ইচ্ছেমত উড়াব আমার ইচ্ছেঘুড়ি…!!!

(তাইফুর ভাই যথার্থই বলেছেন, “এই ব্লগের একটা লেখা নতুন আরো কয়েকটা লেখার উপজীব্য বলেই বোধহয় ব্লগটি মন্ত্রমূগ্ধতায় পুর্ণ।” ফয়েজ ভাইএর ‘ঘাই’ গল্পটা পড়ার পর এই পোস্টটা লিখতে গিয়ে বারবার আমারও তাই মনে হচ্ছিল…ফয়েজ ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!)

এক।

পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা আমার বহুদিনের অভ্যাস। এটা অনেকটা গুপ্তধন খোঁজার নেশার মতন…হাবিজাবি নানান বই ঘাটাঘাটি করে মাঝে মাঝে দেশি বা বিদেশী দুর্লভ বই পেলে যে আনন্দ হয় তার সাথে বুঝি একমাত্র গুপ্তধন পাবার আনন্দের তুলনাই চলে…তাছাড়া পুরনো বইয়ের একটা অন্যরকম গন্ধ আছে…পাতা উল্টাবার সময় গন্ধটা যখন নাকে বাড়ি দেয়…কেমন জানি একটা অনুভুতি হয়…!!!

‘বই পড়া’ দোকানটি আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় এবং পুরনো বইয়ের দোকান। আমাদের বাসার একেবারে কাছেই। নিয়মিত যাতায়াত আছে বলে দোকানদার মকবুল ভাইএর সাথে আমার সম্পর্ক নিছক ‘ক্রেতা’ ছাপিয়ে বর্তমানে ‘ভাই’…
-স্লামালিকুম, আসিফ ভাই!
-ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছেন মকবুল ভাই?- আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-এই তো চলে যাচ্ছে, আপনাকে কয়েকদিন দেখি না যে…শরীর ঠিক তো?
-শরীর ঠিক আছে, অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম আর কি…তা মকবুল ভাই, নতুন কিছু এসেছে নাকি??
-নতুন? নাহ্‌, আপনার পছন্দের কিছু নেই…তবে রাজশাহী থেকে একটা চালান এসেছে…কোন এক রাজার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর বই…অনেক হাত বদল হয়ে এখন এখানে এসেছে…আপনার জন্য রেখে দিয়েছি…প্যাকিংও খুলিনি…
-মকবুল ভাই, আপনি গ্রেট!
-গ্রেট-ট্রেট কিছু না…এটা তো এখন আপনারও দোকান…ছোটকাল থেকে বই না কিনে আপনি যদি দোকানের এক কর্ণার থেকে কেনা শুরু করতেন তাহলে আজ এই দোকানের মালিক আপনিই হতেন…!
-হা হা হা…ভাল বলেছেন তো!!!
-যান, স্টোর রুমে চলে যান। ওখানে প্যাকেটটা আছে।

আমি স্টোররুমে চলে গেলাম। প্যাকেটটা দেখি আসলেই খোলা হয় নি…আশ্চর্য্য!! প্যাকেট খুলে একটা একটা করে বই নামাতে লাগলাম…বেশীরভাগ বই-ই ব্রিটিশ আমলের…কোম্পানী শাসন ব্যবস্থা, উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বিভিন্ন অবদান, এছাড়া বেশ কিছু আইনের বইও আছে…আর আছে বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ইংরেজী, ফরাসীসহ বেশ কিছু ভাষার উপর বই…’হুম্‌, রাজা সাহেবের ভাষা নিয়ে অনেক কৌতুহল ছিল মনে হয়…’- মনে মনে ভাবলাম আমি। প্যাকেটের একেবারে নিচে দেখি একটা নাম-না লেখা একটা বই। হাতে নিতেই বুঝলাম-বই না, পান্ডুলিপি! পান্ডুলিপিটা বইগুলোর মতন অত পুরনো না, খুব বেশি হলে ১৫/২০ বছর আগের হতে পারে…পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা…ঝরঝরে, পরিস্কার! বইগুলো আবার তুলে রেখে পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে স্টোর রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

-মকবুল ভাই, ভাল কিছু পেলাম না…
-সেকি! রাজার লাইব্রেরীর বই…
-আর বলবেন না…ব্যাটা ছিল আস্ত একটা আঁতেল! আবজাব বই এ ভরা…খালি এই পান্ডুলিপিটা মনে হল ভাল কিছু…
-পান্ডুলিপি?? ওটা কিভাবে এল কে জানে! যাহোক, আপনি ওটা নিয়ে যান…দোকানের পক্ষ থেকে ওটা আপনার জন্য উপহার!
-উপহার হিসেবে দিলেন ছোট্ট একটা পান্ডুলিপি!! আপনার মন দেখি অনেক ছোট…!
-ছোট মন না, ব্যবসায়ী মন!!! হা হা হা…

