বিদায়, কাজীদা!

১৯ জানুয়ারি ২০২২।
সন্ধে ছ’টা।
ঢাকা।

‘ধুশ…শালা!’ শাহবাগ সিগন্যালে অপেক্ষা করতে করতে তৃতীয়বারের মত গাল দিয়ে উঠল সোহেল। প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে গেছে গাড়ি বন্ধ করে থেমে আছে। সিগন্যাল ছাড়ার নামই নেই! অথচ, ট্রাফিক সিগন্যাল একাধিকবার লাল, হলুদ পার হয়ে সবুজ হয়েছে। হলে হবে কী? রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকগুলো ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে, বাঁশী দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অটোমেটেড সিগন্যাল বসিয়ে লাভ কী হলো?! অবশ্য কাদের লাভ হয়েছে তা ওর অজানা নয়। বেশ কিছু রিপোর্ট ওর কাছেও এসেছে। কিন্তু এখতিয়ারে বাইরে বলে কিছুই করতে পারে নি। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে সোহেল আপন মনে ভাবল, ‘মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দুর্নীতিবাজ পুলিশ আমলা আর রাজনীতিবিদদের…’ হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিং বেজে উঠে ওকে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে নিয়ে আসলো। ইলোরা ফোন করেছে, বসের সেক্রেটারি।
-সোহেল ভাই আপনি কোথায়?
-আর বোলো না! এখনও শাহবাগে আটকে আছি!
-বলেন কী? বস তো প্রতি মিনিটে আপনার খোঁজ করছে! বাকি প্রায় সবাই চলে এসেছে। আপনি জলদি আসুন। প্রয়োজনে সিগন্যাল ভেঙে চলে আসুন। স্যার কিছু মনে করবেন না। কাহিনী অনেক সিরিয়াস।
-ইলোরা, কী হয়েছে জানতে পেরেছ?
-নাহ, তবে খুব খুব খারাপ কিছু… আচ্ছা আমি রাখি, স্যার আবার ফোন দিয়েছেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে…

কথা শেষ হতে না হতেই সোহেল দেখল সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি জলদি স্টার্ট করলো। এরপর চট করে ড্যাশ বোর্ড থেকে ম্যাগনেটিক ইমারজেন্সি বিকন বের করলো। সামনের গাড়ি নড়াচড়া করা শুরুর আগেই জানালার কাঁচ খুলে গাড়ির ছাদে বিকনটি রেখে অন করলো। বিকট শব্দে ‘তু তু তু তু’ সাইরেন বাজা শুরু হলো। ততক্ষণে সামনের গাড়ি এগোনো শুরু করেছে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সোহেল পা দিয়ে একসেলেটর চেপে ধরল।

২।

জলদ কণ্ঠের ‘কাম ইন’ শুনে ভেতরে ঢুকল সোহেল। ভেতরে ঢুকেই চমকে উঠলো। রাহাত খানের টেবিলের সামনে সোহানা বসে আছে, ঘুরে তাকাতেই দেখলো সোহানার চোখ-মুখ লাল। তার মানে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। এবার রাহাত খানের দিকে ভালো করে তাকাল ও। স্যারের চোখও রক্ত জবার মত লাল হয়ে আছে। চুল উষ্কখুষ্ক। পরনে পাঞ্জাবি, বোঝাই যাচ্ছে বাসা থেকে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে এসেছেন। জ্বলন্ত চুরুট অ্যাশট্রের উপর একা একা পুড়ছে। রাহাত খানের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। ‘স্যার আবার চুরুট ধরেছেন? ঘটনা আসলেই সিরিয়াস!’ সোহেলের পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো, ‘রানার কিছু হয় নি তো?!’

সোহেল মুখ খুলতে উদ্যত হতেই রাহাত খান হাত তুলে থামার ইশারা করলেন। সোহেল শুনতে পেলো স্যারের ফোনের ডায়াল টোন শোনা যাচ্ছে। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। ওদিকে, দুই রিং এর পর খুট করে অপর প্রান্তের সাথে ফোন কানেক্টেড হলো।
-স্যার রানা বলছি। (সোহেল নিঃশব্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো!) দুঃখিত স্যার, কল ব্যাক করতে একটু দেরী হয়ে গেল। আসলে দুবাই এক্সপো নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে…
-রানা, তুমি এখুনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দাও। দুবাই এক্সপো’র চেয়ে হাজার গুণে জরুরী কাজ পড়েছে! সাথে গিলটি মিয়াকেও নিয়ে এসো।
রানার ঢোক গেলার শব্দ লাউড স্পিকারে সোহেলও শুনতে পেলো। রানার মনের মধ্যে কী চলছে তা এখান থেকে সোহেলও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। কারণ, ফিল্ডে কাজ করার সময় যে কোন অ্যাসাইনমেন্ট এর আগে ওরও একই অনুভূতি হত। কোন মতে নিজেকে সামলে রানা বলল,
-স্যার, কী হয়েছে যদি আভাস দিতেন…
-এম আর নাইন, তোমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মিশন পেতে চলেছ…
-স্যার?!
-হ্যাঁ, রানা, তোমাকে কাজী আনোয়ার হোসেনের দাফনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে!
-ইয়াল্লা…

