প্রশ্ন উত্তরে জিকা ভাইরাস!

জিকা ভাইরাস কি?

ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার বা ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস (West Nile Virus) এর মতন মশাবাহিত একটি ভাইরাস হচ্ছে জিকা।
জিকা ভাইরাসে আক্রান্তের শরীরে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো হল-

১। জ্বর
২। ফুসকুড়ি (Rash)
৩। গিঁটে ব্যথা
৪। কনজাংটিভাইটিস (চোখ লাল হয়ে যাওয়া)

পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি পাঁচ জনের একজন অসুস্থ হতে পারেন। হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা খুবই নগণ্য। অপরপক্ষে, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের ঘটনা খুবই বিরল।

এটি কিভাবে ছড়ায়?

সাধারণত আক্রান্ত এডিস জাতীয় মশার কামড়ের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়ায়।

zika-virus-copy-e1454270258590

অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মাধ্যমে তার গর্ভের বাচ্চায় স্থানান্তরিত হতে পারে। কিন্তু সেটি কিভাবে এবং কখন হয়- তা এখনো জানা যায় নি।
একজন আক্রান্তের শরীর থেকে ৭ দিন পর্যন্ত মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
এখন পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াবার কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াবার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়ায় কি?

খুবই বিরল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যৌন মিলনের মাধ্যমে জিকা ভাইরাস ছড়াবার একটি কেস পেয়েছে বলে জানিয়েছে। ফলে, যৌন মিলনের ব্যাপারে সব রকম সতর্কতা বজায় রাখার জন্য (বিশেষ করে যারা সম্প্রতি জিকা ভাইরাস আক্রান্ত অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন) পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

কোন কোন অঞ্চলে জিকা ভাইরাস রয়েছে?

জিকা ভাইরাসের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে ক্যারিবিয়ান, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার ২৫টি দেশে

অতীতে দেখা গেছে গ্যাবন, মিশর, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, মধ্য আফ্রিকা রিপাবলিক, কম্বোডিয়া, মালেয়শিয়া, পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনস এবং ইন্দোনেশিয়াতে।

জিকা ব্রাজিলে গেল কিভাবে?

এখনো কোন কিছু প্রমাণিত হয় নি, তবে ধারনা করা হচ্ছে ২০১৪ সালের আগস্টে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ভা’য়া ওয়ার্ল্ড স্প্রিন্ট ক্যানোয়িং ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপস (Va’a World Sprint Canoeing World Championships) এর অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকতে পারে। তারা এসেছিলেন মূলতঃ ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, নিউ ক্যালিডোনিয়া, দ্যা কুক আইল্যান্ড এবং ইস্টার আইল্যান্ড থেকে।

বলা হচ্ছে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে আগত দর্শকদের মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে থাকতে পারে। আশংকা করা হচ্ছে আগামী ৫ আগস্ট শুরু হতে যাওয়া অলিম্পিকে (যা অনুষ্ঠিত হবে রিও ডি জেনিরোতে) এই ভাইরাস আরও বেশি পরিমাণ ছড়াতে পারে।

জিকা ভাইরাস কিভাবে নিশ্চিত হবেন?

আক্রান্ত হবার এক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের দেহ হতে রক্ত বা টিস্যুর স্যাম্পল নিয়ে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার জন্য পাঠাতে হবে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শুধুমাত্র আণুবিক্ষণীক পর্যায়ের পরীক্ষার মাধ্যমেই জিকা ধরা পড়বে। মনে রাখতে হবে জিকা ভাইরাস মাত্র সাত দিন কর্মক্ষম থাকবে। এরপর সেগুলো মারা যাবে এবং পরীক্ষায় ধরা পড়বে না।

জিকা’র চিকিৎসা কিভাবে হবে?

দুঃখের বিষয় এখনো পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন বা নির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক বের হয় নি। (সম্প্রতি ভারতীয় বিজ্ঞানীগণ প্রতিষেধক আবিষ্কার করা দাবী করেছেন, সেগুলো এখনো চূড়ান্ত স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে)। আপাতত রোগীর লক্ষণ দেখে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।

ভ্যাকসিন বানানো কি সম্ভব?

অবশ্যই। তবে এরকম একটি ভ্যাকসিন তৈরি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মানুষের উপযোগী করে তুলতে অনেক বছর এবং কয়েক শত মিলিয়ন ডলার খরচ লেগে যেতে পারে।

জানা গেছে বেশ কয়েকটি নামকরা কোম্পানি যেমন ইনোভিও, হাওয়াই বায়োটেক, জিএসকে এবং স্যানোফি এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে বা শুরু করার কথা চিন্তা-ভাবনা করছে।

ভারতীয় কোম্পানি ভারত বায়োটেক জানিয়েছে তারা গত বছর দুজন জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর উপর পরীক্ষা চালিয়েছে। অবশ্য, নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য তাদের আরো সময়ের প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, গত বছর স্যানোফি বিশ্বে প্রথমবারের মত ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনের অনুমোদন পেয়েছিল, যা কিনা সব দিক দিয়ে জিকা ভাইরাসের অনেক কাছাকাছি।

মাইক্রোসেফালি (Microcephaly) কি এবং এর সাথে জিকা’র কি সম্পর্ক?