এরপর দোকান থেকে বের হয়ে আমি ধীরে ধীরে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

দুই।

দুপুর বেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুমে এসে পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে বসলাম। পাতাগুলো কিছুটা হল্‌দেটে হয়ে গেলেও পড়তে কোন সমস্যা হল না। পান্ডুলিপির প্রথম দিকে কয়েকটা কবিতা। ছোট-ছোট সুন্দর কবিতা। আসলে কবিতাগুলো এত ছন্দ-ময় যে কবিতা না বলে-বরং ছড়া বলাটাই বেশি যুক্তিপূর্ণ। এরপর দেখি একটা গল্প। গল্পটার কোন নাম দেয়া নেই, হঠাৎ করেই শুরু করা হয়েছে…আমি পড়া শুরু করলাম-

“হাকিম মিয়ার মনটা বেশি ভাল নেই…ফসল তোলার আগ মুহূর্তে বন্যার পানিতে এভাবে ডুবে গেলে মন খারাপ হবারই কথা…আধপাকা অবস্থাতেই কেটে ফেলবে কিনা-সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না…’আর দুইডা দিন অপেক্ষা কইরা দেহি’-মনে মনে ভাবল হাকিম। এই মুহূর্তে সে মাছ ধরায় ব্যস্ত। বন্যার পানি ওঠার পর থেকেই জমির হাঁটু পানিতে বেশ মাছ পাওয়া গিয়েছিল…আজ অবশ্য জমিতে আর মাছ পাওয়া যায় নি, তাই সে জমির একেবারে পাশেই- ছোট খালটাতে এসেছে মাছ ধরতে…খালটার অবস্থান তার বাড়ি আর জমির মাঝখানে। গ্রীষ্মকালে বেশি পানি না থাকলেও, এখন বর্ষাকালে বেশ পানি হয়েছে। বাঁশের একটা ছোট্ট সাঁকো দিয়ে সবাই খাল পারাপার করে। খালের দুই পাশে এত ঝোঁপঝাড় ঠিক মত দাঁড়ানোই মুশকিল…তাই হাকিম জাল ব্যবহার না করে দূর থেকে কোচ দিয়ে মাছ শিকার করছে…
তবে, ব্যাপারটা সহজ হচ্ছে না- এমনিতেই ঘন ঝোঁপের কারনে ভাল করে কিছু দেখা যাচ্ছে না-তার উপর খালে এত কচুরিপানা…সুতরাং, ভরসা একটাই-মাছ কখন ‘ঘাই’ দেবে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে হাকিম মাছ ধরা বাদ দিয়ে বাড়ি যাবে কিনা একবার ভাবল। মেঘ করে আসছে, তাছাড়া সন্ধ্যা হবারও বেশি বাকি নেই…কিন্তু আজ সকাল বেলা ছেলেটা যেভাবে বড় মাছের জন্য বায়না করল…
-বাজান, আইজ তুমি এক খান বড় মাছ ধইরে আনবা, বুজিছ??-বলেছিল তার এগার বছরের ছেলে ইসমাইল।
-‘হরে বাপ আনুম, যতক্ষণ না তোর লাহান এত্ত বড় মাছ না পাই…বাড়িই আসুম না’- হাসতে হাসতে বলেছিল হাকিম।
কিন্ত এখন পর্যন্ত বড় কোন মাছ পায় নি হাকিম। পেয়েছে ছোট ছোট মাছ। অন্ততঃ একটু মাঝারি সাইজের না হলেই নয়, ছেলেটা যা জেদী…আর কিছুক্ষণ দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে।

**********************************************

ইসমাইল আর আয়েশা- এ দুটিই সন্তান হাকিম মিয়ার। ইসমাইলের বয়স এগার, আয়েশার নয়। বিকাল বেলা মাঠে গিয়ে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা-ধুলা করে প্রতিদিনের মতন সন্ধ্যার আগে খালের পানিতে হাত-মুখ ধুতে এসেছে। আয়েশা হঠাৎ করে বলে উঠল,
-ভাইজান, দেখ্‌, কি সোন্দর কচুরি পানা ফুল…আমারে আইনা দিবি??
-যা ভাগ, ফুল আনতি গেলি পানিত নামন লাগব…অহন আর গা ভিজাইবার মন করতাছে না…
-দে না ভাইজান…
-তরে নিয়া আর পারি না…আচ্ছা দাঁড়া দেহি…

