শুভ জন্মদিন- ভিভ রিচার্ডস, দ্যা কিং!

৭ মার্চ, ১৯৫২ সালে ক্রিকেটের সর্বকালের সবচেয়ে আগ্রাসী এবং ভীতি জাগানো ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডস জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেক্সান্ডার রিচার্ডস। মাঠে শুধু তাঁর উপস্থিতিই প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিত। ২০১৩ সালে ক্রীড়া সাংবাদিক অরুনাভ সেনগুপ্ত ভিভের জন্মদিনে তাঁর ব্যক্তিগত ও খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে দারুণ একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন। আমি সেই লেখাটির ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি।

আমরা যদি ক্রিকেটের সব ধরনের ব্যাকরণ বই এবং পরিসংখ্যানের ঝাঁপি নিয়ে বসি তবুও ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসে ভিভের চেয়ে ভাল ব্যাটসম্যান খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ব্যাট হাতে ভিভকে নামতে দেখে প্রতিপক্ষের স্নায়ুতে যে চাপ পড়ত, সেরকম ব্যাটসম্যান ক্রিকেটে দ্বিতীয়টি এখনও আসে নি!

তিনি যখন প্যাভিলিয়ন থেকে হাঁটা শুরু করতেন তখন থেকেই মাঠে উপস্থিত প্রতিটি চোখ তাঁকে অনুসরণ করত। প্রথম দিকে তিনি ৩/৪ পজিশনে ব্যাট করলেও পরের দিকে সাধারণত ৫ বা ৬ নম্বরে ব্যাট করতেন। পূর্ববর্তী ব্যাটসম্যান আউট হবার পর মাঠ জুড়ে প্রায় সুনসান নীরবতা নেমে আসত। অনেকটা ঝড়ের আগের থমথমে অবস্থার মত।

article-1269869-014D55B00000044D-211_468x303

তিনি সদম্ভে ধীর-স্থির কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে মাঠে প্রবেশ করতেন। উন্নত শিরের উপরে পড়া মেরুন ক্যাপের সামনের অংশটুকু কিছুটা উপরের দিকে উঁচু হয়ে থাকত-যেন বুঝিয়ে দিতেন কাউকে পাত্তা দেয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই! হাতে ত্রি-রঙা রাস্তাফারিয়ান রিস্ট-ব্যান্ডটিও তাঁর ড্যাম কেয়ার ভাবের সাথে দারুণ মানিয়ে যেত। নিতান্ত অবহেলার সাথে কিছুই খেয়াল করছেন না ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলেও মাঠের কোন কিছুই তাঁর চোখ এড়াত না। অনবরত চুইংগাম চিবোনোর কারণে চোয়াল দু’টো প্রায় সবসময়ই নড়ত। এতে তাঁর রাজকীয় ভাব যেন আরও প্রকট হয়ে উঠত! এরপর শরীরের আড়ষ্টভাব কাটানোর জন্য কিছুক্ষণ শক্তিশালী কাঁধ দু’টো ঝাঁকিয়ে ওয়ার্ম-আপ করতেন।

সবশেষে আপাত নিরীহ কিন্তু ভয়ংকর ব্যাটটি পিচের উপর রেখে আম্পায়ারের কাছ থেকে গার্ড চেয়ে নিতেন। দল বা ম্যাচের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন- ফিল্ডারগণ মাঠে ছড়িয়ে পড়তেন। বেশিরভাগ সময়েই তা নিজের অজান্তেই হত, বিপক্ষ দলের অধিনায়ককে এটা বলাও লাগত না। ‘দ্যা কিং’ যখন স্ট্রাইকে থাকতেন ক্লোজে ফিল্ডিং করার সাহস কারও হত না। সবচেয়ে দুঃসাহসী সিলি পয়েন্ট ফিল্ডারও কয়েক গজ পিছিয়ে যেতেন, মিড অন বা মিড অফের ফিল্ডারও নিজের জায়গা বদলে নিতে বাধ্য হত। একই সাথে তারা প্রস্তুত হয়ে যেত যে কোন সময়ে সীমানার দিকে দৌড় শুরু করার!

গার্ড নেবার পর কিছুটা এগিয়ে পিচের গুড লেন্থ এলাকায় ব্যাট দিয়ে দু’একবার ঠুক ঠুক করে অসমান অংশ ঠিক করার ভান করতেন। পিচে সমস্যা থাকুক বা না থাকুক- এটি তিনি সবসময়ই করতেন, সম্ভবত ফিল্ডারদের স্নায়ু-চাপ আরও বাড়িয়ে দেবার জন্য। এরপর বোলারের দিকে সরাসরি নিষ্পলক চাহনি দিতেন- অনেকে বলে এই চাহনি দিয়েই নাকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই এর অর্ধেক জিতে নিতেন! এরপর ক্রিজে ফিরে কিছুক্ষণ ব্যাট উঁচু করে ধরে গ্রিপটি হাতের মধ্যে পরীক্ষা করে নিয়ে চূড়ান্ত স্ট্যান্স নিয়ে বোলারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতেন।

মাঠে নামা থেকে স্ট্যান্স নেয়ার অংশটুকু তাঁর বাঁধাধরা রুটিন ছিল। পৃথিবীতে খুব কম বোলারই ছিল এটুকু দেখেই যাদের গলা শুকিয়ে যেত না। অথচ সময়টা এমন ছিল যখন বিশ্বের বাঘা বাঘা ফাস্ট বোলারগণ সারা পৃথিবী শাসন করে বেড়াতেন। কিন্তু তা হলে কি হবে, ভিভের বিধ্বংসী রূপের কাছে সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন!

