বইটির নাম ”Bookie Gambler Fixer Spy” শেষ পর্ব

এড হকিন্স এর লেখা Bookie Gambler Fixer Spy বইটির দুইটি অধ্যায় আমার পরিচিত ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য অনুবাদ শুরু করেছি। ঠিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। আকারে বেশি বড় হয়ে যাবার কারণে কিছু অনুচ্ছেদ আমি বাদ দিয়েছি।

যাই হোক, আজ সেটার তৃতীয় কিস্তি শেয়ার করছি। মনে রাখবেন স্পয়লার এলার্ট কিন্তু আগেই দিয়ে রাখছি। নিজ দায়িত্বে পড়বেন। কারণ ‘It will change the way you look at cricket!’

———–

প্রথম পর্বঃ

দ্বিতীয় পর্বঃ

৩য় পর্বঃ

৪র্থ পর্বঃ

———–

টসে জিতে ভারতীয় অধিনায়ক এম এস ধোনি প্রথমে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই দলের খেলোয়াড়গণ লাইন ধরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে হাত মেলালো। দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজার পর খেলা শুরু হল। ম্যাচের শুরুতেই ভারত খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। শেবাগ নেমেই মাঠের চারিদিকে ধুন্ধুমার মার শুরু করলেন। ইনিংসের তৃতীয় বলে চার দিয়ে শুরু, এরপর উমর গুলের দ্বিতীয় ওভারে তুলে নিলেন ২০ রান! স্টেডিয়াম-জুড়ে মেন ইন ব্লু’র সমর্থনে নীল রঙের ঢেউ বইতে লাগল। প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই পাকি দল ব্যাকফুটে।

দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আমি আর শেরিন এক সাথে বসে দেখি। শেরিন আমার পুরনো বন্ধু, পেশায় ব্যারিস্টার এবং ক্রিকেট খেলাটিকে বোঝার ব্যাপারে খুব আগ্রহ। আগ্রহ এজন্য নয় যে খেলাটিকে সে পছন্দ করে,আসলে সে বুঝতে চায় নিজের বাবা এবং আঙ্কেল পার্সির মন জয় করার জন্য। কারণ তারা দুজনই ক্রিকেটের পাগলা ভক্ত!

খেলা দেখার সঙ্গী হিসেবে শেরিন একেবারে ফার্স্ট ক্লাস, কেননা সে সবসময় সাথে করে দারুণ মজার মজার বিস্কুট নিয়ে আসে। অবশ্য, খেলার মাঝে আমাকে প্রচুর প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হয়-‘লেগ স্পিন ব্যাপারটা আসলে কী?’ ‘ছয়-তিন ফিল্ডিং কিভাবে সাজায়?’ ‘আচ্ছা, অমুক ক্যাপ্টেন বোলিং চেঞ্জের ব্যাপারে কী ভুল করল আরেকটু বুঝিয়ে বল তো…আঙ্কেল পার্সিকে বলে চমকে দিতে চাই!’

বরাবরের মত শেরিন খেলা শুরু হবার পর বাসায় আসল। শেবাগ যখন উমর গুলদের তুলোধোনা করছিল তখন সে আমার বাড়ীর নিচে এসে কলিং বেল বাজিয়ে এলাকা গরম করে ফেলল!

‘শেবাগ দারুণ খেলছে, তাই না?’ বলতে বলতে ঘুরে ঢুকল। ‘আমার মনে হয় ভারতের ব্যাটিং এর সামনে পাকিদের বোলিং তেমন সুবিধে করতে পারবে না। যাই হোক, টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটিং দলের এর সাথে সেরা বোলিং দলের টক্কর…সেই চিরন্তন ব্যাট-বলের লড়াই। ঠিক না?’

‘তুমি উইজডেন পড়া শুরু করেছো নাকি?’

‘নাহ! আঙ্কেল পার্সির কাছ থেকে জেনেছি। ভাবলাম তোমাকে একটু ভড়কে দিই!’

