ছিল, আছে, থাকবে…!!!

১|

১৯৯৫ সাল।
লান্চের পর প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ক্যাডেটই ড্রেস চেন্জ করে ছোট্ট কিন্তু পরম আকাংক্ষিত ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু আগেও যে হাউসটি লান্চ ফেরত ক্যাডেটদের কল-কাকলিতে মুখর ছিল, তা এখন সুনসান নিরব…
এমন সময় সমস্ত নিরবতাকে খানখান করে চিত্‍কার, ‘ডিউটি ক্যাডেট, ডিউটি ক্যাডেট….’
৩/৪ সেকেন্ডের জন্য সময় যেন থেমে গেল, এরপর শোনা গেল অন্য একটি গলার আওয়াজ ‘ইয়েস প্লিজ…!’ সাথে ধুপধাপ দৌঁড় এবং সিঁড়ি বেয়ে নামার শব্দ।

ডর্ম ১২-এর গতকালই সদ্য আসা ক্লাস সেভেনের অধিকাংশই ঘটনার আগামাথা বুঝতে না পেরে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। পিচ্চি অনিক শেষ পর্যন্ত চুপ থাকতে না পেরে ওর লকার পার্টনার (গাইড) শুভকে প্রশ্ন করল,
– ‘ইয়েস প্লিজ, শুভ ভাই…একটা প্রশ্ন করব প্লিজ??’
শুভ নিজের কাজ ফেলে এসেছিল অনিককে জরুরী কিছু বিষয়ে ছবক দেবার জন্য। সে কিছুটা বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ না করে ভাবের সাথে বলল
– ‘গো অন…!’
-‘ইয়েস প্লিজ, ডিউটি ক্যাডেট জিনিসটা কি??’
-‘ডিউটি ক্যাডেট হচ্ছে-ডিউটি ক্যাডেট…ক্লাস এইটের ক্যাডেটরা তাদের ক্যাডেট নম্বর অনুযায়ী ডিউটি ক্যাডেটশীপ করে থাকে, একজন দোতলায়-আপস্টেয়ার ডিউটি ক্যাডেট…অন্যজন নিচতলায়-ডাউনস্টেয়ার ডিউটি ক্যাডেট। তারা সব ইভেন্টের আগে নিজ নিজ ফ্লোরের সবাইকে ডেকে দেয়। আবার বাঁশি বাজিয়েও কতক্ষণ বাকি আছে জানায়। সিক রিপোর্ট, প্যারেড স্ট্যাট, চিঠি- সবকিছু তারাই তদারকি করে…যতদিন না গ্রান্ড জুনিয়র ব্যাচ আসবে, ততদিন এই ডিউটি ক্যাডেটশীপ চলতেই থাকবে…চলতেই থাকবে….!’
-‘ইয়েস প্লিজ, সিক রিপোর্ট, প্যারেড স্ট্যাট-এসব কি??’
-‘তুমি আজাইরা প্রশ্ন বেশি কর…এসবের চেয়ে জরুরী জিনিস শেখাই তোমারে… প্রথমে পানিশমেন্ট…!! হ্যান্ডস ডাউন হচ্ছে…….!!’

২|

দেড় বছর পরের ঘটনা।
নাইট প্রেপের পর সবাই কমনরুমে ঢুকছে বিটিভিতে গুরুত্বপূর্ণ (!) ‘নিউজ এট টেন’ উপভোগ (!) করার জন্য। এমন সময় হাউস প্রিফেক্ট আদিবের গলা,
‘ডিউটি ক্যাডেট, হাউস ডিউটি ক্যাডেট…’
এদিকে অনিক, শিপলু এবং সাবিত তখন কমনরুমে বসে বলিউডের নায়িকা বিষয়ক জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছিল। দ্বিতীয়বারের মতন আদিবের চিত্‍কার শোনার পর সাবিত বলল,
-‘আজ ডিউটি ক্যাডেট কে রে?? তার খবর আছে…! বসে তো ক্ষেপছে মনে হয়…’
-‘আয় হায়, মনেই ছিল না!’ বলে অনিক বই খাতা ফেলে লাফ দিয়ে কমনরুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