একেবারে প্রথম বল থেকেই আক্রমণ শুরু করতেন ভিভ। মোটামুটি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ম্যাচের ভাগ্য বদলে যেত। হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশনের পাশাপাশি ক্রিজটাকেও দারুণভাবে তিনি ব্যবহার করতেন। প্রায়ই অফ স্ট্যাম্প বরাবর সরে গিয়ে ব্যাট চালাতেন। বলে যতই গতি বা লেন্থের তারতম্য, সুইং, টার্ন, বাউন্স যাই থাকুন না কেন- বেশিরভাগই মিড অন বা মিড উইকেট দিয়ে সীমানা পার করতেন। লেগ বা অফসাইডে ফুল লেন্থের হলেই দেখা যেত জোরালো ড্রাইভ শট। বোলার যদি সাহস করে শর্ট পিচ করত তাহলে সেটাকে পুল বা হুক করে স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন!

বলের গতি বেশি থাকলে ব্যাকফুটে যাবার সময় না পেলেও শট খেলতে তাঁর কোন সমস্যা হত না। বিশ্বের খুব কম সংখ্যক ব্যাটসম্যান যারা ফ্রন্টফুটে-ই শর্ট পিচ খেলার ক্ষমতা ছিল (বা আছে) ভিভ নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। খালি খালি তো আর তাঁর আত্মজীবনীর নাম Hitting Across the Line ছিল না!

এমন না যে তিনি ভুল করতেন না। একবার অসি ফাস্ট বোলার রডনি হজের বিদ্যুৎ গতির একটি বল ভিভের মুখে আঘাত হানে, সাথে সাথে চোয়ালের এক পাশ ফুলে গিয়েছিল। কিন্তু ভিভের চেহারা দেখে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। চোখ-মুখে কোন ভাবান্তরই ছিল না, এমনকি আগের মত আয়েসি ভঙ্গিতেই চুইংগাম চিবচ্ছিলেন! ঠিক পরের বলটিই হজ আবার বাউন্সার দিলেন। এবারে বলটির ঠিকানা হল স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে সীমানার অনেক বাইরে বসে থাকা দর্শকদের মাঝে!

শুরুর কথা-হিটিং এক্রোস দ্যা লাইন

ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যানের অবসরের পর অনেক ব্যাটসম্যান এবং গবেষক তাঁর অবিশ্বাস্য ব্যাটিং রহস্যের সমাধান বের করার চেষ্টা করেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হচ্ছে ব্র্যাডম্যান ছোটবেলায় ব্যাটের বদলে স্ট্যাম্প দিয়ে গলফ বলে আঘাত করতেন। তাঁর বাড়িতে একটি বড় পানির ট্যাংক ছিল। গলফ বলটিকে এমনভাবে মারতেন যেন তা পানির ট্যাঙ্কে লেগে ফিরে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন তিনি অনবরত এই কসরতটি করতেন। আর একারণেই ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে বল আঘাত করতে তার কখনও সমস্যা হত না। এই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক ব্যাটসম্যানই ব্র্যাডম্যানের মতন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর ধারে কাছে কেউ যেতে পারেনি।

ভিভ রিচার্ডসেরও একটি ফরমুলা ছিল, অবশ্য সেটি ট্রেনিং সেশনে করার জন্য অনেক বেশিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। এন্টিগা’র মত ছোট্ট দ্বীপ দেশের জন্য পদ্ধতিটি অবাক করার মত কিছু ছিল না, কেননা সে আমলে এন্টিগা’য় ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম তো দূরের কথা, ক্রিকেট খেলার মাঠই ছিল অপ্রতুল!

রিচার্ডস এবং তাঁর কিশোর বন্ধুরা মিলে নিজেরাই এবড়ো-থেবড়ো মাঠ যতটা সম্ভব সমান করে নিতেন। মাঝে মাঝে সেটুকু করাও সম্ভব হত না। বেশিরভাগ সময় খেলার আগের দিন মাঠের উপর তাঁরা পানি ছিটিয়ে দিতেন যাতে করে পিচ নরম হয়ে কিছুটা সমান হয়ে যায়। সারারাত তাঁদের উৎকণ্ঠায় কাটাতে হত, রাতের বেলা গরু চরে মাঠ নষ্ট করে দেয় কি না-এই ভেবে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সকল প্রার্থনা আক্ষরিক অর্থেই জলে যেত অর্থাৎ মাঠে গিয়ে দেখতেন গরুর পায়ের আঘাতে মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে। অবশ্য, খেলা ঠিকই চলত! সমস্যা হচ্ছে গর্তে পড়ে বল উল্টো-পাল্টা বাউন্স করত। যেহেতু তাঁদের কাছে শরীর বাঁচাবার তেমন কোন সরঞ্জাম থাকত না-নিজেকে অক্ষত রাখার জন্য বলের গতিবিধি শেষ পর্যন্ত খেয়াল করতে হত এবং সেই অনুযায়ী ব্যাট করতে হত। সবাই বলের লাইনে শরীর না নিয়ে ব্যাট দিয়েই বলকে আঘাত করার চেষ্টা করতেন। ভিভ নিজেই বলেছেন যে ছোটবেলার সেই ‘ট্রেনিং’ ই ছিল তাঁর জীবনের সেরা। এবং জীবনে যত দিন, যত জায়গায় ক্রিকেট খেলেছেন ছোটবেলার মতন আকর্ষণীয় ক্রিকেট কোথাও খেলেন নি!