লন্ডনের বৃষ্টিতে ভেজা কোট খুলে ও নিজের আসনে থিতু হতে না হতেই শেবাগ এলবিডব্লিউ আউট হয়ে গেল, ওয়াহাব রিয়াজের বলে। ‘তাও ভাল টেন্ডুলকার আউট হয় নি’, শেরিন বলল, ‘তাহলে তো মনে হয় ওদিকে লোকজন আত্মহত্যা করা শুরু করত!’

কিছুক্ষণ পর চা খেতে খেতে আমার ‘মাফিয়া বন্ধুদের’ ব্যাপারে জানতে চাইল। কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন করার ছলে আমি জানালাম ওরা কিন্তু মানুষ হিসেবে অতটা খারাপ নয়। এরপর ‘ফিক্সিং’ এর ব্যাপারে পার্থিবের কাছে যেসব তথ্য পেয়েছি বা কথোপকথন হয়েছিল সেসব ওকে দেখালাম।

ওদিকে খেলা কিন্তু এগিয়ে চলছিল। শেবাগ আউট হলেও ভারত দ্রুত গতিতেই রান সংগ্রহ বজায় রাখল। ১০ ওভার শেষে ভারত ১ উইকেটের বিনিময়ে ৭৩। টেন্ডুলকারের রান ২৫ বলে ২৩। ওর প্রতিটি রান স্টেডিয়ামে যে উচ্ছ্বাস তৈরি করছিল, তা যেন আমি হাজার মাইল দূরে বসেও শুনতে পাচ্ছিলাম। রান সংখ্যা যত বাড়ছিল, সাথে বাড়ছিল পুরো দেশের উন্মাদনা। ভারতের ক্রিকেট দেবতা যেন ব্যাট হাতে দুষ্ট ও অশুভ শক্তিকে কচুকাটা করছে। এ সময় টেন্ডুলকারের বিরুদ্ধে পাকিদের করা এল বি’র আবেদন আম্পায়ার নাকচ করলেন। ‘নট আউট’ ঘোষণার পর দর্শকের চিৎকারে টিভির শব্দ কমাতে বাধ্য হলাম!

‘আচ্ছা এই ম্যাচও কি ফিক্স করা?’ শেরিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল।

‘অসম্ভব! এ রকম ম্যাচ ফিক্স করার কথা কেউ ভাবারও সাহস পাবে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। তাছাড়া এটা ওদের দেশের মান-সম্মানের প্রশ্ন, শেৎসা!’

‘হুম, আমারও তাই মনে হয়। পাকিরাও নিশ্চয়ই এতটা বুদ্ধু নয়।‘ সে বলল। বুঝলাম গত বছরের লর্ডস ম্যাচ স্পট-ফিক্সিং এ পাকিদের সম্পৃক্ততার কারণে ও এই কথা বলেছে।

শেরিনের কথা শেষ হতে না হতেই শহিদ আফ্রিদির কিছুটা খাটো লেন্থের বলে ব্যাটফুটে গিয়ে খেলতে গিয়ে শচিন টেন্ডুলকার মিসটাইমিং করে ফেলল। মিড উইকেটে থাকা মিসবাহ-উল-হক ঝাঁপিয়ে বলটি তালুবন্দী করতে ঝাঁপ দিল। কিন্তু বলটি তার হাতের ফাঁক হলে মাটিতে পড়ে গেল।

‘ওহ মাই গড!’ শেরিন উচ্চস্বরে হেসে উঠল। ‘এরা তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে হারছে!’

‘আরে, না!’ আমি বললাম। ‘পাকিরা বরাবরই ফিল্ডিং এ দুর্বল দল। তাছাড়া ক্যাচটাও অনেক কঠিন ছিল।‘

শেষ পর্যন্ত টেন্ডুলকার যখন আউট হল তখন সে শত কোটি মানুষের বহুল আকাঙ্ক্ষিত শতক থেকে মাত্র ১৫ রান দূরে ছিল। ঐ ৮৫ রানের মাঝেই ছিল চার চারটে লাইফ! প্রতিটি মিসের পর শেরিন আগের চেয়েও বেশি উত্তেজিত হয়ে পাকিদের ‘নিষ্কর্মার দল’, ‘নির্বোধের দল’ ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছিল পাশাপাশি আমার দিকে তাকিয়ে খোঁচা মারছিল- ‘কী! তুমি না বলেছিলেন এই ম্যাচ ফিক্স করা না!’ আমি প্রতিবারই ভাঙা রেকর্ডের মত ‘ওদের ফিল্ডিং অমনই’ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম।