লাইটস অফ এর দশ মিনিট পর অনিক যখন ওর ডর্মে একেবারে ঘেমে নেয়ে ঢুকল, প্রথমে মনে হল সবাই বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে। ডর্ম লীডার ক্লাস নাইনের আযম এডমিট বলে ওরাই এখন ক্ষমতায়! অনিক ওর বেডের কাছে যেতেই শুনতে পেল চিকন গলায় আমিনুল বলছে,
-‘এই বয়েজ, অনিক কি পেল রে??’
-‘কি আবার, এক্সট্রা ডিউটি ক্যাডেটশীপ…!!’ বলে সবক’টা একসাথে হি হি করে হাসতে লাগল।
-‘শালারা…খুব তো মজায় আছ…খাইতা আমার মতন এক্সট্রা, টের পাইতা…তোদের মতন বন্ধু থাকলে তার আর শত্রুর কোন দরকার নাই!!!’
হলুদ ডিম লাইটের অনুজ্জ্বল আলোয় সবার-এমনকি অনিকের হাসি মুখ দেখে মনে হল শত্রুর দরকার না থাকায় সবাই বরং খুব খুশিই…!

৩|

২০০০ সাল।
মেজাজ খারাপ হয়ে আছে অনিকের। একটু আগে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে ওরা-সব প্রিফেক্টরা কথা বলে এসেছে। আজকের প্রিন্সিপ্যালস ইন্সপেকশন নাকি চরম হতাশাজনক হয়েছে, বিশেষ করে অনিকের হাউসের অবস্খা তো ভয়াবহ…তাই স্যার ঠিক করেছেন, আগামীকাল আবার হবে। আর এবার যে হাউস খারাপ করবে তাদের কপালে খারাবি আছে…!
‘শালা…বিপ…বিপ…!!’

বেশকিছুক্ষণ গালাগালি করে মনটা হালকা করে হাঁক ছাড়ল,
‘ডিউটি ক্যাডেট…!’

৪|

১,২,৩…২৫!!
-‘আরিব্বাস! ২৫ জন!! এবারের রি-ইউনিয়নে আমরাই মনে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিব্লিস তোরা??’
-‘আরে নাহ! কয়েকটা জুনিয়র ইনটেকে আরও বেশি আছে, তয় মোটামুটি সিনিয়রগো মধ্যে আমরাই বেশি…’
-‘বয়েজ, এইসব গোনাগুনি বাদ দে…ক্ষিদা লাগছে, চল ডিনারে যাই…’
-‘হ চল চল…সেই কখন খাইছি…মনেই নাই…’

অনিক, শান্ত, ইরফান, সাবিত… সবাই একসাথে ডাইনিং হলের দিকে রওনা হল। হাঁটতে হাঁটতে কত কথা, গল্প, স্মৃতিচারণ, অভিনয় করে ডেমো দেয়া, গান…!
একটি হাউসের পাশ দিয়ে যাবার সময় বর্তমান ক্যাডেটদের কয়েকজনকে দেখা গেল, উত্‍সুক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় হঠাত্‍ চিত্‍কার শোনা গেল,
-‘ডিউটি ক্যাডেট, হাউস ডিউটি ক্যাডেট…!!’

মুচকি হেসে অনিক সবার সাথে ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়াল।

৪,৭৮৩ বার দেখা হয়েছে

৯২ টি মন্তব্য : “ছিল, আছে, থাকবে…!!!”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম....
    পুরোটাই মোবাইলে লেখা...
    সিসিবিতে দিতে বহুত কষ্ট হইছে...প্রথমে তো ৩নং প্যারা দিতেই পারছিলাম না...
    যাই হোক, অবশেষে পুরাটাই আইছে...!!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    জুনা ভাই তো পুরা ফাটায়া ফেলছেন... :boss: :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    @ম্যাশ, আমারো এখন ডাউট হইতেছে...
    মনে হয় ওটা ফর্ম প্ল্যান না...কে কোন ফর্মে- এইডা জানা লাগত...


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. ডর্ম লীডার ক্লাস নাইনের আযম এডমিট বলে ওরাই এখন ক্ষমতায়!