১৯৭২ সালে ভিভ রিচার্ডস ইংল্যান্ডে গিয়ে ক্রিকেটের উপর ট্রেনিং পাবার সুযোগ পান। সাথে ছিল এন্ডি রবার্টস নামক আরেকজন স্বদেশী উদীয়মান যুবক। একটি ক্রিকেট-প্রেমী স্বেচ্ছাসেবক দল তাঁদের যাতায়াত খরচ এবং কোচিং ফি’র টাকা পরিশোধ করেছিল। দুই নবীন খেলোয়াড় গিয়ে ভর্তি হলেন অ্যালফ গোভার ক্রিকেট স্কুলে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, ইংলিশ কন্ডিশন এবং ক্রিকেটের ব্যাকরণ প্রিয় ইংরেজদের দ্বারা তাঁর ব্যাটিং পদ্ধতির সংস্কার করা চেষ্টা-সব মিলিয়ে ভিভ ভালোই বিপদে পড়েছিলেন। অবশ্য বিশ্ব ক্রিকেটের কপাল ভাল যে, স্টান্সের ছোট-খাট পরিবর্তন ছাড়া শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব ব্যাটিং পদ্ধতির কোন পরিবর্তন করতে হয় নি!

উল্লেখ্য, সে সময় তিনি ফুটবল নিয়েও বেশ সিরিয়াস ছিলেন। এন্টিগা’র জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইতেও অংশ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাবার একটি কথাতেই তিনি ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন। কথাটি ছিল ‘আজ পর্যন্ত কোন ক্যারিবিয়ান ফুটবলারের কথা রেডিওতে আসেনি। অথচ এই অঞ্চলের সবাই কিন্তু গ্যারি সোবার্স বা এভার্টন উইকস কে চেনে, শ্রদ্ধা করে!’ মোক্ষম যুক্তি, এর উপর কোন কথা হয় না। সুতরাং, ফুটবল নয়, ক্রিকেটই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যান জ্ঞান! এ সময় তাঁর পুরো পরিবার উন্নত জীবনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করে। ভিভ একাই রয়ে যান। স্থানীয় এক বারে পার্ট টাইম কাজ করার পাশাপাশি ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন পূরণে কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত রাখেন!

ক্যারিয়ারের শুরু

মূলত ইংল্যান্ডের অ্যালফ গোভার ক্রিকেট স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই ভিভ সবার নজর কাড়া শুরু করেন। সে সময় কেন্ট ক্রিকেট দল এন্টিগা সফরে এসেছিল। ভিভ রিচার্ডসের দারুণ ব্যাটিং দেখে কলিন কাউড্রে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এই ছেলে একদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলবে!’ এরপর মেন্ডিপ একোর্নস দলের এন্টিগা সফরের সময় সমারসেটের ভাইস চেয়ারম্যান ভিভের নৈপুণ্যে দারুণ মুগ্ধ হন। কিছুদিনের মধ্যেই ভিভ সমারসেটের ল্যান্সডাউন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য পুনরায় ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। এ সময় আরও একজন নবীন ক্রিকেটারের সাথে তাঁর পরিচয় হয়, যার সাথে পরবর্তীতে আজীবনের জন্য দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল-যার নাম ইয়ান বোথাম!

সমারসেট কাউন্টি ক্লাবের হয়ে খেলার সময় তিনি অধিনায়ক হিসেবে ব্রায়ান ক্লোসকে পেয়েছিলেন। ভিভ জানিয়েছেন তিনি নানা কারণে ক্লোসের কাছে কৃতজ্ঞ, অনেক কিছু শিখেছেন। সম্ভবত সেসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফাস্ট বোলারের বলে আঘাত পেলে দমে না গিয়ে উলটো চোখ রাঙিয়ে বোলারের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই কাজটি ব্রায়ান ক্লোসা খুব ভাল ভাবেই করতেন!

১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে খোদ ক্লাইভ লয়েডের কাছ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলার জন্য নিমন্ত্রণ পেলেন ভিভ রিচার্ডস। জীবনের প্রথম সফর ছিল বিশ্বের প্রায় অপর প্রান্তের দেশ ভারত। বাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম টেস্টেই তাঁর অভিষেক হল। অবশ্য শুধু ভিভ নন, একই ম্যাচে অভিষেক হল আরেকজন যুবকের- গর্ডন গ্রিনিজ!

গ্রিনিজের শুরুটা হল স্বপ্নের মতন। দুই ইনিংসে করলেন যথাক্রমে ৯৩ এবং ১০৭! কিন্তু, ভিভের অভিষেক সুখকর হল না। ভাগওয়াত চন্দ্রশেখরের স্পিন বোলিং এর ফাঁদে পড়ে দুই ইনিংসেই অল্প রানে আউট হলেন। রান করলেন সর্বমোট মাত্র ৭। তবে নিজের জাত চেনাতে বেশী দেরী করলেন না। পরের টেস্টেই দিল্লীতে খেললেন অপরাজিত ১৯২ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস! এর মধ্যে চার ছিল ২০ টি এবং ছক্কা ছিল ৬ টি!

সিরিজ শেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল যখন বাড়ি ফিরছে ততদিনে ক্রিকেট বিশ্ব জেনে গেল তাঁরা একজন নবীন ব্যাটিং জাদুকর পেয়ে গেছে!