মিসবাহ প্রথম মিসের পর ক্যাচ ফেলে অভিজ্ঞ ইউনিস খান। গাছ থেকে পাকা ফল পাড়ার মত আলতো করে হাতের মধ্যে নিয়েও কেমন ভাবে জানি বলটি হাত থেকে পড়ে গেল! এর পরের কালপ্রিট কামরান আকমল। টেন্ডুলকারের ব্যাটের কানায় লাগা বল সে গ্ল্যাভসবন্দী করতে ব্যর্থ হল। ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা বলে উঠল ‘টেন্ডুলকার সকালে কী খেয়েছে…বাটারি ফিঙ্গার?!’

এর কিছুক্ষণ পর কামরানের ভাই উমর আকমলও ক্যাচ মিসের মিছিলে সামিল হল। ক্রিকইনফো’র বল বাই বল কমেন্ট্রিতে লেখা হল- ‘হচ্ছেটা কী! টেন্ডুলকার মিড উইকেট দিয়ে পুল করার চেষ্টা করতে গিয়ে বল হাওয়ায় মারল। সেখানে থাকা উমর বলটি দেখল, সুন্দর করে টাইমিং করে ঝাঁপ দিয়ে ধরল এবং হাত থেকে ফেলে দিল!’ হাফিজ রাগে গজরাচ্ছে। আফ্রিদিকে দেখে মনে হল অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। এটা ছিল টেন্ডুলকারের চতুর্থ ড্রপড চান্স!

পরবর্তীতে ধোনির এজ করা বলও কামরান আকমল ধরতে ব্যর্থ হল, যা ছিল পাঁচ নম্বর ড্রপ। এটা ঘটল ৪২ তম ওভারে। কাহিনী জমানোর জন্য বলতে পারতাম-এই পর্যায়ে আমার বিশ্বাস কিছুটা টলে উঠল। ফলে, আমি পার্থিবকে মেসেজ পাঠালাম- ‘এসব কী হচ্ছে?’ তবে বাস্তবে এমন কিছু ঘটল না। যদিও শেরিন অনেকক্ষণ ধরে ‘মাফিয়া বন্ধুদের’ কাছে খোঁজ নাও’ বলে ঘ্যানঘ্যান করছিল।

দেখতে দেখতে আরও এক ওভার শেষ হয়ে গেল। ইনিংসের শেষটুকু আয়েশ করে দেখার জন্য শেরিন চা বানানোর জন্য কিচেনে ছুটল। এই সুযোগে আমি ইমেইল, বিভিন্ন সংবাদপত্রের ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং সবশেষে টুইটার একাউন্ট চেক করলাম। দেখলাম যে দশ মিনিট আগে পার্থিব মেসেজ পাঠিয়েছেঃ

বুকি আপডেট… ভারত প্রথমে ব্যাট করবে এবং ২৬০ এর বেশি রান করবে। ওদের প্রথম ১৫ ওভারে ৩ উইকেটের পতন ঘটবে। পাকিস্তান ১০০ রান পর্যন্ত মসৃণ গতিতে এগোবে, এরপর দ্রুত ২ উইকেট হারাবে। ১৫০ রানে ৫ উইকেটের পতন ঘটবে এবং এরপর ধ্বস নামবে। ২০ রানের বেশি ব্যবধানে হারবে।

‘শেৎসা!!’ আমি চিৎকার করে ডাক দিলাম। ‘জলদি দেখে যাও!’

‘কী হয়েছে?’

‘একজন বুকি আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছ। ম্যাচে কী হবে সেটার স্ক্রিপ্ট লিখে জানিয়েছে!’