জামাটা খুলে ভাল করে দেখে নিল ঠিক কোন খানে কচুরিপানার ফুলটা আছে…উপর দিয়ে সাঁতরানোর চেয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। ‘আচ্ছা, বাজান তো ওদিকেই মাছ ধরতাছে…দেইখা ফেললে গালি দিব কিনা’-ভাবতে ভাবতে পানিতে নেমে পড়ল ইসমাইল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে…পানিতে নামার পর ইসমাইলের গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠল…তারপরও লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ডুব দিল সে…

**********************************************

‘কচুরি পানার ওখানটায় পানি কি একটু নইড়া উঠল???’ মনে মনে ভাবছে- হাকিম। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি, ঝোঁপ-ঝাড়- ঠিক মতন কিছুই দেখা যাচ্ছে না…তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল সে। ‘হ, ঠিকি দেখছিলাম, পানি নড়তাছে…’- পানির নড়া দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড় মাছ…নিশ্বাস চেপে রেখে ধীরে ধীরে কোচটা তুলে ধরল হাকিম…আর একবার নড়লেই কিংবা কিছু একটা দেখা গেলেই…চোখ সরু হয়ে গেছে…হাতের পেশীগুলো হয়ে গেছে টানটান…”

**********************************************

‘যাহ্‌, বাকি পাতা কই???’ তন্ন তন্ন করে সারা ঘর খুঁজেও কোথাও পেলাম না…মোবাইলে মকবুল ভাইকে ফোন করে পাতাগুলো আছে কিনা দেখতে বললাম। একটু পর দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন, নেই।
‘এতক্ষণ খালি খালি পড়লাম…শেষের পাতাগুলো আছে কিনা-আগে দেখলাম না কেন???-নিজের উপরই রাগ হতে লাগল।
মেজাজটা গরম করে ছাদে চলে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটের ধোঁয়ায়, নাকি অন্য কোন কারনে কে জানে-একটু পর রাগটা পড়ে গেল। ভেবে দেখলাম, গল্পটার শেষ না থাকাটাই ভাল হয়েছে…আমি এখন ইচ্ছামত গল্পটার সমাপ্তি টানতে পারি…ভাল কিংবা মন্দ!!!

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ফিল্টারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলাম…

৪,৪১৯ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “ইচ্ছেমত উড়াব আমার ইচ্ছেঘুড়ি…!!!”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    এইটা কি রাজা সাহেবের লেখা? 😮
    অসাধারন (আর কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না)
    এইরকম একটা লেখা উপহার দেবার জন্য আপনাকে :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)

    জুনায়েদ, 'ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে' টাইপ অসাধারণ একটা গল্প হইসে।
    ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা প্লট কে কিভাবে রোমহর্ষক করে উপস্থাপন করা যায়, শিখলাম। ফিনিশিং না টাইনাও কি সুন্দর ফিনিশিং।
    তুই আসলেই একটা অলরাউণ্ডার। কমেন্ট এবং লিখা দুই বিষয়েই :boss:


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    কি কমু বুঝতাছিনা। কেন জানি বেশ স্বস্তি পাইলাম শেষে আইসা। হাকিম যে ইসমাইলরে কোচবিদ্ধ করার সুযোগ পাইলোনা এইটাই মনে হয় কারণ।এইরম টান টান গল্পের লাইগা জুনারে :salute: দেয়া ছাড়া আর কিস্সু করনের নাই।

    পোলাডার ভক্ত হয়া যাইতাছি দিনকে দিন। কি লেখায় কি কমেন্টে :hug:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    জুনায়েদ, "শেষ হইয়াও হইলা শেষ"।

    প্লট, ফিনিশিং খুব ভাল লাগছে।
    এত ভাল একটা গল্পের শুরুতে আমাকে টেনে আনছ, খুশিও লাগছে, আবার একটু "ক্যামন ক্যামন" মনে হচ্ছে। :shy:

    তোমার লেখনিকে :salute:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. আন্দালিব (৯৬-০২)

    কবীর ভাই, ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে। আপনার লেখা এখন মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে মনে হইতেছে। 😀 😀

    দাঁড়ান, আমি একটা একটা করে সবগুলাই পইড়া ফেলবো। ভালো থাইকেন বস্‌! :salute:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর(৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।