আমার বিসিএস পরীক্ষা…!!!

আমার খুব শখ ছিল বিসিএস পরীক্ষাটা হেব্বি মাস্তি করে দেব…একে তো জীবনের প্রথমবার, তার উপর আবার চান্স পাব কিনা- এরকম কোন টেনশন নেই। কারন আমি নিশ্চিৎ যে আমার হচ্ছে না। জীবনে আর বিসিএস দেয়া হয় কিনা-কে জানে!! সুতরাং মাস্তি না করার কি আছে??

কিন্তু হায়! মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক…সিট প্ল্যান দেখে জানতে পারলাম, আমার সিট পড়েছে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ, লক্ষ্মীবাজার!!! অর্থাৎ কিনা সদরঘাটের কাছাকাছি…আমি থাকি বনানী, সেখান থেকে সদরঘাট…হিসাব করে দেখলাম প্রায় ২০০ কিমি দূরে…অন্ততঃ ১৫ কিমি তো হবেই!!! ৭০০/৮০০ টাকা খরচ করে সদরঘাট যাওয়ার চাইতে ঐ টাকা দিয়ে ফ্যান্টাসি কিংডম গেলে কত না মজা হত- ভেবে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। পরীক্ষার চিন্তা আমাকে ছুঁতে না পারলেও, পরীক্ষার দিন অতদূর যাব কেমন করে- চিন্তা করতে করতে আমার চোখ-মুখ শুকিয়ে যেতে লাগল…আমার মা বললেন, ‘যাক এতক্ষণে তোকে পরীক্ষার্থী মনে হচ্ছে…’ যে কারনেই হোক, আমি যে পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করছি- এতেই আমার মা আমার উপর খুশি হয়ে গেলেন…!!! বাসায় পরীক্ষার্থী আমরা দুই জন, আমি আর ভাবী। ভাবীর পড়া দেখে অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ লজ্জা পেয়ে পড়ত…ভাগ্যিশ ক্যাডেট কলেজে পড়েছিলাম…!!!
যাহোক, আল্লাহ্‌ তার প্রিয় বান্দাদের যেভাবে বাঁচান সেভাবে আমাকেও বাঁচালেন…আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন রায়হান জানালো আমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাবে এবং নিয়েও আসবে…আগের দিন রাতে তাই মেস বি’তে চলে গেলাম…সকালে ঘুম থেকে উঠলাম পৌনে সাতটার সময়…উঠে মিনিট পাঁচেক চিন্তা করলাম লাস্ট কবে এত সকালে উঠেছিলাম তা বের করার জন্য…কিন্তু মনে করতে পারলাম না…অতঃপর প্রক্ষালণ শেষ করে কোন মতে নাকে মুখে কিছু গুজে আমরা রওনা হলাম। আমার ঢাকা ভার্সিটির বন্ধু এবং ডিপার্টমেন্ট মেট ফারজান (ককক, ১৬ ইনটেক) এর সিট পড়েছিল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল- যেটি একই এলাকায়, ওকে টিএসসি থেকে তুলে নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। আমরা যাচ্ছি আর যাচ্ছি…পথই শেষ হয় না…এক সময় তো ভয়ই পেয়ে গেলাম…সাথে নেই পাসপোর্ট, শেষে না আবার পাসপোর্ট ছাড়া বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া চলে যাই…খোদার অশেষ রহমত! এমন কিছু হল না…এক সময় আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম…ভাইরে ভাই কি জায়গা…!

তখন বাজে মাত্র পৌনে নয়, আর আমাদের কেন্দ্রে রিপোর্টিং নয়টা বিশ মিনিটে। সময় কাটানোর জন্য চা-সিগারেটের শরনাপন্ন হলাম…অবশেষে সময় হল এবং আমরা যার যার কেন্দ্রে চলে এলাম…আমার সিট ছিল পাঁচ তলায়। এডমিট কার্ডের সাথে মিলিয়ে সিট দেখে নিলাম…পরীক্ষার তখনো বাকি অনেক সময়…এমন সময় শুনতে পেলাম প্রকৃতি ডাকছে…কিন্তু সাড়া দিতে গিয়ে পড়লাম বিপদে…টয়লেটগুলো এত নোংরা এবং পানিও নেই…!!! সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে ঐদিন আমার সাথে কোন টয়লেট পেপারও ছিল না…অনেকক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম অ্যালবাট্রস মারতে হবে…অতঃপর কি আর করা, পিএসসি থেকে যে খামে করে এডমিট কার্ড পাঠিয়েছিল তা দিয়েই…! তখনি শিওর হয়ে গেলাম আমার প্রিলিতে হচ্ছে না…

