সূর্যপুত্র (পর্ব নয়)

সূর্যপুত্র
(ভূমিকাসহ পর্ব এক)
(পর্ব দুই)
(পর্ব তিন)
(পর্ব চার)
(পর্ব পাঁচ)
(পর্ব ছয়)
(পর্ব সাত)
(পর্ব আট)
(পরীক্ষার চাপে দিশেহারা হয়েও মাঝে মাঝে ব্লগে আসি…আর অবাক হয়ে দেখি…কোন এক অজানা কারণে…পুকুরের মতন ঢেউহীন ব্লগ!!! :no:
কোন বার্তা নেই…কোন অস্বাভাবিক …ফাটাফাটি…লেখার ঢল নেই…আগের কয়েকটি লেখা-ই অবহেলিতের মতন পড়ে রয়েছে…!! 😕 😕
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে-ই জানি…, আমি লেখা দেবার পরে পরেই…নিশ্চয়-ই আমার দেয়া অক্সিজেনের কারণে-ই ;;; …ব্লগ আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়…।
সেকারণেই, শত পাঙ্গানীর মাঝে-ও আমার এই সূর্যপুত্র নিয়ে আরেক দফা লেখা দেয়া!!)

০৩ মে, ২০০৯।
ভারত মহাসাগরের কোন একটি স্থানে……ভারতীয় কোষ্টগার্ড জাহাজ “………”-এ

৫৪। প্রতিদিনই…সকাল হতেই ঘুম থেকে ওঠেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল…আজ সকালেও ঘুম ভেঙ্গে অন্যদিনের মতই…কেবল সকাল হয়েছে নিশ্চয়ই…ভাবলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। কিন্তু, ঘড়ির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন তিনি…বেলা সাড়ে এগারটা!! ব্যাপার কি? এতক্ষণ তো কখনওই ঘুমাইনা ! কাল রাত্রে অনেক ধকল যাওয়ায়…মরার মতই ঘুমিয়েছি…ভাবলেন তিনি। তারপর দ্রুত ডিউটিরত স্টুয়ার্ডকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার? আমাকে ডাকনি কেন?”
-“স্যার, আপনি মনে হয় অনেক টায়ার্ড ছিলেন…তাই আপনাকে ডাকিনি।”
-“কিন্তু, আমার তো মর্নিং ওয়াচ ছিল!!!”
-“স্যার, কমান্ডিং অফিসার স্যার এবং এক্সিকিউটিভ অফিসার স্যার…দুজনেই বলেছেন…আপনি বেশী টায়ার্ড হয়ে থাকলে, আপনাকে যেন ডিস্টার্ব না করা হয়!”
বিষয়টা কি? অবাক হয়ে ভাবলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। তারপর শ্রাগ করে টেবিলে ব্রেকফাস্ট লাগাতে বললেন।

৫৫। প্রায় আধাঘন্টা পরে, ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট + লাঞ্চ) করতে করতে শ্রীলঙ্কান বোটগুলির কথা মনে হল লেফটেন্যান্ট দার্শিলের।ডিউটিরত স্টুয়ার্ডকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“শ্রীলঙ্কান জেলেদেরকে কি রাত্রেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে? না কি আজ সকালে?”
-“স্যার, জানিনা স্যার…এক্ষুনি দেখে এসে জানাচ্ছি…!
ডিউটিরত স্টুয়ার্ড বেশ খানিকক্ষণ পরে এসে জানাল… শ্রীলঙ্কান জেলেদেরকে তখনও পর্যন্ত ছাড়া হয়নি।
…কি ব্যাপার? এখনও পর্যন্ত ওদেরকে ছাড়া হয়নি কেন?- আপনমনেই শুধালেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। তারপর, ব্রাঞ্চ শেষে জাহাজের কোয়ার্টার ডেকের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি…