মাইক্রোসেফালি একটি জন্মগত ত্রুটি যাতে বাচ্চার মষ্কিষ্কের উন্মেষ অসম্পূর্ণ থাকে এবং মাথার আয়তন থাকে তুলনামূলক ছোট। এই সমস্যার কোন প্রতিষেধক নেই বা কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। এই ধরনের বাচ্চাদের হৃদরোগ, বেড়ে ওঠার সমস্যাসহ বুদ্ধিমত্তাজনিত সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। মাইক্রোসেফালি খুব সাধারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০,০০০ নবজাতকের মধ্যে ২ থেকে ১২ টি ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়।

খবরে জানা গেছে সবচেয়ে জিকা-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে আখ্যা পাওয়া ব্রাজিলে মাইক্রোসেফালির হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে এই হার প্রতি ১০,০০০ নবজাতকে ১০০ জন বা ১ শতাংশ! যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি!

ব্রাজিলের নানা গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে জিকার প্রাদুর্ভাবের এলাকা এবং সময়ের সাথে মাইক্রোসেফালি কেসের একটি সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে এখনো কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

গত ১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ব্রাজিলের নবজাতকদের ক্রমবর্ধমান জন্ম-ত্রুটি ও স্নায়ুবিক বৈকল্য বৃদ্ধি এবং জিকার ভাইরাসের সাথে এর সম্ভাব্য সম্পর্ক অনুমান করে Global Health Emergency ঘোষণা করেছে।

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা’র ডিরেক্টর জেনারেল ডঃ মারগারেট চ্যান বলেছেন ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে ‘জোর ধারনা’ (Strongly Suspected) করা হচ্ছে।

এর আগে কেন জিকা ভাইরাস এবং জন্ম ত্রুটির ব্যাপারটির সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় নি?

এতদিন পর্যন্ত যেসব এলাকায় জিকা ভাইরাস দেখা যেত যেমন, মধ্য আফ্রিকা বা এশিয়াতে মানুষ জিকায় আক্রান্ত হত জীবনের একেবারে শুরু দিকেই। ফলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আক্রান্তের ঘটনা তেমন ঘটে নি বললেই চলে।

অপরপক্ষে আমেরিকা মহাদেশে অনেকটা আকস্মিকভাবেই এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে যারা অন্তঃসত্ত্বা রয়েছেন বা অচিরেই মা হতে যাচ্ছেন তারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সন্তানসম্ভবা অবস্থায় জীবনে প্রথমবারের মত আক্রান্ত হবার কারণেই সম্ভবত জন্মত্রুটির সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

এ কারণে কোন কোন দেশে আপাতত মহিলাদেরকে বাচ্চা না নেবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অন্ততঃ যতদিন না তারা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা এর কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে!

জিনগতভাবে পরিবর্তিত বা জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএম) মশা কি এই ভাইরাসকে রুখতে পারবে?

ব্রিটিশ কোম্পানি অক্সিটেক সম্প্রতি এডিস ইজিপ্টাই (Aedes aegypti) নামক মশার ডিএনএ’র দুটো জিন পরিবর্তন করে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড প্রজাতি তৈরি করেছে। একটি জিনের কারণে এদের ডিম আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী রশ্মির নিচে জ্বলজ্বল করে- এতে করে সনাক্তকরণ সহজ হবে। আরেকটি জিনের কারণে মশার বংশধর মারা যাবে।

অক্সিটেক দাবী করেছে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড মশা আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দিলে এডিস ইজিপ্টাই’র সংখ্যা কমপক্ষে ৮০ ভাগ কমে যাবে এবং জিকার আশংকাও বহুলাংশে কমবে।

অক্সিটেক আরও বলেছে মশার পরিবর্তিত ডিএনএ মানুষ বা অন্য কোন পশু বা প্রাণিতে স্থানান্তরিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে জিনগত পরিবর্তনের ব্যাপারে জনসমর্থন কম থাকার কারণে এই প্রকল্প এখনো বাস্তবায়িত হতে পারে নি।

বিঃ দ্রঃ এটি একটি ভাবানুবাদ। মূল লেখাটি এখান থেকে পড়তে পারবেন।

৪,২২৬ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “প্রশ্ন উত্তরে জিকা ভাইরাস!”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    জানা গেলো অজানা এক রোগের কথা।
    হলে কি করা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
    চিকিৎসার কি উদ্যোগ নিতে হবে।
    বাংলাদেশে এ ভাইরাসের অবস্থা/অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য এসব নিয়ে আরো এক-দু লাইন যুক্ত হলে আরো উপযোগী হতো।
    সাধুবাদ। এ লেখায় আমাদের বিষয়টা জানানোর জন্য।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।