কালো ঘোড়ার আরোহী!!! পর্ব পাঁচ

পর্ব

৯।

কয়েক দিন পর।

বেশ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শেরিফ মরগান। মনের মধ্যে কেমন জানি কু ডাক দিচ্ছে!! কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ানক কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে…অথচ সবকিছু কি ভাল ভাবেই না চলছিল!!! কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি, উইলিয়াম্‌স গ্যাং-কে ও কি সুচতুর উপায়ে নেতৃত্ব দিয়ে চলছে…
শুরুটা অবশ্য এমন ছিল না। দিব্যি জর্জটাউনের শেরিফ হিসেবে ওর দিন চলে যাচ্ছিল। জর্জটাউন তখন ছিল একেবারেই শান্ত, নিরিবিলি একটি শহর। অপরাধ সংঘটিত হত না বলেই চলে…ছোট খাট কিছু হলেও মানুষের জান-মালের ক্ষতি হয় এমন কিছু তো অবশ্যই হত না। এরপর বছর দুয়েক আগে শহরে এল উইলিয়াম্‌সরা। প্রথমেই ও বুঝেছিল, এদেরকে পাত্তা দিলে মাথায় উঠবে, শহরের শান্তির বারোটা বেজে যাবে। প্রথম দুই তিন মাস সুবোধ বালকের মতন ছিল ওরা, এর পর দেখা গেল মাঝে মাঝেই স্টেজযাত্রীরা ডাকাতির মুখে পড়ছে। ধীরে ধীরে রাতের আঁধারে ছিনতাই, এমনকি মানুষ হত্যাও শুরু হয়ে গেল। একদিন ও সরাসরি গিয়ে উইলিয়াম্‌সকে চ্যালেঞ্জ করল। বদলে উইলিয়াম্‌স যে প্রস্তাব দিল, তাতে শেরিফের ভিত নড়ে গিয়েছিল। ওর হতচকিত অবস্থা দেখে উইলিয়াম্‌স পরামর্শ দিল-ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে। সিদ্ধান্তটা নেবার সময়ই মরগান বুঝতে পারল ওর মধ্যে একটি লোভী, উচ্চাভিলাষী স্বত্ত্বা রয়েছে। ঠিক হল, উইলিয়াম্‌সদের সকল দুষ্কর্ম শেরিফ সামাল দেবে, বদলে লাভের অর্ধেক অংশ পাবে।

কিছুদিনের মধ্যে শেরিফ টের পেল বাকি তিনজন যতই নিষ্ঠুর, নির্দয় হোক না কেন-ওদের মধ্যে কূটবুদ্ধি খুব কম। তখনই এ ব্যাপারে ওর প্রতিভা প্রকাশ পাওয়া শুরু হল। অর্থাৎ সকল কর্মকান্ডের পরিকল্পনা ও করত, সম্পাদন করত বাকি তিনজন। এভাবেই ও দলের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। ফলাফল-ওর অফিসে ঝুলানো জর্জ ওয়াশিংটনের বিশাল ছবিটার পেছনের দেয়ালে থাকা গোপন ভল্ট ভর্তি অলংকার, সাথে লক্ষাধিক ডলার। ও ছাড়া একমাত্র উইলিয়াম্‌স এর হদিস জানে, একদিন অসাবধানবশতঃ ওর চোখে পড়ে গেছে। কিন্তু আর মনে হয় বেশি দিন এভাবে চলা যাবে না। অনেকেই ওর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। তাছাড়া উইলিয়াম্‌সও কেমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে…

‘আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? লুটের সব মাল নিয়ে যদি পূবের কোন শহরে কিংবা মেক্সিকোতে পালিয়ে যাই…’ চিন্তাটা মুহূর্তেই দূর করে দিল। উইলিয়াম্‌স কে ফাঁকি দেয়া গেলেও ফিলিকে ফাঁকি দেয়া যাবে না…ট্র্যাকিং ও খুব বেশি ভাল…ফিলি পিছু নিয়েছে- এমন ভাবনা নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা সুখের হবে না…রেমন্ড মরে গিয়ে একটা জিনিস ভাল হয়েছে…অন্ততঃ ভাগিদার তো একজন কমেছে!!! মাইকের ব্যাপারটা ভালভাবে চাপা দেয়ার জন্য নিজেকে মনে মনে আবার বাহবা দিল মরগান। তবে একটা জিনিস ওর মাথায় ঢুকছে না, ডেভ কেন এত চুপচাপ আছে!! ওর মতন মানুষ যে কিনা রোগী মরলেও বিচলিত হয়ে যায়, অথচ ভাইএর মৃত্যুতেও এত স্বাভাবিক আছে…কি আছে ওর মনে???

