ধাক্কা!

১।

কেবিনের মধ্যে ঢুকে দেখি বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন, জেগে আছেন না ঘুমচ্ছেন- ঠিক বুঝতে পারলাম না। নার্স বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছে বাবার সাথে বেশি কথা না বলতে। আমি আস্তে করে বাবার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। সাথে সাথে বাবা চোখ খুলে তাকালেন।
-বাবা, এসেছিস।
-জ্বি, অফিস থেকে একটু আগেই বের হয়ে এলাম। ভাবলাম তোমার সাথে একটু বেশি সময় কাটাই…
-কি রায় দিল?
-বাবা, ওসব নিয়ে এখন চিন্তা কর না তো। এখন তোমার পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার। ডাক্তার বলেছে কোন প্রকার স্ট্রেস না নিতে।
-বউমা কিছু বলছে না, নার্সরা টিভি দেখতে দিচ্ছে না, তুই ও জানাচ্ছিস না…এতে তো আমার স্ট্রেস আরো বেড়ে যাচ্ছে। তুই রায়ে কি হল বল…

আমার বৃদ্ধ বাবার আশান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। এরপর আস্তে করে বললাম-
-৯০ বছরের জেল। বয়স বিবেচনা করে মহামান্য আদালত ওকে মৃত্যদন্ড থেকে অব্যহতি দিয়েছে।

আমার বাবা সারা জীবনই ছিলেন একজন যোদ্ধা। হাজার দুঃখ-কষ্ট, বাঁধা-বিপত্তিতে তাঁকে কোনদিন ভেঙ্গে পড়তে দেখি নি। এমনকি মরনব্যাধি হওয়া স্বত্ত্বেও বাবার প্রাণশক্তি এতটুকু কমে নি। সেই বাবা কেমন মনমরা হয়ে গেলেন। একটু আগেও তাঁর চোখে আমি যে তেজ দেখতে পাচ্ছিলাম তা যেন হঠাৎ-ই নিভে গেল। শুধু শুনতে পেলাম বাবা বিড়বিড় করে বলছেন ‘এত বড় ধোঁকা! এত বড় বেঈমানি!’!

আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা মনে হল কিছুটা ধাতস্ত হয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলা শুরু করলেন।

-তোর মায়ের কবরের পাশে বেলী ফুলের গাছ লাগিয়েছিলাম কেন জানিস?
-কেন বাবা?
-আমি চেয়েছিলাম তোর মা আর আমার কবরের মাঝখানে বেলী গাছ থাকবে। তোরা যখন আমাদের কবরের দেখতে আসবি তখন দেখতে পাবি আমাদের দুজনের কবর ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে…
-বাবা, তুমি আর কথা বল না…
-কিন্তু এখন আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছি। আমি মারা গেলে তুই আমাকে কবর দিবি না, আমার লাশটা পানিতে ভাসিয়ে দিবি…
-কি বলছ বাবা? এটা কিভাবে সম্ভব??
-কোন ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে কি করতে হয়? প্রথমে আস্তে করে ডাকতে হয়, এরপর জোরে ডাকতে হয়, তাতেও কাজ না হলে ধাক্কা দিতে হয়। আমি আমাদের এই ঘুমিয়ে পড়া মানুষদের ধাক্কা দিতে চাই। তাছাড়া এই লোক আমাদের পাশের গ্রামের। ও মারা গেলে নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়িতে কবর দেবে। আমি ঐ মাটিতে শুতে চাই না।
-কিন্তু বাবা…
-আমি কোন কথা শুনতে চাই না। তুই যদি আমার আত্মাকে শান্তি দিতে চাস-তাহলে যেভাবে বলছি তাই ই করবি…ব্যাস! এটাই আমার শেষ ইচ্ছা!!

২।

আজ দুই মাস হল বাবা মারা গেছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা তাকে একটি ফুটো করা নৌকায় করে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। ফুটো করা নৌকার কারনে বেশিক্ষণ ওটা ভেসে থাকে নি, বাবার মৃতদেহ নিয়ে ওটা গভীর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। পরিবারের অন্যরা অনেক আপত্তি করেছিল, কিন্তু বাবার আত্মার শান্তির কথা ভেবে আমি বাবা যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবেই করেছিলাম।

বাবার এই ‘শেষ বিদায়’ খুব আলোড়ন তুলেছিল। হাজার হাজার মানুষ সেদিন নদীর পাড়ে ভীড় করেছিল। সাথে মিডিয়ার লোকজনও ছিল। আমার ‘অনুভূতি’ জানিয়ে অনেক সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলাম। টিভি, সংবাদপত্র, রেডিও, ব্লগ, ফেসবুকে ঐ ঘটনা নিয়ে ঝড় উঠেছিল। গত এক মাসে আমি পঞ্চাশেরও বেশি টক শো’তে অংশ নিয়েছি। বলতে অস্বস্তি লাগলেও বাবার কারনে আমি অনেক তারকা খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলাম। সাধারণ মানুষসহ অনেকেই এই ঘটনা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারে নতুন মাত্রা দেবে বলে আখ্যা দিয়েছিল।

কিন্তু আজ দুই মাস পর আমি কোন আর কোন পরিবর্তন দেখছি না। সবাই এখন আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। কেয়ারটেকার সরকার আসবে কি না, দেশের জন্য কোনটি ভাল হবে, কোন দল কাদের সাথে জোট বাঁধবে- এই হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত!

আমার বাবার অনুমান ঠিকই ছিল যে, জাতি হিসেবে আমরা ঘুমিয়ে আছি। তবে বাবার হিসেবে একটু ভুল ছিল। আমাদের ঘুমটা জেগে থাকা ঘুম। আর কে না জানে- যে জেগে ঘুমায়, তাকে জাগানো যায় না!! ধাক্কা দিয়েও না…

(ঘটনা, স্থান, কাল, পাত্র কিছুটা কাল্পনিক-কিছুটা সত্য!)

৫ টি মন্তব্য : “ধাক্কা!”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এ লেখায় আসলে কমেন্ট করার মত কোন ভাষা নেই। কোন ধাক্কাতেই আর কোন কাজ হবার নয়।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শিবলী (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।