ওহ, মুস্তাফিজ? ও তো আমার…

(প্রথমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আকারে দিয়েছি, প্রথম পাতায় আগে থেকেই দু’টি ব্লগ ছিল বলে এখানে দিতে দেরি হল!!)

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, নির্বাচক বা কোচ, সাংবাদিক বা আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধব…গত কয়েকদিনে যে যেভাবে পারছে মুস্তাফিজের সাথে নিজের নাম জুড়ে দেবার চেষ্টা করছে। এমন ভাব যে তার কারণেই মুস্তাফিজ আজ এই অবস্থানে এসেছে!!
আজব আমাদের জ্যুস খাওয়া মেন্টালিটি!

এবার আসল কথা বলি!
২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগরে আমার বাবার পোস্টিং ছিল! ঐ সময়টাতে কলেজ বা ভার্সিটি ছুটি হলে আমি সাতক্ষীরাতেই যেতাম! কাউকে চিনতাম না বলে বেহসিরভাগ সময় একা একাই ঘুরে বেড়াতাম! কখনও হেঁটে-হেঁটে, কখনও বা মোটরসাইকেলে চড়ে।

২০০৫ সালের মে কিংবা সেপ্টেম্বরের কোন এক দিনের ঘটনা!
সেদিন ছিল শনিবার কিংবা বুধবার!
মোটরসাইকেলে করে আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিলাম। এক সময় খেয়াল করলাম আমি সাতক্ষীরা সদর থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। অচেনা পথ, একটু ভয় ভয় লাগলেও চলতে থাকলাম। প্রায় ৩৫-৪০ মিনিট পর মনে হল, ‘আর না! এবার ফেরত যাই!’ ঘুরতে যাব হঠাৎ দেখি সামনের একটি স্কুলে বেশ কিছু ছেলে ক্রিকেট খেলছে! ভাবলাম কিছুক্ষণ আমিও খেলি।
ছুটিতে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে…ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে…
থুক্কু…টাইগারদা চলে এসেছিল! (আই মিন ট্যাগরদা!)

যাই হোক, ছেলেগুলোর সাথে আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমি ব্যাট করতে নামলাম। লিকলিকে, শুকনো ছোট্ট একটি ছেলে বল করতে আসল। আমি তো অবাক! এই টুকু পিচ্চি বল করবে?? কিপারকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এই পিচ্চিকে কেন দিলে?’
-ভাইজান, কথা কম! এ পিচ্চি না, ওর নাম মুস্তাফিজ। বোলিং সেই রকম!
-তাই নাকি? মেজাজটা গরম হয়ে গেল! বলে কি!!

ওর করা প্রথম বলেই ফ্লিক করে ডিপ ফাইন লেগ অঞ্চল দিয়ে ছক্কা মারলাম। এর পরেরটা শর্ট অব লেন্থের ছিল, পুল করে স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে সীমানা ছাড়া করলাম। তৃতীয় বল, মুস্তাফিজ রাগে ফুঁসছে! দৌড়ে এসে বল করল, ফুল টস! আলিম দার দেখলে নো বল তো ডাকতই, সাথে ছয়-সাত রান দিত…যদিও ওখানে কেউ নো ডাকল না! আমি অবশ্য প্রস্তুত ছিলাম, মিড উইকেট দিয়ে আবার ছক্কা মারলাম! এবার দেখি ছেলেটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে…ভাবলাম, ‘নাহ্‌, এভাবে মারা ঠিক হচ্ছে না!’

চতুর্থ বলটি অফ স্ট্যাম্পের উপর হাফ ভলি ছিল। আমি চাইলেই এক্সট্রা কাভার দিয়ে চার মারতে পারতাম। তা না করে আলতো করে ড্রাইভ করে এক রান নিতে গেলাম! ও মা! ও দেখি ক্রিজে আমার লাইন বরাবর দাঁড়িয়ে আছে! আমি আরেকটু হলেই ওর সাথে ধাক্কা খাচ্ছিলাম! কোন মতে বাউলি কেটে নিজেকে (এবং ওকেও, কেননা ঐ সময়ে আমার সাথে বাড়ি খেলে ও উড়ে চলে যেত!) বাঁচালাম!