**************************************************

-হ্যালো শেরিফ!
ভুত দেখার মতন চমকে উঠে মরগান দেখল অফিসের দোরগোড়ায় মাইক দাঁড়িয়ে। কিছুটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, কিন্তু চোখদুটো বড্ড বেশি জ্বলজ্বল করছে।
-তু-তুমি???? তুমি বেঁচে আছো???
-দেখতেই পাচ্ছ, বেঁচে আছি এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি…
-কিন্তু রেমন্ড…মানে আমি…মানে তুমি তো…
-মানে মানে করে কোন লাভ নেই…ইচ্ছে করেই তুমি সবার কাছে আমার ব্যাপারে উলটাপালটা বলেছ। আসল কাহিনী তুমিও জানো যে রেমন্ডই আমাকে গুলি করেছিল।

প্রথম চমক কেটে যেতেই মরগান দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। মাইকের পক্ষে ওর ভূমিকা জানার কথা না…সুতরাং কোনমতে ওকে বুঝিয়ে যদি উইলিয়াম্‌স এবং ফিলি’র মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়…যে-ই মরুক ওর তাতেই লাভ হবে…!!!

-বিশ্বাস কর। আমার কিছু করার ছিল না…ওরা পিস্তল ধরে আমাকে শাসিয়েছে…আমি নিরুপায় ছিলাম…!
-আমি জানি। এখন যা বলি মন দিয়ে শোন…আমি ফিলিকে খুন করতে যাচ্ছি আর উইলিয়াম্‌স কে ধরে এনে তোমার হেফাজতে দেব। খবরদার, তুমি এর আগে নাক গলাবে না। আর সব কিছু ভালোয় ভালোয় হলে তুমি শেরিফের পদ থেকে সরে যাবে। তোমার মতন মরা শেরিফ এই শহরের দরকার নেই। বুঝতে পেরেছ???
-তুমি যা বলবে তাই হবে…প্রয়োজনে আমি এ শহর ছেড়েই চলে যাব…
-সেটা পরে দেখা যাবে। বলে মাইক অফিস ছেড়ে বের হয়ে গেল।

চট করে দরজাটা লক করে ভল্ট থেকে সব বের করে গোছগাছ করা শুরু করল মরগান। আর মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল, ‘একটা সুযোগ…শুধুমাত্র একটা সুযোগ যেন পাই…!!!!’

১০।

শেরিফের অফিস থেকে বের হয়ে রবার্ট এর সেলুনের দিকে হাঁটা শুরু করল মাইক। ডেভ এর কাছ থেকে জেনেছে ব্রেকফাস্ট করতে ফিলি ওখানেই গেছে। হঠাৎ এক অদ্ভূত চিন্তা ওর মাথায় খেলে গেল, ওদের দুইজনের মধ্যে যে কোন একজন এর আজই ছিল জীবনের শেষ ব্রেকফাস্ট!! শহরের খুব বেশি লোক ওকে চেনার কথা না, তারপরও অনেককে দেখা গেল ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে। ওদের কি দোষ, ‘মৃত’ কাউকে হেঁটে বেড়াতে দেখলে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক!!

ফিলিকে দেখতে পেয়ে মাইকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সেলুন থেকে বের হয়ে আস্তাবলের দিকে যাচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। নিজের মনে নিজেকেই বোঝাতে থাকল ‘কন্ট্রোল…কন্ট্রোল ইয়োর সেলফ…!!! আর মাত্র ত্রিশ গজ দূরে…
-ফিলি!!!

পাই করে ঘুরে দাঁড়ালো ফিলি। ওর মুখের অবাক হওয়া অভিব্যক্তি মাইক স্পষ্টই দেখতে পেল। ভালোই হয়েছে, ওকে একটা চমক দেয়া গেছে…এরকম ছোট-খাট ব্যাপারই মাঝে মাঝে জয় পরাজয় নির্ধারনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

-আরে, মাইক যে…!! তুমি দেখি বেঁচে আছ! বেচারা রেমন্ড! আজ ও থাকলে তোমাকে দেখে কত ‘খুশি’ হত!! ফিলির নার্ভের জোর দেখে মাইক কিছুটা অবাক হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে পুরো ঘাঘু মাল! কি চট করেই না নিজেকে সামলে নিল! ওকে কোনমতেই আন্ডার-এস্টিমেট করা যাবে না…

-চিন্তা কর না, ফিলি। আমি তোমাকে এখনই রেমন্ড এর কাছে পাঠাচ্ছি। যত খুশি ওকে আমার গল্প শুনিও!
-হা হা হা…তাই নাকি?? বেশ দেখাই যাক, কে রেমন্ড এর কাছে যায়…

দুজনের মধ্যকার দূরত্ব এখন বিশ গজের বেশি হবে না। মাইক কিছুটা সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল। প্রথমে ঠিক করেছিল শুধু ডান হাতেই পিস্তল ড্র করবে। কিন্তু এখন মত বদলে দুই হাতে ড্র করার সিদ্ধান্ত নিল। কোন সুযোগ নেয়া যাবে না। আশপাশে যারা ‘লাইন অব ফায়ার’ এ ছিল, দ্রুত সরে গেল।

মাইকের মাথা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। ডেভ এর চিন্তাযুক্ত মুখ…কেট এর মুখের আর্তি…ব্লাকের আঘাতের চিহ্ন…শেরিফের চোরের মতন চেহারা…কিছু নেই…শুধু আছে একটাই চিন্তা-ফিলিকে মারতে হবে। তীক্ষ্ম চোখে ফিলির হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।

