আর্থার অ্যাশের উইম্বলডন বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি!

দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে কাটিয়ে মুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা যে গুটিকতক মানুষের সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন- তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন আর্থার অ্যাশ! দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ-বৈষম্য ও সারা পৃথিবীর জাতিগত ভেদাভেদ দূর করার অভিপ্রায়ে এই দু’জন কিংবদন্তীর মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল! পরবর্তীতে তাঁরা এইডস এর ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই এইডস এর করাল গ্রাসেই ১৯৯৩ সালে আর্থার অ্যাশ এর জীবনের অবসান ঘটে।

১৯৭৫ সালে অল ইংল্যান্ড ক্লাবে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে যখন ৩২ বছর বয়সী অ্যাশ উইম্বলডন জিতলেন, ম্যান্ডেলা তখন কারাগারে বন্দী হয়ে ছিলেন! কোর্টের বাইরের নানা অর্জনের জন্য তিনি এমনিতেই গ্রেট স্পোর্টস-ম্যান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। আর উইম্বলডন বিজয়কে বলা হয় তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।

এই সপ্তাহে অ্যাশ এর সেই যুগান্তকারী অর্জনের ৪০ বছর পূর্তি হয়েছে। একজন আন্ডারডগ এবং সত্যিকারের ভদ্রলোক আর্থার অ্যাশ সকল হিসেব-নিকেশ, বাঁধা পেরিয়ে হারিয়েছিলেন তৎকালীন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জিমি কনর্সকে! জিমি কনর্স ছিলেন দারুণ মেধাবী কিন্তু ঠিক সেরকমই খামখেয়ালি ও বেপরোয়া!
অ্যাশ শেষ পর্যন্ত তিনটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতেছিলেন- ১৯৬৮ সালে দেশের মাটিতে ইউ এস ওপেন, ১৯৭০ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং অবশ্যই ১৯৭৫ সালের উইম্বলডন। অথচ ‘৭৫ এর উইম্বলডনে তিনি যখন খেলতে গেলেন, সবাই ভেবেছিল অ্যাশ ফুরিয়ে গেছে…ভাববেই না কেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি তো কোন মেজর টুর্নামেন্ট জেতেন নি!

তবে, সেবার অ্যাশ এমনিতে আলোচনার কেন্দ্রতে ছিলেন। কেননা ফেভারিট কনর্স এর সাথে তাঁর একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। কেননা, ঐ বছরের শুরুর দিকে কনর্স এর ‘দেশপ্রেম নেই’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। দেশের জন্য ডেভিস কাপে অংশ না নিয়ে সে সময় কনর্স লাস ভেগাসের একটি আকর্ষণীয় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিল বলে অ্যাশ ঐ কথা বলেছিলেন।

কনর্স হাঁটুর ইনজুরিতে ভুগতে থাকলেও দারুণ খেলে শিরোপার দিকে এগিয়ে চলছিলেন। অসাধারণভাবে খেলে তিনি সেমিফাইনালে রস্কো ট্যানারকে হারান, যিনি গতিময় সার্ভ করার জন্য খ্যাত ছিলেন। ওদিকে অ্যাশ কোয়ার্টার ফাইনালে হারান উঠতি তারকা ও ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন বিওন বোর্গকে, সেমিফাইনালে হারান অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট টনি রোশ‘কে। সেমিফাইনালের খেলাটি পঞ্চম সেট পর্যন্ত গড়িয়েছিল!

ফাইনালে সবদিক দিয়েই ফেভারিট ছিলেন কনর্স। এর কনর্স ছিলেন ১ নম্বর সিড খেলোয়াড় এবং দুজনের মধ্যকার আগের তিন মোকাবেলার প্রতিবারই অ্যাশ পরাজিত হয়েছিলেন। অ্যাশের স্বভাবসুলভ আগ্রাসী খেলা কনর্সের বিরুদ্ধে বরাবরই অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।

অনেক আগে পাঞ্চো গনজালেজ নামের এক বর্ষীয়ান খেলোয়াড় অল্পবয়সী কনর্সকে গতি বা শক্তি নয়, বরং বৈচিত্র্যের মাধ্যমে পরাজিত করেছিলেন। অ্যাশ সেই পন্থা অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিলেন! ‘লো এন্ড স্লো’ নামে পরিচিত এই পদ্ধতির কারণে কনর্স তাঁর সহজাত বিধ্বংসী ফোরহ্যান্ড খেলতে পারছিলেন না। অপরপক্ষে আর্থার অ্যাশ দারুণভাবে লব এবং প্লেসমেন্টের উপর নির্ভর করে খেলে চলছিলেন। শেষ পর্যন্ত কৌশলেরই জয় হয়, আর্থার অ্যাশ জেতেন ৬-১, ৬-১, ৫-৭, ৬-৪ সেটে!

arthur-ashe

ম্যাচ শেষে হ্যান্ডশেকের সময়ে কেউ কারো সাথে একটি কথাও বলেন নি! এটাই ছিল আর্থার অ্যাশের শেষ কোন গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনালে খেলা! ১৯৭৯ সালে পরপর দুইটি হার্ট এটাক হবার কারণে তাঁর ক্যারিয়ার অকালেই শেষ হয়ে যায়!