‘কী বলছ তুমি! দেখি…দেখি…পড়ে দেখি… ওহ খোদা! ভারতের রান কত হল?’

সে সময় ভারত আসলেই ২৬০ রানের কাছাকাছি। এক ওভার বাকি থাকতে দলীয় রান ৭ উইকেটে ২৫৬। শেষ ওভারটি করল ওয়াহাব রিয়াজ- ডট-উইকেট-সিঙ্গল-সিঙ্গল-উইকেট-দুই! অর্থাৎ ভারত শেষ করল কাঁটায় কাঁটায় ২৬০ রানে। শেরিন থ মেরে বসে আছে। আমিও চুপ করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি।

‘এক সেকেন্ড,আমি বলে উঠলাম, পার্থিব বলেছিল ভারত ২৬০ এর বেশি করবে। তারমানে অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমরা এখনও পাই নি। পাকিস্তানের ইনিংস না দেখে কিছু বলা ঠিক হবে না।‘

‘পুরাই অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার!’

আসলেই তাই। পার্থিব এর আগের দুইবারই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তবে, এত বিস্তারিত তথ্য এবারই প্রথম জানিয়েছে। আমি স্কোরবোর্ডে আরেক বার চোখ বুলিয়ে নিলাম। মোট দু’টি অসঙ্গতি দেখতে পেলাম- ভারত প্রথম ১৫ ওভারে ৩ উইকেট হারায় নি এবং ওদের রান ২৬০ এর বেশি হয় নি। আপাতদৃষ্টিতে ভারতীয় দল কোন ঘাপলা করেনি বলেই মনে হচ্ছে। মেসেজে পাকি ইনিংসের ব্যাপারে বর্ণনা একটু বেশিই বিস্তারিত। ‘পাকিস্তান ১০০ রান পর্যন্ত মসৃণ গতিতে এগোবে, এরপর দ্রুত ২ উইকেট হারাবে। ১৫০ রানে ৫ উইকেটের পতন ঘটবে এবং এরপর ধ্বস নামবে। ২০ রানের বেশি ব্যবধানে হারবে।‘

যাই হোক, আমি বেটিং জগতের দুই সহকর্মীর কাছে পার্থিবের মেসেজের কথা জানিয়ে ইমেইল পাঠালাম, যাদের একজনের নাম জিওফ্রি রিডল, পেশায় সাংবাদিক। আরও জানালাম আমার আশঙ্কা হচ্ছে পাকিদের ব্যাপারে যা লেখে আছে হুবহু সেটাই ঘটবে। কারণ পার্থিবের আগের দুই তথ্যও সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ফিরতি মেইলে ওদের কাছ থেকে ছাপার অযোগ্য জবাব পেলাম। বুঝলাম দুজনেই অবাক, বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের মত হাই ভোল্টেজ ম্যাচে এমনটি হতে পারে, সেটাও পাক-ভারতের মত চিরশত্রু দুই দলের মধ্যে, সেটা কে-ই বা সহজে বিশ্বাস করতে পারবে? এক ফাঁকে ওরা আমাকে জানালো যে দুজনই ভারতের পক্ষে বড় অঙ্কের বাজি ধরেছে!

খেলা নিয়ে আমার যে উত্তেজনা ছিল সেটার বদলে দেখা দিল আশঙ্কা, ভয় এবং অবিশ্বাস। শেরিনের অবস্থাও শোচনীয়। সোফার সামনে ঝুঁকে বসে আছে, হাঁটু দুটো একসাথে, কুশনটা বুকের কাছে শক্ত করে ধরে রাখা। প্রার্থনা করছে পার্থিবের তথ্য যেন ভুল প্রমাণিত হয়!