সময় যেন থেমে গেল।

মনে হল অনেকক্ষণ পর ফিলির ডান হাত নড়ে উঠল। হোলস্টারের দিকে হাত বাড়াতেই মাইক দুই হাতে ড্র করল। শপাশে যারা ছিল, তারা জীবনে প্রথমবারের মতন এমন জোড়া হাতের শুটিং দেখল…মাইক এত দ্রুত এবং যুগপৎ ভাবে গুলি করল যে কানে একটা গুলিরই শব্দ এল। ফিলি অবাক হয়ে মাইকের দিকে তাকিয়ে রইল…ও ভাবতেও পারে নি, মাইক এতটা ফাষ্ট!! খাপ থেকে পিস্তল বের করতে পারলেও গুলি করার সুযোগ পায় নি। ফিলি সাদা শার্ট পড়ে ছিল বলে পরিষ্কার দেখা গেল, ওর বুকের উপর যেন নতুন এক জোড়া চোখ গজিয়েছে…ধীরে ধীরে সেই ‘চোখ দুটো’য় অশ্রুর মতন রক্ত দেখা গেল। অবশেষে ও ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। তবে মাটিতে পতনের ফলে কোন ব্যথা অনুভব করল না, করবে কি করে! তার আগেই যে প্রাণ পাখি উড়াল দিয়েছে…!!

ডেভ এতক্ষণ কিছুটা পিছনে থেকে সব দেখছিল। সে দৌড়ে মাইকের কাছে গেল। মাইককে অক্ষত দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল।
-মাইক, তুমি এত ফাস্ট জানতাম না তো!!! গ্রেট শুটিং ম্যান!!
-এখনই এত খুশি হবার কিছু নেই…পালের গোদাটা এখনো বাকিই আছে…

আশ-পাশে যত মানুষ ছিল, বিস্ময়ের ঘোর কেটে উঠতেই তারা হাত-তালি দেয়া শুরু করল। অনেকে তো মাইকের কাছে এসে পিঠ চাপড়ে বাহবাও দিল। এত হৈ চৈ শুনে অন্যান্য আরো অনেকের মতন উইলিয়াম্‌সকেও রাস্তায় আসতে দেখা গেল। ফিলির লাশ এবং মাইককে দেখে ওর আর ঘটনা বুঝতে কিছু বাকি রইল না। চট করে উপস্থিত জনতা আবার দুই পাশে সরে গেল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে মাইক বলে উঠল,
-উইলিয়াম্‌স, তোমার দিন শেষ। আমি চাইলেই এখন তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটা আমার স্টাইল না। আমি সবাইকেই সুযোগ দিই। তুমি যেহেতু খালি হাতে লড়তে বেশি পছন্দ কর, তোমার সাথে আমি খালি হাতেই লড়ব!

খুশিতে উইলিয়াম্‌স এর হলুদ দাঁত বের হয়ে গেল। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। পিস্তলে যে ফিলিকে বিন্দুমাত্র আহত না হয়েই মেরে ফেলতে পারে, তার সাথে পারা ওর কম্ম্য না। কিন্তু খালি হাতে…
-বেশ বেশ, কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ বাগড়া দেবে না-তার গ্যারান্টি কি???

-আমি গ্যারান্টি!!!
বক্তার দিকে সবাই ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, রবার্ট শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
-তোমাদের লড়াইতে যে বাগড়া দেবে, আমার শর্টগানের গুলিতে সে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে…

সব দেখে উইলিয়াম্‌স কুতকুতে চোখে মাইককে উদ্দেশ্য করে বলল,
-শুভ কাজে তাহলে আর দেরি কিসের…এস তোমার ধোলাই শুরু করি…!!

মাইক কোন জবাব না দিয়ে উইলিয়াম্‌স এর দিকে এগিয়ে গেল।

৩৭ টি মন্তব্য : “কালো ঘোড়ার আরোহী!!! পর্ব পাঁচ”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    দারুন!
    একেবারে টিন-এইজে ওয়েষ্টার্ণ পড়ার সময়কার টানটান উত্তাপ পুরো লেখা জুরেই... :thumbup:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    পর্ব চাইরের পর প্রায় মাস খানেক গ্যাপ :bash:
    বাকিগুলা সব খায়া ফেলসি 🙁
    রিভাইজ দিয়া আসি।
    একসাথে দুইতিন পার্ট লেইখা রাখতে পারোসনা?


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    *
    সদস্যঃ ৪ অতিথিঃ ২১

    o আদনান (১৯৯৪-২০০০)
    o টিটো রহমান (৯৪-০০)
    o কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    o তানভীর (৯৪-০০)

    বাহ ৯৪ রক্স

    জুনা লেখা ভালো হইচে


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    :gulli2: :gulli2: নিজেরে ক্যামন যেন ওয়েষ্টার্ন কাউবয় হিরু :ahem: লাগতেছে। :gulli: :gulli:
    পরের পর্ব জলদি দিয়েন।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুলহাস (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।