গ্রামটিতে ‘৭১ এ কোন কুকুরই ছিল না!!

১১ মে, ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানী সৈন্যরা আসছে জানতে পেরে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। যারা রয়ে গেছে, তাদের আসলে যাবার আর কোন জায়গা নেই। অবশ্য সুলায়মান, রহমত এবং মফিজ-যারা কিনা বর্তমান ‘গন্ডগোল’ এর বিরুদ্ধে, তারা উলটো অধীর আগ্রহে পাক বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছে।

অবশেষে দুপুরনাগাদ পাকি বাহিনী গ্রামের একেবারে উপকন্ঠে এসে পৌঁছলো। দলটা বেশি বড় নয়, কমান্ডিং অফিসার একজন মেজর। মেজর সরফরাজ গ্রামের একমাত্র পাকা স্কুল ঘরটায় একটা চেয়ার পেতে বসে তার এডভান্স টিমকে নির্দেশ দিলেন,
-সাব শালে বাঙ্গাল কুত্তকো ঢুন্ডো অর মার ডালো।

নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা হৈ হৈ করতে করতে এগিয়ে গেল। পরবর্তী ৪০ মিনিট গ্রামের উপর যেন ঝড় বয়ে গেল। দূর থেকে সৈন্যদের হাঁক-ডাক, গুলি, কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল। বেশ কয়েকটি ঘর বাড়িতে ওরা আগুনও জ্বালিয়ে দিল।

সৈন্যরা যখন ধ্বংস-যজ্ঞ চালাচ্ছিল মেজর সাহেবের খেদমতে গ্রামের ‘ঐ তিনজন’ তাদের আন্তরিকতা এবং আনুগত্য দেখিয়ে দিল। প্রথমেই গাছ থেকে ডাব পেড়ে সাহেবের তৃষ্ণা মেটালো, এরপর দ্রুত পুকুরে জাল ফেলে ইয়া বড় বড় রুই মাছ ধরল। মফিজ তো এরই মধ্যে একটা ছাগল জবাই করে ফেলল।

বেশ খানিকটা সময় পর সৈন্যরা স্কুল ঘরের কাছে ফিরে এল। মেজর সরফরাজ ডাবের পানি খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল,
-মার ডালা সাবকো?
-জ্বি সাব, লিকেন বহুত তাকলিফ হুয়া। হামকো বহুত ভাগায়া।
-কিতনে থে?
-সাব ছে (৬) থা।
-লিকেন ইয়ে লোগনে তো কাহাথা কামছে কাম পাঁচ্ছিছ (২৫) হোগা!
-ক্যায়া বাত কার রাহে সাব, ইতনে সারে কুত্তে, ও ভি এয়ছি ছোটা সা গাঁওমে??

মেজর সাহেবের পুরো দশ সেকেন্ড লাগল পুরো ব্যাপারটি বুঝতে। তিনি এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে, সুলাইমানের চিৎকার করে বলা কথাটা তার মাথায় প্রথমে ঢুকল না। যখন বুঝলেন ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

আসলে পাক বাহিনী আসছে শুনে এক দল মুক্তিযোদ্ধা গত কাল রাত থেকেই গ্রামের বাইরে অবস্থান নিয়ে ছিল। কথা ছিল শত্রুপক্ষ যদি দলে ভারী না হয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই মুক্তিবাহিনী একশনে যাবে। মেজরের নির্দেশে সৈন্যরা যখন গ্রামে জ্বালাও-পোড়াও করছিল তখনই তারা চারিদিক থেকে গ্রামটাকে ঘিরে ফেলে।

অপ্রস্তুত পাক বাহিনীকে পরাস্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন বেগ পেতে হল না। বেশিরভাগই মারা পড়েছে। মেজর সরফরাজকে দেখা গেল সান-গ্লাস পড়া অবস্থায় চেয়ার নিয়ে উলটে পড়ে থাকতে। অবশ্য তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তিটা এখনো ভালোই বোঝা যাচ্ছে!

মুক্তিযোদ্ধাদের একজন তাদের কমান্ডার শান্তকে জিজ্ঞাসা করল,
-শান্ত ভাই একটা জিনিস বুঝতাছি না, হারামজাদাগুলা এত কিছু রাইখ্যা কুত্তার পিছনে লাগল ক্যান? হালারা সবডি কুত্তা মাইরালাইছে!!!
-উঁহু, সবগুলোকে মারে নি। এখনো তিনটে বাকি আছে…

কথাগুলো বলে শান্ত ভয়ংকর চোখে স্টেনগানটা বাগিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা সুলায়মান, রহমত এবং মফিজ এর দিকে এগিয়ে গেল।

৫,৬৩৬ বার দেখা হয়েছে

৩৫ টি মন্তব্য : “গ্রামটিতে ‘৭১ এ কোন কুকুরই ছিল না!!”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    :boss: পাকবাহিনীর নির্বুদ্ধিতা,মুক্তিযোদ্ধাদের একশান,রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা এবং সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর গণহত্যা-এই চারটা জিনিস এত অল্প কথায় এমন মজা করে আমার পড়া আর কোন গল্পে দেখিনি(আমার পড়াশোনার পরিধিটা অতিশয় ক্ষুদ্র বলে এটাকে খুব বড় কোন কমপ্লিমেন্ট না ভাবাটাই কাম্য)।

    এক কথায় দুর্দান্ত!

    জবাব দিন
  2. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    কথাগুলো বলে শান্ত ভয়ংকর চোখে স্টেনগানটা বাগিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা সুলায়মান, রহমত এবং মফিজ এর দিকে এগিয়ে গেল।

    ওক্কে, ফায়ার :gulli2: :gulli2: :gulli2:

    জবাব দিন
  3. রকিব (০১-০৭)

    আমার একটা থিম দখল হয়ে গেলো। 😕 :((
    বরাবরের মতোই স্বল্প কথায় মাতিয়ে দিলেন। ভালো লাগলো ঝুনাদা। পারিবারিক প্রথা মেনেই আপনাকে মগডাল ঝুঁকিয়ে অভিবাদন। 😀


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাহমিদ

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।