‘ওর কথা আগের দুইবার ফলেছে।‘ আমি জানালাম। ‘পরপর তিনবার নিশ্চয়ই সঠিক হতে পারবে না। আরে সম্ভাবনার সূত্র বলে তো একটা ব্যাপার আছে না কি!আমি নিশ্চিত ওর কোথাও কোন ভুল হচ্ছে।‘

পাকিদের ইনিংস শুরু হওয়া মাত্র আমরা অজানা এক আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলাম। এটা চিরায়ত সেই আতঙ্ক নয় যা যে কোন খেলা দেখার সময় হয়। অর্থাৎ, নিজের দল ভাল করবে, খুব বাজে পারফর্ম করবে, নাকি এমন কিছু করবে যা নিয়ে ফলাফল যাই হোক গর্ব করা যাবে- এই চিন্তায় যে আতঙ্ক হয়। এ রকম সময় মনে হয় পেটের ভেতর নাড়ি-ভুঁড়ি গিট্টু পেকে যাচ্ছে, হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়, মনে হয় পাঁজর চিড়ে বেরিয়ে আসবে! আমি তখন যে আতঙ্ক বোধ করছিলাম সেটা একেবারেই অন্যরকম। যেন আমি নিশ্চিত জানি খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে, কিন্তু মনে-প্রাণে চাইছি সেটা যেন না ঘটে! নিজেকে একেবারেই অসহায় মনে হচ্ছিল।

‘খুব দ্রুতই পার্থিব ভুল প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে, শেৎসা।‘ আমি ওকে আশ্বাস দেয়ার ছলে বললাম। ‘পাকিস্তানের যে স্বভাব, দেখা গেল শূন্য রানেই ওদের দুই উইকেট হাওয়া! সেক্ষেত্রে ‘মসৃণ গতিতে ১০০ রান’ করার সম্ভাবনাই থাকবে না!’

‘হুম, অমনটি হতেই পারে।‘ মৃদু কণ্ঠে শেরিন সায় দিল।

ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম ও শেষ বলে পাকি উইকেটে কিপার ব্যাটসম্যান কামরান আকমল বাউন্ডারি মেরে দলের রানের চাকা সচল করল। শেরিন এবং আমি ভীত চোখে একে-অপরের দিকে তাকালাম। আমাদের আতঙ্কের মধ্যে রেখেই পাকিস্তান দারুণ সূচনা করল। ৮ ওভার শেষে ৪৩, বিনা উইকেটে। রান তোলার গতি ওভারে ৫.৩৭।

‘সত্যি সত্যিই ওরা মসৃণ গতিতে এগোচ্ছে!’ শেরিন মন্তব্য করল।

এ সময় পাকিদের প্রথম উইকেটের পতন ঘটল। কামরান আকমল। জহির খানের স্লোয়ার বলে পরাস্ত হয়ে ক্যাচ আউট। দলীয় রান ১ উইকেটে ৪৪। অপর উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ হাফিজের সাথে যোগ দিল আসাদ শফিক। দুজনে মিলে নিয়ন্ত্রণের সাথে দলকে এগিয়ে নিতে থাকল। হাফিজ আউট হল ১৬তম ওভারে। ক্রিকইনফোতে লেখা হলঃ ‘হাফিজ কী চিন্তা করছিল কে জানে?! আরও একবার সেট হয়ে আউট। ৪০ বলে ৩০ রানের সম্ভাবনাময় ইনিংসের বাজে সমাপ্তি। ফুল লেন্থ বলে প্যাডেল সুইপ, হ্যাঁ প্যাডেল সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে ধোনির হাতে ধরা! ওহ ডিয়ার! চাপ? নাকি অতি আত্মবিশ্বাস?’

হাফিজ আউট হলেও পাকিস্তান ইনিংস পথ হারা হল না। শফিক এবং ইউনিস খান সাবলীলভাবে রান করতে লাগল। ২৩ তম ওভারের পঞ্চম বলে দুই রান নেয়ার মাধ্যমে দলীয় শতরান পূর্ণ হল। সেই ওভার শেষে দলের রান রেট ৪.৩৪। জেতার জন্য প্রয়োজন ২৭ ওভারে ১৬১। কোন সন্দেহ নেই পরিস্থিতি এখনও পাকিদের নিয়ন্ত্রণেই।

‘এই বার, শেৎসা, আমি বলে উঠলাম। পাকিস্তান তো ঠিকমতই শতরান পূর্ণ করল। এবার দেখা যাক কী ঘটে।‘

‘হ্যাঁ, আরেকবার মেসেজের এই জায়গাটা পড়ে শোনাও তো!’