১৯৭৫ সালের প্রথম বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ভিভের তেমন কোন সাফল্য ছিল না। কিন্তু তাঁর ফিল্ডিং ছিল দুর্দান্ত! বিশেষ করে ফাইনাল ম্যাচ জয়ে ভিভের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি ৩ জন ব্যাটসম্যানকে রান আউট করেছিলেন, এদের মধ্যে চ্যাপেল ভ্রাতৃদ্বয়ের উইকেট ছিল। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল আকাশে খুশিতে যেন আকাশে উড়ছিল।

দুঃখের বিষয় আকাশে উড়তে থাকা ক্যারিবিয়দের খুব নির্মমভাবে মাটিতে নামিয়ে আনল অসিরা। ঐ বছরের শেষের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অসি পেস বোলিং এর সামনে নাস্তানাবুদ হল। ডেনিস লিলি এবং জেফ থমসনের আগুন ঝরা বোলিং এর সামনে ক্যারিবিয়দের সকল প্রতিরোধ বালির বাঁধের ভেঙে পড়ল! অসিরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কে আক্ষরিক অর্থেই যেন গুঁড়িয়ে দেবার পণ করে নেমেছিল। হাসিই-খুশি ক্যারিবিয় দল প্রথমবারের মতন ক্রিকেটের কদর্য ও নির্মম দিকটি দেখতে পেল। রিচার্ডস পঞ্চম টেস্টে একটি সেঞ্চুরি করলেও পুরো সিরিজে তেমন কিছু করতে ব্যর্থ হলেন। তাঁর দলও সিরিজ হারল খুব বাজে ভাবে ৫-১ ব্যবধানে! ক্যারিবিয় দলপতি ক্লাইভ লয়েড এই সিরিজের শিক্ষা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন। এই সিরিজের পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। ক্রিকেট বিশ্বকে এককভাবে শাসন করার যুগও শুরু হয় এই সময় থেকেই।

অজেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল

অসি সিরিজের পর ক্লাইভ লয়েড সিদ্ধান্ত নেন পিস দিয়েই বিশ্ব জয় করবেন। প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেবার জন্য তিনি ৪ পেসার খেলানো শুরু করেন। ফর্মুলা অনুযায়ী পেসারগণ ভয়ানক বল করে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ধরাশায়ী করা শুরু করল। অবশ্য, ক্যারিবিয় ব্যাটসম্যানরাও বসে রইল না। এ সময় গ্রিনিজ এবং হেইন্স দলের ব্যাটিং সূচনা করা শুরু করলেন- পরবর্তীতে এই জুটি সর্বকালের অন্যতম সেরার স্বীকৃতি পেয়েছিল! পাশাপাশি ক্লাইভ লয়েডের অধিনায়কত্ব ও ব্যাটিং এ সময় শিখরে পৌঁছে এবং ওয়েস্ট দলও একের পর এক ম্যাচ জেতা শুরু করে। সবচেয়ে বড় কথা- মিডল অর্ডারে ছিলেন দ্যা কিং- ভিভ রিচার্ডস! দ্রুতই বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিণত হন। ক্যারিবিয় বোলারদের ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলিং এর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল ভিভ রিচার্ডস এর ব্যাটিং।

শুরুটা হয় জ্যামাইকা থেকে, যেখানে কুখ্যাত ‘ব্ল্যাড বাথ’ টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সফরকারীদের ভারতের উপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ আহত বাঘের মতন দল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভারতীয় অধিনায়ক বিষাণ বেদী ভয় পেয়ে দুই ইনিংসই আগে ভাগে ডিক্লেয়ার দিয়ে দেন, যাতে ব্যাটসম্যানরা অক্ষত হয়ে ফিরতে পারে! এই সিরিজেই রিচার্ডস ৩ টি শতক হাঁকান!

এরপরের ভুক্তভোগী দলটি ছিল ইংল্যান্ড। টনি গ্রেগ ক্যারিবিয়দের ‘গ্রোভেল’ (হামাগুড়ি দিয়ে মাফ চাওয়া) করানোর ঘোষণা দেবার পর ক্ষিপ্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজ জিতে নেয়। রিচার্ডস ৪ টেস্টে করেন সর্বমোট ৮২৯ রান, যার মধ্যে নটিংহ্যামে করা ২৩২ এবং ওভালের ২৯১ রানের ইনিংস ছিল।

১৯৭৬ সালে এক মৌসুমে ভিভ রিচার্ডস করলেন মোট ১৭১০ রান। শতক হাঁকালেন মোট ১১ টি। এই বছরে টেস্টে তাঁর গড় ছিল অবিশ্বাস্য-৯০!

পরের বছর কাউন্টিতে সমারসেটের হয়ে এক মৌসুমে করলেন ২১৬১ রান। এ মৌসুমে তাঁর করা ৭ টি শতকের মধ্যে ৩ টিই ছিল দ্বিশত!