সিটে গিয়ে দেখি আমার পাশেরজন ডিইউ’র জিওগ্রাফির এক আপু…কথা বার্তা হতে হতে এক সময় জানা গেল কোন এক বিশেষ কারনে তিনি ক্যাডেটদের পছন্দ করেন না…আমি ঐটুকু সময়ে যতটুকু সম্ভব তার অপছন্দ দূর করার চেষ্টা করলাম…এক সময় আমাদের উত্তরপত্র দেয়া হল…আমি ফর্ম পূরণ করে অনেক সময় আছে দেখে প্রশ্ন দেখা ছাড়াই গোল্লা পূরণ শুরু করলাম…হি হি হি…এই না দেখে আপুটা দিল ঝাড়ি! উনি এম্নিতেই অনেক টেনশনে ছিলেন, আমার ঐসব দেখে তা গেল আরও বেড়ে…আমি নিয়ত করে গেছিলাম প্রশ্ন পাবার আগেই বেশ কয়েকটা পূরণ করব, কিন্তু আপুটার তীব্র বাধার মুখে বেশি করতে পারলাম না…
অবশেষে ১০টায় পরীক্ষা শুরু হল…ইংরেজী আর ম্যাথ পার্ট সহজই মনে হল…আমি পূরণ করতে লাগলাম…সবচেয়ে মজা লাগল দৈনন্দিন বিজ্ঞানের একটি প্রশ্ন দেখে, এসেছে যে ‘কোন কারনে গাছের পাতার রঙ হলুদ হয়ে যায়?’ যদিও আমার কখনও এমন কিছু হয়নি তবুও উত্তর লিখলাম…এক সময় পাশের আপুটা আমাকে বললেন ওনার নাকি বাংলাদেশ এবং বাংলা সাহিত্যের অনেক কমন পড়েছে, আমি চাইলে দেখতে পারি!!! আমি ভাবলাম মন্দ কি! অ্যালবাট্রস কি তবে আপনাআপনি গলা থেকে খসে পড়ল- ভাবতে ভাবতে গোল্লা পূরণ করতে লাগলাম…সময় শেষ হবার কিছুক্ষণ আগে দেখি বেশ কয়েকটা গোল্লা পূরণ বাকি আছে…আমি ভাবলাম, এত টাকা খরচ এপ্লাই করে, এত কষ্ট করে এত দূর আসার পর কিছু গোল্লা পূরণ না করে যাওয়া ঠিক হবে না…প্রশ্ন দেখতে আর ইচ্ছা করল না…প্রতিটা ভুল উত্তরের জন্য ০.৫ নম্বর কাটা যাবে- এমন নির্দেশনাও আমাকে দমাতে পারল না…আমারে নম্বর কাটার ভয় দেখায়, হাহ্‌!!! ঠিক এগারোটায় পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল…

বের হয়ে দেখি রায়হান টিপিকাল অভিভাবকদের মতন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে…পার্থক্য হল টিপিকাল অভিভাবক মনে হয় না সিগারেট খাওয়ায়, রায়হান আমাদের আবার চা-সিগারেট খাওয়ালো!!! লোকজনের কাছে শুনলাম, প্রশ্ন নাকি খুব আনকমন হয়েছে এ কারনেই অনেকের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, আমি খুব বিজ্ঞের মতন সবার সাথে সায় জানালাম। মনে মনে ভাবলাম- প্রশ্ন কমন হলে কি আর আনকমন হলেই বা কি? আমার কাছে তো সবই এক!!

ঐদিন ডিইউ’র ডি ইউনিটেরও ভর্তি পরীক্ষা ছিল, ফলে রাস্তায় ট্রাফিক হল সেইরকম!!! সব কিছু পিছনে ফেলে যখন বাসায় আসলাম, ততক্ষণে দেড়টার মতন বাজে। ভোলাভালা ভাবীর কাছে শুনলাম ওর নাকি পরীক্ষা বেশি ভাল হয় নি। ওকে চেতানোর জন্য জিজ্ঞাসা করলাম লিখিত পরীক্ষার উপর কোন বই-টই আছে কিনা!!! – ভাবীর মন খারাপ ভাবটা আরো বেড়ে গেল…তাও কোন মতে বলল, ‘আমার তো মনে হয় হবে না, বই আছে, তুই নিয়ে পড়িস…!!!’ আরও বলতে লাগল, ‘খালি খালি এত পড়াশুনা করলাম, না পড়লেই ভাল ছিল…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভাবছি রেজাল্ট কবে দেবে…পৃথিবীতে নাকি অনেক মিরা-কল হয়…আমার প্রিলিতে হতে হলে, মিরা’কে শুধু কল করলেই চলবে না…এসএমএস এবং ভয়েস মেইলও করতে হবে…এরপরেও হলে বিবেকের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত হয়ত খাতাও চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারি…
খবরদার, আমার প্রিলিতে হোক- এমন দোয়া কেউ করবেন না…
তাহলে আবার ৯টা নাকি ১১টা পরীক্ষা দিতে হবে…!!! সেটা অনেক কষ্টকর ব্যাপার হবে…!!!

৪,১৭৩ বার দেখা হয়েছে

৪৩ টি মন্তব্য : “আমার বিসিএস পরীক্ষা…!!!”

