকে জড়িয়ে ধরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বালিশ ঠিক করে দিল, ঘুমন্ত ছোট্ট ভাইটা যেন এঞ্জেল।এঞ্জেলটির কপালে চুমুর চিহ্ন একেঁ দিয়ে ঘুমের আয়োজন করে আপুসোনা ।

৩,৯০১ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “অপ রূপ কথা”

  1. কনক রায়হান (৯৮-০৪)

    ভাইয়া মনে আছে তুমি তো আগে আমাকে এরকম গল্প শুনাইতা.......
    ইস পিচ্চি কালে যদি ফিরে যাইতাম .......
    অবশ্য এখন ফিরে গেলে আর শুনাইতা কিনা কে জানে??খালি আপু আপু করতা..ছোট ভাইটারে পাত্তাই দিতা না 😀

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    পাবলিশ করব কিনা ভাবতে ভাবতে অনেক টাইম পার হয়েছে, বহুদিন কিছু লেখি না তাই এই অপ রূপকথা কে অপরূপ কথা বলে চালিয়ে দিলাম

    কস্কি মমিন, এত চমৎকার লেখা নিয়াও পাব্লিশ করবি কি করবি না ভাবিস ??
    বিনয়ের অবতার ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    অনেকগুলা লাইন ভাল্লাগছে :-* ... কোট করলে "কাট ইওর কোট এ্যাকর্ডিং টু ইওর ক্লোথ" হয় না বইলা কোট বানাইতে পাল্লাম না। :bash:

    ৫ দাগায়া গেলাম O:-)

    (তোর "আপু, আপু" আর গেল না) :goragori:


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. তানভীর (৯৪-০০)

    দারুণ লাগল তপু। :thumbup:
    আমি রূপকথার ভীষণ ভক্ত......এখনও রূপকথার গল্প পেলে পড়ি।
    যদিও মিল নেই তবুও কেন জানি জীবনানন্দের "তবে রাজপুত্র হয়ে কি লাভ" কবিতাটার কথা মনে পড়ল।

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    তপু, দারুণ হয়েছে। তাইফুরের ভাষায় বলতে হচ্ছে ......... অবতার!! :grr:

    (তোর “আপু, আপু” আর গেল না)

    আপু তো শেষ পর্যন্ত কম পাইলা না!! :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    ছোটদের নিয়ে গল্প লেখার মানুষের বড় অভাব।

    যারা ছোটদেরকে নিয়ে ভাবে তাদেরকে আমার অনেক বড় মাপের মানুষ মনে হয় :thumbup: :thumbup:

    যদিও এইটা রুপকথা ছেড়ে একটু আপুকথা টাইপের হয়ে গেসে তারপরও :hatsoff:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. রকিব (০১-০৭)

    আপনার লেখা আমার কুব্বালা লাগে না, পুরাটা পড়ার আগেই কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। আজো তাই হলো। :boss: :boss:
    আমারো এখন আপুসোনা আছে :goragori: :goragori:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  8. দিহান আহসান

    বুঝতে পারলাম না, অপ রূপকথা কেন মনে করলে? :-B
    ৩০০ তম পোষ্ট তারপর অপরূপ লেখা, চমৎকার। মিষ্টি পাওনা রইলো। 🙂
    এবারো আপুসোনাকে নিয়ে আসলে? আপুসোনা বিরাট ভাগ্যবতী এমন পাগল ভাই পেয়েছে। অবশ্য ভাই থাকা মানেই মনে হয় বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। 😀

    জবাব দিন
  9. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    নাহ লেখাটা দারুন হয়েছে । ছোট থাকতে গল্প না বললে খেতে চাইতাম না । তখন আমার খালামনিরা গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দিত, আর আমরা পিচ্চির দল গোল হয়ে বসে খেতাম আর গল্প শুনতাম । খুব মধুর একটা স্মৃতি মনে করায় দিলিরে অবতার ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিহান (অতিথি)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।