এরপরের ঘটনা শুধু ভিভ নয় সারা বিশ্বের ক্রিকেটকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল-কেরি প্যাকার সিরিজ! ভিভসহ ক্যারিবিয় অন্য যারা প্যাকারের হয়ে খেলেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে নিজের দেশের অনেক সমর্থক দুয়ো দিয়েছিল! এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে, দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলার সময়। অনেকেই বিদ্রোহী ক্রিকেট সিরিজে খেলার ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিতে পারে নি, কেউ কেউ তো অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু প্যাকারের দেয়া অর্থ ওয়েস্ট ইন্ডিজ তারকাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। তাঁদের মধ্যে পেশাদারিত্বও জাগিয়ে তুলেছিল।

রিচার্ডস নির্দ্বিধায় বলেছিলেন তিনি প্যাকার সিরিজ খেলতে আগ্রহী ছিলেন। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ছিল প্রতিটি খেলোয়াড়ের নৈপুণ্য এবং পেশাদারিত্বের চরম পরীক্ষা! প্রতিটি দেশের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া এই সিরিজটি ছিল দারুণ জমজমাট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ! প্রতিটি ব্যাটসম্যানের জন্য প্যাকার সিরিজ ছিল দারুণ চ্যালেঞ্জিং। হবেই বা না কেন? বোলারদের মধ্যে ছিলেন এন্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট, ডেনিস লিলি, লেস পাস্কো, ইমরান খান, মাইক প্রকটর, গার্থ লা রুঁ প্রমূখ! এঁদের মাঝেও ভিভ রিচার্ডস সুপার টেস্টের অন্যতম সফল তারকা ছিলেন। ভাল খেলেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল এবং ব্যারি রিচার্ডসও।

ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়গণ প্রতিভাবান ফিজিও ডেনিস ওয়েইট এর সাথে কাজ করার সুযোগ পান। পরবর্তীতে তিনি ক্যারিবিয়দের ফিজিও হিসেবে নিযুক্ত হন খুব দ্রত তাঁর নেতৃত্বে পুরো দল হয়ে ওঠে শারীরিকভাবে অত্যন্ত ফিট। শেষ পর্যন্ত সকল বিতর্কের অবসান শেষে সবাই যখন নিজ নিজ দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে হয়ে উঠল অজেয়!

শীর্ষস্থান দখল

১৯৭৯-৮০ সালে ক্যারিবিয় দল অসিদের কাছে নাস্তানাবুদ হবার মধুর প্রতিশোধ নিলো। অস্ট্রেলিয়াকে তাদের মাটিতেই ক্যারিবিয় বোলারগণ উড়িয়ে দিলেন। এদিকে ভিভ রিচার্ডস ব্যাট হাতে জ্বলে উঠলেন, ৯৬.৫০ গড়ে ৩ টেস্টে করলেন ৩৮৬ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জিতল ২-০ ব্যবধানে।

এরপর ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ভিভের অপরাজিত ১৩৮ রানে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয়বারের মতন শিরোপা জিতে নিলো।

ভিভ হয়ে উঠলেন বিশ্ব ক্রিকেটের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। তাঁর স্থান দখল করতে পারে এমন কেউ ধারেকাছেও ছিল না। নিজেকে প্রতি নিয়ত নতুন উচ্চতায় নেয়া শুরু করলেন।

ভিভের ব্যাট সারা পৃথিবীর সকল মাঠেই সমানভাবে চলতে থাকল, একই ভাবে চলতে লাগল চুইংগাম চাবানো। শ্মশ্রু সম্বলিত মুখটি ধীরে ধীরে ক্রিকেট বিশ্বে রাজকীয় রূপ নেয়া শুরু করল। এ সময়ই তিনি ‘দ্যা কিং’ উপাধি পেলেন। ব্যাটিং এর পাশাপাশি চলল দারুণ ফিল্ডিং, স্লিপে দাঁড়িয়ে চমৎকার সব ক্যাচ নেয়া, এমনকি মাঝে মাঝে অফ ব্রেক বোলিং করে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক-থ্রু-ও এনে দেয়া শুরু করলেন!

ক্রিকেট বিশ্বের একের পর এক প্রান্ত জয় করা শুরু হল, নতুন নতুন রেকর্ডও তৈরি হতে লাগল! ১৯৭৯-৮০ মৌসুম থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত ভিভ রিচার্ডস কোন সিরিজ হারেন নি। এ সময় প্রথমবারের মতন ইংল্যান্ড দল ব্ল্যাকওয়াশের লজ্জা পেল। রিচার্ডস সমানভাবে রান করতে লাগলেন ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটেই! এরমধ্যে ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একদিনের ম্যাচে খেললেন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। বব উইলিসকে শেষ বলে ছক্কার মেরে শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ১৮৯ রানে। এখনও এটাকে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ইনিংস বলা হয়। উল্লেখ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেদিন মোট ২৭২ রান করেছিল। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর ছিল বাপতিস্তার করা ২৬! শেষ উইকেট জুটিতে ভিভ সহযোদ্ধা মাইকেল হোল্ডিং কে নিয়ে ১০৬ রান যোগ করেছিলেন। হোল্ডিং করেছিলেন মাত্র ১২ রান!
অধিনায়কত্ব গ্রহণ

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বটবৃক্ষ ক্লাইভ লয়েড অবসর নেবার পর ১৯৮৫ সালে ভিভ রিচার্ডস অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। পরিবর্তনটি মোটেও সহজ ছিল না। ব্যক্তি জীবনে রাস্তাফারিয়ান জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হবার কারণে অনেকে তাঁর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরাজমান নোংরা রাজনীতিও তাঁর বিপক্ষে ছিল, কেননা এন্টিগা ছিল অন্যান্যদের তুলনায় আয়তনে ও প্রভাবে বেশ ছোট।

তাঁর নিজের ভাষায়, ‘এ সময় অনেকেই আমার অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করল। অনেকে আমার পেছনে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শুরুতেই সবাই আমাকে ক্লাইভের সাথে তুলনা করা শুরু করল, যা একেবারে অনুচিত ছিল। যাই হোক, এত কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সফল হওয়াই তো প্রকৃত অধিনায়কের লক্ষণ!’

খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা ছিল না, তাঁরা ভিভকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত। সমস্যা শুরু করল অন্যরা। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও লোকজন বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল! ইংল্যান্ডের জিওফ্রে বয়কট বলে বসলেন ভিভ রিচার্ডস এর মারকুটে ব্যাটিং করার দিন শেষ!

ভিভ অবশ্য নিজের স্টাইলেই বয়কটকে জবাব দিয়েছিলেন-টেস্ট ম্যাচে মাত্র ৫৬ বলে শতক হাঁকিয়ে! এরপর ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ব্যর্থ হবার পর সবাই যখন ভিভের সমালোচনা করছিল তার ঠিক পরের সিরিজেই জীবনের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেললেন। দিল্লীর নিচু ও ধীর পিচে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত টেস্ট জিতে নেন!

ক্যারিয়ারের শেষ বছরগুলো

ভিভের ক্যারিয়ারের শেষ অংশটুকু তেমন উজ্জ্বল ছিল না। তেমন রান পাচ্ছিলেন না, স্ট্রোকগুলো আগের মতন চোখ ধাঁধানো হচ্ছিল না। পুরনো ভিভকে মাঝে মাঝে চোখে পড়লেও ধারাবাহিকতা ছিল না। জীবনের শেষ ২৭ টেস্টে মাত্র ২ টি শতক করেছেন। অন্যদিকে, শেষ ৪৬ টি একদিনের ম্যাচে রান করেছেন এক হাজারেরও কম, মাত্র ২৭.১৯ গড়ে।

দল মোটামুটি ভাল করলেও নিজের পারফরমেন্সের গ্রাফ দিন দিন নিম্নমুখী হওয়া শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালে নিজের ১২১ তম টেস্টটি খেলে তিনি অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময়ে তিনিই ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট রান সংগ্রহকারী। ২৪ টি শতক এবং ৫০.২৩ গড়ে তাঁর মোট সংগ্রহ ছিল ৮৫৪০ রান।

তিনি সর্বমোট ৫০ টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন এর মধ্যে জয় ২৭ টি, পরাজয় মাত্র ৮ টি। তাঁর নেতৃত্বে দল কোন সিরিজ হারে নি, যা এখনও একটি রেকর্ড!

ভিভের একদিনের ম্যাচের পরিসংখ্যানও ঈর্ষণীয়! ১৮৭ ম্যাচে ৪৭ গড়ে রান করেছেন ৬৭২১। তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ৯০! ক্যারিয়ারে মোট ৩১ বার তিনি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতি ৬.০৩ ম্যাচে একবার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে (৭.২৪) যা অনেক শ্রেয়!

Swagger বা ভাব মারাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া

শুধু পরিসংখ্যানও ভিভ রিচার্ডস এর মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। তবুও, সেগুলো যা বলতে পারে না তা হল মাঠে তাঁর উপস্থিতি বিপক্ষ দল, দর্শকদের উপর কি রকম প্রভাব ফেলত! অজেয় ভাব নিয়ে কেউ ভিভের মত এতদিন ধরে ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করে নি। এমনকি এখনও তিনি এন্টিগাতে রাজার মত সম্মান পান!

সমারসেট-গ্ল্যামারগনের মধ্যকার এক ম্যাচের গল্প এখন ক্রিকেট ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। ভিভ কথার চেয়ে ব্যাট দিয়েই জবাব দিতে বেশি পছন্দ করতেন তার একটি অনন্য উদাহরণ এই গল্পটি।

সেদিন ভিভ ব্যাট করছিলেন এবং গ্ল্যামারগনের বেশ গতিশীল ফাস্ট বোলার গ্রেগ থমাস বল করছিলেন। এক পর্যায়ে গ্রেগ পরপর দুই বল ভিভকে পরাস্ত করতে সক্ষম হলেন। ভিভকে রাগানোর জন্য সামনে এগিয়ে বললেন, ‘এটা গোলাকার, দেখতে লাল এবং প্রায় ৫ আউন্স ওজন!’ (অর্থাৎ ‘মিস করছ কেন?’)

ভিভ কিছু না বলে চুপ করে হেঁটে পিচের গুড লেন্থ এলাকায় ব্যাট দিয়ে কিছুক্ষণ ঠুক ঠুক করে কাল্পনিক উঁচু-নিচু জায়গা সমান করার ভান করে ক্রিজে ফিরে গেলেন। এবং পরের বলের জন্য প্রস্তুত হলেন।

গ্রেগ থমাস দৌড়ে এসে বল করলেন এবং ভিভ সজোরে ব্যাট চালালেন। ‘টকাস’ আওয়াজ শুনেই সবাই বুঝতে পারল দারুণ টাইমিং হয়েছে! সেই গোলাকার, লাল রঙের এবং ৫ আউন্সের বলটি সীমানা পাড় হয়ে, গ্যালারি ছাড়িয়ে, পাশের রাস্তার উপর দিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল টোন নদীতে। ভিভ এবার থমাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো বলটি ভাল করেই চেন, যাও নিয়ে এসো!

ঠিক এমনটিই ছিলেন স্যার আইজ্যাক আলেক্সান্ডার রিচার্ডস। ক্রিকেটে মাঠে সকল প্রকার ভাব মারার একমাত্র কপিরাইট তাঁর একার ছিল!