৫৬। লবিতে পৌঁছাতেই জাহাজের কমান্ডিং অফিসারের সাথে দেখা হয়ে গেল তার-
-“গুড নুন স্যার!!!” সিও-র কাঁধে কমান্ডারের অ্যাপুলেট এবং র‌্যাঙ্ক দেখে যারপর নাই হতবাক হয়ে গিয়েছেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল।
-“ওয়েল, গুড নুন। তুমি তো সকালের পার্টি মিস্‌ করেছ…রাতেরটা কিন্তু মিস্‌ করো না ইয়াং ম্যান!”
-“স্যার, ইয়েস স্যার…!!!”
ঘটনা কি? আমি কি কিছু মিস্‌ করলাম না কি? আপন মনে ভাবতে ভাবতে সামনে এগুলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। খানিক পরে জাহাজের কমিউনিকেশন অফিসার… লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সুখবন্ত সিং তাকে দেখে বললেন…
-“ওয়েল ডান ইয়াং ম্যান। হেডকোয়ার্টার্স থেকে তোমার কথা শুনে ইন্টেলিজেন্স ডাইরেক্টর-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর স্যার খুব খুশী হয়েছেন…এবং কমান্ডিং অফিসারের পাশাপাশি…তুমিও ডিজি ইন্ডিয়ান কোষ্টগার্ডের স্পেশাল অ্যাপ্রিসিয়েশন লেটার পাবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন”
“তা তো করবেই…আমার আপন বড় ভাই ওইটা…আপনি তো আর সেটা জানেন না স্যার”-ভাবতে ভাবতে কোয়ার্টার ডেকের দিকের পরিবর্তে জাহাজের মেইন কমিউনিকেশন রুমের দিকে এগুতে লাগলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল… “কি কি মেসেজ এসেছে? আর, জাহাজ থেকে গিয়েছে-ই বা কি ধরণের মেসেজ? তিনি-ই বা কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন এগুলির সাথে?” মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল।

৫৭। জাহাজের মেইন কমিউনিকেশন রুমে পৌঁছে সকল মেসেজের সিরিজ পড়ে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো লেফটেন্যান্ট দার্শিলের। এতগুলি ঘটনা ঘটেছে…এত মেসেজ ট্রান্সমিট হয়েছে…আর তিনি কি না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলেন!!!!! জাহাজের কমান্ডিং অফিসার…এক্সিকিউটিভ অফিসার…সবার প্রতি একটা তীব্র ক্ষোভ… রাগ… অভিমান জন্মে গেল তার। ক্রমেই সেগুলি ঘুরে ঘুরে তার নিজের দিকে ফিরে আসতে লাগলো…আর ঘুমানোর রাত পেলেন না তিনি!!!
মেসেজের সিরিজে স্পষ্ট করে লেখা আছে…ভারতীয় জলসীমার ভিতরে…(আন্তর্জাতিক জলসীমা হতে প্রায় আড়াইশ’ ন্যটিক্যাল মাইল ভিতরে) অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতঃ মাছ ধরার এবং বৈধ কাগজপত্র প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ায় আঠারটি ফিশিং বোটসহ একশত তেরজন শ্রীলঙ্কান জেলেকে ধরেছে ভারতীয় কোষ্টগার্ড জাহাজ “……”। এ সময়ে জাহাজের অফিসার অফ দি ওয়াচ হিসাবে দায়িত্বরত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট দার্শিল যথেষ্ট সূচারু এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়ে উক্ত কর্মতৎপরতা সহজভাবে সম্পন্ন করেন।
এই মেসেজের সিরিয়ালের একটিতে আরও বলা আছে… দায়িত্ব পালনকালে…জাহাজের এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সুবল আগরওয়ালা-র সাথে প্রতিবাদমূলক এবং অশালীন/অসৌজন্যমূলক/আক্রমনাত্মক আচরণ করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কান জেলেদের একজন আহত হয়। নেহায়েত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক্সিকিউটিভ অফিসার এ বিষয়ে কোন অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে রাজী হননি…বরং আরও বলেছেন… “অন্য দেশের লোকেরা যে রকমই হোক না কেন…আমরা, ভারতীয়রা সকল সময়েই ধৈর্য্য এবং সহনশীলতার প্রতিমুর্তি হয়েছি…এবং হবো।”
আরেকটি মেসেজে …… জাহাজের কমান্ডিং অফিসার, তাঁর এই কৃতিত্বের সম্পূর্ণ দাবীদার বলে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সুবল আগরওয়ালা এবং অফিসার অফ দি ওয়াচ হিসাবে দায়িত্বরত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট দার্শিলকে।