যাই হোক, মেজাজ আবার গরম হয়ে গেল! আমার পার্টনারকে ডেকে বললাম সিঙ্গেল নিতে। ও সানন্দে রাজি হয়ে পরের বলটাতে কোন মতে ব্যাট লাগিয়ে সিঙ্গেল নিল। এবার আমি স্ট্রাইকে। পেছনের পা’টা লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে রেখে আগ্রাসী স্ট্যান্স নিয়ে দাঁড়ালাম। ওভারের শেষ বল। ও দৌড় শুরু করল, আম্পায়ারকে অতিক্রম করে বল ছুঁড়লো! লোয়ার ফুল টস, আমি সজোরে স্ট্রেইট ড্রাইভ করলাম। বল গিয়ে সোজা ওর ডানহাতে লাগল। ও তো চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি শুরু করল!

এই সেরেছে!
আমি দ্রুত ওকে নিয়ে পাশের হাসপাতালে চলে গেলাম। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে বলল,
-আপনাদের জন্য একটি খারাপ খবর আছে। মুস্তাফিজ আর কখনো বল করতে পারবে না। (আপনাদের কি বলেছি, ও তখন ডান হাতে বল করত? না বললে এখন জেনে নিন!)
উপস্থিত সবাই নাটকীয়ভাবে ‘না!’ বলে চিৎকার করে উঠল! আমি বললাম,
-ডাক্তার, কিছুই কি করার নেই?
-অবশ্যই আছে। আপনি এই ঔষধগুলো কিনে আনুন!!
এটা বলে আমার হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিল। ব্যাটা বদমাইশ!

প্রথমে ভেঙ্গে পড়লেও ধীরে ধীরে আমরা শোক সামলে নিলাম। আমি রোজ ওকে দেখতে যেতাম। পরবর্তী একমাস আমি ওকে বিভিন্ন দেশের বাম হাতি বোলারদের ভিডিও, টিউটোরিয়াল দেখানো শুরু করলাম! আমার কথা ছিল, ”তুই যদি বাম হাতে ট্য়লেট করতে পারিস, বল করতে পারবি না কেন রে, মুস্তা?” ওর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ঝামেলা করলেও সেজো ভাই খুব আন্তরিক ছিল। তিনিও দারুণ সঙ্গ দেয়া শুরু করলেন।

একমাসের মধ্যেই ও হালকা রান আপে বল করা শুরু করল। ওদিকে আমার ভার্সিটির ক্লাস মিস হয়ে যাচ্ছিল বলে ঢাকায় ফেরাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল। ফলে, ওর সেজো ভাইকে সবকিছু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসলাম। এরপর বাবার পোস্টিং ঢাকা হয়ে গেল, আমিও নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম…
এখন মুস্তাফিজকে দেখে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। কে জানে, ডান হাতে বল করলে ও হয়তো আরও ভাল করত! নিজেকে এখনো কিছুটা হলেও অপরাধী মনে হচ্ছে। সেদিন কেন আমি অত জোরে মারতে গেলাম! কেন? কেন?

মুস্তা, তোর মনে আছে? আমিই তোর সেই জুনায়েদ ভাই!!

২৭ টি মন্তব্য : “ওহ, মুস্তাফিজ? ও তো আমার…”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    মুস্তার ডান হাতের বারোটা বাজিয়ে ওকে দিয়ে বাম হাতের কাজ করানোয় আপনার আইপি সহ ব্যান চাই জুনাদা :duel:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    কালকের খেলার আগে মুস্তাফিজকে টিপস দাওনি? নাকি পাড়ার কাবাবের দোকানে শর্মাদের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো। তোমার গল্পেই ওরা মুস্তা কে চিনে ফেলেছে,

    ভালো লিখেছো,


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. সাবাবা সাইনী (২০০৬-২০১২)

    ভাইয়া আমি আসলেই হিসাব করা শুরু করেছিলাম যে ২০০৫ এ মুস্তাফিজের বয়স কত ছিল 😛
    পরে ওর বল এ আপনার চার- ছক্কা মারা দেখে বুঝলাম সামথিং ইজ রং =))

    এম্নে ভাই ওর আর শচিন এর অনেক মিল পাই আমি, শচিন এর জীবনীতে পড়েছিলাম যে ও ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিল কিন্তু দেখেন হয়েছে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান; আমাদের মুস্তাফিজ হতে চেয়েছিল ব্যাটসম্যান কিন্তু হয়েছে বোলার। শচিন এর জীবনেও ওর এক ভাইয়ের অবদান অনেক আর আমাদের মুস্তাফিযুরের ও 🙂
    ছেলেটা ধরে রাখতে পারলেই হয় 🙁 (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।