———-

বিঃদ্রঃ আজ আরও একজন ক্যাপ্টেনের জন্মদিন। তিনি আমাদের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের একজন-ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

১৪ টি মন্তব্য : “শুভ জন্মদিন- ভিভ রিচার্ডস, দ্যা কিং!”

  1. ফারাবী (২০০০-২০০৬)

    ৪ টেস্টে ৮২৯ ! সেই যুগের ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৯০ ! শেষ ২৭ টেস্টে মাত্র ২ সেঞ্চুরীর পরেও ক্যারিয়ার গড় ৫০+ ! সেই মান্ধাতার আমলে, এতসব ভয়ংকর ফাস্ট বোলারদের যুগে ৫৬ বলে সেঞ্চুরী ! ১ মৌসুমে ১৭০০ রান, ১১ টেস্ট সেঞ্চুরী!
    শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দেখেই এনাকে অমানুষ হিসেবে অভিহিত করা যায়। সাথে ঠাণ্ডা খুনে মেজাজটা যোগ করলে, এই ব্যক্তিকে রাক্ষস উপাধি দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে।
    চমৎকার লেখা ভাই। অনুরোধ রাখার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙂

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    অনুবাদের কারণে যে কথাগুলো লিখতে পারি নি-

    ভিভের অবসরের পর একদিনের ম্যাচে কেউ একটু আক্রমণাত্মক ব্যাট করলেই তাঁকে ভিভের সাথে তুলনা করা মিডিয়ার একটি স্বভাব। বিশেষ করে ইংরেজ এবং ভারতীয় মিডিয়া এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। ভিভ যে আমলে ৯০.২০ স্ট্রাইক রেট নিয়ে ব্যাট করেছেন তখন সারা বিশ্বের গড় স্ট্রাইক রেট ছিল মাত্র ৬৫.৯২! ১৮৭ টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৩৩ টি ছিল নিজের দেশে। সে আমলে পিচ ঢাকা হত, তিনি কখনোই হেলমেট পড়তেন না এবং বিশ্বের প্রতিটি দলেই ছিল ভয়ংকর সব ফাস্ট বোলার।

    এবার চিন্তা করুন ভিভ রিচার্ডস যদি এই আমলের সাদা বল, ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন, পাওয়ার প্লে, ফ্রি হিট, অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলো এবং সেই আমলের তুলনায় ধার-বিহীন বোলিং পেতেন তাহলে কি করতেন?

    আপনার আমার মনে হয়ত তেমন প্রতিক্রিয়া হবে না, তবে বোলারগণ ঠিকই শিউরে উঠবেন!

    ভিভ রিচার্ডস যে বোলারদের এক বিভীষিকার নাম ছিল!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ঘুমে চোখ ভেঙ্গে আসছিল, কিন্তু এই ব্লগটা পড়া শুরু করতেই সব উধাও! দূর্দান্ত হয়েছে। সরাসরি প্রিয়তে।

    আর যেকথা আমি আগেও বলেছি, আবার বলি- ক্রীড়া বিষয়ক লেখাটা আরও সিরিয়াসলি নিয়ে নাও .........


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    Greg Thomas কে গ্রেগ থমাস বলায় আমার আপত্তি আছে
    এই Th এর উচ্চারন ট আর ঠ এর মাঝামাঝি। তবে ট-এর বেশি কাছে।
    এটাকে টমাস বলাই শ্রেয়তর।
    খুব বেশি হলে ঠমাস বলা যায়।
    থমাস বেশ দুরের উচ্চারন।
    এটা দেখে নিতে পারো Thomas (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভিভ সম্পর্কে কোন এক বোলার বলেছিলেন, ওকে খারাপ বল করলে ছয় মারে, আর ভালো বল করলে চার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ভিভের খেলা প্রথম দেখি ১৯৯৪ কি ৯৫ তে। হ্যা ঠিকই লিখছি, ৯৪ বা ৯৫। ঐ সময় মাস্টার্স কাপ নামে একটা টুর্নামেন্ট হতো যা কিনা স্টার টিভির প্রাইম স্পোর্টস (পরে স্টার স্পোর্টস) লাইভ দেখাত। সেখানে সব দেশের সাবেকরা খেলত। ফান টুর্নামেন্ট হলেও গ্রিনিজ রিচার্ডসডের রাজসিক পদচারণা সেখানেও ছিল। যদিও বড় ভাইদের কাছ থেকেই জানতে পারি তখনকার ঐ খেলা তাদের আসল খেলার ছায়া মাত্র।

    তবে ভিভের নামটি আসলে জেনে গিয়েছিলাম তারও আগে ১৯৯২ সালেই। ৯২ এর বিশ্বকাপ ধরেই প্রথম ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহের সূচনা। তাই তারপরে ক্রিকেট বিষয়ক যে কোন লেখা পেলেই গোগ্রাসে গিলতাম। পুরাতন এমনি কোন ম্যাগাজিনেই ভিভ রিচার্ডস আড় কলিন ব্লান্ড এর নাম জানতে পারি। পরেরজন এখনকার সময়ে খুব বিখ্যাত না হলেও জন্টি রোডসের গুরু হিসেবেই তিনি আলাদা জায়গা নিতে পারেন, ঐ লেখা পড়ে এমনটাই আচ করেছিলাম। বলা বাহুল্য ওি সময়ে জন্টি মাত্রই রাইজিং স্টার।