  1. কবীর তোর গল্প শুনে মর্মাহত হলাম। জীবনে কত পরীক্ষা দিলাম!!! কই কেউ তো কোনোদিনও বলল না-যে ভাই আমি এটা পারি, এই নাও আমার খাতা দেখো........মানুষকে ২ মিনিটে আপন বানিয়ে ফেলার রেসিপিটা কি জানতে পারি???

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)
    এসেছে যে ‘কোন কারনে গাছের পাতার রঙ হলুদ হয়ে যায়?’ যদিও আমার কখনও এমন কিছু হয়নি তবুও উত্তর লিখলাম…

    মামা দেখছেন,আমাগোরে গাছ বইল্লা দাম দেয়না কিন্তু দেশের সবচে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলার একটাতেও আমরা সবুজ না হলুদ এইটা নিয়া প্রশ্ন আছে।পাবলিক দেখুক এইবার যে আসলেই গাছেরাও মানুষ B-)

    জবাব দিন
  3. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    "মাই মাম সেইস 'মিরাকল হ্যাপেনস এভরি ডে ইন দিস ওয়ার্ল্ড'। পিপল আর দেয়ার হু ডাজনট থিংক সো বাট দে ডু"।

    ফরেস্ট গাম্পের কথাগুলোই বললাম - এটা আমার মনের কথাও বটে।
    মনে মনে চাচ্ছি যে হয়ে যাক তোমার।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)
    অ্যালবাট্রস কি তবে আপনাআপনি গলা থেকে খসে পড়ল-

    হাহাহাহা, জুনা যা শুরু করছোস, নেক্স্ট বিসিএস এ সিউর আমাদের তোর জন্ম সাল, পছন্দের খাবার এইসব মুখস্ত কইরা যাওন লাগবো। :boss:

    আর মিরারে কল করাকারি নাই, ডাইরেক্ট ধিরা আনার পিলান করছি। :grr:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  5. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    জুনায়েদ ভাই ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে 🙂


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  6. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)
    …হিসাব করে দেখলাম প্রায় ২০০ কিমি দূরে…অন্ততঃ ১৫ কিমি তো হবেই!!!
    ভাবীর পড়া দেখে অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ লজ্জা পেয়ে পড়ত…ভাগ্যিশ ক্যাডেট কলেজে পড়েছিলাম…!!!
    কোন কারনে গাছের পাতার রঙ হলুদ হয়ে যায়?’ যদিও আমার কখনও এমন কিছু হয়নি তবুও উত্তর লিখলাম…

    :khekz: :khekz: :khekz:

    ঘুম থেকে উইঠঠাই বিপক মজা পাইলাম আপনার লেখা পইড়া। শুভকামনা রইলো। 🙂

    জবাব দিন
  7. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    :khekz: :khekz: :khekz:
    শালার গোল্লা পূরনের বদলে লেখা লেখি বা কমেন্ট হলে ১০০ ভাগ নিশ্চিন্ত থাকতাম তুমি ছাড়া আর কেউ বেলই পাইত না।

    গোল্লা গুলা ঠিকমত ভরাট করছিলা তো? নাকি ইমটি বানাইছ???

    ইমটি না বানাইলে তোমার হয়ে যাবে...


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  8. তাইফুর (৯২-৯৮)
    ভাবীর পড়া দেখে অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ লজ্জা পেয়ে পড়ত…ভাগ্যিশ ক্যাডেট কলেজে পড়েছিলাম…!!!
    প্রশ্ন দেখা ছাড়াই গোল্লা পূরণ শুরু
    অ্যালবাট্রস কি তবে আপনাআপনি গলা থেকে খসে পড়ল
    মিরা’কে শুধু কল করলেই চলবে না…এসএমএস এবং ভয়েস মেইলও করতে হবে

    দোয়া করি, আরও ৯/১১ পরীক্ষা দেবার মানসিক প্রস্তুতি তৈরী হোক তোর।
    তোর প্রিলি কনফার্ম।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    হুম...বিসিএস?? ওটা আমাদের কালেও ছিল, সেই ১৯৬৯-এ!

    অফটপিক : বাবার ঠেলায় ওইপথে একবার গেছিলাম। ইডেনে সিট পরছিল। পলানোর পথ পাইতাছিলাম না। জীবনে কুনু পরীক্ষায় তো ফেল করি নাই। কি করি, কি করি?? পরীক্ষা দিয়া ফেল করুম কেমনে? না দিলে এক কথা।
    তো কেমনে জানি জ্বর আইলো। পরীক্ষার হলে গিয়া সাদা খাতা জমা দিয়া আইয়া বাবারে কইলাম, হলে মাথা ঘুইরা পিরা গেছিলাম, বমি করছি। পরীক্ষা দিতে পারি নাই। ইত্যাদি। বাবাও পুলার কথা আরেকবার মাইন্যা নিল। ব্যস আমারো বিসিএস দর্শন শেষ হইলো। সরকারি চাকরি তো কুনুদিনই করতে চাই নাই।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।