১৯৮৮ সালে তাঁর শরীরের এইডস এর জীবাণু ধরা পড়ে! ধারণা করা হয়, পাঁচ বছর আগের হার্ট সার্জারির সময়ে ব্যবহৃত রক্ত থেকে তাঁর শরীরে এটি প্রবেশ করেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে তিনি এইডস-সংক্রান্ত নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যান। মারা যাবার আগ পর্যন্ত এইডস এর ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে গেছেন। তৎকালীন ও ভবিষ্যতের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের একজন অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আজও অমর তিনি! সেরেনা, ভেরেনা কিংবা জেমস ব্লেকদের মত খেলোয়াড়দের অন্যতম অনুপ্রেরণা তিনিই!

প্রায়ই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে প্রশ্ন করে, অসুখে ভোগার কারণে কখনও আমার মাঝে ‘হোয়াই মি?’ এই অনুভূতি কাজ করেছে- কি না? কখনোই না।

হার্টের অসুখ বা এইডস এর জন্য যদি আমি ‘হোয়াই মি?’ প্রশ্ন করি, তাহলে তো জীবনে যত সাফল্য অর্জন করেছি- সে জন্যও বলতে হবে! সেক্ষেত্রে ১৯৭৫ এর উইম্বলডন জেতার পরদিন সকালে উঠে আবার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, ‘হোয়াই মি?’

আর্থার অ্যাশের শেষ বই ‘Days of Grace’ এর এই অংশটুকু আসলে যেন তাঁর জীবনেরই সারমর্ম তুলে ধরে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ইতিবাচক এবং বিনয়ী একজন মানুষ! মরণ-ঘাতী অসুখও যা তাঁর থেকে কেড়ে নিতে পারে নি।

~এটি একটি ভাবনুবাদ।
মূল লেখার লিংকঃ 40 Years On: Ashe’s greatest on-court triumph

৮ টি মন্তব্য : “আর্থার অ্যাশের উইম্বলডন বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি!”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ধন্যবাদ জুনাদা আর্থার অ্যাশ আর তার উইম্বলডোন জয় নিয়ে লেখার জন্য। সত্যি কথা বলতে আমি ওর সম্পর্কে আজকের আগে বিশেষ কিছুই জানতাম, শুধু নামেই চিনতাম। আজকেই আর্থার অ্যাশের ওই ম্যাচ নিয়ে বিবিসিতে এই লেখাটা পড়ছিলাম। সেখানে আপনার বলাগুলোর পাশাপাশি আরো দু একটা চমকপ্রদ তথ্য পেলাম। ডেভিস কাপে না খেলা নিয়ে অ্যাশের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কনর্স ওর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়ের করেছিল উইম্বলডনের কিছুদিন আগে। আর অ্যাশ কনর্সকে ম্যাচের আগে মনস্তাত্তিক চাপে ফেলার জন্য ফাইনালের দিন মাঠে এসেছিল আমেরিকার ডেভিস কাপ দলের ট্রাকস্যুট পরে 🙂 ১৯৯৩ তে মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও সে তৎকালীন বুশ সরকারের হাইতি উদ্বাস্তু সংক্রান্ত নীতির বিরোধিতা করে গ্রেফতারও হয়ে ছিলেন।

    আবারো ধন্যবাদ জুনাদা এই কিংবদন্তিকে নিয়ে লেখার জন্য :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    পৃথিবী যতদিন থাকবে বর্ণবাদ, রেসিজম চলবে।
    আজ বিকালে গাড়ি ঘুরাচ্ছি।
    ত্রি পয়েন্ট পয়েন্ট টার্ন।
    এক টা ছেলে আসছে দেখে গাড়ি ব্যাক না করে স্টপ করে রাখলাম ও যাতে আরামে পথটুকু পার হতে পারে।
    ছেলেটি ১৪-১৫ বছরের সাদা।
    গাড়ির পিছন দিয়ে যেতে যেতে বলল আমি ওর গায়ে গাড়ি উঠিয়ে দিতে চাই কিনা?
    আমি কালো হলো একথা বলত না, কারণ সেক্ষেত্রে আমি ফাক ইউ ইত্যাদি বলে বাতাস গরম করে ফেলতাম। সাদা হলেও বলত না কারণ আমি সেক্ষেত্রে ওর জাত ভাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    অন্যসব ধরণের লেখার মাঝে (যেমন গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতিকথা) হঠাৎ করে একজন টেনিস কিংবদন্তীকে নিয়ে এই ঝরঝরে লেখাটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো। খুব ভালো হয়েছে- শর্ট, ক্রিস্প এবং ইনফরমেটিভ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।