‘লেখা আছেঃ পাকিস্তান ১০০ রান পর্যন্ত মসৃণ গতিতে এগোবে, এরপর দ্রুত ২ উইকেট হারাবে। তৈরি হয়ে যাও। এবার বোঝা যাবে আসলেই মেসেজের তথ্য সঠিক কী না। আর যাই হোক- ‘দ্রুত দুই উইকেটের পতন’ তো লুকানোর মত কিছু না!’

পরবর্তী ওভারে বল করতে এল যুবরাজ সিং। ইউনিস প্রথম বলে সিঙ্গল নিলো। শেরিন এবং আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এভাবে পরপর চার বল হয়ে গেল। কোন উইকেটে পতন ঘটল না।

‘যদি কোনমতে আর ২০ টা রান এভাবে ওরা করতে পারে তাহলে কোন প্রকার স্ক্রিপ্টের সম্ভাবনা নিশ্চিন্তে বাতিল করা যাবে।‘ আমি আশাবাদ ব্যক্ত করলাম।

‘দেখা যাক।’ শেরিন বলতে না বলতেই যুবরাজ পঞ্চম বল করতে উদ্যত হল। আমরা আবারও দম বন্ধ করে ফেললাম…যুবরাজ ছোট্ট রান আপে বলটি করল…শফিক ক্রিজ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে বলকে থার্ড ম্যানের দিকে খেলার চেষ্টা করল… কিন্তু ব্যাটে বলে হল না এবং বোল্ড! মিডল স্ট্যাম্প মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

‘বোল্ড হিম! য়ুভি! য়ুভি! য়ুভি!’ টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস চিৎকার করে উঠলেন!

‘আরেকটি ম্যাজিক্যাল ব্রেক থ্রু’, বলল রমিজ রাজা।

‘হ্যাঁ, তা তো বটেই!’ মুখ বিকৃত করে বলে উঠল শেরিন।

‘এখন যদি আরেক উইকেট যায়’, আমি বললাম, ‘তাহলে ধরে নিতে হবে সত্যিই ফিক্সিং…‘

ঠিক ১০ বল পর আবার যুবরাজ সিং বল করল, সুন্দর সাবলীল হাই-আর্ম একশন। বলটি ছিল ফুল লেন্থের, ড্রাইভ করার জন্য আদর্শ। ইউনিস খানও সেটাই করতে গেল। অন্ততঃ হাবভাব দেখে সেটাই মনে হল। কিন্তু হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন মিলল না। বরং দূর থেকে দেখে মনে হল কেউ যেন ওর পায়ের সাথে দড়ি টান দিয়েছে। বেসামাল হয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে শট খেলতে গেল। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটে-বলে ঠিকমত হল না। ব্যাটের উপরের অংশে লেগে বল হাওয়ায় উঠল, সোজা মিড অফের হাতে। পাকিস্তানের দলীয় রান দাঁড়াল ৪ উইকেটের বিনিময়ে ১০৬। অর্থাৎ, মাত্র ৬ রান করতেই ১০ বলের ব্যবধানে ২ উইকেটের পতন। ‘দ্রুত ২ উইকেটের পতন’ না বলে উপায় কী!

‘তাহলে আর কী, যা হবার তাই হল!’ আমি বলে উঠলাম।

‘পুরাই ফালতু! একেবারে ফালতু! ফালতু…ফালতু…!’ শেরিন ক্রুদ্ধ!