    তো বলছিলাম সেই ম্যাগাজিনের কথা। সেই ম্যাগাজিনে, ভিভের অবসরের পরেই হয়তো তার হোমেজ হিসাবে লিখা হয়েছিল 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁকে' এই শিরোনামে লিখাটি। লেখাটির পরতে পরতে লেখক ভিভের প্রতি মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেমনটি এই লেখাতেও এসেছে তেমন কিছু কাহিনীও ঐ লেখা পড়েই জেনেছিলাম। তবে এই লেখা পড়ে ভিভের আবির্ভাবের পিছনের গল্পগুলো একদম মুগ্ধ করে গেল। খেলা না দেকেও শুধু তার শটের ছবি দেখেই ভদ্রলোকের ফ্যান হওয়া যায়। আনকনভেশনাল হিটিংয়ের জন্যই ভিভের মহিমা আরো বেশি।

    আপনি যেমনটি পাদটিকায় লিখেছেন, নতুন ভিভ খুঁজে পাওয়াটা অনেকটা আর্জেন্টিনার নতুন ম্যারাডোনা পাওয়ার মত (যদিও হাল আমলে মেসি নতুন ম্যারাডোনার কৌতুককে চিরতরে বিদায় করে দিয়েছেন )। ভিভের তুলনাগুলো নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি বরং। ভিভের সাথে তুলনায় মনে হয় প্রথম আসেন ইনজামাম উল হক। ভিভের যেখানে শুরু সেখানেই ইনজামামের শুরু। আর ভিভের মত চুইংগাম চাবানো আর বিশ্বকাপে ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে ইনজামামের মাঝে অনেকেই ভিভের ছায়া দেখেছিলেন। ভিভের ছায়া পেলেই ভিভ হয় না। ইনজামাম যদিও নিজের ক্যারিয়ারকে অনেক দূরে টেনে নিয়ে গেছেন তবে সেটা ভিভের ছায়া হয়ে নয় বরং তার নিজের ধরণেই। ইংলিশ মিডিয়ার আতিশয্য আর ফার্স্ট ক্লাশের ফর্ম গ্রেম হিককে নতুন ভিভ বানিয়েছিল কিছুদিন। বলাই বাহুল্য এই নতুন ভিভের চাপ নিতে না পেরেই কিনা হিক তার ফার্স্ট ক্লাশের সেই রেকর্ড আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আনতে পারেন নি। তবে সবচেয়ে হাস্যকর তুলনা বোধ হয় ছিল রিকার্ডো পাওয়েলের সাথে। আমরা ২০০ সালে হঠাৎ করেই জানলাম, লারাকে পিছনে ফেলে উইন্ডিজের নতুন মহানায়ক এসেছে। নতুন ভিভ পঅয়েল। সেই তুলনাটা এসেছিলো পাওয়েলের একটা বা দুইটা ইনিংস দেখে। এখানে সেখানে ক্যামিও ছাড়া পাওয়েল বলবার মত কোন কিছুই করতে পারেন নি ক্রিকেটে।

    হাল আমলে এমনকি ম্যাককালাম এবি কেও রিচার্ডসের সাথে তুলনায় বসিয়ে দেয় অনেকে তবে সেটা আসলে ভিভের রাজসিকতার তুলনা বুঝাতেই হয় এমনটিই মনে হয় আমার কাছে। পরিসংখ্যান হয়তো গাধা। তবে তা সবসময় সত্যি নয়। ৯০ এর দশকের পুরোটা সময় ধরে সর্বোচ্চ গড় ধরে রাখা শচীনের গড় ছিলো (৪২) আড় স্ট্রাইকরেট ছিলো (৮৬)। বলাবাহুল্য শচীনের খেলা যারা দেখেছেন সবাই বলবে এই নাম্বার গুলোর মাহাত্ম্য কি। নব্বইয়ের আরেক এন্টারটেইনার জয়াসুরিয়ার স্ট্রাইকরেট (৮৯) (এভারেজে পিছনে থাকবেন লোয়ার অর্ডারে একটা বড় অংশে খেলায়)। তো এই দুজনের এক যুগ আগে খেলে শচীনের চাইতে বেশি গড় আর জয়াসুরিয়ার চাইতে বেশি স্ট্রাইকরেট ব্যাপারটাই ভীতিকর। আর হ্যা ব্যাটিংয়ের সময় হেলমেট নামক জিনিসটি ব্যবহার করেন নি তিনি। এবং এক যুজেরও বেশি সময় দাপটের সাথে সামলেছেন আশি নব্বইয়ের দুর্ধর্ষ পেস ব্যাটারিদের।

    লেখাটা অনেক ভালো লেগেছে জুনায়েদ ভাই।
    **** পুনশ্চ: ম্যাককালামের শেষ টেস্টের ইনিংসটির সময় আগি নিজেই 'ব্যাজ'কে তুলনা করেছিলাম গ্রেট ম্যানের সাথে। তবে বলাই বাহুল্য তুলনাটা মোটেই আক্ষরিক নয়। বরং ইনিংসের রাজসিকতা বুঝাতেই বলা।

    জবাব দিন
  7. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো জুনাদা। এই টি২০র যুগে মাঝে মাঝে ভাবি আগের যুগের কিছু ব্যাটসম্যান এখন খেললে কী ভয়ংকর অবস্থাই না হতো! ভিভ রিচার্ডসের নাম মনে আসে সবার আগে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।