৫৮। সার্বিক পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে স্রেফ হতভম্ব হয়ে গেলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। তাঁর জীবনে এরকম বিভ্রান্তিকর অবস্থায় তিনি আর কখনও পড়েছেন কি না … মনে পড়ছে না…। এমন কি…, ট্রেনিংরত অবস্থায়…তাঁর বড়ভাই যখন টার্ম কমান্ডার হিসাবে অন্য সব কোর্সমেটদের সাথে তাকেও পানিশ্‌মেন্ট দিয়েছেন…এবং তারপর কোর্সমেটরা তাকে তাঁর ভাইয়ের জন্যে বকাঝকা করেছে…তাঁর ভাইয়ের নামে রাগের মাথায় খারাপ কথা বলেছে… তখনও তাঁর এইরকম হজবরল অবস্থা মনে হয় নি!! এ কি হল…!!! এখন কাকে কি বোঝাবেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল!!! কমান্ডিং অফিসার বেশ ভাল একটা চালই দিয়েছেন…ভাবলেন তিনি।

৫৯। পরবর্তী বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে মাথাটা ঠান্ডা করলেন…তারপর আবার জাহাজের কোয়ার্টার ডেকের দিকে রওনা দিলেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল। হাজার হলেও, গত রাতে তিনি কথা দিয়েছেন…শ্রীলঙ্কান স্কিপারদের কাছে ছোট হয়ে থাকবেন তিনি…যদি আদৌ দেখা না করেন!!!

৬০। জাহাজের কোয়ার্টার ডেকের মেঝেতে…৪০/৬০ বোফর্স গানের পার্শ্বে হাত-পা বেঁধে রাখা স্কিপারদের অবস্থা ততক্ষণে খুবই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। সকালে নামমাত্র খাবার দেয়া হলেও…তাদের কোন বাথরুম সুবিধা দেয়া হয় নি…। এবং সকাল থেকে কোন অফিসার-ই তাদের সাথে দেখা কিংবা কথা বলতে আসেনি!! আচ্ছা…এরা কি মানুষ??-আপনমনেই ভাবছিল হৃদয়। ওদের মধ্যে গুণওয়ার্দানা এবং নাথুরাম কাকার অবস্থা বেশী খারাপ হয়েছে। দুপুরের খরতাপে …ক্ষুধায়…তৃষ্ণায়…সবার অবস্থাই কাহিল… কি হবে ওদের? এমন সময়ে ওদের সামনে লেফটেন্যান্ট দার্শিল এসে হাজির হলেন…
-“হ্যালো,…হাউ আর ইউ?”
-কোনমতে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুললো হৃদয়, “ওয়েল…ইউ আর এলাইভ! আই থট…ইউ আর আইদার ডেড্‌…অর হ্যাভ লিভ্‌ড দ্যা শিপ্‌। ”
-“নো…নট দ্যাট্‌। লিস্‌ন, আই য়্যাম রিয়েলি স্যরি ফর হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং টু ইউ অল। বাট, বি শিওর, আই শ্যাল ট্রাই মাই বেষ্ট…টু হেল্প ইউ!”
-“ওয়েল, আই ডু নট নো…হোয়াট উই হ্যাভ ডান…অর হোয়াট ইউ আর ডুইং উইথ আস…এভেন দেন…ইট্‌স অল রাইট। আই গ্র্যান্ট ইউর এপোলোজি…” হৃদয়ের মুখে ক্ষীণ হাসি দেখে লেফটেন্যান্ট দার্শিলের অপরাধবোধটা আরও বাড়লো।
-“হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
-“ আই থিঙ্ক, ইউ ক্যান নট হেল্প আস লিভিং দ্যা শিপ…। সো প্লীজ হেল্প আওয়ার এল্ডার্‌স ফ্রম দিস্‌ হিট এন্ড স্টারভিং কন্ডিশন।”
-“ওকে, ওকে…আই শ্যাল ডু দ্যাট ইমিডিয়েটলি…” তাদের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলেন যেন লেফটেন্যান্ট দার্শিল।

৬১। শেষ বিকেলের এক চিলতে রোদ এসে ক্ষুধার্ত…পরিশ্রান্ত…অসহায় শ্রীলঙ্কান স্কিপারদের অসহায়ত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
[ক্রমশঃ]

২,৭৯১ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “সূর্যপুত্র (পর্ব নয়)”

  1. দিহান আহসান

    ভাবছিলাম তোমার মত করে ইমো দিয়া মন্তব্য করুম, কিন্তু খালি ইমো দেয়াটাও একটা আর্টের পর্যায়ে নিয়া গেসো তুমি ;;; তাই দিলাম না 😛
    সিঙ্গারা পাওনা রইলো :grr:
    কোর্সের চাপের মধ্যেও পোষ্ট দিসো, অনেক ধইন্যাপাতা 🙂
    লিখতে থাকো, ভালো হচ্ছে :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।