নীলা-৫ম পত্র

নীলা-৪র্থ পত্র
নীলা-৩য় পত্র
নীলা-২য় পত্র
নীলা

সত্য অনেক সময় অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় তা মেনে নেয়াও খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র! কি থেকে যে কি হয়ে যায়,কেউ কিছু বলতে পারে না। কিছু হয়ে গেলে কারো কিছু করারও থাকে না। আর এর কোন নালিশ নেই,কোন প্রতিকার নেই,থাকে শুধু এক বুক হাহাকার।

কতদিন টিএসসিতে দুজনের পাশাপাশি বসে থাকা হয় না! হাতে হাত রেখে ওর অপার উষ্ণতায় হারিয়ে যাওয়া হয় না! ওর নীল চোখের গভীরতাটুকু যে কেড়ে নিয়েছে ক্যান্সার নামের অদ্ভুত অসুখটি! যে মেয়েটির উচ্ছ্বলতায় ভুলে যেতাম আমার সব কষ্টগুলো,সে আজ নিয়তির করাঘাতে পর্যুদস্ত। শুধু আমার সাথেই কেন যে এমন হয়! আব্বুর অসুখের পরেও তো এতটা অসহায় হয়ে পড়িনি!

আজ নীলার জন্মদিন। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন,কারণ এই দিনে নীলা পৃথিবীতে এসেছে,আর আমি ওকে পেয়েছি। গত কয়েক বছর ধরে এই দিনে কত কি যে করেছি! এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছি,Arches এর সব চেয়ে সুন্দর গিফট কিনেছি। এই দিনটার প্রতীক্ষায় সময় যেন কাটতোই না!এই দিন খুব ভোরে উঠে (আসলে রাতে আদৌ ঘুম হত কিনা,আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে!) নিজের সব থেকে সেরা ড্রেস পরে ঘড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা,কখন ৮টা বাজবে! রোকেয়া হলে যেতে ১ ঘন্টা,অপেক্ষা আরো ১ ঘন্টা। ওর আবার রেডী হতে একটু বেশী সময় লাগে কিনা! তারপর……

তারপর হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো,দুজন মিলে একসাথে লাঞ্চ,আবার বেড়ানো। ওর সাথে প্রায়ই বেড়ানো হয়,তবে এই দিনের অনুভূতি অন্যরকম। আর দিনের শেষে বিদায়ের সময় ওর একটুখানি উষ্ণ ছোঁয়া। আমি আমার পূর্ণতা খুঁজে পেতাম ওই একটুখানি ছোঁয়ার মাঝে….ওর না বলা কথাগুলোর স্পর্শ পেতাম ওই ছোট্ট আলিঙ্গনে। আমার সবকিছু আমি ত্যাগ করতে পারি ওই ছোঁয়াটুকুর জন্য….

আজ ২৬ জুন। আমার নীলার জন্মদিন। সকাল ৮টা। তবে আজকের দিনের জন্য কোন পূর্ব পরিকল্পনা নেই,নেই কোন প্রস্তুতি। অন্যান্য বার ওর হলের সামনে অপেক্ষা করি। আজও করছি,ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগের একটা কেবিনে বসে। আজ সকাল ১১টায় ওর অপারেশন।

কাল সারারাত ঘুম হয়নি আমার। আমার দুঃসময়ের বন্ধুগুলো গভীর রাত পর্যন্ত থেকে একে একে চলে যায়। ২টার দিকে আহসান বারান্দার ওয়েটিং চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমি নীলার বেডের পাশে বসে থাকি। ওর ছোট্ট মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে,খেয়াল করিনি। ভোরে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড় থেকে কিছু ফুল কিনে এনেছিলাম। ওর ঘুম ভাঙতেই ফুলগুলো এগিয়ে দেই। ওর কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলি,”Happy Birthday,sweet heart,and many many happy returns…”। ও দুর্বল হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। ওর সঙ্কীর্ণ বেডে বসে ওকে আমার কোলে তুলে নেই। ক্ষীণস্বরে বলে,”আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখ। কোথাও যেতে দিও না আমাকে।” “দেব না। দেখ,তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি হতে দেব না।”,ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি। আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কোন এক অদৃশ্য শূণ্যতার অজানা আশঙ্কায় আমার ভিতরটা বার বার কেঁপে ওঠে। চোখের পানি আড়াল করে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।

আমি যদি ঈশ্বর হতাম!

কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর কাছে ব্রেন টিউমার অপারেশনের একটা ক্লিপ দেখেছিলাম। ওর ভাই ডাক্তার হওয়ায় পেয়েছে। ওই বীভৎস দৃশ্য ১ মিনিটের বেশি দেখতে পারিনি। কেন যেন আজ ওই দৃশ্য বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। আমার নীলা……

ডাক্তারদের এত রিকোয়েস্ট করলাম,অপারেশনের সময় আমি যেন ওর পাশে থাকতে পারি। কোনভাবেই তারা অনুমতি দিল না। বলল,”নিয়ম নেই”। কিন্তু আমার নীলা একা ওখানে কিভাবে থাকবে!

ওকে ওটি তে নিয়ে যাচ্ছে। ওর হাত ধরে ওর পাশে হেটে যাচ্ছি আমি। ওটিতে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে কি যেন বলতে চাইল। ওর মুখের ওপর ঝুঁকতে বলল,”তোমাকে অনেক ভালবাসি”। “আমিও”,আমি ওর ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে বলি। হয়ত এটাই ওকে দেয়া আমার শেষ আদর….

আহসান কই থেকে যেন ২ প্যাকেট বেনসন কিনে আনছে। ওটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছি। আমি তো কখনো চেইন স্মোকার ছিলাম না! ব্রেন টিউমার অপারেশনের ক্লিপটার কথা মনে পড়তে থাকে আর আমি নিজের সমস্ত সত্বা দিয়ে প্রার্থণা করতে থাকি পরম শক্তিমানের কাছে……

আমার বন্ধু আর ভাইয়েরা বারান্দায় বসে আছে। সবাই নিঃশ্চুপ। জানি,ওরাও আমার মতই প্রার্থণা করছে। ওদের ঋণ তো কখনো শোধ করতে পারব না!

আমি যদি ঈশ্বর হতাম! অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও…..

(চলবে…… 🙂 )
*******************************************************************************

গল্পটার অধিকাংশ আমার জীবন থেকে নেয়া হলেও কাল্পনিক।উল্লিখিত কোন চরিত্র কারো সাথে মিলে গেলে,তা অনভিপ্রেত ও কাকতাল মাত্র।লেখক দায়ী নয় 🙂

৩,২৬২ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “নীলা-৫ম পত্র”

    • জাবীর রিজভী (৯৯-০৫)

      🙂 থ্যাঙ্কস, আদনান ভাই।

      আমি আসলে ১০০০ পর্বের মেগা সিরিয়াল দিতে চাই নাই, যেটা চুইংগামের মত টেনে লম্বা করতে হয়।। লেখার শুরুটা এক্সপেরিমেন্টাল ছিল 🙂 । আর গল্পের প্রধান অংশে ঢোকার জন্য একটু তাড়াহুরোর দরকার ছিল। কারণ শুধুমাত্র ভূমিকাতেই প্রায় ৪ টা পোষ্ট লেগে গেছে। লেবু বেশি চিপলে তিতা হওয়ার চান্স থাকে, ভাই। সবথেকে খারাপ সমস্যা হল, প্রতিটি সিরিজের কিছু নিয়মিত পাঠক থাকে। এটা একসাথে যেমন ভয়ংকর আনন্দের 🙂 , সেই সাথে পর্বত প্রমান দায়িত্বেরও 😐 । কারণ,পরের পোষ্টে ওই পাঠকগুলোকে সন্তুষ্ট করতে হয়।

      গত পর্বের অনাকাংখিত তাড়াহুরোর জন্য লেখক দুঃখিত ও পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী 🙁

      জবাব দিন
  1. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    তোর শ্রেষ্ট পর্ব এটা। কষ্টের অনুভুতি দিয়ে গেলি। মানুষের অনুভুতির খুব সুন্দর উপস্থাপন দোস্ত। আর মাহমুদের মত আমিও কই নীলার কিছু হইলে লেখকরে আমি x-( x-( 😡 😡 :gulli2: :gulli2:

    জবাব দিন
  2. জাহিদ (১৯৯৯-২০০৫)
    গত পর্বের অনাকাংখিত তাড়াহুরোর জন্য লেখক দুঃখিত ও পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী

    ক্ষমা করা হলো, :hug: :hug: কিন্তু শর্ত আছে, পরের পর্ব তাড়াতাড়ি চাই। 😡 😡

    জবাব দিন
  3. আহসান কই থেকে যেন ২ প্যাকেট বেনসন কিনে আনছে। ওটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছি। আমি তো কখনো চেইন স্মোকার ছিলাম না!

    তুই চেইন স্মোকার ছিলি না???? 😮 😮 তাইলে কেডা ছিল???

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জাবীর রিজভী (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।