    রুম লীডার অ্যাডমিট থাকলে যে একটা মাস্তি হইতো না......জটিল!!!......আমরা ক্লাস সেভেনে থাকতে আমাদের রুম লীডার জুবায়ের ভাই প্রত্যেকদিন রাতে লাইটস আউটের পরে চলে যাইতো উপরে ক্লাসমেটদের সাথে রুম ক্রিকেট খেলতে :goragori: ......আর আমাদের তখন শুরু হইতো যার যার বেডে শুয়ে শুয়ে চিল্লাচিল্লি,আড্ডা... :guitar: :goragori: ।পাশের রুমে থাকত ক্লাস ইলেভেন......একদিন রাতে ইলেভেনের তারেক ভাই এসে এমন পাঙ্গা দিল... :frontroll: :frontroll: বাপ রে বাপ...।আমাকে আর আরেকটা কাকে যেন স্লিপিং ড্রেসের উপরেই তিন বার গোসল করাইলো...এম্নি তখন শীতের রাত।অবস্থা টাইট হয়ে গেছিল।জুবায়ের ভাইও অবশ্য কম বকা/পাঙ্গা 😉 খায় নাই...সবই জানি...... 😀

    জবাব দিন
  5. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    একবার পুরা কলেজ সকালে পিটিতে লেট ছিল বইলা এডু আমারে টানা ৮ দিন কলেজ ডিউটি ক্যাডেট বানাইছিল। পরে জ্বরের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হইয়া রক্ষা পাইছিলাম।


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  6. হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    আমার রেকর্ড কেউ ভাংতে পারবে বলে মনে হয় না, পুরা ক্লাস এইটে ৫২ টা হাউস ডিউটি ক্যাডেট, এর মধ্যে টানা আছে ২০টা :(( শেষের দিকে আমি আর কাউকে জাগাইতাম না, :just: হুইসেল বাজাইতাম আর সরাসরি ফল-ইনে যাইতাম :gulli2:

    জবাব দিন
  7. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    এই হাউস ডিউটি ক্যাডেট থাকার জন্য রাতে "কাহো না পীয়ার হ্যায়" দেখতে পারি নাই...
    প্যারেড স্টেট ভুল করার লাইজ্ঞা কলেজ ডিঊটি ক্যাডেট ভাই দৌড়ের উপর রাখছিল। x-(
    সেই যে ঋত্তিকের সাথে আমিশার সমুদ্রের পাদদেশে নাচন ছোট মনে কাঁদন থুক্কু কাঁপণ দিছিল... আহা। :dreamy: 😛
    ভাই আপনে পুরাটা মোবাইলে লিখছেন??!!! :hatsoff:
    এই না হলে ফিলিংস ভাই। :salute:

    জবাব দিন
  8. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    জুনা, কি মনে করাইয়া দিলিরে!! ~x(

    ডিউটি ক্যাডেটের সবচেয়ে মজা ছিল, ক্লাস, প্রেপ ফাঁকির সুযোগ। পুরা কলেজ আজাইরা ঘুইরা বেরানো। ডাইনিং হলে আগে আগে গিয়া বাড়তি খাওন। হাউজে হাউজে চিঠি বিলানোটাও খারাপ লাগতো না। বড় ভাইরা খোঁজ নিতো ইস্পেশাল চিঠি আইলো কিনা! ভাবটাই আলাদা। আহ্ আবার যদি সুযোগ পাইতাম......

    :guitar: :guitar: :guitar:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  9. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    হাউজ ডিউটি ক্যাডেটশীপ ভূয়া, খালি কষ্ট আর পাঙ্গা।
    কলেজ ডিউটি ক্যাডেট হইলে মজা ।
    আমিও বেশ কয়েকবার কলেজ ডিউটি ক্যাডেট হইয়া অনেক খানাপিনা করিয়াছি। কাবাব, পুডিং, চপ ইত্যাদি ইত্যাদি। 🙂


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  10. ডিউটি ক্যাডেট জিনিসটা ভাল ব্যবসার কাজ। ৬০ টাকা রেটে ডিউটি ক্যাডেট কইরা দিতাম আমি আর আহসান। আর নূরুল হক স্যার ডিউটি মাস্টার থাকলে সেই ডিউটি ক্যাডেটশীপ কইরা দিলে পুরা টার্মের কাবাব আর সুপ। আহহহহহ 😀 😀 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।