কিছুক্ষণের মধ্যে জিওফ্রি রিডলের কাছ থেকে ইমেইল পেলাম। ‘কী ইনফো দিলে!’ অন্যজন তো ফোনই করে বসল। সে জানালো যে নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না! ‘মনে হচ্ছে আমি যেন পুরনো খেলার রিপ্লে দেখেছি, জানি কখন উইকেটের পতন ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফলাফল কী দাঁড়াবে!’ ওদিকে শেরিন পুরোই সাইলেন্ট মোডে চলে গেছে। চুপচাপ চা বানানোর জন্য কিচেনের দিকে চলে গেল।

মন্দের ভাল এই যে পরের ‘ঘটনা’ ঘটার আগে আমরা কিছুটা সময় পেলাম। আমি শেরিনকে আরেকবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে পুরোটাই আমাদের অতি কল্পনা হতে পারে। এমনও হতে পারে ৪ উইকেট হারালেও বাকি রান পাকিরা সহজেই সংগ্রহ করে, ম্যাচ জিতে ফাইনালে চলে গেল! ২৭ তম ওভার শেষে ওদের সংগ্রহ ১১২। উইকেটে উমর আকমল এবং মিসবাহ উল হল। স্ক্রিপ্ট যদি ঠিক থাকে তাহলে ১৫০ পূর্ণ হবার আগে একাধিক উইকেটের পতন ঘটার সম্ভাবনা নেই।

কেন জানি মনের মধ্যে আর কোন টেনশন বা আতঙ্ক কাজ করছিল না। ভয়ানক কোন আশংকা সত্যি হবার পর ভগ্ন হৃদয় যেভাবে নিয়তিকে মেনে নেয়, আমিও সেভাবে সবকিছু মেনে নেয়ার মত পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছি। শেরিন এবং আমি মুখ কালো টিভির পর্দায় খেলা দেখতে লাগলাম। স্টেডিয়ামের হাজারো মানুষ তখনও চিৎকার করছে, উল্লাস করছে, পতাকা ওড়াচ্ছে। ওদের দেখে কিছুটা হিংসে হল। ওরা এখনও খেলাটাকে উপভোগ করতে পারছে। যেটা আমরা আর পারছি না।

কেমন এক ঘোরে মাঝেই পাকিদের রান ১৫০ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেল। উমর আকমল এবং মিসবাহ চেষ্টা করছে ইনিংসকে মেরামত করে সামনে এগিয়ে নিতে। আমাদের মধ্যে পুরনো আতঙ্ক আবার কিছুটা ফিরে এলো। আবার ‘ঘটনা’ ঘটার সময় হয়ে গেছে। ১৫০ থেকে ৮ রান দূরে থাকা অবস্থায় উমর আকমল আউট হল। হরভজন সিং এর স্পিন বলের বিরুদ্ধে এলোমেলো শট খেলতে গিয়ে কুৎসিতভাবে আউট।

‘আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না’, শেরিন বলল। ‘আঙ্কেল পার্সি শুনলে রেগে আগুন হয়ে যাবেন!’

একেবারে স্ক্রিপ্ট মোতাবেক পাকি দল ৫ উইকেটে ১৫০ পূর্ণ করল, ৩৭ তম ওভারে। শুধু তাই নয়, ঠিক পরপরই ব্যাটিং ধ্বসও শুরু হল। ৬ষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হল আব্দুল রাজ্জাক। খেলার মাঝে মাঝে প্রায়শই গ্যালারির দর্শকের চিন্তিত মুখ, দাঁত দিয়ে নখ কাটার দৃশ্য দেখা গেলেও ধারাভাষ্যকারের মুখে আসল কথা শোনা যাচ্ছিল, ‘অদ্ভুত ব্যাটিং’… ‘বাজে শট’…’ব্যাটসম্যানের মাঝে রানের গতি বাড়ানোর কোন আগ্রহই নেই’… ইত্যাদি। সমালোচনার তীর সবচেয়ে বেশি গেল ইউনিস খান এবং মিসবাহর দিকে। ইউনিস করেছে ৩২ বলে ১৩, স্ট্রাইক রেট ৪০.৬২ এবং নিজের ইনিংসের প্রথম ৪২ বলে মিসবাহ রান করেছে মাত্র ১৭, যার মধ্যে ২৭টি ছিল ডট বল। ঐ সময়টুকুতে পাকিদের প্রয়োজনীয় রান রেট ৬.০৭ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৮.৪৫। ইউনিস-মিসবাহ জুটি মোট বল খেলেছিল ৭৪ টি, রান করেছে মাত্র ৩০!