কথাটা শুনেই সোহেল চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। খেয়ালই নেই রাহাত খান এখনও ওকে বসার কথা বলেন নি। ওদিকে সোহানা টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করেছে। সোহেল কী বলবে, কী করবে…কিছুই মাথায় আসছে না। হঠাৎ শুনতে পেলো রাহাত খান ওকে ডাকছেন,
-সোহেল! সোহেল!!
-স্যার?
-বি স্ট্রং মাই বয়! এত বছরের ট্রেনিং, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাও। ভাবাবেগের সময় এখন নয়। আমাদের হাতে অনেক কাজ।
-জি স্যার! কিন্তু কখন, মানে কীভাবে…মানে…
– গত অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। মাঝে পাঁচ বার হসপিটালাইজড ছিলেন। চিকিৎসার সময় খুব একটা পাওয়া যায়নি। গত ১০ ই জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্ট এ ছিলেন। আজ বিকাল চারটার পর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন…
-ইন্না…রাজিউন।
-তুমি আমাদের সকল দেশের সব অফিসে নির্দেশ দাও- কাজী আনোয়ার হোসেনের সাথে আমাদের প্রতিষ্ঠানের যাদেরই পরিচয় হয়েছে সবাই যেন এ এস এ পি ঢাকায় উপস্থিত হয়। বিসিআই, রানা এজেন্সির বাইরের লোকদেরও বলতে হবে। মারভিন লংফেলো এবং অ্যাডমিরাল হ্যামিল্টনের সাথে কথা হয়েছে। খবর পেয়েছে গগল, রেমারিক, মুরসহ অনেকেই। বাকিদের জানাতে হবে। সোহানা ইতোমধ্যেই তিন গোয়েন্দার সাথে কথা বলেছে। প্রথম যে ফ্লাইট পাবে সেটাতেই ওরা রওনা হচ্ছে। রাশেদ-মেরী, জিনা এবং বরিসরাও আসছে। তুমি, রেজা-সুজাকে ট্রেস করো, খবর পৌঁছে দাও।
-‘জ্বি স্যার।’ অবিচল কণ্ঠে জানালো সোহেল। ‘কিন্তু কুয়াশার কী হবে?’ বোঝাই যাচ্ছে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে। একেবারে পোক্ত, পোড় খাওয়া সৈনিকের মত শত দুঃখ-কষ্ট বেদনা সামলে পেশাদার আচরণ করছে।
-ডার্ক ওয়েব, আন্ডার ওয়ার্ল্ড সহ সবখানে জানিয়ে দাও আগামী এক সপ্তাহ কুয়াশাকে আগের সকল অপরাধের ইনডেমনিটি দেয়া হলো। কেউ ওকে তাড়া করবে না। শহীদ, কামাল যেন ওকে সাথে নিয়ে আসে। একই কথা প্রযোজ্য খায়রুল কবিরের ক্ষেত্রেও।
-বাকি থাকলো অয়ন-জিমি এবং রাজুরা।
-হ্যাঁ ওদেরকেও জানাতে হবে। তবে, আরও লোক আছে, ওরাই শেষ নয়। সেবার সকল সাবেক বর্তমান লেখক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জানাতে হবে। পাশাপাশি প্রয়াত শেখ আব্দুল হাকিমের পরিচিতদেরও ডেকে পাঠাও। আমি চাই এই সুযোগে তিক্ততা কিছুটা যেন কমে যায়। সময় থাকতে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ওঁদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারিনি। এখন কিছুটা হলেও চেষ্টা করি…
-স্যার মাত্র চার মাসের মাথায় দু’জন চলে গেলেন…
-হ্যাঁ, আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো!

৩।

গিলটি মিয়াকে সাথে নিয়ে রানা দুবাই এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। রানা এজেন্সির নিজস্ব গাড়ি। স্থানীয় এক কম বয়সী যুবক গাড়ি চালাচ্ছে। ছেলেটা কিছুদিন হলো ড্রাইভার হিসেবে যোগ দিয়েছে। খুবই বিশ্বস্ত। সাবলীল গতিতে চকচকে, মসৃণ রাস্তা দিয়ে ওদের গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে। তবে, রানার কোন দিকে খেয়াল নেই। জানালা দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে আর কিছুক্ষণ পরপর ভিজে ওঠা চোখ মুছে নিচ্ছে। ওদিকে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে গিলটি মিয়া মাঝে মাঝেই শব্দ করে কাঁদছে… রানা পকেট থেকে ফোন হাতে নিয়ে ব্লু টুথ অন করে গাড়ির অডিও প্লেয়ারের সাথে কানেক্ট করলো। প্লে লিস্ট থেকে একটি নির্দিষ্ট গান খুঁজে বের করে প্লে বাটনে চাপ দিলো। ইতালির গান, তবে ইংরেজিতে গাওয়া। মন খুব বিক্ষিপ্ত হলে এই গানটি ও টানা শুনতে থাকে। তখন হাউ মাউ করে কান্না আসে, বুকটা হালকা হয়। আজ ওর শব্দ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কয়েক সেকেন্ড পর গান শুরু হলো-

এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী
আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি।
সে রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু – ঘুমিয়ে পড়ো না।

যদি কোকিল ডাকে, বুঝবে আমি আসছি।
আর ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিও, আমি আর বেশী দূরে নেই।
তারপর,হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে, আমি এসেছি।
সে রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না…

৩ টি মন্তব্য : “বিদায়, কাজীদা!”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সেবা কি, কাজী আনোয়ার হোসেন কি সেটা যারা সেবা পড়ে নাই, মাসুদ রানা পড়ে নাই তারা কোনোদিন বুঝবে না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।