দলীয় ১৮৪ রানে ৭ম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হল শহিদ আফ্রিদি। হরভজন সিং এর বল তুলে মারতে গিয়ে বীরেন্দর শেবাগের হাতে আউট। ভারতীয় জাতীয় দলের সাবেক ক্যাপ্টেন, ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী বললেন ‘পাকিস্তানীদের গেম প্ল্যান বড্ড অদ্ভুত!’ নাহ! তিনি আফ্রিদির আউট নিয়ে বলেন নি। কারণ বাজে শটে উইকেট বিলিয়ে দেয়া তার জন্য নতুন কিছু নয়, অবাক করা ব্যাপার হল আফ্রিদি ক্রিজে থাকা অবস্থাও পাকিরা ব্যাটিং পাওয়া প্লে নেয় নি! অথচ তার মত মারকুটে ব্যাটসম্যান উইকেটে থাকা অবস্থায় পাওয়ার প্লে নেয়াটাই সবচেয়ে বেশি যুক্তিসঙ্গত হত। যাই হোক, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং পাওয়ার প্লে নিলো ৪৫ তম ওভারে, যখন ক্রিজে মিসবাহ এবং উমর গুল। ৪৮ তম ওভারে মিসবাহ বাউন্ডারি হাঁকানোর পর ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস বিভ্রান্ত স্বরে বলে উঠলেন, ‘ঠিক এই কারণেই আমরা বুঝতে পারছি না ওটা (ব্যাটিং পাওয়া প্লে) কেন আগে নিলো না!’ মিসবাহ সেই ওভারে মোট ১৪ রান তুলে নিলো। রমিজ রাজাও হতভম্ব, ‘যদি সে এরকম শট খেলতেই পারে, তাহলে আরও আগেই থেকে কেন খেলা শুরু করল না?!’

ভারত শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে নিলো ২৯ রানে। মিসবাহ শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হল। সে সময় টিভিতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হল। একসাথে বসে আছেন, শান্ত ভঙ্গিতে হাত তালি দিয়ে দুই দলকে অভিবাদন জানালেন। চেহারা দেখে কারও মনের ভাব বোঝার কোন উপায় নেই। স্কাই স্পোর্টস এর বিশ্লেষক হিসেবে নিয়োজিত সাবেক পাকি অল রাউন্ডার আজহার মাহমুদ বলল, ‘দুই সিনিয়র মিসবাহ এবং ইউনিসের ইনিংসই পাকিস্তানকে ডুবিয়েছে। রান তোলার কোন সদিচ্ছাই চোখে পড়ে নি।‘ সাবেক ইংলিশ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান নিক নাইট বললেন, ‘আমি ঐ দুজনের ইনিংসের কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পাচ্ছি না!’

খেলা শেষে শেরিন ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। ‘মনে হচ্ছে আমার জীবন থেকে ক্রিসমাস চুরি হয়ে গেছে!’ বেদনার্ত কণ্ঠে সে বলল। ‘আমি আর জীবনে তোমার সাথে কোনদিন ক্রিকেট খেলা দেখব না!’

পরবর্তীতে এক খবরে জানা গেল পাকিদের অমন পরাজয়ের পর লাহোরের ২০ বছর বয়সী এক যুবক আত্মহত্যা করেছে। এই হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনে আমার জর্জ অরওয়েলের সেই কথাটা মনে পড়ল। আমার মনে হল তিনি সম্ভবত ভুল বলেছিলেন!

(চতুর্থ অধ্যায় শেষ। আমার অনুবাদ করাও শেষ। সবাইকে কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সবাই ভাল থাকুন।)

১টি মন্তব্য “বইটির নাম ”Bookie Gambler Fixer Spy” শেষ পর্ব”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা!
    পর্দার অন্তরালে কত কিছুই ঘটে থাকে, যা আমরা জানিও না, আবার জেনে থাকলেও করার কিছুই থাকে না, হতবাক দর্শক হিসেবে খেলাটি দেখে যাওয়া ছাড়া!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।